অনামিকা ।। শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

অভয়া সংবাদ-২

অনামিকা
শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়


আপনারা অনেকে আনন্দবাজারে নীলোৎপল বিশ্বাসের লেখা সেই ফিচার পড়েছেন। অভয়ার মা নিজের মেয়ের নাম “ডক্টর অমুক” লেখা নেমপ্লেটে সর্বক্ষণ বাতি জ্বালিয়ে রাখেন, নেভাতে দেন না। সামনেটা ভোরবেলা ঝাঁট দিতে গিয়ে কাঁদেন। তাঁদের মিষ্টি মেয়ের মিষ্টি নামখানা আঁকড়েই বাঁচতে চান। কিন্তু ‘বিচারাধীন বিষয়’ ‘নিয়ম নেই’ ইত্যাদির নিষেধাজ্ঞায় নিজের কন্যার নামটাও মুখে আনতে পারছেন না। আইনে বাধা আছে ঠিকই, কিন্তু সেটা কতখানি। যদি তাঁরা নিজেরা নামটা বলতে বা পাবলিশ করতে চান?  ভেবেছিলাম নিয়ে কিছু বলব না, কত বিশেষজ্ঞ আছেন, আইনজীবীরা নিয়মিত মত দিচ্ছেন। আমি বলার কে? সামান্য অখ্যাত লেখিকার বেশি তো না। কিন্তু অভয়ার স্মৃতিতে একটি মূর্তি উন্মোচনের পর মনে হল শুধু লিখলে হবে না, কিছু বলাও দরকার।

গত ১৭ই সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টে অভয়া কাণ্ডের শুনানি নিয়ে বেশ শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। আপামরের মনের আকুতি কিছুটা হলেও পূরণ করে রাজ্য সরকারকে কিঞ্চিত বাচিক রগড়ানি দিয়েছিল আদালত। এবার কিন্তু সেই তুলনায় সোশাল মিডিয়ায় আলোচনা কম। লাইভ স্ট্রীমিং চলাকালে বা তার ঠিক পরেই কোনও কোনও চ্যানেল ও বিশেষজ্ঞ কোর্টের বক্তব্যে রাজ্য সরকারকে তীব্র ভর্ৎসনা খুঁজে পেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও আমার উপলব্ধি ছিল একেবারে বিপরীত। পরে দেখলাম আরও অনেকেই হতাশ পুরো ব্যাপারটা নিয়ে। আমরা দেখলাম ১৭ই সেপ্টেম্বর তৃতীয় শুনানিতে অভয়া মামলাটি যেখানে ছিল প্রথম নম্বরে, সেখানে ৩০শে সেপ্টেম্বর তার ক্রমিক সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াল ৪২ এবং সেটা দ্বিতীয়ার্ধ্বে। আমি শুনানির বিশদে যাব না। শুধু দুটি আইনি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ বা প্রশ্ন করতে চাই। আর চাই অনুপম ভাস্কর্য সম্পর্কে দুটি কথা বলতে যার সঙ্গে আইনি বিষয়দুটির একটি জড়িয়ে আছে।

        ১. দেখলাম দুপুর ২টোয় যে শুনানি হওয়ার কথা ছিল তা আরম্ভ হতে হতে বিকেল ৪টা বাজল। কিন্তু শুনানি হল মাত্র ১ ঘণ্টা। অথচ সেদিন আদালত কক্ষে ছিলে ৩৩টি বিষয়, ৪২টি পক্ষ, ২১০ জন উকিল। ভাবুন একবার! তার মধ্যে প্রায় ২০ মিনিট চলে গেল। নির্যাতিতার ছবি ও নাম ব্যবহার করা নিয়ে আপত্তিতে। ডাক্তার ও নির্যাতিতা দুই পক্ষের আইনজীবীরাই প্রবল আপত্তি তোলেন এবং বিচারকও প্রবল গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন। করুণা নন্দী জানান অভয়ার ছবি ব্যবহার করে হিন্দী গানের রীলও তৈরি হচ্ছে। অভয়ার মা-বাবার উকিল বৃন্দা গ্রোভার পরিবারের লেখা চিঠি জমা করে সোশাল মিডিয়ায় কন্যার ছবি ব্যবহার নিয়ে পরিবারের আপত্তির কথা জানালেন। বলেন ফিলমও তৈরি হচ্ছে যা পরিবারকে ভীষণ অস্বস্তিতে ফেলছে।

