দীপার বকেয়া পদক
ভারতীয় তাও আবার বাঙালী মেয়ের কাছে
ব্যাপারটা অভাবনীয় মনে হয়েছিল পশ্চিম দুনিয়ার। দুস্থ ভারতীয় জিমন্যাসটিকে একদা
বাঙালীর একটা জায়গা ছিল, সেটা তো আন্তর্জাতিক মহলের জানার কথা নয়। ওদিকে
জিমন্যাসটিকে রাশিয়ার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য, বলা যায় অলিম্পিকে জায়গীরদারি
প্রতিষ্ঠিত। রাশিয়ার প্রতিযোগী মারিয়া পাসেকার তুলনায় সাদামাটা ও নড়বড়ে ভল্টকে
আশ্চর্যজনকভাবে বেশি নম্বর দিয়ে এগিয়ে না দিলে দীপার অন্তত রজত পদক জয় নিশ্চিত
ছিল। কিন্তু মাত্র .১৫ নম্বরের জন্য ব্রোঞ্জ পদকটিও হাতছাড়া হল।
হট ফেভারিট সিমোন বাইলস তো মঞ্চে
অবতরণের আগেই জিতে বসেছিলেন। সিমোন নিজের কাজটা ঠিকঠাকই করেছিলেন। তবু ২০১৮-র বিশ্ব
চাম্পিয়শিপে সিমোন বাইলস দুরূহতার তুল্যমূল্য নিদর্শন রাখার আগে পর্যন্ত
প্রোদুনোভা ভল্টই (Produnova vault) ছিল সর্বাধিক ডি-স্কোর ৬.৪ পাওয়া একমাত্র
কঠিনতম ভল্ট বলে স্বীকৃত ছিল, যেটা দীপা অবিশ্বাস্য সাহস দেখিয়ে দু বারই দেন, এবং
শূন্যে ডাবল সামার সল্ট দেওয়ার পর যতখানি নিখুঁত ল্যান্ডিং সম্ভব, ততটাই নিখুঁত
পদক্ষেপে অর্ধ-উবু বা স্কোয়াট অবস্থায় থিতু হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন।
ভারতের জিমন্যাসটিকে ঐতিহ্য নেই, এই
ধারণা তাড়িত না হয়ে বিচারকমণ্ডলী স্বতঃস্ফূর্ত স্কোরিং করলে দীপার নম্বর সিমোনের
প্রাপ্ত স্কোরকেও ছাড়িয়ে গেলে আশ্চর্য ছিল না। জিমন্যাসটিক সম্রাজ্ঞীকে
শিরোধার্য রেখেও যদি রাশিয়ার ঘরানার ভার অলিম্পিকের মাথায় চেপে না থাকত, তাহলে
ভারতীয় মেয়েটির দ্বিতীয় হওয়া আটকাত না। সুইজারল্যান্ডের প্রতিযোগী গিউলিয়া
স্টেনব্রুগার তৃতীয় স্থানে যথাযথ মনে হলেও রাশিয়ার পাসেকার চতুর্থ স্থানে নেমে
যাওয়ার কথা ছিল, যদি বংশকৌলিন্যের চেয়ে প্রদর্শনের মান একমাত্র বিচার্য হত।
দৌড়, লং জাম্প, হাই জাম্পের মতো
জিমন্যাসটিকের নির্দিষ্ট মাপ হয় না। এর স্কোর কিছুটা বিচারকদের পছন্দ দ্বারাও
প্রভাবিত হয়। তবে টেকনিক্যাল বিষয়ে অভিজ্ঞ না হলেও দর্শকদেরও একটা বিচার ক্ষমতা
থাকে। সেই দৃষ্টি পুরোপুরি নিরপেক্ষ রেখেই কথাগুলো বলা।
প্রসঙ্গত সিমোন বাইলস ২০১৮-র বিশ্ব
চ্যাম্পিয়নশিপে কঠিন চেং ভল্টেই বাড়তি একটি অর্ধ্বমোচড় বা হাফ টুইস্ট বাড়িয়ে
কাঠিন্যের নতুন রেকর্ড গড়েন ঠিকই এবং সিমোনের সম্মানে তার নামকরণও হয় 'বাইলস-1
ভল্ট', কিন্তু সেটা International Gymnastics Federation (FIG) এর দুরূহতার
