৪
নুবরা উপত্যকা
২৫শে জুলাই ২০২২
২৫ তারিখ আমাদের যাত্রা খারদুংলা পাস হয়ে নুবরা উপত্যকার পথে। উচ্চতার কারণে ও অক্সিজেনের অভাবে শরীর কাহিল হলে আর রক্ষা থাকে না। তাই নুবরার দিকে যাত্রা করার আগে পর্যটকদের অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখতে বলা হয়। চালকের নাম রিগজ়িন। তিব্বতী ভাষায় Rigzin শব্দের অর্থ জ্ঞানী। কিঞ্চিত দরাদরির পর ৪৫ হাজার টাকায় ২৫-৩০ জুলাই আমাদের গন্তব্যগুলো ঘুরিয়ে ৩১-এ লে ফিরিয়ে আনবে চুক্তি হয়েছে। ৬ জন বসার মাহিন্দ্রা বোলেরো গাড়িতে তিনজন যাচ্ছি। আরেকটি পরিবার সঙ্গে থাকলে টাকাটা ভাগাভাগি হয়ে যেত। তারা থাকলে খাতির যত্নেরও ভাগ পেত।
গাড়ি প্রথমে বাজারে গেল। তারপর ‘এই পথ যদি না শেষ হয়…’।
সুনীল আকাশ ছাড়া চতুর্দিকে সব পাথুরে মেটেরঙা, বর্ণচ্ছ্বটা নেই। কিন্তু সেই প্রাকৃতিক
ভাস্কর্য ও কারুকার্যও দেখে মোহিত হতে হয়।
পথে মাঝেমাঝেই বাইক বাহিনী চোখে পড়ে। কারও কাছেই অম্লযান ভাণ্ডার দেখলাম না। অবশ্য যারা এমন উচ্চতায় টানা মোটরবাইক চালিয়ে যেতে পারে, তাদের রক্ত এমনিতেই অক্সিজেনের গোডাউন। অধিকাংশ বাইকে দুজন করে আরোহী; হয়তো পালা করে চালাবে। কিন্তু অনেকেই একা। কয়েকটি মেয়েও আছে।
-
খারদুংলা পাস:
খারদুংলা
পাসে গাড়ি দাঁড়াল। ১৮,৪০০ ফুটের মান রেখে খানিকটা ঠাণ্ডা ছিল। একটা টিলার মাথায়, সম্ভবত
‘খারদুংলা টপ’-এ চড়ে সবাই ছবি তুলছে দেখে আমরাও উঠেছিলাম। আমার মাথা টলে পড়ে যাওয়ার
উপক্রম হয়েছিল, সঙ্গে হাঁফ। নতুন কিছু নয়। ভার্টিগো ও স্পন্ডেলিসিসের জন্য মাথা ঘোরা
আমার সঙ্গে সাথী, আর সিঁড়ি চড়লে সমতলেও হাঁপাই। কিন্তু বিশ্বের দ্বিতীয় উচ্চতম মোটরযোগ্য
সড়কপাসের উচ্চতাকে সম্মান জানিয়ে একটা টিলায় সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করে আমি বাস্তবিকই
খানিকটা টলমলে আর খিটখিটে হয়ে গেলাম।
যতটা না কাবু হয়েছিলাম, তার চেয়ে বেশি অভিনয় করতে হল অক্সিজেন সিলিন্ডারের ভাড়া উসুল করার জন্য। নতুবা ড্রাইভারের অভিজ্ঞ চোখ বুঝতে পেরেছিল, আমার কষ্ট বিশ্রাম ও খানিকটা নীচে অবতরণে পর নিজে থেকে ঠিক হয়ে যাবে। সত্যিই মোমো ও কফি খাওয়ার পর খারদুংলাতেই চাঙ্গা হয়ে গেলাম। গাড়ি ছাড়ার আগে একটা ফলক থেকে টুকে নিলাম — খারদুংলা (টপ): ১৮৭৬০ ফুট, খারদুংলা গ্রাম: ১৪৭৬৩ ফুট।
ডিসকিট মঠ:
নামতে নামতে চোখে পড়ল প্রকান্ড দুটি অট্টালিকা – একটি
পাহাড়ের মাথায় আরে অন্যটি তার পাদদেশে। দ্বিতীয়টিই বেশি সুন্দর লাগল। গাড়ি থামতে জনপ্রতি
৩০ টাকার টিকিট কেটে সেটাই ঘুরেফিরে দেখে নিলাম। প্রকাণ্ড বুদ্ধমূর্তির নীচে বসে, বৃত্তাকার
দেওয়ালে “ওঁ মণিপদ্ম হুং” লেখা চোঙাকৃতি অসংখ্য ঘণ্টার বেষ্টণীর বেশ কয়েকটা ঘুরিয়ে
ঘুরিয়ে লম্বা বারান্দা বেয়ে মন্দির প্রদক্ষিণ করে বেশ খানিকক্ষণ কাটালাম। এককথায় অপূর্ব
নিসর্গ।
গাড়িতে ফিরতে রিগজ়িন বলল, “ওঁয়াহা জানা হেয়?”