মহামান্য প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বলেন, ফিল্ম বন্ধ করতে হলে পৃথক আবেদন করতে হবে, কিন্তু সোশাল মিডিয়া থেকে ছবি অবিলম্বে সরাতে হবে। তিনি বিরক্তি প্রকাশ করেন কোর্টের বারণ সত্ত্বেও কেন এটা হবে। পুনরায় কড়া নিষেধাজ্ঞা দিলেন। ইন্দিরা জয়সিংহ দাবি করেন সামাজিক মাধ্যমে নজরদারির জন্য নোডাল অফিসার নিয়োগ করা হোক। নোডাল অফিসারের দাবিতে শীলমোহর দিলেন বিচারপতি। বললেন নোডাল অফিসার সোশাল মিডিয়ায় নির্যাতিতার ছবি বা নাম ব্যবহাহৃত হতে দেখলে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারেন। সুপ্রিম কোর্টেও জানাতে পারেন। রাজ্য সরকারই ব্যবস্থা নিতে পারে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে।

বোঝা গেল এটি অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ, যা পরিবারকে আহত করবে, পরিবারকে অস্বস্তিতে ফেলবে। বাস্তবিকই ধর্ষিতা অত্যাচারিতা মৃতা মেয়েকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হতে দেখলে খারাপ লাগারই কথা। কিন্তু তার নামটাও বদলে ফেলতে হবে? আমরা কিছুদিন আগে ইউটিউবে দেখলাম একটি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে অভয়ার মাকে কাঁদছেন, যে নামের সঙ্গে ডিগ্রী বসাতে গিয়ে এত ত্যাগস্বীকার সেই নামটাই হারিয়ে যাবে? মেয়েকে অভয়া তিলোত্তমা কত কী বলে ডাকা হচ্ছে! দিল্লীর নির্ভয়া কাণ্ডের নির্যাতিতাকেও দামিনী বা নির্ভয়া বলা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন মেয়েটির মা। নিজে একটি চ্যানেলে বলতে গিয়ে বারবার নিজের কন্যার ছদ্মনাম নয়, প্রকৃত নামটাই বলে ফেলছিলেন। আর সেই সময়টা বিপ করে দেওয়া হচ্ছিল। পার্কস্ট্রীট ধর্ষণকাণ্ডের নিগৃহীতা, যাঁকে দরদামে পোষায়নি বলে সাজানো অভিযোগ করেছেন বলে কুৎসিত মন্তব্য করা হয়েছিল, তিনি পরিষ্কার জানান, “Stop calling me Park Street Rape Victim. I am Suzet, Suzet Geordon.”

অর্থাৎ আপত্তিটা নির্যাতিতা বা পরিবারের থাকে না, আপত্তি থাকে সমাজের, যে মনে করে ধর্ষণ হলে ঘৃণ্য অপরাধীর নয় অপরাধের বলি হওয়া মেয়েটির লজ্জা ও সেই পরিবারের কলঙ্ক। এমন কলঙ্ক যে তার ছবি ঝাপসা করে দিতে হবে, পারলে পৃথিবী থেকে সরিয়েই দিতে হবে। কিন্তু এর উৎস কোথায়? না আর্টিকেল 228-A ধারা যেটা বর্তমানে ভারতীয় ন্যায়সংহিতার 72(1) ধারা। কী আছে তাতে?

Section 228-A of the Indian Penal Code (IPC) makes it illegal to disclose the identity of a victim of certain offenses:

Section 376, Section 376A, Section 376AB, Section 376B, Section 376C, Section 376D, Section 376DA, Section 376DB, and Section 376E. সবকটাই কোনো না কোনও প্রকার ধর্ষণ সংক্রান্ত। এইসব ক্ষেত্রে নির্যাতিতার নাম প্রকাশ করলে The punishment for disclosing the identity of a victim includes:
Up to two years in prison and A fine.

The offense is cognizable, bailable, and non-compoundable.

