সীমান্ত প্রহরায় লাদাখ ।। ৫ ।। হুন্দর থেকে তুরতুকের পথে

 

হুন্দর থেকে তুরতুকের পথে

২৬শে জুলাই ২০২২

 



২৬শে জুলাই সকাল সকাল তুরতুকের উদ্দেশ্যে রওনা হব বলে প্রাতঃরাশের টেবিলে হাত ধুয়ে বসে আছি। হঠাৎ একটা ছোট্ট কুকুরছানা এসে আমাদের সঙ্গে খেলা জুড়ল। প্রিয় খেলা হল আমার পায়ের পাতা কামড়ানো। জুতো থাকায় সুবিধা করতে না পারলেও বেশ টের পাচ্ছিলাম, ধারালো দাঁত জুতো ভেদ করলে ব্যাপারটা আর খেলা থাকবে না। ও ব্যাটার জন্যই টেবিল ছেড়ে ছুটোছুটি করতে হল খানিক। এদিকে অতটা দূর যাব, কিন্তু আলু-পরোটার বরাত দিয়ে খাদ্যের দেখা নেই।

উর্বী বলল, “কীভাবে হাত ধুলো দেখলে? সাবান দিয়ে প্রায় কনুই পর্যন্ত ধুয়ে আটা মাখল ছেলেটা।” পাহাড়ি রাজ্যে জলাভাব খুব সাধারণ সমস্যা। স্থানীয়রা দিনের পর দিন স্নান না করে থাকাই অভ্যাস করে ফেলে। কিন্তু লাদাখিদের নোংরা থাকতে দেখিনি, অন্তত আমরা যেটুকু দেখেছি। আর এই ছেলেটা তো নেপাল থেকে এসেছে শুনলাম। গত রাতে এরই মুখে অব্যবস্থার জন্য দুঃখ প্রকাশের বদলে চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনে বেশ রাগ হয়েছিল। সকালে ওর হাত ধোয়ার ধারাবিবরণী ও পরোটার স্বাদ সেসব ভুলিয়ে দিল। এক রাত্রি থাকা-খাওয়া ও সকালের জলখাবার মিলিয়ে সম্ভবত ২০০০-২২০০ টাকা মতো লেগেছিল, লিখে রাখা নেই।

যাইহোক, পাকিস্তান সীমান্ত ঘেঁষা নৈসর্গিক গ্রাম বলে শুধু নয়, মধ্য এশীয় একটি উপজাতির বসতি বলে তুরতুকের একটা ভৌগোলিক ও নৃতাত্ত্বিক গুরুত্বও আছে। প্রাতঃরাশ করেই বিল মিটিয়ে গাড়িতে। মালপত্রসহই উঠলাম, নুব্রা কারণ ফিরে এলেও উঠতে হবে অন্যত্র।

 

সিয়াচেন ওয়ার মেমোরিয়াল:


রাস্তায় পড়ল ‘সিয়াচেন যুদ্ধ স্মারক’ (Siachen War Memorial)। যুদ্ধের পোশাকে দণ্ডায়মান ৫ জন সেনা জওয়ানের মূর্তি সাজানো। ৫০ টাকা করে টিকিট কেটে সেখান থেকে খানিক দূরে সামান্য চড়াই ধরে গিয়ে স্মারক-মঞ্চ জাতীয় একটা নির্মাণ।

কয়েকজন সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল। ফেরার পথ ঢালু। আমার একটু আগ্রহ দেখে একজন আরোহী “চালাইয়ে চালাইয়ে” বলে সাগ্রহে নিজের সাইকেল ধরিয়ে দিল। কী ভালো ছেলে, নির্দ্বিধায় চালাতে দিয়ে আর ফেরতও চাইল না। পাহাড়ি রাস্তায় অনভ্যস্থ আমি ভরসা পেলাম না, কন্যে তো শেখার চেষ্টাই করেনি, শুভঙ্করই চালিয়ে আনল। টিকিট কাউন্টারের কাছে ফিরতেই ৫০ টাকা সাইকেল ভাড়া। ছেলেটাকে ধারেকাছে দেখা গেল না। যাইহোক আমাদের গন্তব্য ছিল তুরতুক গ্রাম।

