দক্ষিণ কেরলে কয়েকদিন

 

দক্ষিণ কেরলে কয়েকদিন

 

মল্লিকা ব্যানার্জী

 

ভ্রমণপিপাসু মাত্রেই জানেন বর্ষায় প্রকৃতির রূপ অন্য এক মাত্রা পায় ,তাই যতই গুগুল জানাক বর্ষায় কেরালা অফ্ সিজন তবু   একটু শেষের দিকে মানে অগস্ট মাসের মাঝামাঝি গেলে মুন্নার সম্পূর্ণ অন্যরূপে যে ধরা দেবে তা বলতে পারি


আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ব্যাঙ্গালোর থেকে,কারণ পুত্র বর্তমানে সেখানেই কর্মরত ,ব্যাঙ্গালোর থেকে বাসে অনায়াসে মুন্নার পৌঁছানো যায় কিন্তু হাতে ছুটির দিন কম থাকায় আকাশ পথ বেছে নিয়েছিলামখুব ভোরের ফ্লাইট নিয়ে মাত্র দেড় ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম কোচি এয়ারপোর্ট  ভীষণ পরিষ্কার আর সুন্দর ট্রাডিশানাল ভাবে সাজানোএয়ারপোর্ট পিতলের বিশাল প্রদীপ পিলসুজ, টেরাকোটার টালি দিয়ে চমৎকার ভিতর বাইরে সাজানো।


কর্তার কর্মসূত্রে সুদীর্ঘকাল উত্তর পশ্চিম ভারতে কাটানোয় প্রথমেই চোখ টানল দক্ষিণের মানুষদের পোশাক পরিচ্ছদ আর আচার ব্যবহার পুরুষরা বিশেষত যারা আত্মীয় স্বজনকে নিতে এসেছেন ,এমনকি ক্যাব ড্রাইভারদের পরনেও হাতা গোটানো বুশ শার্ট আর হাফ লুঙ্গির মত করে বাঁধা সাদা ধুতি --তবে ধুতির পাড়টা কারুর নীল তো কারুর গোলাপী বা অরেঞ্জ এয়ারপোর্টের বাইরেই কেউ কেউ লটারির টিকিট বিক্রি করছেন,পরে ঘুরতে ঘুরতে বুঝলাম লটারীর ব্যবসা এখানে বেশ রমরমিয়ে চলে

আমাদের ঘোরাটা যেহেতু এজেন্সীর সাথে ঠিক করা ছিল তাই বেরোতেই এজেন্সীর কর্মচারী ল্যান্ডার আর ড্রাইভার রমেশ এগিয়ে এল  ব্রেকফাস্ট করব কিনা জিজ্ঞেস করাতে জানালাম বেঙ্গালুরুর লাউঞ্জে ভরপেট ব্রেকফাস্ট করা আছে  কোচি থেকে মুন্নার প্রায় ঘন্টা পাঁচেকের জার্নি ,প্রথমে শহরের মধ্যে দিয়ে খানিক চলে হাই ওয়েতে গিয়ে পড়লাম , তার আগে সুন্দরী পেরিয়ার নদীর ওপরের ব্রিজ খানা পেরিয়ে এসেছি

ড্রাইভার রমেশবাবু ইতিমধ্যে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে একটি রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ী থামাল ,ইংরাজীতে জানাল এরপরে আমরা ইড্ডুকি জেলায় ঢুকব ,পথে ভাল দোকান নেই তাই বাথরুম সেরে নেওয়া ভাল



 আমরা তিনজন মানে কর্তা,পুত্র আর আমি সাথে রমেশবাবু চার কাপ বেশ ঘন দুধের মিষ্টি কফি খেয়ে যাত্রা করলাম  রাস্তার দুপাশ জুড়ে সবুজের সমারোহ, চলতে চলতেই খানিক ঝপ ঝপ করে বৃষ্টি হয়েই রোদ ঝিকমিক করে পাতার ফাঁকে লুকোচুরি খেলে নিল 