It can be tried by any magistrate

আইনটি আনা হয়েছিল নির্যাতিতা ও তার পরিবারকে সামাজিক অপমান ও বঞ্চনা থেকে রক্ষা করা। আমাদের সমাজের যা মানসিকতা, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই আইন। কিন্তু কোনো ভিক্টিম  বা তার পরিবার যদি অপমানিত বোধ না করে তাহলে? তাই But There are some exceptions to this section, including:

# If the printing or publication is done by or with the authorization of the victim যেমন সুজেট বলেছিলেন
# If the victim is dead or minor or of unsound mind, and the printing or publication is done by or with the authorization of the victim's next of kin যেমন তথাকথিত অভয়ার মা প্রথমদিকে বলেছিলেন
# If the printing or publication is done by or under the order of the police officer making the investigation into the offense. যে ব্যতিক্রমে প্রাক্তন সিপি পড়ছেন।

সুতরাং নাম পরিচয় প্রকাশ করা কোনোমতেই চলবে না এই যে ধারণা ছড়ানো হচ্ছে সেটা একেবারেই ভুল। এই ব্যতিক্রমগুলোর কথা একেবারেই চেপে যাওয়া হয়েছে। নির্যাতিতার প্রতি সহানুভূতির ছলে টিপিক্যাল পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব থেকেই এই অবস্থান। অথচ কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতন রুখতে “Vishakha Guideline” প্রণীত হয় যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তা “Bhanwari Devi Rape Case” নামে পরিচিত, যেখানে নিগৃহীতার নাম গোপন করা হয়নি। আমরা জানি অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ভাঁওরীদেবী নিজের গ্রামে চাইল্ড ম্যারেজ আটকানোর চেষ্টা করছিলেন। সেই অপরাধে তাঁকে মুখিয়ার নির্দেশে বারবার গণধর্ষণ করা হয়েছিল। তিনি থানায় নালিশ করলেও কারও শাস্তি হয়নি। কিন্তু একটি আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। ১৯৯২ সালে কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের একটি সম্মিলিত মঞ্চ তৈরি হয় "বিশাখা"। একটি জনস্বার্থ মামলা বা PIL করা হয় যার জেরে কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গহেনস্থা প্রতিরোধ সংক্রান্ত কিছু নির্দেশিকা নিয়ে আসে সরকার। ভাঁওরীদেবী স্বনামেই সেই আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। আর পার্টিকুলার অপরাধটিত মামলাটিও তাঁর নামেই পরিচিত। অথচ গ্রামাঞ্চলেই সোশাল শেমিং বেশি হয়, যার কারণে এই প্রোটেকশন ভাওরীদেবীদেরই বেশি দরকার ছিল। নাকি সামান্য অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীর মানসম্মান নিয়ে ভাবার দরকার নেই?

আসলে ধর্ষিতা নারী বেঁচে থাকলে স্বেচ্ছায় নিজের নাম ভুলতে, মুখ ঢাকতে চায় না। তাই লাগাতার অপরাধ রুখতে না পেরে এখন অকস্মাৎ প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার বিবেক জেগে উঠেছে। অপরাধ যখন দমন করা যাবেই না, তখন তার বলিকেই ‘নেই’ করে দাও। তার পরিবারকেও তার নাম অবয়ব ভুলিয়ে দাও। আপনজনেদেরও মগজধোলাই করে দাও, ও নাম নিতে নেই, নিলে মেয়েকে অপমান করা হবে, তার আত্মা শান্তি পাবে না, পরিবারের নিরাপত্তা ও সম্মান নষ্ট হবে, বিচারাধীন বিষয় ইত্যাদি। ঘুরিয়ে বলা -- তাঁদের মেয়ে কলঙ্কিনী। কিন্তু আজীবন এই ছদ্মনাম ও মুখ লুকোনোর ফতোয়াই যে পরিবারের কাছে একটা ট্রমাটিক বোঝা, সেটা বোঝার মতো বোধবুদ্ধি সংবেদনশীলতা পিতৃতন্ত্রে নেই। আপনারা অনেকে আনন্দবাজারে নীলোৎপল বিশ্বাসের লেখায় পড়েছেন অভয়ার মা “ডক্টর অমুক” লেখা নেমপ্লেটে সর্বক্ষণ বাতি জ্বালিয়ে রাখেন, নেভাতে দেন না। সামনেটা ভোরবেলা ঝাঁট দিতে গিয়ে কাঁদেন। তাঁদের মিষ্টি মেয়ের মিষ্টি নামখানা আঁকড়েই বাঁচতে চান। কিন্তু ‘বিচারাধীন বিষয়’ ‘নিয়ম নেই’ ইত্যাদির নিষেধাজ্ঞায় নিজের কন্যার নামটাও মুখে আনতে পারছেন না। কিন্তু আইনেই আছে নামটা বলতে বাধা নেই যদি নিজেদের অভিমত লিখিত জানান।