“ও কেয়া হেয়?”
“ডিসকিট মনেস্ট্রি।”
“তো ইয়ে কেয়া থা?”
“ইয়ে ভী ডিসকিট মনেস্ট্রি। নয়া বনা।”
আমরা নতুন অংশটি দেখেছি, পূরোনো মূল মনেস্ট্রি হল চূড়ায়
অবস্থানকারী অট্টালিকাটি। ঘড়ি অনুযায়ী বিকেল গড়াতে চলেছে। হুন্দর পৌঁছোনো নিয়ে চিন্তা
নেই, কিন্তু তক্ষুণি যাত্রারম্ভ না করলে বালিয়াড়িতে উটের সাফারি ঐদিন আর সম্ভব নয়।
পরের দিন তুরতুক থেকে ফিরে কি সাফারির সময় থাকবে? দোনোমনো করতে করতে গাড়ি কিছুটা গড়িয়ে
গেছে। রিগজ়িন হঠাৎ গাড়ি ঘোরাল, “ক্যামেল সাফারি আজ নহী হো পায়েগা। আপ মনেস্ট্রি দেখ
লো। সাফারি কল তুরতুক সে ওয়াপস আকে কর লেনা।”
হাঁফাতে হাঁফাতে ১৭৪টা সিঁড়ি গুণে শাক্যমুণির দর্শন
পেলাম। আরও ১৪-১৫টা সিঁড়ি ভাঙলে একেবারে চূড়ায় আরেকটা বুদ্ধমূর্তি আছে যার দরজায় সন্ধেবেলা
সময় উত্তীর্ণ হওয়ায় তালা পড়ে গেছে। তবে কালীমা ও তারামা এখানেও দেখা দিলেন। ছোটছোট
কুঠুরিতে কাচবন্দী তারা ও কালীর মূর্তিগুলো দেখে কেনা ও ছবি তোলা — দুটো ইচ্ছাই
চাগাড় দিয়ে উঠল। ছবি তোলা নিষিদ্ধ। অন্ধকারে সুবিধাও হল না।
গাড়িতে যখন ফিরলাম তখন আকাশে আলো। উট-বিহার যখন সম্ভব
নয়, তখন ডিসকিট মঠের নিজস্ব বিপণীতে একটু ঢুঁ মারা যাক। একটা ছোট্ট পেতলের কিন্তু ঝকঝকে
সোনালি অপরূপ তারা মূর্তি কিনে ফেললাম একটু দরাদরির পর ৪৫০ টাকা দিয়ে। ওখানে নাকি দরাদরি
চলে না।
হুন্দরের বালিয়াড়ি:
-
নাচতে নাচতে দেখি আমার বর ইঙ্গিতে আর মেয়ে চেঁচিয়ে সরে যেতে বলছে। আবিষ্কার করলাম অন্য এক ক্যামেরাম্যানের নৃত্যরতা বৌ ভাতৃবধূ মেয়ে মা শালী শাশুড়ি ভাইপো ভাইঝি প্রমুখদের নুব্রা ধন্য করা নাচের ভিডিওর মাঝে আমি সাক্ষাৎ ফটোবম্বার ধুড়ি ভিডিও-বম্বার হয়ে অঙ্গ দোলাচ্ছি। ওদিকটায় গিয়েছি পোশাকওয়ালি বুড়ির নির্দেশেই, সে আমাকে স্টেজের সোলো পারফরমেন্সের বদলে মাটিতে গ্রুপডান্স করাবেই। ঘনঘন গান বদলানোয় এমনিতেই জুত পাচ্ছিলাম না, তার ওপর এমন অপমান!নুব্রা উপত্যকার অন্যতম আকর্ষণ ‘স্যান্ডডিউন’ বা বালিয়াড়ি।
আকাশে আলো থাকলেও কমে এসেছে, তার ওপর পৌঁছোনোর মুখেই বৃষ্টিপাত শুরু হল। একটা সরু নালার
ওপর একটা ছোট্ট সাঁকো। সাঁকো পেরিয়ে টুকটাক স্টল ছাড়িয়ে বেশ দূরে সাফারির আয়োজন, আর
তার জন্য বিরাট লাইন। এদিকে বৃষ্টি টিপটিপ থেকে রিমঝিমের দিকে।
ড্রাইভার বলল, “দেখ লিজিয়ে, হো গয়া তো আচ্ছা।” কিন্তু
আমার মেয়ে গেল বিগড়ে -- গাড়ি থেকে নেমে এক পাও এগোবে না। অষ্টাদশী কন্যা পাঁচ বছরের
শিশুর মতো মাটিতে পা দাপিয়ে বলল, “কোথাও যাব না, এক্ষুণি হোটেল চলো।”
“ক্যামেল সাফারি?”
