সৎকার
শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
“ট্রেন চলছে না, আর রেলের অফিস? ডোন্ট জোক। এত পেটে ব্যথা নিয়ে বেরিও না পপি। আর বাবুয়ার আয়ামাসী এলে উসে হী বোলো না কুছ পকানে কো।”
“ট্রেইন না চললে কি অফিসে কাজ থাকতে নেই? তুমি টোটাল লকডাউনের মাধ্যেও অফিস যাওনি? ফ্যাক্টরি কর্পোরেট হচ্ছে বলে কি ডিএডি ফ্যাক্টরি অ্যাকাউন্টস্ দেখা ছেড়ে দিয়েছে এখনই? ওদিকে আমার একাডেমিতেও কামাই হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন।”
“আর ছাড়ো তো তুমার একাডেমি। বরং বেটুকো তৈয়ার করো।” পশ্চিমবঙ্গে থেকে ও বাঙালী মেয়ে বিয়ে করে বাংলা বুঝলেও হিন্দী মিশিয়ে এমন জগাখিচুড়ি ভাষাতেই কথা বলে অরিজিত। বেটু হল বেটা-র আদুরে সংস্করণ।
“এই ক্রিকেটের দৌলতেই কিন্তু পরিচয়, ভুলো না। উঃ, তখন হপ্তায় হপ্তায় কলাইকুণ্ডা থেকে এখানে আসার কী ধূম!”
“সেই তো, বহুত গলতি করেছি। তাই তোমার মা বাবা এখনও মানতে পারলেন না আমাকে। কী, না বিহারী আছি। তুমলোগ বৈদ্য অউর হাম বিহারী রাজপুত। তাও মানল না। আর তুমার বোন কী করল? বেগমজান? বাওবাহ্!”
“দেখো একেই শরীর খারাপ লাগছে, এসব কথা ভালো লাগছে না। তোমার বাড়ির লোক হন্ডাসিটি-সহ গুচ্ছের দাবি দাওয়া না করলে এত কমপ্লিকেশন কিছুই হত না। ন্যাশনাল লেভেলের ক্রিকেটার, ঝুলন গোস্বামীর টীমে কয়েকটা ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচও খেলে এসেছি – এমন বৌয়ের জন্যও দহেজ চাই।”
“আই সী! আমার বাপ মার দোষ? এই যে তুমাকেই শাদী করলাম, আমার ঘরের লোগ নারাজ় হয়নি? স্যাক্রিফাইস কেয়া তুমনে অকেলে কিয়া? তুমাকে কি আমার গাঁও ঘরে ছেড়ে এসেছি? কলকাতার মতো শহরে নিজের মতো ইনডিপেন্ডেন্টলি আছো। ফাইনালি আমি কোতো টাকা দহেজ নিয়ে বিয়ে করেছি?”
“রোজগেরে বৌ হলে আর দহেজ লাগে নাকি?”
বাবা মা গয়া জেলার মানুষ। তাঁরা যাই বলে থাকুন, অরিজিৎ নিজে যথেষ্ট নির্লোভ ও চরিত্রবান ছেলে। রাগতে যাচ্ছিল। তার আগেই পুষ্পিতার চলভাষ গান গেয়ে উঠল।
“হ্যালো। বললাম না, শরীরটা একদম ভালো নেই। আজ মিটিংটা আমার ড্রয়িং-এই হোক। আমি অফিস যাচ্ছি না।”
“এই শুরু হল! সামনে পুজো, এবার তাই নিয়ে মাতবে। হাউজ়িং-এ আর লোক নেই? টেক রেস্ট দিস ইয়ার। এই শরীরে কেউ এত স্ট্রেইন নেয় না। এই বোছরটা তোমার বিশ্রাম দরকার পপি। আমি ফেরার পথে ডক্টর শর্মার অ্যাসিসটেন্টের সঙ্গে কথা বলে ফিরব।”
