দুর্গাপূজার সময় শহরের কোলাহল থেকে বাঁচতে একটু দূরে শান্ত কোনো পরিবেশে
যেতে চেয়েছিলাম। তখনই এক ট্রাভেল কোম্পানির বিজ্ঞাপনে মন নেচে উঠল।
ধান্যকুড়িয়ার নাম শুনে খুব খুশি হলাম। তবে এবার পূজোর অভিষ্ট লক্ষ্য হোক
ধান্যকুড়িয়া। এই ধান্যকুড়িয়া বিখ্যাত জায়গায় পরিনত হয়েছে এখানকার প্রায়
দুশো বছর পূর্বের কয়েকটি জমিদার বাড়ির জন্য। দুশো বছর পূর্বের হলেও বাড়ি গুলো
এখনও সযত্নে সংরক্ষিত। এই জমিদার বাড়িগুলোতে সেই প্রাচীন সময় থেকে দুর্গাপূজা
হয়ে আসছে এবং এখনও ভালো ভাবেই তা হচ্ছে।
ধান্যকুড়িয়ার সবচেয়ে প্রাচীন হলো গায়েন জমিদার বাড়ী। চমৎকার সুন্দর
গথিক ডিজাইনে ইট রঙের মোটা মোটা থামযুক্ত রাজপ্রাসাদ। গায়েন পরিবারের আদিপুরুষ
গোবিন্দ চন্দ্র ইংরেজদের সাথে পাটের ব্যবসা করে বিপুল ধন সম্পত্তি অর্জন করেন।
তিনি ধান্যকুড়িয়ায় জমি কিনে জঙ্গল সাফ করিয়ে প্রাসাদ তৈরি করান। তিনি ই ১৮০
বছর আগে এ বাড়িতে দুর্গাপূজা শুরু করেন। গোবিন্দ চন্দ্রের পুত্র মহেন্দ্রনাথ ' বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স ' এর
সদস্য ছিলেন। তাঁকে ' জুটলর্ড ' বলা হতো। তাঁর আমলেই গায়েন দের পাটের ব্যবসার
বিপুল শ্রী বৃদ্ধি ঘটে। গোবিন্দ চন্দ্রের আমলে গায়েন বাড়ির যে মূল মহল নির্মিত
হয়, পুত্র মহেন্দ্রনাথ তার আর ও বৃদ্ধি ঘটান। তার সঙ্গে তিনি ইউরোপীয়ান দুর্গের
আদলে এক বিরাট বাগান বাড়ি তৈরি করান, যা ' গায়েন গার্ডেনস " নামে জনপ্রিয়।
গায়েন বাড়িতে সাবেকি নিয়ম মতো একচালার প্রতিমায় পূজো করা হয়। নিয়ম মেনে সন্ধিপূজোয় বন্দুক থেকে গুলি ছোঁড়া, নবমীর দিন ধুনো পোড়ানো ইত্যাদি প্রথা আজ ও পালন করা হয়। একটা সময় কাহার দের কাঁধে চেপে মা বিসর্জন যেতেন। এখন অবশ্য আর কাঁধে বিসর্জন হয় না। আমরা সপ্তমীর দিন পুজোর সময়টা গেছিলাম। সেখানে তখন ঢাক বাজছে, কাঁসর ঘন্টা বাজছিল, ধূপের ধুনোয় সুন্দর ভক্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল।
এবার আসছি ধান্যকুড়িয়ার বল্লভ রাজবাড়ীর কথায়। ধান্যকুড়িয়ার বল্লভ পরিবার একটি অত্যন্ত বর্ধিষ্ণু পরিবার। এই পরিবারের শ্যামাচরণ বল্লভ পাটের ব্যবসা করে ধনী হয়ে সুনাম অর্জন করেছিলেন। একবার দুর্ভিক্ষের সময় তিনি নিজের বাড়িতে একটি অন্নসত্র খোলেন এবং এক বছরের ও বেশী সময় ধরে প্রতিদিন কমপক্ষে দুই হাজার মানুষ কে খাওয়ান। ইউরোপীয় ধাঁচে তৈরি এই বাড়ির ছাদে বিভিন্ন আকৃতির কয়েকটি মূর্ত্তি আছে । সেজন্য