সূত্রপাত

 

সূত্রপাত




 

একটা ঝোঁকের মাথায় শুরু করা এই আন্তর্জালক পত্রিকা – “স্বয়ংসিদ্ধা ত্রৈমাসিক”। ঝোঁক কারণ এটি আসলে অপাত্রে দান করার পর দত্তাপহরণ বা নামের পুনরুদ্ধার।

ইতিহাসটা অবশ্য আরেকটু পুরোনো। পত্রিকা সম্পাদনার সূত্রপাৎ হয়েছিল সাহিত্য জগতে প্রবেশের আগেই। তখন আমি দেশ ও আনন্দবাজার পত্রিকায় চিঠির পর চিঠি লিখে প্রত্যাখ্যানের পর প্রত্যাখ্যানে ক্লান্ত। ২০০৭-০৮ নাগাদ একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মুখপাত্র ‘সেবা লিংক’ নির্মাণের অবৈতনিক স্বেচ্ছাশ্রম যেচে কাঁধে নিই। সম্বল শুধু আন্তরিকতা ও বিশুদ্ধ অনভিজ্ঞতা। সঙ্গে ছিল আর্থিক প্রতিবন্ধকতা ও সম্পাদনা করলেও নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় পরের হস্তক্ষেপ। তবু সম্পূর্ণ আমার একার তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত প্রথম সংখ্যায় শুধু সাহিত্যের অঙ্গন নয়, সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য, কর্মপরিসর, ভবিষ্যৎ রূপরেখাও অনেকটাই তুলে ধরা গিয়েছিল। কিন্তু ছাপা ও পাতার মানের দৈন্যের জন্য অর্থাভাব নয়, অভিযুক্ত হলেন সম্পাদিকা। অথচ ঐ একটি মাত্র সংখ্যাই প্রকাশ পেয়েছিল এই অযোগ্যার সম্পাদনায়। তারপর বিচক্ষণ সমালোচকরা আর সেটা চালাতে পারেননি।

পরে ২০১৫ সালে যখন চুটিয়ে নিয়মিত লিখছি, তখন আরেকটি পত্রিকার দায়িত্ব নিলাম। আমার সম্পাদনায় শুধুমাত্র পুজো সংখ্যা প্রকাশ পেয়েছিল। সেটাই ছিল সর্বশেষ সংখ্যা। প্রকাশনার সঙ্গে আমার তিক্ত বিচ্ছেদ যখন আসন্ন, তখন ঘটে গেল প্রকাশকের অকাল প্রয়াণের মতো নিদারুণ ট্রাজেডি। তিক্ততা ও বিষাদে পত্রিকা করার চিন্তা ত্যাগ করি।

পরবর্তীকালে একটি কবিতা সংকলন “সোচ্চার – সময়ের উচ্চারণ” ও অণুগল্প সংকলন “ভয়কল্প” সম্পাদনা করলাম যথাক্রমে নিজের স্বতঃপ্রণোদিত তাগিদে ও একটি প্রকাশনার হয়ে। নিজের স্বাধীনভাবে করা ‘সোচ্চার’ নিয়ে স্বারোপিত সময়সীমার চাপ ছাড়া আর কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু ‘’ভয়কল্প” সম্মানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে উপহার দিল আরেক প্রস্থ তঞ্চকতা।