পিত্তথলিতে পাথরটা ধরা পড়েছে বছর দেড়েক আগে জন্ডিস নিয়ে বাড়াবাড়ির জেরে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর। প্রথম দিকে গা বমি ও অরুচির সময় বদ বহজম ভেবে হজমের ও বমির ওষুধ খেয়ে গেছে। চোখ জিভের তলা ও গা যে হলুদ হয়ে গেছে, তা নিজেরা প্রথমটায় লক্ষ্যই করেনি। পাথরটা ছোট। কিন্তু জমেছে পিত্তথলি থেকে নির্গত পিত্তনালীর মুখে, যার ফলে পিত্তরস ক্ষরণে বাধাজনিত অবস্ট্রাক্টিভ জন্ডিস হয়ে গিয়েছিল।
মেডিকেল বোর্ড বসেছিল। অস্ত্রোপচারের কথা উঠলেও ডাক্তারদের পদ্ধতি ও মাত্রা নিয়ে দ্বিমত ছিল। কেউ বললেন, পুরো কোলেসিসটেকটমি করে না রহেগা বাঁস না বজেগা বাঁসুরী করে ফেলতে; অর্থাৎ পুরো গলব্লাডার বাদ দিতে। কারও মতে স্ফিংকটেরোটমি পদ্ধতিতে নালীতে সামান্য কেটে শুধু পাথরটুকু বার করে আনার কথা; মানে মশা মারতে কামান দাগানোর দরকার নেই। আবার তাই নিয়েও দ্বন্দ্ব। পাথরটা লেজ়ার বা শব্দ তরঙ্গ দিয়ে ভেঙে ফেলা হবে, নাকি সরাসরি শল্যচিকিৎসার দ্বারাই বার করা হবে? আবার কারও মতে কাটাকুটির দরকারই নেই, লিথোট্রিপসির মাধ্যমে জোরালো তরঙ্গ দ্বারা শুধু বাধা ভেঙে ফেলাই যথেষ্ট। বিচূর্ণ পাথর পিত্তনালী বেয়ে ক্ষুদ্রান্ত্রে এসে যথাস্থান দিয়ে বিদায় নেবে। কিন্তু সেখানেও সমস্যা, কারণ পুষ্পিতা তখন সদ্য সীজ়ারিয়ান অপারেশন
করে মা হয়েছে। ছেলে চার মাসের। আগে ধরা পড়লে হয়তো এক ধাক্কায় দুটোই হয়ে যেত। সাময়িকভাবে উপসর্গ থেকে সেরে উঠে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেও এল। শুধু স্টেশন থেকে ফিরে শত ক্লান্তিতেও
ছেলেকে স্তন্যপান করানোর যে অভ্যাস বজায় রেখেছিল, সেটা অসুখের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। তারপর
বছর খানেক এটাকে ঘাঁটানোর দরকারও হয়নি। কিন্তু মাস খানেক হল পেটের মধ্যে আবার চিড়িক মারা ব্যথা শুরু হয়েছে। সঙ্গে প্রবল গাগোলানো। গত সপ্তাহে তো মনে হচ্ছিল ভেতরে কেউ ছুরি গেঁথে দিয়েছে। তবে নিয়মিত
অফিস যেতে হচ্ছে না, এই যা রক্ষা।
এদিকে করোনা সংক্রমণের ভয়ে হাসপাতাল নার্সিং হোম যেতেও ভয়। মনে হচ্ছে কোভিড উনিশ ছাড়া যেন আর সব অসুখের মনুষ্যদেহে প্রবেশ নিষেধ, যেন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে না, যেন মেয়েদের সঙ্গে ঘটা ঘটনাগুলো সামাজিক দূরত্ব মেনে ঘটছে। লকডাউনের সৌজন্যে অবশ্য পুষ্পিতার অসুখে বিশ্রাম ও দুগ্ধপোষ্য ছেলের কাছে থাকা, আর দুটোই হয়ে যাচ্ছে। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে থাকলেও অবশ্য বুকের
দুধ পান করানোর উপায় নেই। কষ্ট একটু কম থাকলে নিজের হাতে তেল মাখায়, স্নান করায়। কিন্তু
বাগ না মানা যন্ত্রণা আর বমিভাবে নিজেকে নিয়ে বেশিরভাগ সময় এমন ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়,
