বর্ষপূর্তি

 


আজ ৯ই জুলাই। সেই কালরাত্রি ঠিক আর একমাস পরে। জানি না অনাদি-অনন্ত নিস্পৃহ মহাকালের বুকে ৯ই আগস্ট দিনটাও আসার আগে ভয়ে কেঁপে উঠছে না তো? বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে ঝিমিয়ে যাওয়া আরজি কর ধর্ষণ-হত্যাকাণ্ডের বিষয়টা আবার চাগাড় দিয়ে উঠেছে। কিন্তু মিডিয়াকে টিআরপি দেওয়া ছাড়া ডঃ দেবনাথের নির্মম পরিণতির কপালে আর কিছুই জুটবে না -- দুর্নীতির চক্রব্যুয়ে ফাটল তো ধরেইনি, বিচারও অধরা।

মাঝেমাঝে মনে হয়, কোনও মানুষ কি দেবতার চেয়েও ক্ষমতাবান হতে পারে? দেবতাদেরও যুদ্ধে জয়-পরাজয় ছিল। অসুরদের উপদ্রবে ইন্দ্রকেও বলতে হয়েছিল “ত্রাহী মাম্”। প্রবল পরাক্রমী প্রায় অজেয় বীরেদেরও পতন হয়েছিল : “অতিদর্পে হতা লংকা, অতি মানে চ কৌরবাঃ।” নেপোলিয়ান থেকে হিটলার, বেপরোয়া স্বৈরাচারের বলে আজীবন অপরাজেয় ছিল না কেউই। কিন্তু এক নারী কি পৃথিবীর ভয়াবহতম নিষ্ঠুরতম পুরুষদের হারিয়ে ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে চলেছেন? কোন যাদুবলে কিংবা কোন ‘সঙ্ঘ’বলে?

পৃথিবীর ইতিহাসে বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে এমন অটুট সেটিং করে পাবলিককে বোকা বানানোর নজির আর কোথাও কোনোদিনও ছিল কিংবা আছে কিনা জানা নেই। যে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি, অনাচার, দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র, সুনির্দিষ্ট সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড করে ভারতের একটি "তথাকথিত" অঙ্গরাজ্যের সরকার ক্ষমতায় টিকে আছে, তার এক শতাংশ করলেই অন্য রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের শ্রীঘরবাস ও সরকারের পড়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত আছে। 

আইপিএস ক্যাডারের নীতিহীন লবিবাজির কথা আমলাতন্ত্রে অভিজ্ঞজনেরা জানে। কিন্তু যে অতুলনীয় নৃশংস প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ষণ ও হত্যাকে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা দায়িত্ব নিয়ে ধামাচাপা দিল, তদন্তযোগ্য ফরেন্সিক প্রমাণগুলোকে খতিয়ে দেখা তো দূর, চক্ষুপ্রস্খালনের খাতিরেও সুস্পষ্টরূপে জড়িতদের ন্যূনতম জিজ্ঞাসাবাদটুকু করল না, সেটা যে এই অভাগা রাজ্যবাসীকে নিষ্পেষণ করা দুর্নীতির বখরা কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছোনোর পাকাসড়কের অকাট্য প্রমাণ, তা বুঝতে যদি এখনও কারও বাকি থাকে, তাহলে তার মাথার চিকিৎসার দরকার। নতুবা সে ঠাণ্ডামাথার শয়তান। আমার তো মনে হয় দ্বিতীয়প্রকারের সংখ্যাই সিংহভাগ। এই দুর্নীতির দৌলতে শুধু ব্যাংক ব্যালেন্স নয়, একপক্ষের হিন্দু ও আরেক পক্ষের বাঙালী জাতিবিদ্বেষী হিংস্র আবেগও পরিপুষ্ট হয়েছে। নতুবা ২০২৪-এ কোটা আন্দোলনের নামে ঘটে যাওয়া বাংলাদেশে মৌলবাদী অভ্যুত্থান শুধু ওদেশের মৌলবাদী ও আমেরিকার ডীপ স্টেটের যোগশাযোশের ফলে সম্ভব হয়েছে বলে মনে হয় না। সেটা হয়ে থাকলে এদেশের উড বি সুপার পাওয়ার রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী হিন্দুদরদী সরকারের ভ্রূকুটি থাকতই থাকত, যেটা উপেক্ষা করার হিম্মত নেকড়ে হায়না খ্যাঁকশিয়ালদের হত না। 

