বাঙালিয়ানা কি
যাদুঘরের নমুনা হতে চলেছে?
একটা বিশেষ দরকারে পুজোর সময় গাজ়িয়াবাদ
গিয়েছিলাম, আবার বিশেষ পরিস্তিতির কারণে অষ্টমীর দিন ফিরেও আসি। ট্রেনেরই টিকিট
কাটা ছিল, কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতির দাবিতে উড়েই আসতে হল। আমাদের আবাসনের
ছবিগুলোর মধ্যে আলোকোজ্জ্বল বর্ণময় হাতছানি থাকলেও দমদমে নেমে নিজের প্রিয় শহরকে
চিনতে কষ্ট হল, বছরকার দিনেও নতুন জামা নেই বলে যেন মনমরা।
বছর চারেক বছর আগেও দেখেছি শারদীয়া দুর্গাপুজোর সময়
মণ্ডপগুলির নির্দিষ্ট পরিসীমা ছাড়াও কলকাতার প্রতিটি রাজপথ এমন আলোর মালায় সেজে
থাকত, যে সারা মহানগরী ও শহরতলী যেন উৎসবের আমেজে ঝলমল করত। আমার কন্যা ও তার
বন্ধু রাতের উড়ানে দমদম পৌঁছালে তাদের নিয়ে আসতে গিয়ে দেখেছি নেতাজী সুভাষ
চন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সালঙ্কারা সুসজ্জিতা রূপসী হয়ে বাঙালীর
শ্রেষ্ঠ উৎসবে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।
কিন্তু পরপর তিন বছর ধরে দেখছি কলকাতা বিমানবন্দরে
পুজোর ছোঁয়া ক্ষীণ হতে হতে এ বছর পুরোপুরি উধাও। ইস্টার্ন বাইপাস ধরে তো যাইনি,
কিন্তু যশোহর রোড, বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে ও কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে সহ অন্যান্য
রাজপথগুলি প্রায় নিরাভরণ। কয়েকটি বাড়ি, হোটেল ইত্যাদি নির্মাণ নিজেদের মতো
সাদামাটা সাজগোজ করেছে। ভিড়ও নেই। অবশ্য ভিড় ও যানজট এড়াতেই বিরাটীর রাস্তা
ধরেনি ক্যাব চালক।
কিন্তু পুজো কি শুধু পশ্চিমবঙ্গের রাজধানীর কিছুকিছু
অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ? নাকি দুর্গাপুজো ব্যাপারটাই ভীষণ সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে এখনও
পর্যন্ত বিজাতীয় বিরাগ থেকে অপ্রভাবিত কিছুকিছু ভাগ্যবানের মধ্যে।
অথচ দিল্লী বিমানবন্দরের টার্মিনাল একে দেখলাম
গমগমিয়ে বসেছে "গরবা"-র জলসা। ফাটিয়ে বাজছে "বল্লে বল্লে"
থেকে "মা শেরোওয়ালী" -- গরবা থেকে ডাণ্ডিয়া বিবিধভারতী। এটাই তো
দিল্লীওয়ালী আঞ্চলিক সংস্কৃতির সৌন্দর্য।
তাহলে কলকাতা কেন নিজের শত শত বছরের সাংস্কৃতিক চরিত্রকে
মেলে ধরতে সংকুচিত?