মাত্রায় প্রোদুনোভা ভল্টেরই সমতুল্য (D-6.4) ছিল। পরে ২০২১-এ বাইলস দুরূহতার
নতুনতর রেকর্ড গড়েন যার নাম 'ইয়ারচেনকো ডাবল পাইক ভল্ট' (Yurchenko double pike
vault) যাকে সিমোনেরই নামে বলা হচ্ছে 'বাইলস-2 ভল্ট' যার দুরূহতার মাত্রা
International Gymnastics Federation (FIG) নির্ধারণ করে ৬.৬ পয়েন্ট। তবে
সংস্থাভেদে এর ডি-স্কোর ৬.৪ অর্থাৎ প্রোদুনোভা বা "দীপা ভল্ট"-এরই
তুল্য। এই ডি-স্কোর নিয়ে ভিন্নতা থাকলেও আগামী বিশ্ব চাম্পিয়নশিপে বাইলস-২
ভল্টখানাই কঠিনতম ভল্ট বলে বিবেচিত হতে চলেছে। গত বিশ্ব চাম্পিয়নশিপে ডিফিকাল্টি
লেভেল ৫.৬-এর বেশি ওঠেনি। অবশ্যই শুধু কাঠিন্যমাত্রাই জিমন্যাসটিকে সর্বোচ্চ
বিচার্য নয়, উপস্থাপনের পারিপাট্য ও খুঁতহীনতা সমান গুরুত্বপূর্ণ। আছে সৌন্দর্যের
আবেদনও।
যাইহোক, ২০১৬-তেই দীপার বয়স ছিল ২৩
বছর। মেয়েদের জিমন্যাসটিকের পক্ষে একটু ওপর দিকেই। মেয়েদের টেনিসে যেমন ক্রিস
এভার্টদের শৌখিন শৈলী ক্রমশ শক্তিশালী মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা, স্টেফি গ্রাফদের
দাপটে হারিয়ে যেতে যেতে শেষে দুই উইলিয়ামস ভগিনীর দমাদমে একেবারে 'বাপি বাড়ি
যা' হয়ে গেছে, তেমনি এই শতাব্দীতে মেয়েদের জিমন্যাসটিক আইকন আর 'মোমের পুতুল'
নাদিয়া কোমানিচিরা নন। নমনীয়তা পেলবতার জায়গা নিয়েছে পেশিশক্তি, সিমোন বাইলস
যার শীর্ষ প্রতিনিধি। পেশিবহুল গড়নগঠনের দীপাও এই ঘরানার। আর নতুনতর শৈলীতে দেখা
যাচ্ছে, একেবারে ফুলকচি ননীর পুতুলগুলোর পাশাপাশি মধ্য বিশের সবল তরুণীরাও স্থান
করে নিচ্ছে, কখনও বা এগিয়েও থাকছে। তাই হয়তো দীপা কর্মকারের ক্রীড়া কেরিয়ার
গ্রাফ ২০১৬-তেই নিম্নমুখী ধরে নেওয়ার পরিস্থিতি আসেনি। তবে উর্ধ্বমুখী হবে সেটাও
বোধহয় আশা করা যায়নি। কিছুটা আনুভূমিক নতি নিয়ে কিছুদিন এগোবে, এটাই ভেবেছিলাম।
কিন্তু তারপর বারবার চোটের খবর শুনে
ভাবলাম সেই আশাও আর নেই। বাস্তবিক ২০২১-এর টোকিও অলিম্পিকে চোট আঘাতের জেরেই
যাওয়া হল না। তারপর এল গুরুতর অভিযোগ। ডোপ পরীক্ষায় ধনাত্মক। আমার মনে হয়, মানে
নিজে নানা উপসর্গ দমাতে নানা ওষুধ সেবন করতে বাধ্য হই বলে অনুমান করছি, চোটের
কারণে যন্ত্রণা নিরাময়ের জন্য খেলার জগতে নিষিদ্ধ এমন কোনও স্টেরয়েড নিয়ে
থাকবেন, যেটা সেই সময় দেওয়া দেহনিঃসৃত নমুনায় পাওয়া যায়। Higenamine - S3 Beta-2
Agonists ড্রাগটি নিয়ে অনুসন্ধান করে দেখলাম আমার অনুমান কাছাকাছি, কিন্তু
সম্পূর্ণ ঠিক নয়। এটা শ্বাসনালী ও ফুসফুসের সংক্রমণ (COPD) তথা হাঁপানি
