স্বয়ংসিদ্ধা - শারদীয়া পুজো সংখ্যা, ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, ২০২২
সংরক্ষণ কতদিন
ছবি দুটি দুটো অ্যাডমিট কার্ডের। একই ছাত্রীর। প্রথমটায় স্থাপত্যবিজ্ঞান পড়ার প্রবেশিকা পরীক্ষার। সে পেয়েছে ৯৭.২৯৯ পার্সেন্টাইল। পার্সেন্টেজ বা শতাংশর সঙ্গে এই পার্সেন্টাইলের মূলগত তফাত হল এটা সরাসরি প্রাপ্ত নম্বর নয়, বরং একটা তুলনামূলক অবস্থা বোঝায়। ৯৭.২৯৯ percentile মানে ৯৭.২৯৯% প্রার্থীর চেয়ে এই প্রার্থী এগিয়ে। মানে তার সামনে মাত্র ২.৩% জন ছাত্রী বা ছাত্র। একেবারে উচ্চ স্থানাধিকারীদের মধ্যে একজন। বাস্তবিক JEE Mains-এর Architecture বিভাগে ভর্তির পরীক্ষায় ছাত্রীটির সর্বভারতীয় স্থান ছিল ১৯১৫, যেখানে সারা ভারতে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ৩৫,৫৭৮। JEE Mains স্কোরের ভিত্তিতে স্থাপত্য পড়া যায় এমন National Institute of Technology ও Scool of Planning and Architechture-এর সংখ্যা ১৭। স্থাপত্য পড়ার প্রবেশিকা স্বরূপ NATA পরীক্ষার স্কোরও কোনও কোনও শিক্ষায়তনে বিবেচিত হয়। তাছাড়া IIT-গুলোতে প্রবেশাধিকার পেতে চাইলে JEE Mains-এর পর উতরোতে হয় JEE Advanced-ও। তবে তা বাধ্যতামূলক নয়, National Institute of Technology-গুলোতে পড়ার জন্য জয়েন্ট এন্ট্রান্স মেইনস-ই যথেষ্ট। তাহলে এই ছাত্রীর কেন প্রথম রাউন্ডে প্রথম শ্রেণীর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে প্রবেশাধিকার মিলল না? দ্বিতীয় কাউন্সেলিং নিয়েও ঘনিয়ে ছিল অনিশ্চয়তা, বিশেষত করোনা কালে লকডাউন পরিস্থিতিতে। আর্কিটেচার-এ ভরতির চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন কোনও একটা কলেজে অ্যাডমিশন নিতে গিয়েও দেখা দিল সমস্যা। পরীক্ষা না হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের উচ্চমাধ্যমিক কাউন্সিল কল্পতরু হলেও CBSE বোর্ডে ১২ ক্লাস পাস করা ছেলেমেয়েরা অনেকেই চরম ভুলভাল অবমূল্যায়ের শিকার। তেমন অবস্থার বলি হতে হয়েছে একেও। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গের কলেজগুলোতে অনলাইন অ্যাডমিশন এক রহস্যময় ব্যাপার। কিন্তু প্রশ্ন, প্রকৃত পরীক্ষায় এমন ফল নিয়েও ছাত্রীটি নির্দিষ্ট শাখায় পড়ার অনুমতি পেল না কেন?
এবার আসি দ্বিতীয় ছবিতে। রেজ়াল্ট
কার্ডে দেখা যাচ্ছে National Entrence Screening Test (NEST) এ চত্রীর স্কোর
৮৮.৬৯৩ পার্সেন্টাইল। হ্যাঁ, এই পরীক্ষাটিও সে উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে প্রস্তুতি ছাড়াই
দিয়েছিল, কারণ মেডিকেল এন্ট্রান্স NEET এর উপযুক্ত প্রশিক্ষণ চলছিল তার। সেই পরীক্ষা
বার দুই পিছিয়ে যাওয়ায় তিনবার দেওয়ার সুযোগ থাকলেও একবার দিয়েই থেমে যায় কিছুটা
অনিশ্চয়তা ও অনেকটাই অনীহার কারণে। সে যাই হোক, কিন্তু যে প্রবেশিকা পরীক্ষায় তার
প্রাপ্ত স্কোর প্রায় ৮৯ পার্সেন্টাইল, সেই গবেষণামুখী স্নাতকোত্তর পর্যন্ত ইন্টিগ্রেটেড
কোর্সেও পড়া হল না মেয়েটির। কেন?