ওদিকে অভয়াকাণ্ডে প্রাথমিক অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ার বিকৃতকাম সঞ্জয় রাইয়ের নাম, ছবি, ভিডিও ফুটেজ নিয়ে কোনও পক্ষেরই কোনও সমস্যা নেই। রাক্ষসতুল্য ডাক্তার অধ্যাপক সন্দীপ ঘোষের বেলাতেও নেই, টালা থানার অফিসার ইন চার্জ অভিজিৎ মণ্ডলের বেলাতেও নেই। বস্তুত থাকা উচিতও নয়, কারণ ঘৃণ্য অপরাধীদের চিনে রাখাই ভালো। তবে হ্যাঁ, আমাদের দেশে অপরাধীর পরিচয়ও গোপন রাখা হয় যদি সে জুভেনাইল হয়, অপরাধী লজ্জায় মুখ দেখানোর অযোগ্য বলে নয়। যেমন নির্ভয়ার প্রধান নির্যাতক ও খুনি মহম্মদ আফ্রোজ়ের নামটা অনেক পরে জানতে পারি। তাকে ছেড়ে দেওয়ার সময় নিরাপত্তাও ছিল অতুলনীয়। আমাদের দেশে মেয়েদের সুরক্ষার দরকার নেই, কিন্তু তার ধর্ষক-খুনিদের জ়েড ক্যাটিগোরির সুরক্ষা প্রাপ্য। 

৩. ডাক্তারদের একজন উকিল মহেশ জেঠমেলানি প্রশ্ন তোলেন, নির্যাতিতার নাম পাবলিকলি উচ্চারণের অপরাধে সিপি বিনীত গোয়েলের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। সন্দীপ ঘোষও তিনবার নাম করেছে। কলকাতা হাইকোর্টে ইতিমধ্যে মামলা রুজু করা হয়েছে যার শুনানি আজ মানে ৫ অক্টোবর। ভেবে দেখুন বিনীত গোয়েলের উপস্থিতিতে তার অধস্তন প্রমাণ রিমুভাল ট্যাম্পারিং ও অলটার ইত্যাদি করল -- তার জন্য নয়, মিডিয়ার সামনে সিপি নিজের একের পর এক মিথ্যে মিসলীডিং কথা বলার জন্য নয়, চার্জশিট দেওয়ার আগেই একজন ধৃতকে তার পেশাগত পরিচয় গোপন করে ক্রিমিনাল অফ হাইয়েস্ট অর্ডার বলে দেগে দেওয়ার জন্য নয়, প্রধান অপরাধীদের আড়াল করার জন্য নয়, তার বিরুদ্ধে নালিশ হয়েছে একটি সত্যিকারের নাম উচ্চারণ করার জন্য!!!

৪. জুনিয়ার ডাক্তারদের কাজে ফিরে আসার ফরমান জারি হল কারণ অভিযোগ অনুযায়ী আইপিডি ওপিডি করছেন না বলে নাকি সাগর দত্ত মেডিকেল কলেজে এক রোগিনী বেড না পেয়ে চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছে। ডাক্তারপক্ষ অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যে বলে দাবী করেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, জাল ওষুধের যেখানে এত রমরমা যেটা শুধু আরজিকরেই নয় সহজেই অনুমেয়, তাই দিয়ে চিকিৎসা করায় রোগীদের কিছু হলে দায়টা কি সরকারেরও নয় যার মেশিনারি ব্যবহার করেই এইসব দুর্নীতি চলছে?  