যে সেই আয়াই ভরসা।
অরিজিৎ এখন ডিফেন্স অ্যাকাউন্টসে কাজ করে। সেনা হাসপাতাল সিভিলিয়ানদের জন্য না হলেও অরিজিত বায়ুসেনা থেকে অবসরপ্রাপ্ত এক্স সার্ভিসম্যান হিসাবে চিকিৎসার সুবিধা পায়। পুষ্পিতাকে প্রথমে কলকাতার সবচেয়ে বড় সেনা হাসপাতালে নিয়ে গেল। সেখানে শুধু ব্যয়ই কম নয়, নিয়মানুবর্তী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রোগীকে অযথা ঘুরপাক না খাইয়ে সরাসরি সঠিক চিকিৎসা করে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়; মড়া আগলে বিল বাড়ানোর গল্প নেই।
অন্যান্য সরকারী হাসপাতালের মতো দীর্ঘ সরণীতে দাঁড়িয়ে থাকার দরকার হয়নি। ‘মেজর ডক্টর সাবনে বোলা এমআরআই করনা হ্যায় তো আভী কে অভী করনা হ্যায়’। মানে তিন দিনের মাথায় হাতে রিপোর্ট চলে এল। কিন্তু পাথরের আকার ও অবস্থান দেখে এবং কোভিড পরিস্থিতি মাথায় রেখে সেনা হাসপাতাল অপারেশনের দায়িত্ব নিল না; কোনও বিশেষজ্ঞের অধীনে ভালো জায়গায় খোঁজ নিতে বলল।
অগত্যা একটি বেসরকারী কর্পোরেট কেতার সুপার স্পেশালিটি হসপিটালে ভর্তি হল পুষ্পিতা। শুধু অনুসন্ধান করতে হলে এমআরসিপি করা যায়। কিন্তু পাথর বা টিউমার সনাক্ত
ও নিষ্কাষণ দুটোই করা সম্ভব ইআরসিপি দ্বারা। এন্ডোস্কোপিক রেট্রোগ্রেড কোলানোজিওপ্যানক্রিয়াটোগ্রাফি – পুরো নামটা ঠোক্কর না খেয়ে উচ্চারণ করা দুঃসাধ্য। অরিজিতকে ভালো করে বোঝালেন ডাক্তার শর্মা। আগায় ক্যামেরা বসানো একটা এন্ডোস্কোপির নল মুখ দিয়ে পেটে ঢুকিয়ে পাকস্থলী হয়ে ডিওডেনাম মানে ক্ষুদ্রান্ত্রের মুখ পর্যন্ত চারিয়ে দেওয়া হবে। তারপর একটা সরু নল বা ক্যাথিটার পিত্তথলি পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে সেই পথে রঞ্জক প্রয়োগ করবে যাতে ফ্লুয়োরোস্কোপি বা বিশেষ একধরণের এক্স-রেতে ভেতরের ছবিটা ভালোভাবে ফুটে ওঠে। শেষ পর্যন্ত এন্ডোস্কোপ নল দিয়েই সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি প্রবেশ করিয়ে পাথরটিকে ভেঙে ফেলা হবে। তবে এখানেই শেষ নয়, অস্ত্রোপচারের পর পিত্তথলীতে ফুটো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেক্ষেত্রে দরকারে আর একটা সরু নল বা স্টেন্ট ঢুকিয়ে তা মেরামত করে পিত্তক্ষরণ আটকানোর ব্যবস্থা থাকবে। তাছাড়া প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হওয়ার পর রয়েছে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, যেমন গলায় কষ্ট, বমিভাব ইত্যাদি।
শুনতে শুনতে অরিজিতের মাথা ঘুরছিল। প্রশ্ন করল, “ইস অপারেশনমে কোই রিস্ক?”