“না”
“একটু হাঁট…”
“না”
“ওদিকটা কী সুন্দর, একটু ব্রীজ পেরিয়ে চল…”
“বললাম তো না!”
ওর বকুনি শুনেই বোধহয় বৃষ্টি একটু ধরে এল। এখনও পর্যটকদের
উচ্ছ্বলতা। আমার হোটেলে ঢোকার একটুও ইচ্ছা নেই, ভাগ্যক্রমে শুভঙ্করেরও নেই। আমি বোঝানোর
চেষ্টা অব্যাহত রাখায় উত্তর পেলাম, “তুমি অক্সিজেন নিয়েছ, তাই এত এনার্জি। আমি নিইনি,
আমি কিচ্ছু করব না।”
একদল মহিলা রংচঙে পোশাক ও মাথায় টুপি পরে নাচছিল। স্থানীয়
পোশাকে ছবি তোলা পর্যটন কেন্দ্রের মার্কামারা বৈশিষ্ট্য। শুভঙ্কর মেয়েকে ভোলাতে ভোলাতে
ক্লান্ত হয়ে বলল, “তুমি নাচবে?”
আমি উর্বীকে বললাম, “তুই নাচবি?”
“না-------”
আমি স্টেজের মতো নাতিউচ্চ চাতালের কাছে গিয়ে খোঁজ নেওয়ার
আগেই দেখি আমার বর একটা বুড়োকে টাকা দিয়ে বলছেন, “ইনকো পহেনা দিজিয়ে।”
কী আর করি? সং সেজেছি যখন একটু প্রতিভাও দেখানো যাক।
পোশাকওয়ালী বুড়ি ইঙ্গিত করল সিমেন্টের চাতাল থেকে নেমে অন্যদের সঙ্গে গিয়ে নাচতে। আরেকটি
বারবার গান বদলানোর হুকুম করে সব গুলিয়ে দিচ্ছিল। “হুই হাম চাং কী-ই-ই…” জাতীয় একটা
কিছুর সঙ্গে বেশ হেলেনের কায়দায় চাতাল থেকে মাটিতে অবতীর্ণ হয়ে নাচতে নাচতে দেখি আমার
বর চোখ পাকিয়ে ইঙ্গিতে সরে যেতে বলছে। যতবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জানতে চাই, কী হল, ততবার
কটমটিয়ে নাচে বাধা দেয়। অবশেষে লক্ষ্য করলাম, আসল বাধার উৎস অন্য এক ক্যামেরাম্যান।
তার নুব্রা ধন্য করা নৃত্যরতা বৌ ভাতৃবধূ মেয়ে মা শালী শাশুড়ী ভাইপো ভাইঝি প্রমুখ মান্যগণ্যদের
ভিডিওর মাঝে আমি সাক্ষাৎ ফটোবম্বার ধুড়ি ভিডিও-বম্বার হয়ে অঙ্গ দোলাচ্ছি। আর তাই আবার
বরের চোখেমুখে ভর্ৎসনা একটু আগে যিনি মত না নিয়েই বৌকে সং সাজানোর বরাত দিয়েছেন!
কিন্তু জায়গাটা কি ওদের কেনা? আমি যেখানে খুশি নাচি,
ওরা বাধা দেওয়ার কে? আর দিলেই বা আমার বর আমার বদলে ওদের পক্ষ নিয়ে আমাকেই শাসন করবে?
ব্যাস্! মেয়ের সঙ্গে মায়েরও মুড আমসি!
এবার তিনি ক্যামেরা বাগিয়ে অনুনয় করলেন, “তুমি ওদিকে
গিয়ে নাচো।”
“না।”
“তাহলে স্টেজে উঠে নাচো।”
“না, ওরাই তো নীচে পাঠিয়ে দিল।”
তাও বরের কথা রেখে চাতালের কাছে যেতে লাদাখি বৃদ্ধা
আবার নীচে ওদের সঙ্গে নাচতে বলল। একটু ঝাঁঝিয়ে জানালাম ওরা অন্য গ্রুপ। শুভঙ্কর আবার
বলে, “কী হল, একটু নাচলে না?”
“আমার মুড নেই। এখানে নয়, ওখানে নয় –- ”
“তাহলে?”
“মামমাম নাচলে তাও কথা ছিল। ড্রেস পরতে হবে না, সঙ্গে
থাকবি?”