কিন্তু দেখলাম চিকিৎসা ক্ষেত্রে নিরাপত্তা দানে রাজ্য সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে মৃদু বিরক্তি প্রকাশ ছাড়া আর বিচারপতির কোনও বক্তব্য নেই। পুলিসের সামনেই সাগর দত্ত ও ন্যাশালান মেডিকেলে অশান্তি ঘটছে, কথায় কথায় মহিলা ডাক্তার নার্সদের আরজিকর করে দেওয়ার হুমকির অভিযোগ উঠছে -- ইত্যাদির মাধ্যমে রাজ্য সরকারের ব্যর্থতা বা সদিচ্ছার অভাব প্রমাণিত এবং সাগরদত্তে চলা তাণ্ডবের ভিডিও দ্বারা প্রত্যয়িত। কিন্তু কোর্ট শুধু বললেন, ৩০-এ অক্টোবরের মধ্যে সিসিটিভি সহ নিরাপত্তার সব ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু না করলে কী হবে বললেন না। অথচ জুনিয়র ডাক্তারদের শাসানো হয়, কাজে না ফিরলে রাজ্য সরকার ব্যবস্থা নিতে পারে। অকুস্থলে ৯ আগস্ট উপস্থিত থাকা ডাক্তাররা কেন এখনও কাজ করছে, ইন্দিরা জয়সিংহের আপীল মতো তাদের বাধ্যতামূলক ছুটিতে কমপালসরি লীভে পাঠানোর কোনও নির্দেশও দেওয়া হল না। এগুলো আপনারা দেখেছেন, আমি শুধু নিজের পর্যবেক্ষণ জানাচ্ছি।  

৫. শুধু তাই নয়, রাজ্য সরকার যে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার কিছুই হয়নি। তার প্রমাণ সাগর দত্ত ধুন্দুমার ও তার ভিডিও। বলা হল সিবিআই-এর কাছে অনুমতি নিতে হচ্ছে বলে নাকি দেরি হচ্ছে। কিন্তু তৎপরতা কাকে বলে তা সেমিনার রুমের পাশের ঘরটি তড়িঘড়ি ভেঙে ফেলার মাধ্যমে পরিলক্ষ্যিত। আর বিলম্ব কাকে বলে তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি ও পেয়ে যাব। এখন সময়মতো কাজ না করতে পারার হাজারটা যুক্তি দেখানো যায়, ডকুমেন্ট দ্বারা সাবস্ট্যানশিয়েটও করা যায়। কিন্তু না করেই করে দিয়েছি বলে বেড়ানোর মিথ্যাচারের কি কোনও শাস্তি নেই? এটা কেন contempt of court নয়? সরাসরি শীর্ষ আদালতের নির্দেশ অমান্য করে মিথ্যাচার।

৬. সিবিআই দুটো ভাগে রিপোর্ট দিল। একটা রেপ ও মার্ডার দ্বিতীয়টি আর্থিক দুর্নীতি। কোর্ট সন্তুষ্ট। অথচ শিয়ালদা কোর্টে জানা গেছে সিবিআই ওসি অভিজিৎ মণ্ডল ও সন্দীপ ঘোষকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেরাই করেনি। তাই ঐ দু’জনের সিবিআই কাস্টডিই পেল না। বিকল্পে পাওয়া গেছে জুডিশিয়াল কাস্টডি এবং সেটাও কোর্টেরই পরামর্শে আবেদন করায়। শিয়ালদা কোর্টে সন্দীপ ও অভিজিতের নারকো টেস্টের অনুমতি নেওয়ার শুনানি ছিল ৩০ সেপ্টেম্বর। কিন্তু সেই অনুমতি পাবে কী করে যদি ১৫ দিন ধরে জেলে বন্দী রেখে জেরাই না করা হয়ে থাকে। যদিও এখন শুনছি জেরা করা হচ্ছে, কিন্তু এইরকম তদন্তের পরিণতি মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সব জলে যাবে। চার্জশিটও জমা পড়বে কিনা সন্দেহ। গেলেও অভিযোগ প্রমাণ হবে না।  শুধু শুনে যাচ্ছি --- অমুক আর তমুকের ফোন কল থেকে পাওয়া যাচ্ছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। এমনটাই দাবি করেছে সিবিআই।

