সীমান্ত প্রহরায় লাদাখ ।। ২ ।। পদার্পণ ।।

 

পদার্পণ

২৩শে জুলাই ২০২২



 

২৩শে জুলাই ভোর ৪টে ৩৫-এ কাক ডাকার আগে দিল্লি থেকে লে-র দিকে ওড়া। আকাশে আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে তুষারাচ্ছাদিত হিমালয়ের চূড়াগুলোর দৃশ্য জানলায় চোখ রেখে গিলতে লাগলাম। পাহাড় আমার কাছে প্রথমবার নয়, বরং পাহাড় আমার প্রথম প্রেম। সাড়ে ছটা নাগাদ লে বিমানবন্দর। আশ্চর্য লাগল। অতখানি উচ্চতায় অত সকালেও মোটেই তেমন শীত নেই, গায়ে মামুলি গরম জামা চাপানোর পর বেশ ত্বকসই বাতাস।

পুঁচকি কনভেয়ার বেল্টে মালপত্র উদ্ধারের জন্য দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই দুটো অজানা নম্বর থেকে আমাদের দুজনের কাছে ফোন এল। শুভঙ্করের ডিফেন্স অ্যাকাউন্টস্ ডিপার্টমেন্ট্ (DAD)-এর লাদাখে কর্মরত কর্মীরাই থাকার ব্যবস্থা করেছে। শৈলেন নামের ছেলেটি গাড়ি নিয়ে এসেছে নিজেদের DAD গেস্টহাউসে নিয়ে যাবে বলে। আর ওদিকে ওদের বিভাগেরই আরেক কর্মী বর্তমানে কলকাতায় ফিরে আসা অনুপমের ব্যবস্থাপনায় নবনীল নামে একজন বর্ডার রোডস্‌-এর গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে তাদের স্থানীয় রোড কনস্‌ট্রাকশন কোম্পানি (RCC)-র অতিথিশালায় নিয়ে যাবে বলে। এয়ারপোর্ট থেকে একটু দূরে হলেও একাশি আরসিসি-তেই চললাম। এয়ারপোর্টের একেবারে নিকটবর্তী ডিএডি-র ঘরখানা বুক করে রাখাই রইল লাদাখের অন্যত্র ঘুরে লে-তে ফিরে পুনরায় হোটেল বুকিং-এর পর্ব এড়াতে। ভাড়া তো সামান্যই। তাছাড়া আমার বরের জনপ্রিয়তার এইটুকু দাম তো হাসিমুখেই দেওয়া যায়।

সচরাচর সমতল থেকে একলাফে ১১,৪৮০ ফুট উচ্চতায় উঠে এলে সমতলবাসীর শরীর বিদ্রোহ করে। প্রায় সব ভ্রমণসূচি ও সরকারি নির্দেশিকাতেই অন্তত ২৪ ঘণ্টা বিশ্রামের পরামর্শ দেওয়া আছে। কিন্তু পথেই কালীমাতার মন্দির বা স্পিটুক মনেস্ট্রি, শান্তিস্তূপ ও ‘হল আফ ফেম’ চোখে পড়তে দেখার জন্য হাঁকপাঁক করতে লাগলাম। সিলেবাস এগিয়ে রাখতে অন্তত স্পিটুক মঠখানাও যদি সেরে রাখা যায়। কিন্তু কালী মাতাও বোধহয় acclamatisation-এর পক্ষে ছিলেন, টানলেন না; রোড কনস্ট্রাকশন কোম্পানির অতিথিশালার নির্ধারিত ঘরে ঢুকতে হল। সারাদিন বেরোনো মানা। 

যেখানে যাই গাছে চড়ি। এখানে গাছ পাইনি, তাই দেওয়াল। মেয়েকে বলে নিজের ছ্যাবলামোর ছবি তুলিয়ে রাখলাম। বাপ-বেটীকে বলিনি, আমার মাথা হালকা ঝিমঝিম করছিল। সন্ধে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত যেহেতু দিনের আলো থাকে, তাই বিকেলের দিকে বেরোনোর জন্য দুই ভ্রমনসঙ্গীকে অনেক পটানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু কেউই ‘অ্যাক্ল্যামেটাইজ়েশন আইন’ ভঙ্গ করতে রাজি হল না। গাড়ি না পেলে কোথাও পায়ে হেঁটেও বেরোনোর উপায় নেই এই জনবিরল শহরে। শুধু জনবিরল কেন, প্রায় গাছপালাশূন্য ধূসর-পাঁশুটে কাদারঙা লাদাখের এই রাজধানী। তার ওপর আছে পথ-কুকুর যারা সন্ধ্যার পর Dr Jekyll থেকে Mr Hyde হয়ে যায়।