এর পরের অধ্যায়, আরও গোলমেলে। আমাদের আবাসনে শারদীয়া পুজোর কালচারাল সেক্রেটারি অর্থাৎ বা সাংস্কৃতিক সম্পাদক বা সাংস্কৃতিক সচিবের শ্রমসাধ্য ভূমিকা পালন করতে হয়েছে দু’বার এবং সেটাও উপরোধে ঢেঁকি গিলে। ২০১৯-এ শরীরে গুরুতর অস্ত্রোপচারের ঝক্কি ও তার চেয়েও বড় কথা নানাবিধ দ্বন্দ্ব জটিলতা কুটিলতার আবর্তে যুঝে সমগ্র সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পালনের পরে স্মরণিকা সম্পাদনা আর করা হয়নি। কারণ শর্ত ছিল প্রক্রিয়াগত সুবিধায় নয় কাজ করতে হবে পরের স্বার্থে; স্বনামে নয়, যাবতীয় খুঁটিনাটি করতে হবে অন্যের বকলমে। সাংস্কৃতিক সচিব যেন সভাপতি ও যুগ্ম সচিবদের ব্যক্তিগত সচিব। চতুর্থী থেকে নবমী পর্যন্ত টানা ছয়দিন ধরে চলা নানান অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতার কোনও ছবি বা প্রতিবেদন তো দূর, গুটিকতক কুশীলবের গোষ্ঠীপ্রেম প্রকাশ ছাড়া প্রথম বছরের পুজোরও কোনও উপস্থাপনাই ছিল না সেই ব্যয়বহুল স্মরণিকায়। ২০২১-এ দ্বিতীয়বার এই গুরুভার সামলানোর সময় নানা বাধাবিঘ্ন খবরদারি মধ্যে শেষ পর্যন্ত সুভেনিরটি করতে পেরেছিলাম, যেটাকে আবাসিকদের শারদীয়া কর্মকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত সচিত্র নথি বলা যায়। কিন্তু আবাসনে নানা প্রদেশবাসীর সমাবেশে বৈচিত্র্যগত আপাত বিরোধিতার মধ্যে সাংস্কৃতিক ঐক্যের বার্তাবাহী দ্বিভাষিক সম্পাদকীয়টি কেউ পড়ে দেখেছেন সন্দেহ। তবে অনুদার বাজেটের মধ্যেই পুজোর মুহূর্ত, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সচিত্র প্রতিবেদন, আগত লেখাগুলিকে পরিবেশনযোগ্য করে নির্দিষ্ট পাতার মধ্যে সংকুলান, সাদাকালো ও রঙীন পাতা হিসাব করে বিজ্ঞাপনগুলির বিন্যাস ইত্যাদি মিলিয়ে প্রায় সবাইকে প্রসন্ন করার মতো দুঃসাধ্য কাজ করেও দেখলাম সঞ্চয়ের ভাঁড়ারে সেই গরল ও বিচ্ছিন্নতা।

আমার অবস্থা ‘সোনার তরী’র মতো, যা “আমারই সোনার ধানে গিয়াছে ভরি” বলে আমার “ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই”। সৃষ্টি সবার মনগ্রাহী হলেও স্রষ্টা কারও কাছেই গৃহীত নন। বাঙালীর বিচিত্র কর্কটবৃত্তি অনুরূপ উৎকর্ষের পথ অবরোধ করতে যারপরনাই সচেষ্ট। আবাসন নির্মাতা সংস্থা ‘সিদ্ধা’ নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ও পুজোয় মহিলাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ মাথায় রেখে তৃতীয় বর্ষের এই স্মরণিকাটির সাধ করে নাম দিই – “স্বয়ংসিদ্ধা”। ক্রমশ বুঝলাম এই নামটির দশা উলুবনে পতিত মুক্তোর মতো। কিন্তু ‘স্বয়ংসিদ্ধা’ নামটি যখন আমার মানসকন্যা, তখন তার লালন পালনের দায়িত্ব আমারই। শুধু দায়িত্ব নয়, তিক্ততা ও রিক্ততার আবহে এর প্রতি একটা ভালোবাসা ও অধিকারবোধও জন্মে গেছে। নামটি অতি প্রচলিত ও বহুলব্যবহৃত হলেও এই নামে কোনও পত্রিকা আছে বলে জানা নেই।

সেই সঙ্গে নিজের ১৫-১৬ বছরের অভিজ্ঞতায় বুঝেছি, পত্রিকা বা সংকলন, প্রকাশনা যেটাই সম্পাদনা করি, করা দরকার স্বাধীনভাবে পরনির্ভরতা ব্যতীত। সৌভাগ্যক্রমে কারিগরী দায়িত্ব পালনের জন্য সহসম্পাদক হিসাবে পাশে পেলাম ভ্রাতৃপ্রতীম প্রবীর মজুমদারকে। আমি প্রচলিত প্লাটফর্মে ওয়েবসাইট নির্মাণ করতে চাইলেও প্রবীরের উৎসাহেই ডোমেইন কেনা। একটু অনিশ্চয়তায় ভুগে আমার অনভিজ্ঞা কন্যা উর্বীকে দিয়েও হাতের পাঁচ ব্লগজিন তৈরি করাচ্ছিলাম, এমন সময় প্রবীরের ফোন – দিদি স্বয়ংসিদ্ধা অনলাইন রেডি। তারপরেও নানাবিধ টানাপোড়েনের মধ্যে নির্ধারিত সময়ে ওয়েবসাইট তথা পত্রিকা প্রকাশ করার তাগিদে শেষে নিজেকেই হাত লাগাতে হল। প্রথম পদক্ষেপ একটু টলমল হতেই পারে। আশাকরি পাঠক ও রচয়িতারা নিজগুণে ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দেবেন।


শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়



 

Post a Comment

Previous Post Next Post