“রিস্ক তো হ্যায়; বাট মোস্ট ইফেক্টেভ ইন দিস কেস অ্যাজ় ওয়েল অ্যাজ় দ্য ওনলি অপশন। কোভিড সিচুয়েশনমে আই কান্ড গো ফর ওপেন অপারেশন, নট ইভেন ল্যাপ্রোস্কপি।” ডাক্তার শর্মা বললেন।
পুষ্পিতা শুনে বলল, “জিগ্গেস করলে না কেন, ডেলিভারির সময় সীজ়ার করার দরকার হলে কি কোভিড সংক্রমণের ভয় থাকে না? সেখানে তো
তিন চারটে ফুটো করেও হয় না। অনেকটা কাটতে হয়। নর্ম্যাল ডেলিভারিরতেও মায়ের শরীরে কিছু
না কিছু ইনজুরি আর ব্লীডিং হবেই।”
এসব প্রশ্ন অবান্তর। যথানিয়মে পুষ্পিতা ভর্তি হল। মেডিক্লেমের প্যাকেজ অনুযায়ী অপারেশনের পর তিন দিন হাসপাতালে রেখেই বাড়ি ফেরার কথা। যদিও দুজনেই সরকারী কর্মচারী, কিন্তু চিকিৎসায় গতি ও স্বাধীনতা ভোগ করতে চিকিৎসা বীমা করিয়ে রেখেছে।
লকডাউন উঠে গেলেও সংক্রমণের হার নাকি তুঙ্গে। যদিও করোনার চেয়ে অন্যান্য রোগে বা দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার অনেক বেশি, কিন্তু নোভেল করোনা ভাইরাস মনে হচ্ছে এই সহস্রাব্দীর জীবাণুদের সুপারস্টার, আর কোভিড উনিশ হল অসুখ-সম্রাট। তাই ট্রেন ছাড়া গণপরিবহন চললেও যাদের দুচাকা বা চারচাকা আছে, তারা সেইসব নিয়েই কর্মস্থলে দৌড়চ্ছে। অরিজিতও বাইকেই যাতায়াত করছে নিউটাউন
থেকে। রেল চলাচল বন্ধ থাকায় ও বেহাল শরীর নিয়ে পুষ্পিতা ঘরবসা বলে ছেলে মায়ের সঙ্গ পেতে অভ্যস্থ হয়ে গেছে। কিন্তু মা হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ইস্তক
এই ক’দিন মা বাবা কাউকেই কাছে না পেয়ে দেড় বছরের ছোট্ট বাবুয়া সারাদিন ঘ্যানঘ্যান করে চলেছে। মা থাকলে আয়ামাসীর কাছেও স্নান খাওয়া
সেরে নেয়, কিন্তু মাকে দেখতে না পেয়ে এই ক’দিন ভীষণ কাঁদুনে হয়ে উঠেছে।
অরিজিতের এমনই কপাল – গয়ার বাড়ির সঙ্গে তো ভৌগোলিক ও
মানসিক দুটো দুরত্বই দুর্লঙ্ঘ্য। ওদিকে পুষ্পিতা বা পপির
মা বাবা বোন কাছাকাছি শান্তিপুরে থেকেও কয়েকবার ফোনে বড় মেয়ে বা দিদির খবর নিয়েছেন মাত্র। মায়ের অসুস্থতার সময় দিদা ও আপন মাসী ছুটে এসে যে দুধের বাচ্চাটাকে বুকে তুলে নেবে আশা করাও ভার; বরং তাঁদের তত্বাবধানে রাখতে গেলে মনে হচ্ছে যেন দাক্ষিণ্য নেওয়া হবে।
পপির ছোট বোন লিপি এখন জাহ্নবী থেকে বেগম জাহানারা রহমান। শান্তিপুরে একই পাড়ায় বাড়ি। অন্য ভাষাভাষীকে বিয়ে করেছে বলে বড় মেয়ে ত্যাজ্য, কিন্তু ছোট মেয়ে ধর্ম ত্যাগ করে বিপরীত মেরুতে চলে যাওয়ার পরেও নাকি সেই জামাইকে নিয়ে খুব দহরম মহরম। সকাল বিকেল যাতায়াত। পুষ্পিতার সঙ্গে অরিজিতের বিয়ের আগেই জাহ্নবীর সঙ্গে আনিসুরের ভাবসাব ছিল। তবে আনিসুর ছেলেটা নাকি ভালো। পারিবারিক ফল ও মাংসের ব্যবসা আছে। মোটা দেনমোহরের কড়ারে জাহ্নবী মানে জাহানারাকে নিকাহ করেছে।