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই উর্বী বলল, “না-----!”
“তাহলে আমিও না। এই জবরজং খুলে ফেলছি।”
শুভঙ্কর এবার মোক্ষম চালটা দিল, “আমার দেড়শো টাকা তাহলে
জলে গেল। মামাই রেগে আছে, তুমি এমন করছ –- তাহলে হোটেলেই যাই চলো…”
আমি হাতে প্লাস্টিকের ফুল ঝাঁকিয়ে কখনও মেয়েকে প্রদক্ষিণ
করে, কখনও আকাশে ঘুঁষি বাগিয়ে, কখনও দু’হাতের আঙুল দিয়ে দেড়শো দেখিয়ে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গীতে
রেগে রেগে নেচে যখন থামলাম, ততক্ষণে বৃষ্টিও থেমে গেছে। শুভঙ্করের দেড়শো টাকা তাতে
উসুল হল কিনা জানি না, তবে আমার মেয়ে আঙুল তুলে “আর্চারি” বলায় বুঝলাম, ওর মেজাজ কিছুটা
সমে ফিরেছে। আমরা কৃতার্থ হয়ে বললাম, “করবি?”
১০০ টাকায় ৫ বার তীর ছোড়া যায়। জীবনে প্রথমবার ভারী
ধনুক তুলে প্রায় ২৫-৩০ মিটার দুরবর্তী বোর্ডে তিনবার গেঁথে দিল। দুটো পরিধি ঘেঁষে বেরিয়ে
গেল।
“ক্যামেল রাইড হবে?”
“হ্যাঁ” শুনেই ছুট ছুট ছুট। সন্ধ্যা সাতটার আকাশে তখনও
পড়ন্ত বিকেলের আলো। আমাদের হোটেল থেকেও বার দুই-তিন ফোন এসেছে আমরা যাচ্ছি কিনা। লাইন
দেখে বিস্তর দোনোমোনো করার পর টিকিট কাটা হল এই প্রতিশ্রতি পেয়ে, যদি তখন আর উট না
মেলে পরের দিন এই টিকিট দেখিয়ে মরূজাহাজে চড়া যাবে। ৮-১০টা উট একসাথে ছাড়ছে, আবার তেমন
একটা দল ফিরে আসছে। এরকম তিন-চারটে উটের ঝাঁক সমতলবাসীর বায়না মেটাচ্ছিল। ৩৫০ টাকা
গুণিত ৩ সমান ১০৫০ টাকা আজ না কাল না জল ভাবতে ভাবতে দেখি হঠাৎ আমাদের ডেকে নেওয়া হল।
নম্বর অনুযায়ী অনেক পেছনে, কিন্তু একটা বড়ো দল একসাথে রওনা হবে বলে তখনই রওনা হতে চলা
সাফারির শেষ তিনটে নম্বর ছেড়ে দিল। কী ভাগ্য!
অপেক্ষা করার সময় আলাপ হয়েছিল একদল মহিলা পর্যটকের সঙ্গে।
‘HURRAH GIRLS’ নামাঙ্কিত সংস্থাটি শুধু মহিলাদের ভ্রমণ করায়। তাদের একজনকে নিজের নম্বর
দিতে গিয়ে কিছুতেই ৭টি অঙ্কের বেশি মনে পড়ল না, মেয়ের সাহায্য নিতে হল। মানে, যতই
হাসিখুশি থাকি, অক্সিজেন ঘাটতির ব্যাপারটা আমার আদৌ অভিনয় ছিল না! তাঁর হাতেই ছবি
তুলে দেওয়া জন্য মোবাইল দিলাম। তিনি চলভাষ ফেরত দেওয়ার আগেই আমার উট তার পশ্চাদ্দেশ
উত্থিত করে ফেলেছে। আমি নাগাল পেলাম না। যা কী হবে? পেছনের উট থেকে জবাব দিল, “আমাকে
দিয়েছেন তোমার মোবাইল। ঘাড় ঘুরিও না, ভালো করে ধরে বোসো।”
“তুমি শিওর, ওটা আমারই মোবাইল?”
অত ঝুঁকি নেওয়ার দরকার ছিল না। কিছু দূর গিয়ে উটওয়ালারা
নিজেরাই ছবিটবি তুলে দিল, যাচ্ছেতাই যদিও। ফিরে যখন এলাম, তখন সূর্যের আলো ম্লান হয়ে
এলেও মরেনি। হোটেলে ঢোকার আগে এখানকার স্থানীয় সূচি মোটামুটি শেষ।
পূর্ববর্তী পর্ব : ৩।। লে সার্কিট-১ পরবর্তী সংখ্যা : ৫।। হুন্দর থেকে তুরতুকের পথে