 


ঘন্টাখানেক পরে পথের মাঝেই পেলাম চিয়াপ্পার জলপ্রপাত ,গাড়ী থামিয়ে দুচোখ ভরে দেখলাম সেই অঝোর ধারাপাত ---এত কাছ থেকে এত বিশাল জল প্রপাত আগে দেখিনি 



মিষ্টি পুরু শাঁস দেওয়া ডাবের জল খেয়ে আবার চলা শুরু খানিক গিয়ে রাস্তা থেকে খানিক সিঁড়ি ভাঙ্গলেই ঘন জঙ্গলের মাঝে ভালারা জলপ্রপাতপশ্চিমঘাট পর্বতের দেবিয়ার নদী এর উৎস স্থল গাড়ী থামিয়ে রাস্তা থেকেই দেখলাম সেই নৈস্বর্গিক দৃশ্য খানি গাড়ী আসতে আসতে পাহারী পথে ওপরদিকে চলেছে বুঝতে পারছি 

পথে একটি সিনেমাহলের মত বাড়ীর সামনে দাঁড় করিয়ে রমেশ জানালেন রিসর্টে পৌঁছে সন্ধ্যাবেলায় আমরা চাইলে পূনর্যনি গ্রুপের দুটি প্রোগ্রাম দেখতে পারি একটি কেরালার ট্রাডিশানাল মার্শাল আর্টের কালারিপায়াট্টু অপরটি নাচের, কথাকলি ফিউশান  টিকিট ৫০০ টাকা করে এক একটি অনুষ্ঠানের,তখনই কেটে নিলাম পরপর দুটি শোয়ের ছটা থেকে আটটা ওবধি চলবে

 

এরপর গাড়ী থামল রিসর্টের খানিক আগে অন্য এক রিসর্টের খাবার জায়গার সামনে ,ঘড়িতে দুপুর দুটো  এই রিসর্টের খাবার জায়গাটি দোতলায় আর সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে সবুজ মখমলের চাদর বিছানো চা বাগান  অতি সুস্বাদু নিরামিষ লাঞ্চ সারলাম কারণ  দিনটি বাড়ীতেও নিরামিষ খাওয়া হয় এরপর পৌঁছলাম নিজেদের বুক করা রিসর্টে,চারিদিক জঙ্গলে ঘেরা ,দিনের বেলায় সুতীব্র ঝিঁঝি পোকার ডাক শহুরে অনভ্যস্ত কানে মনে হল কৃত্রিম শব্দ নয়ত,পুরোপুরি জঙ্গলের অনুভূতি আনতে কি এমন ব্যবস্থা!

পরে স্টাফেদের জিজ্ঞাসা করতেই ভুল ভাঙ্গল আমাদের আপ্যায়ন করল সোনালী জরির পাড় আর ধবধবে সাদা কেরালা কটনের কাপড়ের টুকরো দিয়ে,সাথে জাম রঙের সরবত

এই পাহাড়ের কোলের রিসর্ট গুলির ভিতরে অত্যাধুনিক বব্যস্থা থাকে জিম থেকে সুইমিং পুল সব আছে খালি লিফট থাকে না ---সিঁড়ি বেয়েই ওঠানামা করতে হয় একে হিল স্টেশন তায় মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হচ্ছে তাই হালকা চাদর,হুডি চাপিয়ে নিয়েছিলাম আমরা খানিক বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যে বেলা গেলাম শো দেখতে 

শুরুতেই ছিল মার্শাল আর্ট ,লম্বা ছিপছিপে বেতের মত তরোয়াল নিয়ে ,কখনও ছোট ছুরি আর প্রতিপক্ষ নিরস্ত্র ,আবার কখনও আগুনের মশাল নিয়ে চলল মল্লযুদ্ধ!অদ্ভুত শারীরিক ক্ষিপ্রতা ,আশ্চর্য সব মার প্যাঁচ দেখতে দেখতে কখন যে এক ঘন্টা কেটে গেল জানি না  যেন এক প্রাচীন যুগে পৌঁছে গেছিলাম আর ,কেন যে প্রথম চার পাঁচটি সারি ছেড়ে বসতে বলেছিলেন অচিরেই তা টের পেলাম,--- আগুনের ফুলকি ছিটকে পড়ছে ,যে কোন মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে দূর্ঘটনা তাই এমন সাবধানতা 