অফিস থেকে জ্বর জ্বর ভাব ও গলায় ব্যথা নিয়ে ফিরল অরিজিত। পপির অপারেশন বলে এমনিতেই ছুটির আবেদন করেছে সাত দিন। এর মধ্যে নিজে অসুখে পড়লে আর দেখতে হচ্ছে না। উপেক্ষা না করে কলকাতার সেনা হাসপাতালের বহির্বিভাগে দেখিয়ে নিল। ডাক্তার বললেন করোনা পরীক্ষা করাতে। সর্বনাশ! বৌয়ের আজ বাদে কাল অপারেশন, বাড়িতে দুগ্ধপোষ্য শিশু। অফিসের এক সিনিয়ার অ্যাকাউন্টস অফিসারকে জানাল। ভদ্রলোক এক বিরল ব্যক্তিত্ব। অ্যাডমিন সেকশনে আসার পর পুরো পরিবেশটাই বদলে দিয়েছেন। কাজের ব্যাপারে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও কড়া হলেও অধঃস্তনদের সবরকম সমস্যায় তিনিই প্রধান সহায় ও ভরসা।
মনে মনে হাজারো প্রার্থনা করা সত্ত্বেও করোনা ধরা পড়ল অরিজিতের। সঙ্গে সঙ্গে জ্বর না ছাড়া পর্যন্ত এবং সেরে ওঠার পরেও অন্তত পনেরো দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকার বিধান জারি হয়ে গেল। অ্যাডমিন প্রধান অংশুমান চ্যাটার্জীকে আবার ফোন করল অরিজিত, “স্যর, আমি কম্যান্ড অসপতাল থেকে বলছি। আমার করোনা টেস্ট পজ়িটিভ এসেছে। আমাকে এখোনই কোয়ারেন্টাইনে যেতে হবে ব্যারাকপুর বেস অসপতালে। এদিকে আমার বৌকে অ্যাডমিট করেছি। অপরেশনের হবে এক দো দিনমে। ঘরমে সাল ভরকা বচ্চা। নানী নানাকে সাথ রিশ্তা ওত ভালো না। আপনি দেখেন।“
“তুমি এখনই একটা ইমেইল করে দাও তোমাকে কোয়ারেন্টাইনে যেতে হচ্ছে জানিয়ে। আমি জেসি-র সঙ্গে বলছি। বেস হসপিটালের অ্যারেঞ্জমেন্ট নিয়ে তো চিন্তা নেই। ভালো হয়েই ফিরবে। আর তোমার বৌয়ের বেড নাম্বার, ফোম নাম্বার এটসেট্ট্রা ডিটেইলস দিবে দাও।
অপারেশনের সময় আমরা অফিস থেকে কেউ না কেউ থাকব, চিন্তা কোরো না। যা দরকার লাগে অ্যারেঞ্জ হয়ে যাবে। তারপরেও পালা করে যাওয়া আসা করব আনলেস ইউ বিকাম ফ্রী। কিন্তু তোমার ছেলেটাকে শুধু আয়ার ভরসায় রাখবে, নাকি ওর দিদাকে একবার ডেকে দেখবে? বাড়িটাও তো সারাদিন কাজের লোকের ভরসায় ফেলে রাখতে হবে। রাতের বেলা কে থাকবে?”
অরিজিতের মাথাতেও একই কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল। এই ফোনটা রেখেই ইতস্তত করে শাশুড়ির নম্বরে ফোন করল, সম্ভবত জীবনে দ্বিতীয় কি তৃতীয়বার।
“হ্যালো, আমি অরিজিত বলছি।”
“বলো বাবা, পপি কেমন আছে, কবে অপারেশন? বাবুয়া কার কাছে আছে?”