দুপুরে তিনজনের জন্য ভাত, রুটি ও আন্যান্য পদ মিলিয়ে ছয়জনের মতো খাবার এল। সেনা মেস ও গেস্টহাউসের এটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য। সর্বত্র স্বাদেও আশ্চর্য মিল। বেশিটাই ফেরত পাঠিয়ে রাতের জন্য পরিমাণ বুঝিয়ে দিলাম। আমার তো জব্বর খিদে পেয়েছিল যদিও নাকি এই পরিবেশে খিদে হয় না, বেশি খাওয়াও অনুচিত। 

দুপুরবেলা বাইরে খর রোদ, ঘরেও বেশ গরম। একটা টেবিল ফ্যানও দেওয়া হয়েছে। মধ্যাহ্নভোজের পর শোয়ার সময় শুভঙ্কর অক্সিমিটার বের করে তিনজনেরই রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা পরখ করল। আমার রক্তে অক্সিজেন মাত্র ৬২%। মানে তেমন অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ না থাকলেও উচ্চতা আমায় ভেতর ভেতর স্পর্শ করেছে। এসেই টলমলে মাথা নিয়ে পাঁচিলে চড়া সত্যিই একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। খাড়া প্রাচীর থেকে পড়ে গেলে যাত্রারম্ভেই যাত্রাভঙ্গ হত।

শুভঙ্কর তৎক্ষণাৎ নবনীলকে খবর দিল। অনতিবিলম্বে গাড়ি হাজির। তিনজনে গেলাম সীমা সড়ক সংস্থার Medical Inspection (MI) ছাউনিতে। সেখানে রীডিং ৯২ শতাংশ। আঙুলে নেলপলিশ থাকায় নাকি ভুল রিডিং এসেছিল। যাক স্বস্তি। কিন্তু সুদর্শন তরুণ সেনা চিকিৎসক আমাকে কিছুতেই স্পিটুক মন্দিরের সিঁড়ি ভাঙার অনুমতি দিল না। Diamox জাতীয় ওষুধ ও সহাস্য উপদেশ পেলাম, “Don’t be a Gama in the Land of Lama.”

চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে ছবি তোলার সময় দুটো প্রকাণ্ড স্বাস্থ্যবতী কুকুর এসে শুভঙ্করের গা বেয়ে বুক পর্যন্ত উঠে এল। উর্বী ভয়ে সিঁটিয়ে গেল, তার মাও। কিন্তু ওরা আদর খাবেই! তরুণ ডাক্তার ‘জুলু’ ও ‘নয়না’ বলে ডাক দিতে খুব অনিচ্ছায় নেমে এল। জুলু হল মা, নয়না তার মেয়ে। অমন আহ্লাদী ভাবভঙ্গী দেখে মনেই হল না, সূর্যাস্তের পর একা পথচারী পেলে লাদাখি কুকুররা শুধু কঙ্কালটুকু ফেলে রাখে। এরা অবশ্য সেনা আধিকারিকের পোষ্য, রাস্তার অভুক্ত সারমেয় নয়।

MI থেকে ফেরার পথে আমার পরিচালক ও গাড়ির চালক, দু’জনকে বলেকয়ে অদূরে ‘হল অফ ফেম’ দেখাতে সম্মত করালাম। আমার ভ্রমণসুচি অনুযায়ী শরীর ঠিক থাকলে প্রথম দিনই বিকেল বা সন্ধ্যায় Hall of Fame ও লে মল বা মার্কেট ঘুরে আসার কথা। নতুবা দ্বিতীয় দিনে দ্রষ্টব্য ৭টি স্থানের মধ্যে এটিকেও সংকুলান করতে হবে।

প্রসঙ্গত সেনা আতিথেয়তায় প্রথম দিন গাড়ি পেলেও হোটেল বা বাজার এলাকায় না থাকায় ভাড়া গাড়ি হুট করে পেতাম কিনা সন্দেহ।



হল অফ ফেম (Hall of Fame):

বাংলায় কী বলি — ‘প্রসিদ্ধি গৃহ’? প্রথমে সেখানেই গেলাম। সামনে কতগুলো কামান সাজানো। প্রশস্ত জাতীয় সড়ক দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে গাড়ির ছোটাছুটি দেখে কে বলবে পার্বত্য শহর? ৩০০ টাকার টিকিট। শুভঙ্করবাবু টিকিট কাটতে যাচ্ছিলেন। গাড়ির ড্রাইভার বাধা দিয়ে প্রবেশদ্বারে ‘স্যরজী’কে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের পরিচয়পত্র দেখাতে বলল। বেশ খাতির করে ভেতরে ডাকা হল আমাদের।