এর পর ছিল ট্রাডিশানাল মোহিনীআট্যম ভরতনট্যম ,কথাকলি ,কুচিপুরী আর থেয়্যাম নাচের ফিউশান যাতে মিশে আছে খানিক নাটক ----ভারী সুন্দর এক সন্ধ্যা কাটিয়ে ফিরলাম মুন্নারের রিসর্টে ফেরার পথে ড্রাইভার ভদ্রলোক বললেন পরদিন নটার আগে বেরোলে ইরাভিকুলাম ন্যাশানাল পার্কে লাইনে দাঁড়াতে হবে না

 

 

মুন্নারে দ্বিতীয় দিন

 

সকাল সকাল চান সেরে ব্রেকফাস্ট সেরে চললাম ইরাভিকুলাম পার্ক দেখতে ,মেঘলা আকাশ,সারা রাত বৃষ্টি হয়েছে,দুপাশের সবুজ সতেজ চা বাগানে ঢাকা পাহারী পথ বেয়ে গাড়ী ওপরের দিকে উঠতে থাকল পার্কের গেটের সামনে টিকিট কেটে ওদের নিজস্ব বাসে চেপে যেতে হবে,চাইলে  গাড়ীও বুক করা যায় তবে তার দাম বেশ চড়া

তবে বাসে চাপলে জঙ্গলের শেষ অবধি যাওয়া যাবে না---- এক কিমি মত পায়ে হেঁটে দেখার আমরা বাসই নিলাম কারন উদ্দেশ্য তো বিরল প্রজাতির নীলগিরি তাহের (পাহাড়ী ছাগল )দেখা ,তাই না হাঁটলে মুশকিল মনে হয়েছিল

এই পার্কের গভীরে হাতি আছে আর দেখা যায় নীলাকুরিঞ্জি ফুল যা বারো বছরে একবার ফোটে বাসে চলতে চলতেই পেলাম গায়ের কাছেই লাক্কাম জলপ্রপাত,অপূর্ব সে দৃশ্য তারপর বাস থেকে নেমে ঠান্ডা ভিজে জোলো হাওয়া গায়ে মেখে এগিয়ে চললাম সবাই পিচ্ছিল পাহাড়ের চড়াই পথে  আকাশে ঘন কালো মেঘ ঘুরছে যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন তাই হঠাৎ পাহাড়ের ওপর দেখি একপাল ছোট ছোট শিং ওয়ালা নীলগিরি তাহের ,উঁকি মেরে দেখছে এই বৃষ্টিতে কোন পাগলের দল এলো রে বাবা!

 


এদের পূর্বপুরুষ ইওরোপের আল্পস পর্বতে ছিল প্রায় ৭৫ লক্ষ বছর আগে,কেউ একজন ছিটকে আসে ইরান ককেশাস পর্বত মালায় সেখান থেকে পামির পেরিয়ে হিন্দুকুশ অতিক্রম করে হিমালয়,মাঝে গেছে খরা,বন্যা,আইস এজ এরপর কিভাবে অভিযোজন চালিয়ে শেষে এসে ছড়িয়েছিল পশ্চিমঘাট পর্বতে জানা যায় না  যদিও বর্তমানে এই খাড়া ২০০০ ফিট উঁচু ইরাকিভুলামেই  সাতশটি প্রাণী টিকে আছে, বর্তমানে এরা প্রায় লুপ্তপ্রায় প্রজাতি