শাশুড়িমার কন্ঠে ‘বাবা’ সম্বোধন আর এই প্রশ্নগুলো শুনে অরিজিতের মনটা দ্রব হয়ে গেল। নিজের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক বলতে সপ্তাহে রুটিন ফোন। গ্রামের বাড়ি দাদা ও ছোট ভাইয়ের দখলে। তাছাড়া বিনা দহেজে বিয়ে করেছে বলে অরিজিত ‘বঙ্গালী ভেড়ুয়া’ হয়ে গেছে ওদের চোখে।
গ্রামের বাড়ি না গেলেই যেন ভালো। নিকট আত্মীয় আপনজনদের মধ্যে তো এনারাই। পুরোটাই বলল পুষ্পিতার মাকে।
“আমি লিপির সঙ্গে একটু কথা বলে নিই। তারপর তোমাকে জানাচ্ছি।”
অ্যাম্বুলেন্সে করে যেতে যেতে ফোন এল। “আমি তোমার বাবা আর লিপিকে নিয়ে এখনই রওনা হচ্ছি। আনিসুরও যাবে। ওর গাড়িতেই যাব সবাই। কদিন থেকে তেমন হলে বাবুয়াকে নিয়ে চলে আসব। তুমি ওদিকটা সামলে নাও, তারপর ছেলেকে নিয়ে যেও। ততদিন থাক আমাদের কাছে। জন্মের পর থেকে তো দাদু দিদা মাসী কাউকেই দেখেনি। চিন্তা কোরো না।”
ভেতরটা অনেক হালকা হয়ে গেল। সংকট কাটেনি। তবে সংকটকালে অফিসের ওপরওয়ালা থেকে আপনজনেরা পাশে তো দাঁড়িয়েছে, এটাই মস্ত স্বস্তি।
কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে থাকতে থাকতেই খবর পেল, পুষ্পিতার অবস্থা সঙ্গীন। অপারেশনের পর প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তবে চিন্তার কিছু নেই, রক্ত দেওয়া হচ্ছে; আশা করা যায় জ্ঞান ফিরবে। উদ্গত অশ্রু প্রায় গিলে ফেলে অফিসের সহকর্মীকে ফোন করল। জানা গেল ইতিমধ্যে চার ইউনিট রক্ত দেওয়া হয়েছে; অবস্থার উন্নতি হলেই আইসিইউ থেকে কেবিনে আনা হবে।
“কোরোনার রিস্ক নেই তো?”
“না না, সে টেনশন নেই। একেবারে স্যানিটাইজ়ড এনভায়ারনমেন্টে রেখেছে। বাপ রে! আমরা গেলেই আগাপাশতলা হাজার গণ্ডা স্প্রে করে, তারপর আইসিইউ-তে তো যেতেই দেয় না। সেদিকে নিশ্চিন্ত। শুধু অপারেশন করতে গিয়ে কিছু একটা পাংচার হয়ে গেছে। কী সব স্টেন্ট ফেন্ট বসিয়েছে বলল। এবার শুধু ব্লীডিং বন্ধ হলেই ক্রাইসিস কেটে যাবে।”
অরিজিত শ্বশুরবাড়িতে ফোন করল। বাবুয়া প্রথম দিকে কান্নাকাটি করলেও এখন মানিয়ে নিয়েছে। পপির খবর সবই বলল। এক সময় পাইলট না হলেও বায়ুসেনার অফিসার ছিল সে। কিন্তু এখন কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে দিনরাত শুয়ে বসে নিজেকে এত অসহায় জীব মনে হচ্ছে যে বলার নয়। ওর জ্বর দু’দিনেই সেরে গেছে। কিন্তু ডাক্তার ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়ার পনেরো দিন পর ছাড়া পাবে। আনলক চালু হলেও করোনার করাল থাবা থেকে নাকি এখনও মুক্তি মেলেনি।
সর্দিজ্বর নিয়ে পরীক্ষা করলে হয়তো অনেকেরই করোনা ধরা পড়বে এবং সেটা কোভিড উনিশই, সতেরো
আঠারো বা বিশ নয়। কিন্তু ধরা পড়লে আর রক্ষা নেই। বারো দিন হয়ে গেল।
আর তিন দিন। দিন গুনছে অরিজিত। কিন্তু পপির তো প্যাকেজের মেয়াদ কবে শেষ। অথচ এখনও তো
শুনছে জ্ঞান ফেরেনি। শুধু প্যাকেট প্যাকেট রক্ত দেওয়া চলছে। স্বস্তি একটাই – করোনা সংক্রমণ ঘটেনি। কিন্তু ওর ছুটি হবে কবে?