এটি আসলে ভারতের এই সীমান্তবর্তী প্রদেশের ভূগোল, ইতিহাস, সংস্কৃতির পাশাপাশি সিয়াচেন, অক্সাই চিন থেকে কার্গিল দ্রাস পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ অভিযানের ছবি ও স্মারকের সংগ্রহশালা। একজন সেনাকর্মীর টেবিলে রাখা মডেল দেখিয়ে যুদ্ধ-বিবরণ শুনে বুঝলাম, সৈন্যদের শুধু যুদ্ধকুশল নয়, যথেষ্ট বাকপটুও হতে হয়।

নানা ছবি ও বিবরণ দেওয়ালে টাঙানো। লাদাখিদের মধ্যে একদা ‘polyandry’ বা নারীর ক্ষেত্রবিশেষে বহুবিবাহ বহুলপ্রচলিত ছিল। তবে সবই দ্রৌপদীর দশা। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রী বাকি ভাইদেরও ডি-ফ্যাক্টো বৌ। তাই বলে সমাজ মাতৃতান্ত্রিক তো নয়ই, এমনকি উত্তর-পূর্ব ভারতের মতো মাতৃবংশানুক্রমিকও নয়; পৈতৃক সম্পত্তি যাতে অবিভক্ত থাকে, তারই নিশ্ছিদ্র আয়োজন। অধুনা এই প্রথা অপ্রচলিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন রাজবংশের ইতিহাস দেখলে লাদাখ ও তিব্বতকে ভিন্ন করে দেখা কঠিন, যেমন দুরূহ তিব্বতকে চিনের অংশ সাব্যস্ত করা।

৮টা থেকে একটি শব্দ-আলো প্রদর্শনী আছে। মাঝে বেশকিছুটা সময় আছে দেখে সেই সুযোগে আমার দ্বিতীয় বায়নাটা মঞ্জুর করিয়ে নিলাম। চললাম ‘শান্তিস্তূপ’ দেখতে। 

শান্তিস্তূপ:

একটি অনুচ্চ শিখরে ভীষণ সুন্দর ও ঝকঝকে বৌদ্ধ মঠ। মাথাপিছু ৩০ টাকার টিকিট। স্নিগ্ধ পরিবেশ, অজানা ভাষার গান, চিত্রিত ধপধপে সাদা দেওয়াল আর বিকেলের মিঠে রোদ – সবমিলিয়ে একরাশ ভালোলাগায় মনে হল, ‘শান্তিস্তূপ’ নামকরণ একেবারে সার্থক। পাহাড়চূড়ায় এই মন্দির থেকে ধাপে-ধাপে নীচের শহরটা অপরূপ দেখাচ্ছে।

গানের ভাষা সুর, মন্ত্রলেখা পতাকা, দেওয়াল ও পতাকার লিপি, মন্দিরের ভেতরকার সাজসজ্জা হুবহু ভুটানে যেমন দেখেছিলাম তেমন। তবে ভুটানের মনেস্ট্রি বা ‘জ়োংখা’গুলোর সিঁড়িকে কাঠের খাড়া মই বলাই সঙ্গত, আর এখানে সাধারণ সিমেন্ট বা সিঁড়ি। কিন্তু বাদবাকি অলংকরণ, মন্ত্রলিখিত পাতাকা ইত্যাদি হিমালয়ের পূর্ব ও পশ্চিম যেন অবিকল এক। সম্ভবত বৌদ্ধধর্মের তিব্বতী সংস্করণের প্রভাব ভারতের উত্তরে প্রায় দু’হাজার মাইল দীর্ঘ ভূখণ্ডকে একসূত্রে বেঁধে রেখেছে। ভুটানে একটা ক্যাপশন আকছার দেখতাম: “Free Tibet”। মহাচিনের অংশ নয়, তিব্বতকে স্বাধীন রাষ্ট্র রূপে দেখতে চায় পাহাড়ি বৌদ্ধরা।





শব্দালোক প্রদর্শনী:

লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো দেখব বলে ৭টা ৪০ নাগাদ আবার ফিরে এলাম হল অফ ফেম-এ। পাশেই একটি সুসজ্জিত রেস্তোঁরায় চা খেয়ে ভেতরে ঢুকলাম। ভালোই দর্শক হয়েছে। এবার কিন্তু বিরস মুখে আই কার্ড খুঁটিয়ে দেখা হল।

