৩
লে সার্কিট-১
২৪শে জুলাই ২০২২
সকালে দেখলাম সামলে উঠেছি। লে সার্কিট-১-এর স্থানীয় কিছু দ্রষ্টব্য দেখার কথা। এখন ২৫ থেকে ৩১শে জুলাই পর্যন্ত একটা ৬ আসনের মাহিন্দ্রা বায়না করা আছে। কিন্তু ২৪ তারিখে কোনও গাড়ি বলা নেই। শুভঙ্কর ভাড়া গাড়ির খোঁজ করছিল। লে থেকে প্রায় ১০৬ কিলোমিটার দূরে দুরবুকে বসে আছে শুভঙ্করের আরেক অনুরাগী বিভাগীয় সহকর্মী অ্যাকাউন্টস্ অফিসার মানবেন্দ্র মণ্ডল ওরফে মানু। জানতে পেরে নিজের অফিস থেকে বর্ডার রোডসের একটা গাড়ি পাঠিয়ে দিল। দুর্গম পোস্টিং-এর একটা সুবিধা আছে; গণপরিবহণের অভাবে ‘পেশ-এ-খিদমত’ গাড়িটাড়ি পাওয়া যায়। বেশি চুলবুল লম্ফঝম্ফ করব না সঙ্কল্প নিয়ে জলখাবার সেরে ল্যাদ খেতে ইচ্ছুক বর ও মেয়েকে ধরেবেঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তার ধারে এখানে-সেখানে অনেকটা তুলসী মঞ্চের মতো আকৃতি দেখলাম। পরে জেনেছি ওগুলো কোনও মৃত ব্যক্তির স্মৃতিতে রচিত স্তূপ।
স্পিটুক মনেস্ট্রি বা কালীমাতা মন্দির:
বাঙালী পর্যটন সংস্থার লিফলেটে ‘স্পিটুক মনেস্ট্রি’ লেখা থাকলেও স্থানীয়দের ভাষায় ‘কালীমাতা মন্দির’। ওদের ডিপার্টমেন্টের অনুপম গুহরায় অনেকবার নাম করেছে। অত্যন্ত কালীভক্ত ছেলে। হিমালয়ে বহু দেবতার তীর্থস্থানই তার একাধিকবার ঘোরা। লাদাখে থাকতে পুরো রাজ্যটা চষেছে ও এখনও চষে চলেছে নিজের বুলেট মোটরবাইকে। কলকাতায় আমাদের প্রধান গাইড তথা উপদেষ্টা সেই। কোথায় কী পারমিট লাগবে, আমার বর শুধু টাকা দিয়ে খালাস। পথেপ্রান্তরে গাইডের কথা অমান্য করতে আছে? তাই প্রথমেই কালীদর্শন।
পাহাড়ের গা বেয়ে কিছুদূর গাড়ি গেল। তারপর প্রায় ১৪০
ধাপ সিঁড়ি ভেঙে টঙে উঠে দেখি, বুদ্ধ মন্দিরই প্রধান, পাশে কালীমাতার কক্ষ। আমাদের হিন্দু
মাকালীর বৌদ্ধ সংস্করণ, তবে দেবী এখানে জগজ্জননী আদ্যাশক্তি নন, অনেকটা তথাগতর পার্শ্বচরীর
ভূমিকায় অধিষ্ঠিতা। পুজো দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। তবে শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশ আছে। প্রণামী
বাক্সে টাকা দিয়ে মনে মনে প্রার্থনা করলাম, “এত মানুষের বিশ্বাস তুমি। জগতের মঙ্গল
করো। নিজে প্রসন্ন হও। প্রসীদ জগন্মাতা।”
ভুটানে থাকতে অনেক বৌদ্ধ মঠ দেখেছি যার মধ্যে
পুনাখার মঠের চুড়া স্বর্ণাচ্ছাদিত। সেখানকার বাড়িঘর দোকানেও মাঙ্গলিক কারুকার্য। কিন্তু