যুবক পুরুষদের মদে-মাংসে মজিয়ে ও চিন্তাশীল
বুদ্ধিজীবীদের নির্বিকল্প মৌনতায় সমাধিস্থ রেখে ক্লাবগুলিতে বার্ষিক লাখ টাকার
কড়ারে বশংবদ ক্যাডার নির্মাণের চোখধাঁধানো প্রকল্প চালু রেখে গোটা রাজ্য থেকে
আসলে তার প্রাণের উৎসবকে কেড়ে নিয়ে তাকে আসলে অন্ধকূপে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু ধাক্কাটা মারল কে? আরে, জানি জানি, আপনারা সব
জানেন। তবে অত তাড়াহুড়ো করে উত্তর দেওয়ার দরকার নেই। ভেবেচিন্তে পুরোটা বলুন।
যেকোনও সভ্যতাতেই সংস্কৃতির শিকড় থেকে শাখাপ্রশাখায়
চারিয়ে থাকে তার নিজস্ব ধর্মীয় চেতনা, অঞ্চলভেদে যার রূপ খানিক ভিন্নভিন্ন হয়।
ভারতে কোথাও কোথাও মহালয়ার দিন ঘটস্থাপন করে এই দেবীপক্ষের প্রতিপদ থেকেই শুরু
হয় নবরাত্রি উৎসব অর্থাৎ নবদুর্গা বা দুর্গার নয়টি রূপের আরাধনা। আর কোথাও কোথাও
মানে মূলত পূর্বাঞ্চলে পঞ্চমীর দিন থেকে আরম্ভ হয় সপরিবারে মা দশভূজা দুর্গার
পূজা।
দুর্গাপুজোর সঙ্গে বাঙালীর আবেগ অধিক সম্পৃক্ত হলেও এ
হল কৃষিপ্রধান সভ্যতার হৃদস্পন্দন যা ফুসফুস থেকে অক্সিজেন ছড়িয়ে দেয় দেহের
প্রতিটি কোষকলায়। কৃষীজীবী আদিবাসীদের দাঁশাই উৎসব আর আমাদের নবপত্রিকা তথা
নবপত্রিকাবাসিনী দুর্গার আরাধনার মধ্যে উদ্দেশ্যগত ফারাক কতটুকু?
হে বাঙালী, তুমি দেবদেবীতে বিশ্বাস করো বা না করো,
তুমি আদৌ ঈশ্বরবিশ্বাসী হও বা না হও, তুমি চাকুরীজীবী হও বা ব্যবসায়ী --- এই ক'টি
দিনের মাহাত্ম্য তোমার বার্ষিকগতির একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু না হলেও প্রধান ফোকাস
বিন্দু। কী অর্থনীতি-ব্যবসাবাণিজ্য, কী সাহিত্য, কী গীত-নাট্য-নৃত্য শিল্প, কী
কারুকলা, কী ভাস্কর্য, কী স্থাপত্যশিল্প। এমনকি পুজোবিরোধী মার্কস্-লেলিন প্রচারের
প্রধানতম উপলক্ষ্যও!
এই পুজো শুধু ধর্মীয় উপলক্ষ্য নয়, বাঙালী জাতির
সাংস্কৃতিক হৃদস্পন্দন, মাতৃপরিচয়, পৈতৃক সম্পত্তি। তাহলে সব থাকতেও সর্বহারা করল
কে?
বাঙালীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এক দূরারোগ্য মতবাদে
ধর্মান্তরিত হয়ে গিয়ে ক্রমশ কর্কটরোগাক্রান্ত কোষের মতো বেখাপ্পা বৃদ্ধি পেয়ে
বাঙালীত্ব থেকে এক আলোকবর্ষ দূরে চলে গেছে, যাদের ফেরানো আর জগন্মাতার বশে নেই,
ব্যাপারটা পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ছাড়িয়ে ব্রহ্মাণ্ডের কোন গ্যালাক্সির অধীশ্বরের
নিয়ন্ত্রণে আছে, কে জানে? কিন্তু অবশিষ্ট যারা এখনও আদি অধর্মান্তরিত সনাতন
বাঙালী আছে, তারাই ক্রমশ কাঙাল হয়ে যাচ্ছে। ভিটেমাটি অর্থনীতি ব্যবসাবাণিজ্য --
এসব দিক দিয়ে তো অনেক আগেই উদ্বাস্তু হয়েছে, দুর্গাপুজো হোক বা দুর্গোৎসব -- এখন
সবেধন এই চোখের মণিটাও হারিয়ে অন্ধ হয়ে পড়ার জোগাড়।
হ্যাঁ অন্ধকূপে ধাক্কা কে দিল প্রশ্নটা করেছিলাম না?