স্থানীয় লোকেরা এই বাড়ীকে পুতুল বাড়ি বলে। বাড়ির চারিদিকে বাগান ও বাগানের চৌহদ্দির বাইরে এঁদের একটি নহবত খানা ছিল। শ্যামা চরণ বল্লভ এই বাড়িতে প্রথম দুর্গাপূজা শুরু করেন যা আজও হয়ে আসছে। সাবেকি নিয়ম মেনে আজ ও সন্ধি পুজোয় আকাশে তিনবার গুলি ছোঁড়া হয়। সাদা আর সোনালী কাজ করা বল্লভ দের রাজপ্রাসাদ টি দেখতে বড়ই মনোরম। এর রক্ষণাবেক্ষণ যথেষ্ট যত্নপূর্বক করা হয়েছে। ভেতর দালানে পুজো হচ্ছে ঢাকের বাদ্য সহ। ধুনোর গন্ধে মন ভরে গেল।
বল্লভ রাজবাড়ীর রাসমঞ্চ আছে বাড়ির চারশ মিটার দূরেই। এটি বেশ বড় নবরত্ন শৈলীতে তৈরি। এতবড় আকারের নবরত্ন শৈলী তে তৈরি রাসমঞ্চ বাংলায় বিরল। ধান্যকুড়িয়ায় তে যে বৈষ্ণব ধর্মের প্রচলন ছিল তা এই রাসমঞ্চ ই প্রমাণ করে। কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত বৈষ্ণব রাস উৎসবের সময় এখানে রাধা - কৃষ্ণের মূর্তি স্থাপন করে পুজো করা হয়। এই পুজো কে কেন্দ্র করে তখন এখানে বিরাট মেলা বসে। এই মঞ্চটির প্রতি টি পাশে পাঁচটি করে খিলান আছে। ন'টি চূড়া বিশিষ্ট এই মঞ্চটি পুরো সাদা রঙ করা । মন ভরে দেখে, স্পর্শ করে, ছবি তূলে চলে এলাম।
এরপর আমরা রওনা দিলাম আড়বেলিয়ার উদ্দেশ্যে। এখান থেকে দশ মিনিটের দূরত্ব।
আড়বেলিয়া গ্রামে বসু পরিবারের পুজো শুরু হয়েছিল চারশ বছর আগে। সাবেকি রীতি
অনুযায়ী একচালার প্রতিমা, ঠাকুর দালানেই তৈরি করা হয়। এ বাড়ীর পুজোর জল আনা হয়
ব্যারাকপুর গঙ্গা থেকে। আগে এখানে মোষ বলি হতো তবে এখন আর হয় না। এখন বাংলা
সিনেমার কমেডিয়ান অভিনেতা বিশ্বনাথ বসু এ বাড়ীর ছেলে। তিনি প্রত্যেক বার পুজো র
সময় বাড়িতে আসেন। গাছপালা ঘেরা বাড়ি টা ঘুরতে ভালোই লাগল। একচালার মায়ের
মূর্ত্তি টা দেখে মন জুড়ালো।
![]() |
এরপর আমরা গেলাম আড়বেলিয়ার ই ভট্টাচার্য বাড়ি। বসু বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই এই ভট্টাচার্য বাড়ি। ধবধবে সাদা বাড়িটি মোটা মোটা থামের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। খিলান গুলো সুন্দর সোনালী রঙ করা। প্রাসাদের পাশেই বড়ো একটি ঘাট বাঁধানো দিঘি, জল সবুজাভ রঙের। এখানে পুজোর সময় পাঁচ দিনই চালকুমড়া বলি হয়। এই বাড়ির পুজো এই বাড়িরই সবচেয়ে বয়স্ক সদস্য করেন। বতর্মানের বিখ্যাত নাট্য অভিনেতা মেঘনাদ ভট্টাচার্য এই বাড়িরই সদস্য।
ধান্যকুড়িয়ার সুন্দর, সবুজ, শান্ত গ্রামের শোভা আর পুজো দেখে আমার সপ্তমী
টা মনের মণিকোঠায় সম্পদ হয়ে জমা রইল।