লাদাখের মতো সেগুলোতে তারা বা কালীমাতার অধিষ্ঠান দেখিনি।
ত্রিসীমানায় গাছপালা কেন ঘাস পর্যন্ত চোখে পড়ল না। কী রুক্ষ ন্যাড়া পাহাড়! নীচে বইছে সিন্ধু নদ, সেও ঘোলাটে। সবই মাটি-পাথর রঙা – আশ্চর্যরকম মোনোক্রোমাটিক। সকালের নরম রোদে ওপর থেকে দেখতে তবু কী যে ভালো লাগছিল। মেয়েটা কিছুদূর উঠে এক জায়গায় বসে রইল, ওপর পর্যন্ত এসে দেখল না কিছুতেই।
হাওয়া
মোড়:
পর্যটক আকর্ষণের জন্য এমন নামকরণ। পাহাড়ি পথের বাঁকে বাঁকে এমন অনেক হাওয়া মোড়ের সাক্ষাৎ মিলবে। স্পিটুক থেকে অবতরণ করার পর বড়ো রাস্তায় ওঠার ঠিক কোন বাঁকটিকে ‘হাওয়া মোড়’ বলা হল বুঝলাম না, তবে বাতাসের দমক আছে।
বড়
রাস্তায় পাথর কেটে কাজ হচ্ছিল। চালকের কাছে জানলাম, এগুলোই মুলতানি মাটি। অমনি জেদ
ধরলাম, আমার চাই। কারও মত নেই দেখে নিজেই রাস্তা পেরিয়ে কয়েক টুকরো পাথর কুড়িয়ে আনতে
চাইলাম। জাতীয় সড়কে দুরন্ত গতিতে ছুটন্ত যান। বাপ-বেটী আঁতকে উঠল। ড্রাইভার অগত্যা
নিজেই রাস্তা পেরিয়ে একটা গাঁইতি তুলে নিয়ে খানিকটা পাথর কেটে এনে দিল। আমি তার বৌয়ের
জন্যও নিতে কিছুটা নিতে বলায় “ও কেয়া করেগী” বলে উদ্বৃত্ত পাথর রাস্তার ধারে ফেলে দিল।
সেই পাথর ভেঙে মুলতানি মাটি অবশ্য আমারও ব্যবহার করা
হয়নি। শুধু উৎস থেকে সংগ্রহের আনন্দে কেজি দুয়েক অতিরিক্ত বোঝা বয়ে এনেছি।
বড়
রাস্তায় পাথর কেটে কাজ হচ্ছিল। চালকের কাছে জানলাম, এগুলোই মুলতানি মাটি। অমনি জেদ
ধরলাম, আমার চাই। কারও মত নেই দেখে নিজেই রাস্তা পেরিয়ে কয়েক টুকরো পাথর কুড়িয়ে আনতে
চাইলাম। জাতীয় সড়কে দুরন্ত গতিতে ছুটন্ত যান। বাপ-বেটী আঁতকে উঠল। ড্রাইভার অগত্যা
নিজেই রাস্তা পেরিয়ে একটা গাঁইতি তুলে নিয়ে খানিকটা পাথর কেটে এনে দিল। আমি তার বৌয়ের
জন্যও নিতে কিছুটা নিতে বলায় “ও কেয়া করেগী” বলে উদ্বৃত্ত পাথর রাস্তার ধারে ফেলে দিল।
সেই পাথর ভেঙে মুলতানি মাটি অবশ্য আমারও ব্যবহার করা হয়নি। শুধু উৎস থেকে সংগ্রহের আনন্দে কেজি দুয়েক অতিরিক্ত বোঝা বয়ে এনেছি।
পাত্থর সাহিব গুরুদ্বার:
যাচ্ছি সিন্ধু ও জ়াঁস্কর নদের সঙ্গমের দিকে। সেই পথেই প্রথমে পড়ে ‘পাত্থর সাহিব গুরুদোয়ারা’। থেমে দেখলাম কিছুক্ষণ। ন্যাড়া তৃণশূন্য জায়গায় একটু প্রাণের ছোঁয়া। টানা লাল দড়ি বিছোনো লম্বা করিডোর পেরিয়ে বড় হলঘরে গালিচায় বসে গ্রন্থীর পাঠ শুনলাম কিছুক্ষণ। দুপুর ১২টা থেকে লঙ্গর। অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির যারা দেখেছে, তাদের কাছে এই মন্দির এমন কিছু না, কিন্তু সেনা নিয়ন্ত্রণে বেশ টিপটপ সাজানো গোছানো। ছবিটবি তুলে হালুয়া প্রসাদ হাত পেতে নিয়ে ফের গাড়ি করে নদী-সঙ্গম অভিমুখে চললাম। অবশ্য তার আগে যাব ম্যাগনেটিক হিল।
চুম্বক পাহাড় বা ম্যাগনেটিক হিল:
খুব কৌতুহল নিয়ে চলেছি। হাইওয়ের ওপরেই এক জায়গায় আশেপাশে
বেশকিছু টায়ার সাজানো। বাইকিং রাইডিং কিছু একটা করা যায় বোঝা গেল। কিন্তু রোদ চড়তে
শুরু করেছে, আমি নড়বড়ে, আমার বর বুড়ো, আর আমার মেয়ে ঠানদি। কারও সে-সবে উৎসাহ নেই।
শুনলাম ঐ জায়গাটাই নাকি ম্যাগনেটিক হিল। কিন্তু পাহাড় কোথায়? এ তো প্রশস্ত রাজপথ।
গাড়ি আগুপিছু করে আমাদের চালক বলল, ‘স্টার্ট বন্ধ করনে
পর ভী গাড়ী যা রহী হয়। ম্যাগনেটিক অ্যাকশন।” বললাম, “পর ইস তরফ তো ঢলান হেয়। চক্কা
তো ইঁউহী পিসলেগী।” সে হেসে বলল, “আপ স্টিয়ারিং মে বয়েঠকে দেখিয়ে ম্যাডাম।”
ছেলেটা ঝাঙখণ্ডের, তাই ‘দেখিয়ে’ বলল; উত্তর-পশ্চিম ভারতের
মানুষ ‘আপ’-এর সঙ্গে দিব্যি ‘দেখো’ চালিয়ে দেয়।
সঙ্গম:
একই পথে সিন্ধু নদ ও জ়াঁস্কর (Zanskar) নদ বা নদীর
মিলনস্থল। সেই সময় দ্বিতীয় নদীর নাম কী প্রশ্নও জাগেনি মনে। সঙ্গম থেকে নিমু পর্যন্ত
রিভার র্যাফটিং করে ফিরে আসা যায়, মন সেই দিকেই। গায়ে ফোস্কা পড়া রোদ।
নদীর ধারে টিকিট কাউন্টারে পৌঁছোনোর আগেই পাহাড়ি গয়না
ও অন্যান্য জিনিসের ছোটখাটো পসার। দেখেশুনে একটা হার ও কিছু ফল কিনলাম। নৌকোয় চড়তে
গেলে নিজেদের গাড়ি ছেড়ে র্যাফটিং সংস্থার গাড়ি করে কিছুদূর যেতে হবে। অত্যন্ত চড়া
রোদ বলে দোনোমোনো করে ম্যাচিং দুলের সন্ধান করছিলাম। কিন্তু আমাকে পসারচ্যুত করতে চাটুজ্জে
মশাই ঝট করে টিকিট কেটে ফেললেন। ২৭০০ টাকা তিনজনের। আমরা উঠলাম র্যাফটিং কোম্পানির
জিপে, তার পেছন পেছন আমাদের অনুসরণ করে এল আমাদের সেদিনের গাড়ি।
আমাদের ভেলায় একজোড়া অল্পবয়সী কপোত-কপোতীও উঠল। দুই
পক্ষই নৌ-চালককে আতিরিক্ত ১০০০ টাকা দিয়ে ছবি ও ভিডিও তোলাতে সম্মত হলাম। ভাগে পড়বে
৫০০ টাকা করে।