ভয়ানক রাস্তা। কোথাও ধস নেমেছে বলে রাস্তা বন্ধ আর এক কিলোমিটারের বেশি লম্বা গাড়ির সারি। একটা নদী বা নালা বইছিল। রাস্তা থেকে নেমে ঘুরে আসব কিনা ভাবতে ভাবতেই যানজট কেটে গেল। উঁচুনীচু খোঁচাখোঁচা পাথুরে রাস্তায় চলতে চলতে রিগজ়িনকে শুধোলাম, “স্টেপনি হ্যায় না সাথমে?” ও হোহো করে হেসে বলল, “আজ তক কিসিনে পুছা নহী। চলিয়ে আপনে সোচ তো লিয়া।”

 

তুরতুক গ্রাম:


কিছুদূর পরেই অবশ্য পীচরাস্তা পড়ল। কিন্তু গাড়ি যেখানে থামল সেখানে কোথায় গ্রাম, আর কোথায় নিসর্গ? পথশ্রমে ক্লান্ত শরীর জুড়োব ভেবেছিলাম। কিন্তু সিঁড়ি বেয়ে নদী, নদীর ওপর সেতু, তার ওদিকে সিঁড়ি, আর সেই সিঁড়ি ভেঙে নাকি গ্রাম যার নমুনাস্বরূপ ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি আর বিশেষ ধরনের পোশাক, গোঁফদাড়ি ও অভিব্যক্তির মানুষজন ছাড়া দর্শনীয় কিছু চোখে পড়ল না। এসেছি যখন গাড়ি থেকে নামতেই হল। সাঁকোও পেরোতে হল। তারপর দুই দিকে দুই সারি সিঁড়ি দেখে কোন দিকে যাই ভাবতেও হল।

শেষে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার উপায় যেখানে কাছাকাছি, সেইদিকেই বাঁক নিলাম। তবে ব্যবস্থা দেখে বিয়োগবাসনায় ব্যকুল জল ব্লাডার ছেড়ে মাথার দিকে ধাওয়া করল। শুভঙ্কর কাজ সারতে পারলেও আমরা মা-মেয়ে নাকমুখ মাস্কে ঢেকে ফিরে এলাম।  

জায়গাটা আসলে ছিল বালটিস্তানের অঙ্গ যা পাকিস্তানের দখলে চলে গিয়েছিল। আরব আগমনের আগে আফগানিস্তান (গান্ধার) পর্যন্ত ভারতের বিস্তৃতি ছিল। সে অনেক প্রাচীন ইতিহাস, বর্তমানে প্রাগৈতিহাসিক সাব্যস্ত হওয়ার জোগাড়। একটি ভাঙাচোরা বাড়ি নাকি সংগ্রহশালা বা মিউজ়িয়াম। তার বাইরে তিনজন মহিলা বাচ্চা কোলে। ভারী মজাদার দেখতে বাচ্চাগুলোকে। ছবি তুলতে যেতেই মেয়েরা বাচ্চা দিয়ে নিজেদের মুখ আড়াল করে ফেলছিল। এই ভগ্নকুটিরে প্রবেশের মূল্য ৫০ টাকা শুনে ফিরে আসব কিনা ভাবছিলাম। কিন্তু বাইরে বসা এক মিষ্টিমুখো মেয়ের মুখে নারী পরিচালিত সংগ্রহশালা শুনে টিকিট কেটে ঢুকেই পড়লাম।

নানা ধাতব ও রূপোর গয়না, পোশাক, তৈজসপত্র থেকে ঘরসংসারের নানা জিনিস বেশ আগ্রহভরে দেখাল টিকিট বিক্রেতা তথা গাইড। একটা প্রাচীন বাড়িকেই মিউজ়িয়াম বানানো হয়েছে। সেখানে বাচ্চা রাখার স্থান দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। ওর মুখের কথাই হল ‘উন দিনোঁ’ এমন হত, এমন ছিল না ইত্যাদি। কিন্তু সেইসব দিন বলতে কোনসব দিন, সেসব কিছু জানে না। পুরুষদের অমতে তুরতুকের মেয়েরা নিজেদের সংগ্রহে যার যা ছিল, তাই দিয়ে এই তথাকথিত মিউজ়িয়াম তৈরি করেছে। সম্ভবত সেইজন্য কোন ‘উন দিনোঁ’ হাজার খ্রিস্টাব্দের কোন ‘উ দিনোঁ’ নিজের শাশুড়ীর আমলের, সেই বিষয়ে ধারণা নেই। বাড়ির যাবতীয় কাজের বর্ণনায় ‘সাসুমা’ হলেন কেন্দ্রীয় চরিত্র। পিতৃতন্ত্রে ‘সাসুমা’দের সচরাচর খলনায়িকার ভূমিকায় দেখা যায়; ঐ মেয়েটির বর্ণনাতেই প্রথম শাশুড়ীকুল কর্তৃত্বময়ী হয়েও মায়েরই প্রতিরূপ।