ঘণ্টায় ঘন্টায় পুষ্পিতার মেডভেদিকা হাসপাতালে, অফিসের চ্যাটার্জী সাহেব বা কোনও সহকর্মীকে ও শ্বশুরবাড়িতে ফোন করা ছাড়া একটা হাট্টাকাট্টা জোয়ান মদ্দর কিচ্ছু করার নেই। রাতে ঘুম আসতে চায় না, সারাদিন ঘনঘন হাই ওঠে।
“হ্যালো ম্যাডাম, ইস তরফ। হম তো আপকা ফ্যান বন চুকা।”
বিমানবন্দরের প্রশস্ত রানওয়ে দিয়ে মাথার ওপর উড়ে যাচ্ছে বিকট গর্জন করা বিমান ও হেলিকপ্টার। তারই মধ্যে দুজন হাঁটছে। সামনে এক দির্ঘাঙ্গী ছিপছিপে তরুণী। পেছন পেছন এক পেটানো চেহারার তরুণ। মেয়েটিকে সে পিছু ডাকছে, “হাই অরিজিত হেয়ার। ক্যান ইউ লিসন টু মী?” পুষ্পিতা মুখ ফেরাতেই দৃশ্যটা মিলিয়ে গেল। অরিজিত পুষ্পিতার হাত ধরতে যাচ্ছে, কিন্তু ছবিটা হারিয়ে যাচ্ছে। বিমানের রাত্রিকালীন তীব্র আলোয় চোখ ঝলসে গেল। একটা আলো ক্রমশ অপারেশন টেবিলের আলোর রূপ ধারণ করল। বিমান থেকে অনেকটা প্যারাশুটের মতো লাফিয়ে নেমে এল অজস্র নল, তার, সুচ। একের পর এক নল পুষ্পিতার মুখ দিয়ে ঢুকে চলল। হাতে ফুটতে লাগল ছুঁচ। তার পেটে নাকি হীরের খনি আছে, খনন করে তুলে আনা হবে। পুষ্পিতা মুখে নল নিয়েই অরিজিতের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার তো সময় হবে না, বাবুয়াকে ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে নিয়ে যেও...”
ভোরের দিকে স্বপ্নটা ভাঙতেই উঠে বসল। ঘামে জবজবে ভিজে গেছে। কলাইকুণ্ডা বায়ুসেনা ঘাঁটির চেহারাটা স্বপ্নে অন্যরকম লাগছিল। অরিজিত সেখানে কর্মরত থাকাকালে পুষ্পিতা একটা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়েছিল। তখনই আলাপ। ক্রিকেটের সৌজন্যেই পরে রেলে চাকরি। আর এয়ারফোর্স থেকে অবসরের
পর স্টাফ সিলেকশন দিয়ে ডিফেন্স অ্যাকাউন্টসে ঢুকেছে অরিজিত। একজন সেনা আধিকারিক আর একজন ক্রীড়াবিদ। শারীরিক ও মানসিক দুরকম ভাবেই একে অপরের চমৎকার মানানসই। অথচ দু’জনের
বাড়ি থেকেই বিয়েতে কী অমত!
প্রাতঃকৃত্য সেরে ফিরতে না ফিরতেই মেডভেদিকা হাসপাতালে থেকে ফোন এল। পেশেন্ট এক্সপায়ার্ড! পেশেন্ট পার্টি এসে যেন সব বিল মিটিয়ে দিয়ে যায়। মানে! মাথাটা
খালি হয়ে গেল। অরিজিতের কোয়ারেন্টাইন থেকে মুক্তি পেতে এখনও দু’ দিন বাকি।
“ব্লীডিং বন্ধ হয়নি? কেমন অপরেশন করেছে ডাক্তার?”
“পেশেন্ট কোভিড নাইনটিন পজ়িটিভ ছিল। তাই শরীরের কমপ্লিকেশনস্ বেড়ে গিয়ে ডেথ হয়েছে। আপনি এসে বিল মিটিয়ে দিয়ে যান।”
অফিসে অংশুমান চ্যাটার্জীকে ফোন করে বলল, “স্যর, মেরী মিসেস ইজ় নো মোর। ভুল অপারেশনকে কারণ এক্সেসিভ ব্লীডিং-সে গুজ়র গয়ী। কল তক বোল রহা থা করোনাকা কোই গুনজ়াইশ হী নহী। অউর আজ বোলছে কী কোভিডে মারা গেছে!”