ফেরার পথে ঝেঁপে জল নামল,সাথে ছাতা থাকায় মাথা বাঁচিয়ে ফিরলাম বাস স্টপে ,গরম কফি খেয়ে,সুভেনির শপে ঢুঁ মেরে গেটের কাছে নামলাম  এবার বাকি চা বাগান আর কারখানা ঘোরা তবে তারআগে লাঞ্চ যে রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল রমেশ সেখানে কেরালার ট্র্যাডিশানাল সব খাবার ছিল থুরান,রসম,আভিয়াল,সম্বর সব কিছুই ছিলচীজ, আনারস আর চেরির টুকরো টুথপিকের মত কাঠিতে গাঁথা মিষ্টি বেশ ভালো খেতে লাগল



খাওয়া শেষে গেলাম চা বাগান ঘুরতে ,পঞ্চাশ টাকায় টিকিট কেটে যতক্ষণ খুশি ঘুরে বেড়াও বিশাল চা বাগানে হালকা ঠান্ডা হওয়ায় সবুজ চা বাগানে ঘুরতে ঘুরতে নিজেদের রূপালী পর্দার নায়ক নায়িকা মনে হতে বাধ্য  এরপর ছিল চা তৈরীর প্রসেস দেখা কিন্তু অমন সুন্দর আবহাওয়ায় প্রকৃতিকে ছেড়ে  অ্যাসবেসটসের ছাদের নীচে কি আর যেতে ইচ্ছে করে!

 

তাই সন্ধ্যের আগেই যাতে দেখে নিতে পারি তাই মুন্নার শহর থেকে ১৫ কিমি দূরে মাট্টুপেট্টি বাঁধ দেখতে চল্লাম  সে এক নৈস্বর্গিক দৃশ্য ! বিশাল জলাধার,তার ওপর চওড়া ব্রিজ যদিও চারপাশে উঁচু তারজালি আর একপাশে অঝোরে ঝরে চলেছে দুধ সাদা জলধারা এই লেকে বোটিং,কায়াকিং নানান ওয়াটার স্পোর্টস চলে,আর ব্রিজের ওপর চলেছে ফটোশেসন ,মাত্র কুড়ি টাকায় দারুন সব ছবি তুলে দিচ্ছে লোকাল ছেলেরা,এমনই একজন ডেভিড কুড়িটা ছবি তুলে দশটা ছবির দামেই সব কটা ট্রান্সফার করে দিল ছেলের ফোনে পথে মুন্নারের গোলাপ গন্ধী চা খেয়ে রিসর্টে ফিরলাম  সারাদিনের ক্লান্তি তাই ঘরেই খাবার আনানো হল ,তিনতলা এগ চিকেন স্যান্ডউইচ , চিকেন পরোটা পেট পুরে খেয়ে দুধ সাদা বিছানায় পিঠ ঠেকাতেই মেঘের মত ঘুম নেমে এল দু চোখ জুড়ে --- পরের দিন গন্তব্য আলেপ্পি

তৃতীয় দিন --আলেপ্পি

মুন্নার থেকে আলেপ্পি মাত্র  আড়াই ঘন্টার রাস্তা ,মুন্নার পাহাড়ের কোলে হওয়ায় সব সময় হালকা ঠান্ডা কিন্তু আলেপ্পির দিকে   যতই এগোতে শুরু করলাম বাতাসের আদ্রতার মাত্রাও  বাড়তে থাকল মাঝে মাঝে বৃষ্টি  হলেও গাড়ীর কাঁচ নামালেই টের পাওয়া যায় গুমোট আবহাওয়া রাস্তার দুপাশে কলার বন,রাবার প্লান্টেশন (লম্বা রাবার গাছের গায়ে তেরচা করে কাটা আর সাদা পলিপ্যাকের থলি বেঁধে রাখা,আাঠা নেওয়ার জন্য ) কোথাও আনারসের চাষ হয়েছে ,কোথাও আবার নারকেল আর কাঁঠাল গাছের সারি ,ভেসে আসছে পাকা কাঁঠালের গন্ধ আর এই ক্ষেত ,বাগানেরমাঝেই অপূর্ব সুন্দর বাংলো বাড়ী ,বেশির ভাগই একতলা,কোথাও আবার দু,তিন তলাও আছে ঠিক 

