- আকাশটা কি বিশাল না।
- তুমি তো এক চিলতে দেখতে পাচ্ছ।
- না, আমি এই এক চিলতে থেকেই তার বিশালত্ব অনুভব
করতে পারছি।
- ছাদে যাবে।
- না। ছাদে গেলে বিশাল আকাশের নীচে আমি ক্ষুদ্র
একটা বিন্দুর মত মানুষ হয়ে যাবো। সেখানে আমার কল্পনাগুলো বিশাল আকাশের বিভিন্ন দিকে
ছুটে বেড়াবে। সেগুলোকে একত্রিত করা যাবে না আর। আমার কল্পনা এক ধাবমান উল্কার মত অসীমে
চলে যাবে। তারা ক্রমাগত একে অন্যের থেকে দূরে চলে যেতে থাকবে। তারপর একসময় তারা অন্যকোনখানে
অন্য গ্যালাক্সি তে চলে যাবে। তুমি জানোতো, কল্পনার গতি আলোর গতির চেয়েও বেশী। তখন
আমি আর আমার কল্পনাগুলো ফেরৎ পাবো না। তারা হারিয়ে যাবে চিরতরে। এখানে আকাশ এক চিলতে,
আমিও এক খন্ড, শুয়ে আছি জানালার পাশে। এই বেশ ভালো।
এই বিছানা, এই জানালা,
এই এক খন্ড আকাশ এখন সুরমার সব। বাড়ির পাশের পূজা মন্ডপে ঢাক বাজে, ঘণ্টা বাজে, পুরুত
ঠাকুরের মন্ত্র উচ্চারণ কানে ঢুকছে। কিন্তু দেবী দর্শনের কোন স্পৃহা আজ আর তার মধ্যে
নেই। জন্মাবধি হয়তো এই প্রথমবার তার দেবীদর্শন হবে না। হাত ধরে নিয়ে গেলে যে সে যেতে
পারবে না তা নয়। কিন্তু সে যাবে না, নতুন শাড়ি পড়বে না। মনের গভীরে কোথাও একটা রাগ পুষে রেখেছে সে দেবীর
উপর। রাগ তার সবার উপরে। শরীর তার যত ভেঙে পড়ছে, তত তার রাগ বাড়ছে। এমন সময় বাড়ির
কলিং বেলটা বেজে উঠলো।
- মা মাগো , ভিক্ষা দাও।
দশটা টাকা নিয়ে
আমি ভিখারী বিদায় করতে গেলাম। টাকাটা দিতে গেলে ভিখারী বলে উঠলো, -- মা নেই ?
- কেন ? আমিতো দিচ্ছি। তাকে কি দরকার ।
- মাকে একবার ডেকে দেন বাবু।
এবার বেশ বিরক্তিভরেই
বললাম, মা আসতে পারবে না।
- মা কি বাড়িতে নেই!
- না নেই।
- বাপের বাড়ি গেছে?
- অত খবরে তোমার কি! তুমি যাও এবার।
- সে তো যাবেই। আমার মেয়েটা আজ বেঁচে থাকলে
সেও আসতো।
নিজের মনেই শেষ কথাগুলি
বলতে বলতে ভিখারী বিষন্ন মনে চলে যাচ্ছিল। বয়সের ভারে ঈষৎ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।
হটাৎ ঘরের ভিতর থেকে সুরমা বলে উঠলো,
- ওকে দাঁড়াতে বল।
আমাকে আর কিছু বলতে
হল না। সুরমার গলার আওয়াজ ভিখারীর কানেও ঢুখেছে। সে হাসি মুখে আসতে আসতে আবার দরজার
দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। আমি কিছুটা দৌড়েই ভিতরের ঘরে এলাম।
- এটা কি হল ? আমি তো ভিখারীকে বলেই দিয়েছিলাম
যে তুমি বাড়ি নেই। তোমায় আবার কে গলা বার করতে বলল।
সুরমা আসতে আসতে
বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল,
- তাতে কি তুমি মিথ্যাবাদী হয়ে গেলে !
- তা কিছুটা হলাম বৈকি।
- তাতে কি তোমার কিছু যায় আসে ?
- অবশ্যই আসে। বুড়োটা ভাবলো আমি মিথ্যুক।
- একটা ভিখারী কি ভাবলো তাতে তোমার এতো সম্মানহানি
হয়ে গেল। তোমার মান সম্মান ইজ্জৎ তবে বড় ঠুনকো। একটুতেই টোল খেয়ে যায় দেখছি।।
এই সব বাগবিতন্ডার
মাঝে সুরমা বাইরের ঘরে গিয়ে দরজাটা ধরে দাঁড়ালো। সুরমাকে দেখে ভিখারী হতবাক। তার
কোটরাগত চোখের দৃষ্টি সুরমার মুখের দিকে। সুরমা বলে উঠলো, - কি দেখছো ?
- তোমায় দেখছি মা। এ কেমন রূপ তোমার ?