ঐ ভাঙাচোরা পথে আরেকটু এগিয়ে ‘রাগবো প্যালেস’। সেখানেও ৫০ টাকার টিকিট। ঈগলের কাষ্ঠ-মূর্তী বসানো দরজা দেখে কৌতুহল হলেও ঝরঝরে কাদার ‘রাজপ্রাসাদ’-কে আর সময় দেওয়া গেল না। প্রমিলা-পরিচালিত সংগ্রহশালায় অনেকটা সময় গেছে, তলপেটে জলের চাপও প্রবল। কিছুটা ফিরে এবার উল্টোদিকের সিঁড়ি ধরলাম। সিঁড়ির ধাপে ধাপে খাওয়ার দোকান তথাকথিত ‘বালটি কুইজ়িন’-এর। ভেতো বাঙালীসহ বেশকিছু ভারতীয় পর্যটক হাঁসহাঁস করে গিলছে। আমরা সেখানে কিছু দাঁতে কাটলাম না, শুধু বেশ দুর্গম স্থানে হলেও তুলনায় চলনসই শৌচালয় পেয়ে কাজ সেরে নিলাম। জল ত্যাগ করে দেহে বল পেয়ে আমি সিঁড়ি বেয়ে ঐদিকে আরও উঠে গ্রাম দেখতে ইচ্ছুক হলেও এবং কন্যারও আপত্তি না থাকলেও আমার বর ক্লান্ত ক্ষুধার্ত দেহে আর এক পাও এগোতে রাজি হলেন না। আসার পথে ধস নেমে ঘন্টা দুয়েক দেরি হওয়ায় দুটো মিউজ়িয়াম ঘোরার পর দুটো বেজে গেছে।

ওপর থেকে ফিরতি পর্যটকদের জনে জনে জিজ্ঞাসা করেও ওপরে দর্শনীয় কী জানা গেল না। কয়েকজন বাঙালিকে পেয়ে জানলাম, সেখানেও নাকি ‘মিউজ়িয়াম’। গাড়িতে ফেরার পর রিগজ়িন-এর কাছে জানলাম, ওপরে মানে আরও কয়েকশো সিঁড়ি চড়লে নাকি পোলো গ্রাউন্ডও ও কিছু নিসর্গ ছিল। তাই তো! পোলো খেলার উৎপত্তিই তো এই অঞ্চলে। কিন্তু এমন ঘিঞ্জি দুর্গম দুর্গন্ধময় সৌন্দর্যরোহিত পথে এগোতেই ইচ্ছা করছিল না। পোলো ময়দান দেখতে হলে হেলিকপ্টারে আসতে হয়।

যতটুকু দেখলাম, সৌন্দর্যের ছিঁটেফোটা চোখে পড়ল না। মেয়েদের মধ্যে কিছুটা আবাহন থাকলেও পুরুষদের নজর বহিগতদের কাছ থেকে শুধু ব্যাবসা করায়। পাহাড়ের গায়ে বিপজ্জনক ভাঙা সিঁড়ির ফাঁকে একটু চাতাল মতো পেলেই বালটি কুইজ়িন-এর রেস্তোঁরা। উত্তর ভারতীয়, পরিচিত চিনা ও তীব্বতী খাবারই ‘বালটি কুইজ়িন’ বলে হুড়িয়ে বিকোচ্ছে। আমাদের প্রবৃত্তি হল না। নেমে একটা বাগানঘেরা পরিচ্ছন্ন স্নিগ্ধ মনোরম রেস্তোঁরায় খেলাম। নাম কী লিখে রাখা হয়নি, আমাদের প্রবৃত্তি হল না। নেমে একটা বাগানঘেরা পরিচ্ছন্ন স্নিগ্ধ মনোরম রেস্তোঁরায় খেলাম। নাম কী লিখে রাখা হয়নি, নাম কী লিখে রাখা হয়নি, আমাদের তোলা ছবিতে দুটো নাম ধরা পড়ল Selmo ও Stone cave café & restaurant। নেটে সার্চ করেও এগুলোর কোনোটা বা কোনওটাই কিনা নিশ্চিত হতে পারলাম না। তুরতুক থেকে থং পর্যন্ত বেশ কয়েকটা রেস্তোরাঁ আছে, আর কোনওটাতেই সবুজের অভাব নেই।