মালায়ালী মুভি দৃশ্যমের জর্জ কুট্টির বাড়ীর মত দেখতে 



অধিকাংশ মানুষই খ্রীষ্টান ,সুন্দর সুন্দর চার্চ রয়েছে চৌরাস্তার মোড়ে  বেশির ভাগ মানুষই সাদা ধুতি আর মহিলাদের পরনে শাড়ি না হলে সালোয়ার ,কাঁধে বড় ব্যাগ ,কেজো চেহারা ফ্যাশন নিয়ে মাথা ব্যথা কম

আলেপ্পি পৌঁছতে প্রায় একটা বেজে গেছিল কারণ মুন্নারের রিসর্টেই চান,প্রাতঃরাশ সেরেছি আরাম করে  হাউসবোট বুক করা ছিল , লোটাস হাউস বোটে উঠেই তো চমকের পর চমক --- এসি ,টিভি লাগানো মোটা গদি দেওয়া সোফায় বসে পুরো একটা দিন ব্যাক ওয়াটারে জলপথে ভ্রমণ যত্ন করে বোটে উঠিয়ে নিল হাউসবোটের চালক বিষ্ণু,মালপত্রও গাড়ী থেকে এনে তুলে দিল বোটে

 


বোটে উঠতেই এক গ্লাস করে ঠান্ডা লেবুর সরবত এসে গেল বোট এদিকে চলতে শুরু করেছে  মৃদু দুলুনি খেতে খেতেই ডাইনিং টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে রাঁধুনি কাম কেয়ারটেকার সাবু একটু মোটা চালের ভাত,এরা বলে মাট্টু , আনাজপাতি দেওয়া ডাল, বাঁধাকপির তরকারী যার আরেক নাম থুরান ,পাঁপড় ভাজা আর মচমচে করে পমফ্রেটের মত দেখতে লোকাল কারিমীন মাছ ভাজা আর দই  মাছের কাঁটা একটু বাঁকা,অসাবধানে খেলে আমার মত গলায় বিঁধতে পারে  খাওয়া সেরে বাবা ,ছেলে খাটে গড়াতে গেল,দুলতে দুলতে শুয়ে শুয়ে চারপাশ দেখবে বলে 

 

আমি কিন্তু মোবাইল হাতে সোজা দোতলায়, আর তখনই যেন নীল আকাশে কোথা থেকে ভেসে এল সাদা মেঘের ভেলা ,দুপাশে সারি সারি নারকেল গাছ,ধান ক্ষেত আর লাল টালি দেওয়া সাদা সাদা একতলা বাড়ী গুলো সবাই তাদের রং রূপ মিশিয়ে একখানি অপরূপ দৃশ্যকল্প তৈরী করল



 মন ভরে দু চোখ দিয়ে প্রকৃতির রং রূপ আস্বাদন করতে করতে ঘুরতে থাকলাম ,সত্যিই এক স্বর্গীয় অনুভূতি! মাঝে বৃষ্টি আসায় সাবু এসে সামনে খানিক ত্রিপল টেনে দিল,সোলার এনার্জী ব্যবহার হয়েছে,জল ঢুকলে শট সার্টিক হবার সম্ভাবনা বিকেলে সবাই দোতলায় বসে চা,বেগুনি খাচ্ছি,মানে আমি তো বেগুনিই ভেবেছি,ভুল ভাঙ্গল সাবুর কথায়,---বেগুন নয় কাঁচকলা ছিল নাকি!