এমন কর্দমাক্ত জল জীবনে দেখিনি। সিন্ধু ও জ়াঁস্কর পাল্লা দিয়ে কাদাময় হলেও রঙের তফাত চোখে পড়ছিল। তুখোড় রোদে ঝলসাতে ঝলসাতে পৃথিবীর উচ্চতম নদী র্যাফটিং-এর অভিজ্ঞতাকে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’র মতো লাগছিল। হিমালয়ের কোলে সুউচ্চ পর্বতপ্রদেশে শীতের পরিবর্তে এমন ঝলসানো গরম, আর স্বচ্ছতোয়া নদীর বদলে কাদার প্রবাহ – বিস্মিতর পাশাপাশি হতাশও করছিল। সদ্য হিমবাহের চাপে কাছাকাছি কোনও ধস নেমেছে কিনা, সারা বছরই জল মাটিগোলা কিনা, কেউ বলতে পারল না। ঠাণ্ডায় হাড় কাঁপলে বুঝতাম; কিন্তু আসানসোলের মতো নাক জ্বালানো, গা পোড়ানো, মাথা ঘোরানো রোদে অসুস্থ হতে হবে কে জানত? তপ্ত তট ছেড়ে গাড়িতে উঠে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
লঙ্গর:
এবার ফেরার পথ ধরে আমাদের ৮১ আরসিসি-র অতিথিগৃহ ছাড়িয়ে
যাব উল্টোদিকে। দুপুরে গেস্টহাউসে খাব কিনা জানতে ফোন এল। আমরা ‘হ্যাঁ’ বলেও খেয়াল
হল ১২টা বাজতে মিনিট পনেরো বাকি। রাস্তায় পাত্থর সাহিবে লঙ্গরের সময় হয়েছে। কোনোদিন
লঙ্গরখানায় খাইনি। মণিকরণের গুরুদ্বারে ভিড়ভাট্টায় দেখেও ঠিক তৃপ্তি হয়নি। কিন্তু এটা
যথেষ্ট পরিচ্ছন্নই লাগল। যখন গিয়ে পৌঁছোলাম তখন লঙ্গরের জন্য মানুষের সারি শুরু হয়ে
গেছে। শুভঙ্কর গেস্টহাউসে ফোন করে জানিয়ে দিল দুপুরে বাইরে খাচ্ছি।
বেশ মজার অভিজ্ঞতা। চাকা লাগানো পাত্র নিয়ে ঘুরে ঘুরে
পরিবেশন চলছে। লিভার টেনে জলদানের কায়দাটি তো দারুণ অভিনব। ডাল তরকারি যা পাতে দিচ্ছে
সবই ‘ওয়াহে গুরু’র নাম করে ঘোষণা করে। গ্লাভস পরা হাতে রুটি দিতে দিতে কী যেন ‘দাদা’
না ‘সাদা’ বলে যাচ্ছে এক করসেবক। আমি রুটি খেতে ইচ্ছুক নই শুনেও নড়বে না। বাধ্য হয়ে
দক্ষিণহস্ত প্রসারিত করলাম। রুটি দেয় না। আমাদের অভিভাবক বললেন, “দুই হাত পাতো, এটা
প্রসাদ।” নাস্তিক শিরোমণির ইঙ্গিতে বুঝতে পারলাম ছেলেটা বলছে, “প্রসাদা ওয়াহে গুরুজী।”
১০০ টাকা দক্ষিণা দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
আমাদের ড্রাইভারকে আবার ৫০ বিআরটিএফ ফিরে যেতে হবে পাহাড়ে ১০০ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে। মধ্যাহ্নভোজনের পর আমরা বিশ্রাম নিলে তার সুবিধা হয় বলে একটু ইতস্তত করছিলাম; কিন্তু হয়তো আমার হাতে কাগজ নিয়ে তালিকা মেলানো দেখে সে নিজেই বলল, “দেখ লিজিয়ে”।