খোলা আকাশের নীচে ধাপেধাপে নেমে যাওয়া আ্যাম্পিথিয়েটারের মতো চত্বরে তিনটে সিমেন্টের নাতি উচ্চ দেওয়ালকে পর্দার মতো ব্যবহার করে একটি তথ্যচিত্র দেখানো হল। ভারতীয় সেনার যুদ্ধাভিযানের কাহিনী।  অনেক অজানা ঘটনা শুনলাম যা এখন সব মনে না থাকলেও তখন গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল, চোখও আর্দ্র হয়ে আসছিল। কার্গিল যুদ্ধ বর্ণনাকালে ক্যাপ্টেন কালিয়ার নামটা শোনার জন্য উৎকর্ণ থাকলেও শোনা গেল না। হয়তো বীরত্বের সাক্ষ্য রাখার আগেই বেঘোরে প্রাণ গেছে বলে নানা স্তরের বীরচক্র প্রাপকদের আলোচনায় ঐ ছ’জন হতভাগ্যের উল্লেখ নেই। অসামান্য চলচ্চিত্র ও শব্দের মায়ায় আবিষ্ট হয়ে দেশাত্মবোধে বেশ গদগদ লাগছিল।

 

সুর্য ডুবে গেলেও ঠাণ্ডা নেই। এমনকি বাতাস বইলেও হিলহিলে কাঁপন নেই। কিছুতেই নিজের পূর্ববর্তী পার্বত্য অভিজ্ঞতাগুলোর সঙ্গে মেলাতে পারছিলাম না। সাড়ে এগারো হাজার ফুট উঁচু হিমালয়ের কোলেও দুপুরের ঝাঁঝাঁ রোদের তাতে ঘরে পাখা আর সন্ধ্যায় দমকা বাতাসেও স্নিগ্ধতা!

গেস্টহাউসে ফিরে আমার বরের কানে কানে বললাম, “ড্রাইভারকে কিছু দেবে না?”

চোখের ইশারায় চুপ করিয়ে গাড়ি চলে যেতে শুভঙ্কর উত্তর দিল, “হি ইজ় অ্যান অফিসার। গাড়িটা ওর জন্যই। তুমি অসুস্থ শুনে এসেছিল। তারপর তোমার বায়নাক্কায় ফেঁসে নিজের ডিউটি আওয়ারের পরেও আমাদের সঙ্গে হাসিমুখে ঘুরল।”

 সিনিয়ার অ্যাকাউন্টস্‌ অফিসার এমন কিছু উচ্চপদ নয়। লাদাখের মাটিতে পা রেখে সকাল থেকে যে উষ্ণতা ও সম্মান পাচ্ছি, তা শুভঙ্কর চ্যাটার্জীর বহু বছর ধরে অর্জিত সুনাম, বন্ধুবৃত্তের ভালোবাসা, জুনিয়ার সহকর্মীদের শ্রদ্ধার মিশ্রিত ফল। হয়তো সঙ্গে আরও কিছু এক্স ফ্যাক্টরও থেকে থাকবে।   

যাইহোক, আঙুলে খোবলানো নেলপলিশকে ধন্যবাদ। তারই সৌজন্যে অক্সিজেন মাত্রা বিপদসীমা অতিক্রান্ত মনে হয়েছিল বলে ডাক্তার দেখানোর ছলে দুটো দ্রষ্টব্য সেরে ফেলা গেল, এবং সেটাও অনেকখানি ভালোলাগা সঙ্গী করে।

 মধ্যরাতে নৈশভোজ পেটে বিদ্রোহ শুরু করল। প্রবল বমিভাব ও পেটে মোচড়, যদিও কোনওটাই হতে চাইছে না। এই অবস্থায় কে দেখবে? মেয়ে ও বাপও তো সমতল থেকে হঠাৎ স্বর্গে এসে তেমন স্বস্তিতে নেই। সকালে বেরোতে পারব তো? অভিযোজন আইন অমান্য করে ঐ জলবায়ুতেও আমার কেন খিদে পেয়েছিল? দুটো পুঁচকে হাতে গড়া রুটির সঙ্গে এক চামচ ভাত খেয়ে গুরুভোজনের গুরুতর অভিযোগে বিস্তর বকুনিও খেলাম। ২৪ তারিখে কাছেপিঠে ঘোরা, কিন্তু তার পরের দিন ২৫শে জুলাই সাতসকালে নুবরা উপত্যকার দিকে লম্বা যাত্রা আছে। 

পূর্ববর্তী পর্ব : ১।। যাত্রা                                                              পরবর্তী পর্ব : ৩।। লে সার্কিট-১



Post a Comment

Previous Post Next Post