সন্ধ্যে হতেই নাও তীরে এসে ভিরিয়ে দিল বিষ্ণু, সে আজ বাড়ী যাবে,সাবু থাকবে দেখাশোনার জন্য ওরা বদলাবদলি করে বাড়ী যায় নৌকার সামনের বাংলো বাড়ীটাই হাউসবোটের মালিকের,কিছু দরকার হলেই সাবু নৌকা থেকে লাফ দিয়ে নেমে চলে যাচ্ছে  আমরাও নেমে কছের সেন্ট মেরী চার্চে গিয়ে বসলাম,কাঠের তৈরী হাউসবোট ,মুখোশ কেনাকাটা হল ,ফিরে দেখি সাবু ধূপ ধুনো জ্বালিয়ে রান্নাঘরে ব্যস্ত বাবা,ছেলে টিভি নিয়ে বসতেই আমি গুটি গুটি রান্নাঘরে উঁকি মেরে দেখি চিকেন বানাচ্ছে সাবু,ভিন্ডি ভাজা করা হয়ে গেছে ,হাসতে হাসতে বলল চিংড়ী,কাঁকড়া তো খেলেন না,রুটি কটা খাবেন ?” ছোট্ট ফ্রিজ,গ্যাস,দিয়ে সাজানো রান্নাঘর,রেডী টু ইট রুটির প্যাকেট পাশে রাখা ,  টা রুটি করতে বলে ওর সাথে গল্প জমাই  ওর দুই ছেলে,আইটিতে পড়ছে ,এখানে স্কুল ,কলেজ সব নৌকা করেই যাওয়া আসা করে, ওর জমিজমা নেই তাই কাজ করে বোটে কাল কোচিন ফিরে যাব শুনে বলে আলাপ্পুঝা বীচ্টা দেখে যাবেন ফেরার পথে 

 

রাতে কালো জলের মধ্যে দুলতে দুলতে কখন যেন ঘুম নেমে এসেছে ,ঘুম ভাঙ্গল বিজাতীয় ভাষার চীৎকারে ,বাইরে এসে দেখি ,সামনেই ওনাম উৎসবের জন্য বোট রেসিং এর প্র্যাকটিস করছে ছেলের দল ভাবিনি না চাইতেই এমন এক দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হবে



গরম ধোসা আর কফি সহযোগে ব্রেকফাস্ট করতে করতেই বিষ্ণু হাজির আবার এক চক্কর ব্যাক ওয়াটার ঘুরিয়ে নটায় নামিয়ে দিল গাড়ীর কাছে  সকালের সূর্যের আলোয় আলাপ্পুঝার ব্যাক ওয়াটারের ঝিকমিকি দেখতে দেখতে গাড়ী এগিয়ে চলল কোচির উদ্দেশ্যে

 

চতুর্থ দিন গন্তব্য কোচি

আলাপ্পুঝা বীচের বদলে ড্রাইভার রমেশ নিয়ে গেল মারারি বীচে ,নীল আকাশ আর নীলাভ জলরাশি ভারি স্বচ্ছ, অতি পরিস্কার সমুদ্র তট, তবে এখানে সমুদ্রের রূপ মাঝে মাঝেই ভয়ংকর তাই সাঁতার নিষিদ্ধ তট পরিষ্কারের আসল কারন বোধহয় তটের অনতিদূরে থাকা বিশাল ঝকঝকে শৌচালয়ের ব্যবস্থা, সামান্য মুল্য ধার্য করা আছে খানিক দূরেই আছে কেরালার আয়ূর্বেদিক সেন্টার ,পঞ্চকর্ম ,মাসাজ,স্পা সব কিছুই করানো যায় সমুদ্রতটে খানিক ঘুরে ফিরে গেলাম কোচি শহরেউদ্দেশ্য অতি প্রাচীন পর্তুগাল থেকে আসা ইহুদীদের তৈরী সিনাগগটি দর্শন,যেটি পরদেশী সাইনাগগ নামে পরিচিত

