তৃতীয় বর্ষ, রথযাত্রা সংখ্যা, ২০২৪
মেঘে ঢাকা স্বয়ংসিদ্ধারা
পুনরায় আরম্ভ করলাম আমার ‘অনিয়মিত’ ত্রৈমাসিক ব্লগজিন। এখানেই জানিয়ে রাখি
ISSN নথিভুক্তির ভিত্তিতে এর নাম নতুন নামকরণ হবে। তাই এই সংখ্যা উৎসর্গ করলাম
বিশ্বের জানা-অজানা অসংখ্য স্বয়ংসিদ্ধাদের যাঁরা সিদ্ধকাম হয়েও সাফল্যে সিদ্ধিলাভ
করতে পারেননি পিতৃতন্ত্রের বদান্যতায়, থেকে গেছেন বিশ্ববাসীর অগোচরে। একটু খুলে
বলি।
হাইপেশিয়া এবং অন্যরা
তাঁর নাম ছিল হাইপেশিয়া, জন্ম আনুমানিক ৩৭০ খ্রিস্টাব্দে, তৎকালীন আলেকজান্দ্রিয়াতে।তিনি ছিলেন খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর মিশরীয় নব্য-প্লেটোবাদী দার্শনিক এবং গণিতজ্ঞ। বলা হয়ে থাকে, মহিলাদের মধ্যে তিনিই প্রথম উল্লেখযোগ্য গণিতজ্ঞ।
হাইপেশিয়া পৌত্তলিকতাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন এবং এই কারণে তাঁকে বলা হতো প্যাগান। একজন শিক্ষক হিসেবেও তাঁর সাফল্য ছিল উল্লেখ করার মতো। তিনি যে শুধু বিদ্বান ছিলেন তা-ই নয়, জানা যায়, তাঁর রূপ আর সৌন্দর্যেও নাকি সেসময়ের অনেকেই বিমোহিত ছিলেন।
যদিও তাঁর কোনও ছবি পাওয়া যায়নি, তবে উনবিংশ শতকের কোনও কোনও লেখক তাঁকে সৌন্দর্যের দেবী এথেনের সাথে তুলনা করেছেন।...
হাইপেশিয়ার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি, তাঁকে খুন করা হয়।
দুনিয়াতে যত দার্শনিক বা ধর্মীয় মতবাদ ছিল বা আছে, পাশাপাশি তার বিরোধী মতবাদও অবস্থান করেছে সমান্তরাল ভাবে। আর সেই বিরধিতা সবসময় যে অহিংস হয় না তার নমুনা ইতিহাসে অসংখ্য পাওয় যায়।
খ্রিস্টীয় পঞ্চম শাতাব্দীর একজন ঐতিহাসিক সক্রেতিস স্কলাস্টিকাস উল্লেখ করেছেন যে, ৪১৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের কোনও একদিন বাড়ি ফেরার পথে পিটার নামে একজনের নেতৃত্বে খ্রিস্টানদের একটি দল হাইপেশিয়াকে আক্রমণ করে এবং তাঁকে টেনে হিঁচড়ে একটি পুরনো মন্দিরে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁকে নগ্ন করে বেঁধে রেখে তাঁর চোখের মণি তুলে নেওয়া হয় এবং সবশেষে তাঁর শরীর টুকরো টুকরো করে কেটে শহরের সবচেয়ে জনবহুল স্থান দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাতে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তবে ঠিক কারা তাঁকে হত্যা করেছিল সেই পরিচয় নিয়ে কিছু বিতর্কও রয়েছে।
যেহেতু হাইপেশিয়ার কোনও ছবি পাওয়া যায়নি তাই তাঁকে নিয়ে যেসব ছবি আঁকা হয়েছে বা মূর্তি গড়া হয়েছে তা সবই কাল্পনিক এবং আনুমানিক।
আজকের আলোচ্য এই মূর্তিটি নির্মাণ করেছেন ইতালীয় ভাস্কর ওদোয়ার্দো তাবাচ্চি (১৮৩১-১৯০৫)।এর উচ্চতা ৭৬ ফুট এবং এর নির্মাণ সমাপ্ত হয়েছিল ১৮৭৪ সালে।
১৯৭১ পর্যন্ত যখন পশ্চিমী বহু দেশে মেয়েদের ভোটাধিকার ছিল না, বাইরে বেরোনোর জন্য স্বামীর অনুমতি লাগত, নিজেদের একক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমতি ছিল না, নিজের শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকায় গর্ভপাতের অধিকার তো অনেক দূর, সেই সময় অসংখ্য প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন করেছিলেন বহু নাম না জানা নারী, ইতিহাস যাঁদের কথা বিজ্ঞানী হিসাবে লিখেই রাখেনি। নানার যন্ত্রপাতি বিশেষ করে সেফটি ডিভাইস থেকে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংএর ধারণা ও অনেক প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গোয়েজ নারী বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার তথা উদ্ভাবন, যাঁদের কেউ কেউ উপার্জনহীন গৃহবধূ রূপে সরকারি নথিতে উল্লিখিত ছিলেন। পুরুষরা যখন যুদ্ধে যেত ধ্বংস ও ধর্ষণের নেশায়, পরিবার ও সমাজের সুরক্ষার জন্য মেয়েরা একের পর এক প্রযুক্তি বার করে গেছে। ইতিহাস ও তার গল্পগাথা শুধু আমাদের টমাস আলভা এডিসনের নাম শিখিয়েছে। তাছাড়া জানা গেছে, আইনস্টাইন, অটোহান এঁদের মতো বিজ্ঞানীদের আবিষ্কারও সম্পূর্ণ তাঁদের একার ছিলেন, নেপথ্যে ছিলেন কোনও না কোনও নারী বিজ্ঞানী।
অথচ মেরি কুরি ও আইরিন কুরি ছাড়া
মহিলা বিজ্ঞানীদের নামগুলো কতজন জানি? আমি নিজের লেখার সূত্রে গুটিকয়েক নাম পেয়েছি
জীববিজ্ঞান ও নৃতাত্ত্বিক হিসাবে। কিন্তু আমার পাকু মামমামের সৌজন্যে যা জানলাম,
তাতে চক্ষু ছানাবড়া ও মুখ হাঁ। কিন্তু তিনি লিখবেন না। ‘গেঁয়ো যোগী’ ‘অথবা ঘরকা
মুরগা’ প্রবাদের প্রতি অগাধ আস্থা আর কী। তাই আমিই জানালাম এই ক্ষুদ্র পরিসরে।
আগামীতে একে একে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারলে নিজেই ধন্য বোধ করব।