মধ্য এশীয় সংগ্রহশালা (Central Asian Musium):
গন্তব্য লে প্যালেস ও সেন্ট্রাল এশিয়ান মিউজ়িয়াম। আরেকটা
গুরুদ্বার সময় পেলে দেখা যাবে। ট্রাভেল এজেন্টের সূচিতে নামগুলো দেখেছি। আলগা পথনির্দেশ
ভর করে দেড় ঘণ্টা ঘুরপাক খেয়ে একটা অপ্রশস্ত গলিতে ঢুকলাম যেখান থেকে লে প্রাসাদ যাওয়ার
রাস্তা আছে। গায়ে গায়ে বাড়ি। কিন্তু রাজপ্রাসাদ কোথায় একেক জন একেক দিকে দেখায়, কেউ
আবার কিছুই বলতে পারে না। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎই চোখে পড়ল ‘Central Asian Museum’ ফলক
আঁটা একটা সাদামাটা দরজায়। দেওয়ালে পাথরের ওপর মাটি লেপা মনে হল। এটা সংগ্রহশালা?
৫০ টাকার টিকিট যখন, নিশ্চয়ই দর্শনীয় কিছু
থেকে থাকবে। তা অবশ্য ছিল। স্থানীয় ইতিহাস বিধৃত মূলত মধ্য এশিয়া থেকে আসা আগ্রাসকদের
পরিপ্রেক্ষিতে। পোশাক, অস্ত্রশস্ত্র, তৈজসপত্র, গয়না ইত্যাদি যা যা সচরাচর থাকে। আমার
কন্যা খুব মন দিয়ে সব খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। ওর বয়সে আমার চাকচিক্যহীন ঐতিহাসিক কচকচিতে
মোটেই আগ্রহ ছিল না; কুতুব মিনারে গিয়েও মনে আছে, বেজায় বোর হয়েছিলাম।
ছবি তুললাম অনেক সচিত্র বর্ণনা ও লিপির। অবিকল ভুটানি লিপি যার সঙ্গে দেবনাগরীর বেশ মিল। একটি ছবিতে অঙ্কের সেট থিওরির ভেন ডায়াগ্রামের মতো ভৌগোলিকভাবে মধ্য এশিয়া, তিব্বত ও ভারতকে তিনটি সেট ও লাদাখকে তিনটির সাধারণ অংশ বা ইন্টারসেকশন রূপে দেখানো আছে। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে খুব ভুল মনে না হলেও ভাষা ও সংস্কৃতিতে লাদাখ কিন্তু ভারতেরই উপাঙ্গ, মধ্যএশীয়রা যেখানে বহিরাগত আক্রমণকারী রূপেই এসেছিল। তাছাড়া মহাযান বৌদ্ধধর্মের অন্যতম শাখাটি মূলত তিব্বত কেন্দ্রিক হওয়ায় ভারতের সমগ্র বৌদ্ধ অধ্যুষিত হিমালয় ও ভুটানে তিব্বতীয় শিল্প-সংস্কৃতির প্রভাব। এর সঙ্গে পার্বত্য ভারতেরই আত্মিক সম্পর্ক, যা ধরা পড়ে ভুটানের জ়োংখা লিপি, তিব্বতী লিপি ও লাদাখি লিপির সঙ্গে দেবনাগরীর সাদৃশ্যে। মধ্য এশিয়া ও তার দিগ্বিজয়ী ইসলামের রমরমা ভারতের হিন্দুপুর্ণ কাশ্মীর উপত্যকাকে যেভাবে কাবু করতে পেরেছে, সংলগ্ন লাদাখের বৌদ্ধ স্তম্ভে ততটা ফাটল ধরাতে পারেনি।
দাঁতুন সাহিব গুরুদ্বার:
মিউজ়িয়াম থেকে বেরিয়ে আবার প্রাসাদের খোঁজ। কাছেই একটা