পুরোনো কোচি শহরের জিউ টাউনের সামনে নামিয়ে গাড়ী পার্ক করে দিল রমেশ পরিষ্কার এক চওড়া গলির দুধারে দোকানের সারি, কোথাও মুন্নারের মশলা বিক্রি হচ্ছে, কোথাও সুতোর কাজ, কোথাওবা সুগন্ধী আতরের গন্ধ নাকে ঝাপটা দেবে তবে সব ফেলে ছুটলাম সেই পরদেশী সাইনাগগ দেখতে, মাট্টানচেরির রাজার প্রাসাদের মন্দিরের পাশেই এই সাইনাগগ১৫২৪ সালে মুরেদের আক্রমনে সব হারিয়ে পর্তুগালের ইহুদী রাজা যোসেফ আজার ,স্ত্রীকে কাঁধে নিয়ে সাঁতরে কোচিন পৌঁছান ক্রানগানোরের (কোচিনের )মহারাজা তাঁকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন ,আসলে জলপথে ইওরোপে ইহুদী রাজের সাথে তদানীন্তন ভারতের(আউধ) বহুদিনের বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক ছিল,হাতির দাঁত,মশলা রপ্তানি হত মালাবার উপত্যকার জলপথ ধরে তাই বহুকাল থেকেই নানান জায়গার বিতারিত ইহুদীরা এসে জমা হয়েছেন,আশ্রয় ,জমিজমা পেয়ে গড়ে তোলেন তাদের আরাধনার জায়গা এই পরদেশী সাইনাগগটি ২০০০ এর বেশি ইহুদীরা এখানে সামাজিক ,আধ্যত্মিক এমনকি বিয়ের জন্য  জড়ো হতেন 

পূর্বদিকে জেরুজালেমের দিকে মুখ করা সিনাগগটির ঠিক মাঝখানে বিশাল বিমা,দুপাশে পেতলের স্তম্ভ, রুপো আর ব্রাজেলিয়ান কাঁচের নকশাদার মোমদান আর ঝাড়বাতিতে সুস্বজ্জিত মেঝেতে নীল পোর্সেলিনের ১১৮০ খানা টাইলস যাতে ভেজিটেবিল কালার দিয়ে উইলো গাছের নকশা করা আছে চীন থেকে আনা টাইলস গুলির প্রতিটি কাজ স্বতন্ত্র ,একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যায় এছাড়া রাখা আছে দুটি কপার প্লেট তাতে লেখা কেরাল রাজ চেরামন পেরুমাল জোসেফ রাব্বান নামে এক ইহুদী লীডারকে প্রায় মালাবারের নায়ার মানে সভাসদদের সম্মান দিচ্ছেন 

সিনাগগ থেকে বেরিয়েই ঢুকলাম একটি ক্যাফেতে,মহিলারা কেক বেক করছেন,ঝিম ধরানো কফির গন্ধ ,সাথে থাকছে বইয়ের সম্ভার ক্যাফেটি পুরানো ইহুদীদের বাড়ীতেই বানানো  এরপর আশেপাশের অ্যান্টিক দোকানে ঢুঁ মেরে ,খানিক সুগন্ধী কিনে লাঞ্চ সারলাম গরম চাউমিন,প্র্রণ আর চিকেন স্টেক দিয়ে  কোচিন শহরটি বেশ সুন্দর,প্রচুর শপিং মল,শাড়ীর দোকান  ইচ্ছে থাকলেও শরীর বিশ্রাম চাইছিল তাই হোটেলে ফিরে বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে সন্ধ্যেটা তিনজনে মিলে টিভিতে স্টোলেন নামে দারুন একটি মুভি দেখলাম---চললএকে অপরের ফোন থেকে ছবি,ভিডিও নেবার কাড়াকাড়ি 

 

পরদিন ভোরে চললাম কোচি এয়ারপোর্ট ,ফিরব ব্যাঙ্গালোর ,মনের ক্যামেরায় তোলা ছবি গুলো সযত্নে একের পর এক সাজাতে সাজাতে এবার ঘরে ফেরার পালা

 

Post a Comment

Previous Post Next Post