- তোমার মেয়ের যা রোগ ছিল, আমাকেও সেই রোগে
ধরেছে।
ভিখারীর চোখে অশ্রুধারা।
- গ্রিলের দরজাটা খোল । ওকে ভিতরে বসাও। আমি
ওকে খাওয়াবো।
- এইটা কি বাড়াবাড়ি হচ্ছে না! তোমার যাতে
ইনফেকশন না হয় তারজন্য আমরা বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দিই না। আর ওর জামা কাপড় কি নোংরা।
ওকে তুমি এই সোফায় বসাবে।
ভিখারী আমার কথা
শুনতে পেয়েছে। সে বাড়ির ভিতরে ঢুকতে ইতস্তত করছে। সুরমা গ্রীলের দরজা দুহাট করে খুলে
তাকে ভিতরে আসতে বলল। সে সোফায় বসলো না। খুবই কুণ্ঠার সাঠে মাটিতে বসলো। সুমনা তাকে
কিছু খাবার দিল । সে খাবারগুলি তার ঝোলায় ভরে নিল। আরও কিছু টাকা দিল তাকে সুরমা।
খাবার নিয়ে , টাকা নিয়ে, সে আসতে আসতে দৃষ্টির
অগোচরে চলে গেল।
আমরা দুজনে আবার
ভিতরের ঘরে ফিরে এলাম। সুরমা বিছানায় তার নির্দিষ্ট জায়গাতে আবার শুয়ে পড়লো। তাকে
বেশ ক্লান্ত লাগছে। এই মিনিট দশেকের পরিশ্রম তাকে কাবু করে ফেলেছে।
- ভিখারী তোমার পরিচিত?
- হ্যাঁ, ও প্রতিবার পূজোর আগে আসে। এবারে পূজোর
মধ্যে এসেছে।
- সে তোমার পরিচিত তা আমি জানতাম না। জানলে
তোমাকেই আমি ডেকে দিতাম।
- তুমি কি সেই মিথ্যাবাদীর অপবাদ টা মন থেকে
মুছে ফেলতে পারছো না !
- না , এটা সেরকম কিছু নয়। তবে ওকে তুমি ভিতরে
ডেকে ভুলই করেছো। এতো পরিশ্রম করে তোমায় ঠিক রাখা হচ্ছে, এরকম যেকোন লোককে বাড়ির
ভিতরে আসতে দিলে তবে এতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দরকার কি!
সুরমা কিছু বলল না।
সে চুপ করে শুয়ে শুয়ে খোলা জানলা দিয়ে তার এক চিলতে আকাশ দেখতে থাকলো। উল্টোদিক
থেকে কোন প্রত্যুত্তর না পেয়ে আমিও চুপ হয়ে বসে রইলাম।
এইভাবে কতক্ষণ কেটে
গেছে খেয়াল নেই। হটাৎ আবার কলিং বেল বেজে উঠলো। আমি উঠে গিয়ে দেখলাম সতীশ দাঁড়িয়ে
আছে। আমি দরজা খুলতে খুলতে সতীশ কে বললাম,
- আরে কি খবর , কোলকাতায় এসেছিস খবর পেয়েছি।
তা এতদিনে আসার সময় হল।
- আরে আর বলিস না। বাইরে থাকলে যা হয়। প্রত্যেকবার
আসার পর এতো কাজ জমে থাকে। যাকগে বল, বৌঠান কেমন আছে?
- চ, নিজের চোখেই দেখবি চ।
সতীশ ভিতরের ঘরে
এসে বসলো। সতীশকে দেখে সুরমা বিছানায় উঠে বসলো। কথার পর কথা, হাসি ঠাট্টায় বেশ খানিকটা
সময় কেটে গেল। তারপর একসময় সতীশ বিদায় নিল। বাইরের দরজা বন্ধ করে আমি আবার ভিতরের
ঘরে এসে বসলাম । কিছুক্ষণ আবার নিস্তব্ধতা। সুরমা কথা আরম্ভ করলো,
- কি ব্যাপার, সতীশকে একেবারে ভিতরের ঘর পর্য্যন্ত
টেনে নিয়ে এলে যে।
- ও তোমার সাথে দেখা করতে চাইলো তাই।
- সে তো ভিখারীও চেয়েছিল।
- ভিখারী আর সতীশ এক হল!
- কেন এক নয় ! দুজনেই তো মানুষ।
- তুমি ভিখারীর জামা কাপড়ের অবস্থা দেখেছিলে,
কি নোংরা।
- নোংরা কোথায়। নোংরা তো মানুষের চোখে, মনে
। ওর জামা কাপড়গুলো পুরোনো ছিল। নোংরা নয়।
- সে তুমি যা খুশী ভাবতে পারো। আমি তোমার ভালোর
জন্যই বলেছিলাম।
- সতীশ এর থেকে তবে কোন ইনফেশনজনিত সমস্যার
ভয় নেই কি বল ! যত সমস্যা ওই ভিখারীকে নিয়ে ছিল।
সুরমা কথকটি বলে
আবার তার একফালি আকাশের দিকে চেয়ে থাকলো । একটা চড়ুই পাখি এসে বসেছে জানলার গ্রীলের
উপর। কিছুক্ষণ একই ভাবে সে বসে রইলো । ঘরে তখন আবারও তিনটে প্রাণী। আমি, সুরমা আর চড়ুই
পাখিটা।
বড় মর্মস্পর্শী; চড়ুই আকাশের সাথে ওদের ব্যথা নিশ্চয়ই ভাগ করে নেবে!
ReplyDelete