(Bronchial Asthma) র চিকিৎসায় কাজে লাগে। জানি না, দীপার তেমন অসুখ হয়েছিল
কিনা। তবে একবার এক ক্রীড়াবিদ এফিড্রিন নেওয়ার কারণে নিষিদ্ধ হওয়ায় বেশ অবাক
হয়েছিলাম, কারণ ও বস্তু ভয়ানক সর্দিকাশির জন্য আমাকেই দেওয়া হয়েছিল কয়েকবার। যে
ওষুধ খেলে ঘুম পায়, সেটা কী করে খেলায় সক্রিয়তা বা শক্তি বাড়াতে পারে ভেবে
আশ্চর্য লেগেছিল।
যাইহোক, ঐ খটমট নামের ঔষধ সেবনের
অপরাধে ২১ মাসের জন্য নির্বাসন হল ভারতের প্রথম জিমন্যাসটিক বিশ্বতারকার। ধরেই
নিলাম দীপা কর্মকারের ক্রীড়াজীবনের দীপ নিভে গেল।
তারপর হঠাৎই এই সুখবর। ১৩.৫৬৬ পয়েন্ট
পেয়ে দীপা কর্মকার এশিয়াজয়ী চাম্পিয়ন। প্রোদুনোভা হয়তো দেননি, কিন্তু ফিরে
আসা কাকে বলে দেখিয়ে দিয়েছেন। চরম হতাশায় ডুবে যাওয়ার মতো পরিস্থিতির মোকাবিলা
করে একজন লড়াকু জেদি প্রতিভাময়ীর প্রত্যাবর্তন শুধু যে অত্যন্ত আনন্দের তাই নয়,
অনেকের কাছেই বিশাল অনুপ্রেরণা, যারা নিজেরা চক্রব্যূহ থেকে বেরোতে না পারলেও
কাউকে বিজয়ী হতে দেখে তলিয়ে যাওয়ার বদলে আশায় বুক বাঁধতে পারে।
ছোটোবেলায় খুব ডানপিটে আর গেছো ধরনের
ছিলাম। কিন্তু উপযুক্ত সুযোগ ছিল না। সামান্য সাইকেল কী নাচ শেখারও অনুমতি মেলেনি।
আর নিজের কন্যার পায়ে মাথা খুঁড়ে ক্রমাগত লেগে থেকেও কোনোটাই শেখাতে বা শুরু
করালেও নিয়োজিত রাখতে পারিনি। নাচ, ব্যাডমিন্টন, সাঁতার, গান -- যখন যেটাতে ইচ্ছা
প্রকাশ বা হ্যাঁ করেছে, আমি ছুটেছি। ধেড়ে বয়সে ধরেবেঁধে সাইকেলে শুধুমাত্র
ব্যালেন্স আনতে পেরেছি, কিন্তু চালানোর উৎসাহ বা সাহস সঞ্চার করতে ব্যর্থ। রীতিমত
হুমকি দিয়ে গাড়ি চালানোর স্কুলেও দিলাম। লাইসেন্সটুকুই হল, রাস্তায় বেরোনোর
প্রশ্নই নেই।
সেই কোন টীন এজ থেকে কল্পনায় স্টেফি গ্রাফের মতো মেয়ে চেয়েছি। চোখে ছিল
ক্রিস্টিন ওটো ও জিমনাস্টরাও। এখনও প্রিয় ফ্যান্টাসি কম্পিউটারমুখো মেয়ে আমার
বুলেট নিয়ে.... যাক সে কথা। দীপার সাফল্যে তাই আমার একপ্রকার পরোক্ষ কল্পসুখ।
দারুণ পরিতৃপ্তি।
প্রতিবেদনটা দীপা কেন্দ্রিক হয়ে গেল। ‘খেলা’
পত্রিকার জুলাই ২০২৪ সংখ্যাতেও প্রকাশ পেয়েছে। এখানে আরেকটু সংযোজন করে বলি
— ২০২৩-২৪ এই দুই বছর আন্তর্জাতিক ক্রীড়াক্ষেত্রে
ভারতীয় মেয়েদের সাফল্য ভারতীয় পুরুষদের চেয়ে সবমিলিয়ে বেশিই। কিছু ফেসবুক পোস্ট
ছাড়া সে তুলনায় উচ্ছ্বাস কিছুই নয়। এখানে বিশদে যাব না।
© শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
৩০/০৫/২৪