গাছের গায়ে চোখে পড়ল দাঁতুন সাহিব গুরদুয়ারা-র লেখা ম্লান ফলক। পাশে একটা ৩-৪ তলা নির্ণীয়মান
বাড়ি। সাইনবোর্ড দেখলাম যখন, সৌধও নিশ্চয়ই কাছাকাছিই হবে। এটাও তো সিলেবাসে আছে, সেরে
ফেলি। গাছের নীচে ছোট্ট ঘরের দরজায় বসা এক বৃদ্ধকে পথনির্দেশ চাইতে যা উত্তর পেলাম,
শুনে বিশ্বাস হল না। ঐ ঘরখানাই নাকি দাঁতুন সাহিব। স্বয়ং গুরু নানক এখানে এসে নিজের
মিশবাক দাঁতন পুতে দেওয়ার পর সেই ডাল কালক্রমে মিশবাক বৃক্ষ হয়ে উঠেছে। তারই নীচে তৈরি
হয়েছে এই ‘দাঁতুন সাহিব’ গুরুদ্বার, যেখানে একত্রে দশজনও দাঁড়াতে পারবে না। পাশের অট্টালিকাটি
গুরুদ্বারের অংশ হতে চলেছে কিনা জানা গেল না। ২০ টাকার প্রণামী দিয়ে হাসব না কাঁদব
বুঝে পেলাম না। তবে শ্রী না থাকলেও ইতিহাস একটা আছে, যদি অবশ্য সেটা সত্যি হয়ে থাকে।
লে প্রাসাদ:
প্রাসাদের খোঁজে ঘুরপাক খেতে খেতে খুব ক্লান্ত লাগছিল। তার ওপর রোদ। প্রাসাদের সন্ধানে মসজিদ চত্ত্বর চোখে পড়ল। কিন্তু লে-বাসীদের কাছে লে প্রাসাদের সন্ধান পেতে হিমশিম। এরপর নাকি আবার সিঁড়ি চড়তে হবে। শেষে রাজপ্রাসাদে যাওয়ার মূল রাস্তার সন্ধান পেয়ে গাড়ি সেদিকে চলল। বিকেল ৫টা-৫টা ৩০-এ বন্ধ হয়ে যাবে। হাতে সময় নেই। ঝটপট মাথাপিছু ২৫টাকার টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
আরেক নাম ‘লাচেন পালকার’ প্যালেস। সাততলা প্রাসাদ, পুরোটাই
মাটি দিয়ে পাথর গেঁথে ওপর থেকে মাটি লেপে। ১৬০০ শতাব্দীতে রাজা সেনগি নামগিয়াল নির্মাণ
করিয়েছিলেন। ১৯ শতকের মাঝামাঝি ‘ডোগরা’ শক্তির আক্রমণে এই প্রাসাদ ছেড়ে নামগিয়ালরা
‘স্তোক’ প্রাসাদে চলে যান, যা ‘স্তোক গুম্ফা’ বা ‘স্তোক মনেস্ট্রি’ নামেও পরিচিত। লে
থেকে ১৫ কিলোমিটার দুরের এই গুম্ফা বা প্রসাদে আমাদের যাওয়া হয়নি। খোঁজ পেলাম লিখতে
বসে।
ভেতরে ঢুকে রীতিমতো বাক্যিহারা! বেশ নীচু ছাদ। কোনও
কোনও অংশ কুঁড়ে ঘরের অন্দর বলে ভ্রম হচ্ছিল। লণ্ঠন হারিকেনের আবছা আলোয় কিছু ম্লান
আসবাব ও লাঠি লাগানো ছবি চোখে পড়ল। ম্লান হওয়ারই কথা -- কোনোকোনওটার বয়স ৪৫০ বছর। আমার
শরীর আর দিচ্ছিল না। একটা কাঠের বেঞ্চ দেখে শুয়েই পড়লাম। মেয়ে আর তার বাবা ঘুরে ঘুরে
সিঁড়ি চড়তে লাগল। অষ্টাদশী মেয়ে তো স্পিটুকে ফাঁকি মেরে শক্তি সঞ্চয় করে নিয়েছে। তার