        পাশেই সেনা চেক পোস্ট। শুকনো ফল কিনলাম সেনার একটি স্টল থেকে। তারপর এগিয়ে গেলাম নিয়ন্ত্রণ রেখা বা line of control (LOC) দেখার জন্য। তার মানে LOC শুধু কাশ্মীরেই নেই, লাদাখেও আছে। LOC বললেই যেন কাশ্মীর। আসলে এখনও লাদাখে আভ্যন্তরীণ গোলমাল সন্ত্রাসী কর্যকলাপ নেই বলে সীমা বিতর্ক খবর শোনা যায় না।

 

নিয়ন্ত্রণ রেখা বা line of control (LOC):


১৯৭১-এর যুদ্ধে শুধু তুরতুক নয়, আরও তিনটি গ্রামও ভারতভুক্ত হয়েছিল -- চালুংখা (Chalunkha), থং (Thang) ও তাকশি (Takshi)। এরই সৌজন্যে তারা ভারত সরকার প্রদত্ত ভর্তুকি, পর্যটন, স্কুল, অঙ্গনবাড়িসহ গ্রামীণ উন্নয়ন -- সব সুবিধাই পায়। নিয়ন্ত্রণরেখা থং গ্রামে।

কাঁটাতারের সামনে দাঁড়িয়ে দুরের পাহাড়ে অস্পষ্ট চেকপোস্ট, বাঙ্কার, ইত্যাদি দেখে অবাক লাগছিল এই ভয়ানক দুর্গম, প্রায় অগম্য স্থানে মানুষ কীভাবে ডিউটি করতে পারে। চারপাশে পাকিস্তান কবলিত পাহাড় চূড়া। যে কোনো মুহূর্তে ওপর থেকে গোলাগুলি আসতে পারে। তাই ছোটছোট বাঙ্কারে ভারতীয় সেনা নজরদারি করছে। এমন বিপদসংকুল জায়গায় সরকার পর্যটকদের যেতে অনুমতি দিচ্ছে কেন? Indo-Pak Border View Point-এ দাঁড়িয়ে দেশাত্মবোধ সঞ্চারিত করতে?

        একজন স্বনিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবী গাইড আমার একটা মন্তব্যের সূত্র ধরে বলল, "বিলকুল। ওসব ভী হমারা থা, হমারা হী হোনা চাহিয়ে।" আমি অনেককিছু বলে যাচ্ছিলাম। আমার বর পিঠে হাত রাখতে ছেলেটার নাম জানতে চাইলাম। হাসিখুশি লোকটির নাম সাদিক।

        ফেরার পথে শুভঙ্কর বলল, “মনটা সিঙ্গল ট্র্যাক করে রেখো না। HALL OF FAME-এ light and sound show চলার সময় আমাদের খাতির করে বসানো, জোর গলায় ‘ভারতমাতা কী জয়’ বলা জওয়ানের নাম ছিল আনোয়ার। তুমি বুকের ব্যাজ খেয়াল কোরো না।” আবাল্যের শিক্ষা, অনুশাসন কতকিছু নির্ধারণ করে! লাদাখ পুরোপুরি সেনা নিয়ন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও লাদাখীদের মনে এতটুকু ক্ষোভ নেই, বরং ভারতের সঙ্গে জুড়ে থাকতেই মরিয়া। চীন অনেক চেষ্টাতেও তাদের খেপিয়ে তুলতে পারেনি।




  পূর্ববর্তী পর্ব : ৪।। নুবরা উপত্যকা                                       পরবর্তী সংখ্যা : ৬।। সুমুর থেকে সিয়াচেন


Post a Comment

Previous Post Next Post