৭. শুনে শুনে কান পচে গেছে। কারণ এখনও বৃহত্তর ষড়যন্ত্র আছে কিনা, ধর্ষণ হয়েছে কিনা এইসব খতিয়ে দেখায় তদন্ত আটকে আছে। ষড়যন্ত্র আছে কিনা যদি এখনও নিশ্চিত না হয়ে থাকে আর হওয়ার নয়। কিন্তু ধর্ষণ হয়েছে কিনা এই অনিশ্চয়তা প্রকাশকেই একটা আইনি প্রশ্ন করা যায়। নির্ভয়া কাণ্ডের পর Indian Penal Code ধর্ষণকে redefine করে। বর্তমানে ন্যায়সংহিতাতেও আছে। তাতে proper as per norms penetration ছাড়াও আরও একাধিক নোংরামো ও যৌনাঙ্গে আঘাতকেও ধর্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু ভিক্টিমের যৌনাঙ্গে আঘাত ও রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্নের প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও তদন্তকারী সংস্থা ধর্ষণ হয়েছিল কিনা বুঝতে পারছে না। ধরে নিচ্ছি private part-এ মাথার ক্লাচ ক্লিপ মেলার কথা ময়নাতদন্তের রিপোর্টে নেই। কিন্তু যৌনাঙ্গ ও মুখবিবর-সহ শরীরে একাধিক রক্তাক্ত ক্ষতের কথা আছে। তারপরেও যথাস্থানে কার ধাতু পাওয়া গেছে তাই নিয়েই মিডিয়ায় গরম গরম গবেষণা চলছে। একটি মেয়েকে কামড়ে খামচে খুঁচিয়ে হাড়গোড় ভেঙে দুমড়েমুচড়ে দেওয়ার পরেও ধর্ষণ হয়েছে কিনা তা নিয়ে কেউই নিশ্চিত হতে পারছে না। জানি না সিবিআই ময়নাতদন্তকারী ডাক্তারের মোবাইলে তোলা ছবি পাওয়ার পরেও ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের প্রমাণ পাবে কিনা। 

 

১ ঘণ্টায় ৪২ টি পক্ষ ২০০-র বেশি উকিল। শুনানি হবেটা কী? আমার মতো অনেকেই হতাশ। কেউকেই বলছে ২০২৬ পর্যন্ত টানা হবে। দিল্লীতে যারা সফল কিন্তু রাজ্যের বেলা এত ক্যাজুয়াল, সেখানে বলা বাহুল্য রাজনৈতিক সেটিং তত্ত্বই প্রমাণিত হচ্ছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব তো বটেই। সদিচ্ছার অভাব, গাফিলতি এইসব বললে ভুল হয়, বদিচ্ছা ও ষড়যন্ত্র কথাগুলোই সুপ্রযুক্ত। তারই প্রতিফলন যেন অভয়ার স্মরণে আরজিকরে স্থাপিত ভাস্কর্যটি যদিও তা সরকার পক্ষের নয়, প্রধান প্রতিবাদীদের। আর হাতিয়ার আর্টিকেল ২২৮-এ বা ৭২-১।

এই মৃর্তি ভাস্কর্য শিল্প হিসাবে কতটা সার্থক সেই বিচারে যাচ্ছি না। তাহলে আমার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তবে মূর্তিটি অভয়ার নয় অপরাধ ও যন্ত্রণার প্রতীক মাত্র এই যুক্তি মেনে নিয়েও বলতে হয়, মূর্তির নীচে ক্যাপশনে লেখা আছে ৯ আগস্ট ঘটা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যেখানে “অভয়ার স্মরণে” কথাটা জ্বলজ্বল করছে। ফলে একটি মিষ্টি মেয়েকে চিরকাল এক বীভৎসতার প্রতিমূর্তি হিসাবে স্মরণ করবে মানুষ। যন্ত্রণার অভিব্যক্তি একটি মানবীর মুখেও বসানো যেত। এটা একটা দানবের মূর্তি হয়ে গেছে যেটা মেয়েটির চরিত্রের সঙ্গে একেবারেই বেমানান।