সাতান্ন বছরের বাপকে বৌয়ের খ্যাপামি, মেয়ের বয়স, অফিসের ফোন, ভ্রমণে পরবর্তী থাকার
ব্যবস্থা --- সবদিকেই তাল রাখতে হচ্ছে। শিলং বা সিকিমের মতো কন্যাকে কাঁধে নিয়ে ঘুরতে
হচ্ছে না, এই যা। অবশ্য আমাদের করেসপন্ডেন্স গাইড তথা উপদেষ্টা অনুপম স্যরের বদলে ম্যাডামকেই
অধিকাংশ জ্ঞাতব্য বিষয় জানিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে।
চোখ লেগে গিয়েছিল আমার। নীচ থেকে ওপর দিকে প্রাসাদের
পরিসীমা ক্রমশ কমেছে ভারসাম্য রাখতে। আমার মেয়ে ছয় তলা পর্যন্ত দেখে এসে কী সব বোঝাতে
লাগল, আমার মাথায় ঢুকল না। এমন ধুসর পাঁশুটে মাটির রাজপ্রাসাদ জীবনে প্রথম দেখলাম।
বেরিয়ে এসে নেপাল থেকে আগত একটি পর্যটক দলের কিছু মহিলার
সঙ্গে আলাপ হল। তারা ট্যুর অপারেটরের বাসে এসেছে, আমাদের মতো ঘুরপাক খায়নি। লাদাখের
রাজধানী শহরে এই প্রথম একটি কনডাক্টেড টুরের সাক্ষাৎ পেলাম। হয়তো ভারত সরকারের বর্ডার
রোডসের রাস্তা নির্মাণকারী সংস্থার অতিথিনিবাসের পরিবর্তে বাজার এলাকায় কোনও হোটেলে
থাকলে আরও দেখতাম।
আমাদের নির্ধারিত
ডেরায় ফিরতে হল। খোঁজাখুঁজিতে সময় নষ্ট না হলে আরও দু-একটা দ্রষ্টব্য দেখে নেওয়া যেত,
যেগুলো পরে আর সুবিধা হয়নি। কী কারণে, সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য। আমাদের নামিয়ে চালক ঐ পড়ন্ত
বিকেলেই বেরিয়ে পড়ল শত কিলোমিটার দূরে তার কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। রাতে থাকবে না, কিন্তু
ছেলেটা একবারও তাড়া দেয়নি।
গরমজলে গা ধুয়ে গোছগাছ করে নিলাম। আগামীকাল সাতসকালে
গাড়ি আসবে। বিশ্বের উচ্চতম সড়কপথে ১২০ কিলোমিটার লম্বা যাত্রা।
হাল্কা ছিটেফোঁটা বৃষ্টি পড়ি-পড়ি করে থেমে গেছে। জুলাই
মাসেও এমনটাই নাকি স্বাভাবিক এদিকে। অদূরে পাহাড় চূড়ায় তুষার, আর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে
সাড়ে এগারো হাজার ফুট উঁচু লে উপত্যকায় মেঘলা আকাশেও দিনে-রাতে টেবিল ফ্যান চালিয়ে
শুতে হচ্ছে! কন্যা উর্বীর ব্যাখ্যা, “এখানে গাছপালা নেই, বৃষ্টি নেই। রোদের হিট অ্যাবসর্ব
হবে কী করে?” মনে পড়ল ‘রম্যাণী বীক্ষ’ উপন্যাস সিরিজের কোনও একটাতে তিব্বত যাত্রার
পথে হিমালয়ের কোলে দুরন্ত গরম আর আমবাগানের কথা পড়েছিলাম।
পূর্ববর্তী পর্ব : ২।। পদার্পণ পরবর্তী পর্ব : ৪।। নুবরা উপত্যকা