অথচ আভাস তো পাওয়াই যাচ্ছিল। ২০১৪-য় ভারতে গেরুয়াদল ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মুসলিমরা বিপন্ন এই অলীক ভীতির জিগির তুলে বাংলাদেশে চিরাচরিত হিন্দু নির্যাতন মাত্রা ছাড়াতে থাকে। কিন্তু তার নিন্দা বাম কেন দক্ষিণপন্থীদের কণ্ঠেও শোনা যায়নি। মিডিয়া তো ভাড়ার টা্ট্টু। সন্ত্রাসী সম্প্রদায়ের সাহস বেড়ে গেল। ২০১৮-তেই খাগড়াগড় বিস্ফোরণকাণ্ডে বৃহত্তর ইসলামিক বাংলার নীলনক্শা তথা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মদতও আবিষ্কৃত হয় কেন্দ্রীয় এজেন্সি এনএইএ-এর তদন্তে। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও ইসলামিক জেহাদ-সন্ত্রাসের আঁতাত উন্মোচিত হওয়া সত্ত্বেও তদন্ত শেষপর্যন্ত পরিণতিহীন হয়ে ক্রমশ বিশ বাঁও জলে তলিয়ে গেল। তারপর থেকেই রাজ্যসরকারের সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতিত্বে ভর করা জেহাদি হিংস্রতা দিল্লীর পশ্চিমা জলবাতাসের পরিচর্যায় সোৎসাহে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকল। সোশাল মিডিয়ার কিছু সাহসী সংবেদনশীল বা হুজুকে ব্যক্তি ছাড়া মূলস্রোতের মিডিয়া সন্ত্রাসের ধর্ম হয় না কিংবা হলে তার রং গেরুয়া জাতীয় কাল্পনিক তত্ত্ব প্রচারে তখনও একনিষ্ঠ থেকেছে। হিন্দুনির্যাতন শব্দটি তখনও ছিল নিন্দনীয় অপভাষ। 

২০২১-এ দুর্গাপুজোয় বাংলাদেশে হনুমান-কোরান যুগলবন্দীর প্রেক্ষিতে হিন্দুসাফাই অভিযানের বিস্ফোরণের পরেও এদেশের মিডিয়ার ঘুম ভাঙেনি, সোশাল মিডিয়াই ছিল সংবাদবাহক, আর ভারত রাষ্ট্রেরও ছিল মৌন প্রশ্রয় ছিল। ফলত ২০২৪ থেকে যা হয়ে চলেছে, একটু তলিয়ে ভাবলে বোঝা যায়, তা আসলে এদেশের মাটিতেই বিপরীতধর্মী মৌলবাদের সবর্জনহিতায়চ-র ছদ্মবেশে বাঙালী হিন্দু নির্মূলীকরণের ব্লুপ্রিন্টের চূড়ান্ত বাস্তবায়ন। 

দুর্ভাগ্যক্রমে সেই ষড়যন্ত্রে জাতীয়তাবাদী বাঙালী মনীষা ও মেধাও ব্যবহৃত হয়েছে। যারা পুরোপুরি "বাঙালীর আগে ভারতীয়, বাংলার আগে রাষ্ট্রভাষা হিন্দী" এই জাতীয় বিভ্রান্তিকর বিজাতীয় সাম্রাজ্যবাদী ধারণার প্রচারক, তারা বাঙালীর প্রতি সরাসরি "সালোয়া জুড়ুম"-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ। আর আমরা যারা বুঝতে পারছি, তারাও অতিকায় সঙ্ঘশক্তির দ্বারা সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ভয়ে চুপ করে আছি। কিন্তু যদি মনে করি যা পরিবেশিত হচ্ছে, বিনা প্রতিবাদে বিনা বিতণ্ডায় গ্রহণের ভান করে ঝামেলা এড়িয়ে মনে মনে নিজের বিশ্বাস লালন করে যাব, তাহলে এই ভান বা অভিনয় করতে করতে একসময় বাস্তবিকই এইসব সহজলভ্য ইডিওলজিক্যাল গার্বেজই গলাঃধকরণ আরম্ভ করব। হয়তো ইতিমধ্যে সেই প্রক্রিয়া শুরুও হয়ে গেছে। 

বিপন্ন জাতির একতাই একমাত্র অবলম্বন হওয়ার কথা। কিন্তু ঐক্যের সূতোটা ছিঁড়ে সাক্ষাৎ নরখাদকদের হাতে চলে গেছে, যারা বাঙালী ঘরের নব্য রাষ্ট্রবাদী ছেলেছোকরাদের কাঠপুতলীর মতো পিতৃতন্ত্রের সুরে নাচাচ্ছে হিন্দুত্বের নামে, দেশপ্রেমের নামে— যাতে তারা নিজেদেরই বেহাত ভূমিতে স্বজাতির আর্তচিৎকার বিদেশনীতি, কূটনীতি, পররাষ্ট্রনীতি আউড়ে চাপা দিতে পারে।

Post a Comment

Previous Post Next Post