এই দ্বিতীয় কার্ডেই রয়েছে দুটি অনুচ্ছেদে
তোলা দুটি ‘কেন’-র উত্তর। দেখুন
জেনারেল বা সাধারণ ক্যাটিগরির ছাত্রছাত্রীদের বেলা ন্যূনতম যোগ্যতা বা কোয়ালিফাইং
মার্কস ৮৫ পার্সেন্টাইল। এই কোয়ালিফাইং পার্সেন্টাইল অন্যান্য পশ্চাতপদ জাতের (OBC)
জন্য ৭৫ আর তফশিলি জাতি, তফশিলি উপজাতি ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের (SC/ST/PwD) জন্য
মাত্র ৩০। আলোচ্য ছাত্রীটি পেয়েছে ৮৮.৬৯ শতাংশ নম্বর যা ওর শ্রেণীর যোগ্যতাবাচক
নম্বরের চেয়ে বেশি। তবুও নিজের শ্রেণীতে যোগ্য বিবেচিত হয়নি। এই স্কোর কার্ডে একটি
স্ববিরোধিতা স্পষ্ট দেখা – সর্বোচ্চ ‘Qualifying Percentile’-এর ওপরে থেকেও ‘Not
Qualified’। কারণ জেনারেল ক্যান্ডিডেটদের জন্য সেবার প্রতিযোগিতামূলক কাটঅফ পারসেন্টাইল
নেমেছিল ৯০ পর্যন্ত যার মধ্যে কিছু মেধাবী সংরক্ষিত শ্রেণীর প্রার্থীও আছে। মজার
কথা সংরক্ষণের দাবিদার মেধাবী প্রার্থীরা কিন্তু তাদের ক্যাটিগোরির জন্য সংরক্ষিত
আসন নয়, জেনারেল প্রার্থীদের আসন দখল করে নেয়। অর্থাৎ তাদের মধ্যে থেকে যতই উন্নত
উচ্চ পদাধিকারী উঠে আসুক, কতগুলো জাত বা সম্প্রদায়ের গায়ে ‘অনুন্নত’ বা ‘তফশিলি’ লেবেল
এঁটেই থাকে। ওদিকে ‘জেনারেল’রা একেবারে ‘জিনিয়াস’ না হলে সরকারি প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত
শাখায় পড়াশুনোর অনুমতিই পায় না। ছবিটা সরকারি মেডিকল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও
অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও কমবেশি অনুরূপ। তাই প্রায় স্থাপত্য ও
গবেষণামূলক পড়াশুনোর জন্য যথাক্রমে ৯৭.৩ ও ৮৯ পার্সেন্টাইল নম্বর পেয়েও একজন
ছাত্রীকে ৩০-৪০ পার্সেন্টাইল পাওয়া প্রার্থীদের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে হল, তাদের
জায়গা ছেড়ে দিতে হল। সোজা কথায় পদবী ‘চ্যাটার্জী’ হওয়ার গুনাগার দিতে হল।
সরকারি চাকরি এমনকি পদোন্নতির
বেলাতেও চলছে এই বৈষম্যের আবর্ত। এভাবেই ভারতবর্ষে নিম্ন মেধার সংখ্যাধিক্যে ডাক্তার
ইঞ্জিনিয়ার স্থপতি গবেষক-গবেষিকা অ্যাকাউন্টেন্ট ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে। আর উত্তম স্কোর
করেও উজ্জ্বল ছাত্রছাত্রীদের চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। এই সংকটের সমাধান
স্বরূপ হয়তো এই ছাত্রীটি একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন উপ-বিশ্ববিদ্যালয় (deemed to
be university) বা চলতি ভাষায় প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পুনরায় পরীক্ষা দিয়ে পাস
করে BTech কোর্স বেছে নিতে পেরেছে, হয়তো তাতেও সে স্বচ্ছন্দ, হয়তো সেখানেও উচ্চতর
শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ রয়েছে; কিন্তু এরপর যদি এর মতো ছেলেমেয়েরা স্বদেশ ছেড়ে
বিদেশে পাড়ি দেয়, তাহলে কি তাদের দোষ দেওয়া যায়? ব্রেইন ড্রেইন হওয়ার নেপথ্যে এটাও
একটা মস্ত কারণ। আর যেসব তথাকথিত উচ্চবর্ণের জেনারেল ক্যান্ডিডেটদের সেই সঙ্গতি
নেই, তারা যদি নির্ভরযোগ্য প্রাইভেট কোম্পানিতে কর্মসংস্থান পায় তো ভালো, নয়তো
বরাদ্দ হতাশা। এমন অবমূল্যায়ন যে রাজনীতির ভিত্তি ও পরিণতি, তার সঙ্গে দুর্নীতির
সম্পর্কও অবিচ্ছেদ্য। একদিকে মেধার বহির্গমন, আরেক দিকে দুর্নীতি। সবমিলিয়ে ক্ষতি গোটা
দেশের আপামর জনতার।
যদি সংরক্ষণ রাখতেই হয়, তাহলে
লিঙ্গভিত্তিক সংরক্ষণ থাকার তবু কিছুটা যৌক্তিকতা আছে; কারণ সব জাত সব সম্প্রদায়েই