উত্তরটা এখনও কিন্তু সম্পূর্ণ হয়নি। তাকিয়ে দেখুন--- গণেশ চতুর্থী, নবরাত্রি,
রামনবমী, রামলীলা, হনুমান জয়ন্তী, রাবণদহন, দশেরা, ছট, হোলি, বৈসাখী, ওনাম,
পুতণ্ডু -- এগুলোর কিন্তু ছটা কমেনি। এরা নিজেদের চরিত্রও হারায়নি। শুধু নিষ্প্রভ
ও চরিত্রহীন হয়ে পড়ছে বাঙালীর উৎসবগুলি। হাটেবাজারে, মেট্রোরেলে, টেলিকলিংএ
অবলীলায় আমাদের হুকুম করা হয়, "হিন্দীমে বোলো। ইয়ে বাংলাদেশ নহী।"
বাঙালী মানেই বাংলাদেশী এই সমীকরণ তৈরি করা,
পাকিস্তানকে শায়েস্তা করলেও বাংলাদেশের অবৈধ সরকারকেও তোয়াজ করা, বালুচিস্তানকে
মদত দিলেও চট্টগ্রামের অসহায় আদিবাসীদের আকূল সাহায্য প্রার্থনা শুনতে না পাওয়া,
ঢাল তরোয়ালহীন নিধিরাম বঙ্গসেনাদের আক্ষরিক অর্থেই নখদন্তহীন অশিতিপর শ্মশানগামী
করে তোলা, এখনকার বাঙালী ছেলেপুলেদের "বাঙালী নয় নিজেদের শুধু ভারতীয় ভাবতে
হবে" অথবা "হিন্দু থাকতে হলে হিন্দী জানতে হবে" ইত্যকার আত্মঘাতী
দেশাত্মবোধ শেখানো, একটু একটু করে নারীবিদ্বেষ উস্কে দেওয়া --- এগুলো কাদের
সুচিন্তিত কৌশল?
মাতৃপূজা ব্যাপারটাই যাদের অপছন্দ, তারা দুর্গার
উপাসনা করতে দিতে পারে, তবে সেটা দুর্গাপুজো রূপে নয়, নবরাত্রির ব্রত রূপে। তাই
মূর্তিপূজার বিরোধীদেরই পরোক্ষে ঠিকা দিয়ে রেখেছে
দুর্গা-কালী-সরস্বতী-জগদ্ধাত্রী-অন্নপূর্ণা মনসাদের বস্ত্রহরণপূর্বক প্রাণদণ্ড
দেওয়ার। হিন্দু হওয়ার শর্ত নিরূপিত হয়েছে অন্ধবিশ্বাস। সনাতন ধর্মে দেবভাষা
"সংস্কৃত" (অর্থাৎ সংস্কার সাধিত), কিন্তু আধুনিক সমাজে যেন সংস্কার
নিষিদ্ধ, অথবা হিন্দীতে 'আচ্ছা সংস্কার' বলতে যেমন শুধুই প্রাচীন রীতিনীতি বিশ্বাস
ও পালন বোঝায়, তেমন কিছু।
এই ধারা অবিচ্ছিন্ন থাকলে প্রকৃত (অধর্মান্তরিত)
বাঙালীরা রেড ইন্ডিয়ান বা আরও দু-একটি বিলুপ্তপ্রায় জনজাতির মতো যাদুঘরের
সামগ্রী হয়ে যাবে। বিদেশী পর্যটকরা যেমন চীনে মসুও বা মায়ানমারে পাডং অথবা
আফ্রিকায় মাসাইদের দেখতে যায়, বিশ বছর পর ভারতে আসবে বেঙ্গলি ভিলেজ দেখতে,
যেখানে অ্যাম্পিথিয়েটারে লালপেড়ে সাদা শাড়ি আর হাতে সাদা-লাল শাঁখা-পলা পরে
সিঁদুরখেলার প্রদর্শনী হবে।
শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়