মাস্টারদা সূর্য সেন আত্মত্যাগ করেছেন অকথ্য অত্যাচার ভোগ করে, তাই বলে কি আমরা তাঁর কাল্পনিক অত্যাচারিত নির্যাতনে বিকৃত হয়ে যাওয়া মূর্তি গড়েছি নাকি তাঁর প্রকৃত ছবিটাই দেখতে পাই? এখানে যা করা হয়েছে তার মানে এই দাঁড়ায় মেয়েদের সঙ্গে নোংরা অত্যাচার হলে তাকে কুৎসিত ও বিকৃত করে চিরকালের জন্য আসল সুন্দর মুখটা ভুলিয়ে দিতে হবে। যারা ভাস্কর্যটি মেনে নিতে পারছেন না, বিরূপ প্রতিক্রিয়া করছেন, তারা রীতিমতো বাচিক আক্রমণের শিকার হচ্ছেন – শিল্প বোঝে না, অযথা বিতর্ক করছে, এটা অভয়ার প্রতিকৃতি নয় যন্ত্রণা ও বীভৎসতার প্রতীক ইত্যাদি। প্রশ্ন হল এমন শ্রদ্ধানিবেদন করব কেন যাতে বারবার ব্যাখ্যা দিতে হয়, এটা এটা নয় সেটা? এইসময় মানুষ কিন্তু মূর্তিটাকে ডাক্তার কন্যাটির সঙ্গেই রিলেট করছে। তার মিষ্টি মুখটা হারিয়ে যাবে কিছুদিন পরে, এই বিকট রূপটাই তার প্রতিনিধিত্ব করবে। এখানেই তো পিতৃতন্ত্রের জয় যে মনে করে ধর্ষিতা মুখ দেখানোর যোগ্য নয়, সে পরিবারের পক্ষে কলঙ্ক। যারা মূর্তিটি স্থাপনা করিয়েছে তারা সবাই তথাকথিত সাম্যবাদী উদারপন্থী প্রগতিশীল রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী। পিতৃতন্ত্রসে আজাদির কথা বলে তারা তো তাতেই পরোক্ষে শীলমোহর দিয়ে ফেলছে না কি? একটু ভেবে দেখতে বলব।

মেয়েটিকে আর কত অপমান করবে তোমরা? তোমরা ওর নাম কেড়ে নিলে আইনের অর্ধসত্য ব্যাখ্যা দিয়ে, তোমরা ওর ছবি মুছে দিলে। এগুলো তো প্রমাণ লোপাটের মতো অস্তিত্ব লোপাট। সুন্দর ফুটফুটে একটি মেয়ের মুখের বদলে প্রতীকী দানবিক মূর্তিটাই চিরস্থায়ী হয়ে গেল! এটা তো অস্তিত্ব বিকৃতির চেয়েও বেশি, অস্তিত্ব বদলে ফেলা-- alteration। প্রতীকী মূর্তি যন্ত্রণাকাতর অভিব্যক্তিতে হলেও মূল চরিত্রের সঙ্গে একটা চরিত্রগত সাদৃশ্য থাকবে। কিন্তু এটা কী?

জানি না, মেয়ের মা-বাবা কীভাবে নিয়েছেন। কিন্তু জানি তাঁরা মেয়েকে অভয়া বা তিলোত্তমা বলে ডাকারও পক্ষপাতী ছিলেন না প্রথম দিকে। মা তো কেঁদেছিলেন, যে নামটার সঙ্গে ডিগ্রী বসাত গিয়ে এত পরিশ্রম এত কষ্ট করা, সেই নামটাই হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি, আইনের আংশিক ব্যাখ্যা করে সেই নামটা কেড়ে নেওয়ায় তাঁদেরই সম্মতি আদায় করা হয়েছে। এবার তাঁরা এই বিকট মূর্তিকে নিজের কন্যার প্রতিভূ বলে মেনে নিতে পারবেন তো?

পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম। তাঁরা ব্যাপারটা বিচারাধীন বিষয় বলে এড়িয়ে গেলেন। মনে হল মুখ বদলে প্রতীকী অবয়ব বসানোর নিয়ে তাঁদের আপত্তি থাকলেও কিছু করার নেই; বিচার ব্যবস্থাও শুনছে না, প্রতিবাদীরাও শুনছে না।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post