মেয়েদের পড়াশুনো কেরিয়ার অগ্রাধিকারে পিছিয়ে। তৃতীয় লিঙ্গের মানবাধিকার সংক্রান্ত
৩৭১ ধারা অপনয়নকারী যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের স্বেচ্ছায় ত্রিশঙ্কু জীবন বেছে নেওয়া
তৃতীয় লিঙ্গের জন্যও সরকারি ক্ষেত্রে ২% আসন সংরক্ষিত হয়েছে। এ নিয়ে কথা না বাড়ানিও
ভালো। তবে মেয়েরা সংরক্ষণ ছাড়াই শীর্ষ স্থান অধিকার করে চলেছে, পিছিয়ে পড়া জাতি
হিসাবে অনুকম্পা নয়, দরকার তাদের জীবন জীবিকা ও সম্মানের নিরাপত্তা।
জাতপাত ভিত্তিক সংরক্ষণের স্থপতি
ডঃ বি আর আম্বেদকর অনগ্রসর জাতগুলোর জন্য সংরক্ষণ চেয়েছিলেন স্বাধীনতার পর দশ বছর
পর্যন্ত। সেটা আমাদের তথাকথিত সংসদীয় গণতন্ত্র ও রাজনীতির জটিল সমীকরণ টেনে চলেছে
বছরের পর বছর। জাতপাতের ভেদাভেদ নেই এ কথা কেউ বলতে পারবে না। কিন্তু তা দূর করার উপায়
কি সংরক্ষণ? ১৯৮৯ সালে যখন প্রধানমন্ত্রী ভি পি সিংহের আমলে ‘মণ্ডল কমিশন’-এর
সুপারিশ মেনে সংরক্ষণ বাড়ানো হয়েছিল, তখন অসংরক্ষিত শ্রেণীর শতাধিক ছাত্রছাত্রী
গায়ে আগুন দিয়ে আত্মঘাতী হয়। সেই আগুন কি তখনই নির্বাপিত হয়ে যায়? বর্ধিত সংরক্ষণ কি
জাত-ধর্মের বিভেদানলেই পেট্রলাহূতি দেয়নি? জাত-ধর্মের সংরক্ষণ জাতিগত ও
সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষজাত নারী ধর্ষণ হত্যা কি আটকাতে পেরেছে, নাকি বাড়িয়ে দিয়েছে? এর
সুবিধা কি সত্যিই যারা বৈষম্যের শিকার তারা পাচ্ছে? ‘সংরক্ষিত’ শ্রেণীর নাগরিকরা পরীক্ষা,
চাকরি, এমনকি পদোন্নতির ক্ষেত্রেও বিশেষ সুবিধা পেয়ে যখন আর্থিকভাবে যথেষ্ট
সঙ্গতিসম্পন্ন, তখন তার পরবর্তী প্রজন্মের সংরক্ষণ কেন দরকার হবে? আর গোবলয় বা
দাক্ষিণাত্যের উচ্চবর্ণের করা অপরাধের শাস্তি পশ্চিমবঙ্গের বর্ণহিন্দু
ছেলেমেয়েদেরই বা কেন পেতে হবে? এসবের কোনও উত্তর নেই। বস্তুত এই সংরক্ষণ নীতি
বংশানুক্রমে সুবিধভোগী একটা শ্রেণী সৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই করছে না। তাই এই সংরক্ষণের
সুবিধা ভোগ নিয়েই রাজস্থানে ‘মিনা’ ও ‘গুর্জর’দের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে।
এই সুবিধাভোগের লালসা কীরকম নিউক্লীয় বিভাজনের মতো ক্রমশ বিস্ফোরক রূপ ধারণ করতে পারে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল অতি সম্প্রতি ২০২২-এরই কুড়মালিদের রেল ও সড়ক অবরোধ করে জনজীবন বিপর্যস্ত করে দেওয়া বিদ্রোহে। তারা 'অন্যান্য অনগ্রসর' জাতি বা OBC হিস সংরক্ষণের সুবিধা ভোগ করেও সন্তুষ্ট নয়। তাদের সংবিধানের অষ্টম তফশিল অনুযায়ী 'তফশিলি জনজাতি' বা Scheduled Tribe-এর মর্যাদা বা বিশেষাধিকার চাই। বস্তুত অন্যান্য জনজাতিরা অষ্টম তফশিলভুক্ত বিশেষ সুবিধাভোগী হলে, তাদেরও ৭০-এর পরিবর্তে মাত্র ৩০ পেয়ে ৮৫ পাওয়া 'বর্ণহিন্দু'দের বঞ্চিত করতে চাওয়ার বায়না ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। সংরক্ষণ নামক বিষবৃক্ষের এমনই সুমিষ্ট ফলই তো প্রত্যাশিত।
আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান, সর্বোচ্চ
নাগরিক রূপে একজন জনজাতির মহিলাকে পেয়েছি। রাষ্ট্র ও দেশবাসী তাঁকে প্রাক্ত ১৪ জন রাষ্ট্রপতির মতো একই সম্মান ও সর্বোচ্চ আসনে বসিয়েছে। তার পরেও তিনি যে জনজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত, তাদের
‘পিছিয়ে পড়া’ হিসাবে কেন
সনাক্ত করা হবে? স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে দেশজুড়ে ‘অমৃত মহোৎসব’ পালিত
হল। কিন্তু সংরক্ষণ ‘বিষ’ থেকে মুক্ত হব
কবে?