“ডক্টর কী গলতিসে মারা গয়া ইয়ে সাবিত করনে কে লিয়ে তুম ইনভেস্টিগেশন কী মাঙ কর সকতে হো। লেকিন কোভিডমে এক্সপায়ার্ড মতলব নো পোস্ট মর্টেম।
সিধা জাকে বডিকো জ্বলা.. আই মীন সৎকার কর দেঙ্গে। আপনা গলতি ছুপানে কা এক্সেলেন্ট তরিকা। এক কাম করো, কোভিড বোল রহা হেয় তো স্টেট গভর্নমেন্ট সে ইশ্যু কিয়া এক সার্টিফিকেট ভী হোনা হী চাহিয়ে। উস সার্টিফিকেট কী মাঙ্গ করো। ফির দেখতে
হে্য়।”
“অউর সার্টিফিকেট! মেরী বিবি ভুল ট্রিটমেন্ট সে তড়প তড়পকে মর গয়ী, অঊর ইস কোভিড নে মুঝে উনকে পাস রহনে ভী নহী দিয়া। মেয় ফ্রী রহেতা তো জ়রুর কুছ অউর ইন্তেজ়াম কর লেতা স্যর। মেরে অ্যাবসেন্স মে উনহে মার ডালা, অউর কোভিড কী বহানে বনাকর কহে রহা হ্যায় কী বিল ভরকে একবার দূর সে দর্শন করলো। মুঝে তো রোনে কে লিয়ে ভী ছুট্টি পরসোঁ মিলেগী স্যর!”
“কী বলি বলো
তো? যা ফর্মালিটি করে তুমি এখন তোমার ছেলের দিকে নজর দাও। বছর দেড়কের বাচ্চা। তোমাকেও তো চাকরি করতে হবে। ও কি তাহলে ওর দাদু দিদার কাছেই থাকবে?”
“ওর দিদা দাদু সঙ্গে
তো রিশতা ওতো ভালো ছিল না। পর অভী নাতিকো পা-কর বহুত খুশ। ছোড়নেকো তৈয়ার নহী। লেকিন
বাবুয়াকা মৌসী ও মৌসা কা অ্যাটিটিউড ঠীক নহী।”
“কিঁউ কেয়া
বাত হ্যায়?”
“ওলোগ লগভগ
সসুরালমে কবজা বনায়ে বৈঠে হ্যায়। জাহ্নবী মানে পুষ্পিতা কী ছোটী বহন এক মহমেডান সে
শাদী কী। কিসমত কা খেল দেখিয়ে স্যর। বড়ী বেটী বিহারী রাজপুতসে পেয়ার কিয়া তো মান নহী
পায়ে। লেকিন ছোটী বেটীকো দো-তিন সাল তক তন অউর ফির লগভগ অঙ্গুয়া করকে এক মুসলমাননে
শাদী কী, তো উসকা আরতি উতারা যা রহা হেয়। আনসারুল তো পপি কী মাইকে মে দামাত কম, মালিক
জ়াদা। সাসুমা কী বাত সে পতা চলা, হমারী শাদীমে উসিনে আসলমে
বাধা ডালা থা। বাতো বাতোঁমে ‘জয় বাংলা জয় বাংলা’ করতা হ্যায়।”
“তাহলে কী করবে? ছেলেকে নিজের কাছেই নিয়ে এসো তাহলে।
তারপর আয়ার ভরসায় সংসার রেখে অফিস করতে পারো, কিংবা ওয়ার্কিং মাদাররা যেমন ক্রেশে বাচ্চা
রেখে চাকরি করে, সেভাবেও করতে পারো।”
“স্যর, ও লোগ তো নিজের নাতির দেখভাল করতে জন্যও আমার
ফ্ল্যাট ডিমান্ড করছে। আমার ছেলের খরচ আমিই উঠাব – সে তো ঠীক আছে। কিন্তু এই ফ্ল্যাট
কেন দেব? উই আর জয়েন্ট ওনার অব দিস প্রপার্টি। এটা কিনতে সময় আমি টাকা দিয়েছি, পুষ্পিতা
ভী ইনভেস্ট করেছে। শী ওয়াজ় দ্য ফার্স্ট ওনার। আব উসকে মা-বাপকা
কহেনা হেয় কী উনকী বেটী কী প্রপার্টি উনকে নাম করনা পড়েগা। লেকিন পুষ্পিতা কী প্রপার্টিকা
হকদার তো উসকা বেটা হেয় না স্যর, উসকা মা বাপ কেয়সে হো সকতা, ও ভী এয়সে পেরেন্টস জো
আজ তক কোই রিশতা হী নহী রক্খা?”
“ওনারা তো তোমার ফ্ল্যাটে এসেই নাতির দেখাশোনা করতে
পারেন।”
“আমি তো সেই বললাম। আয়া আছে, কোনও প্রবলেম হোবে বা।
তো জাহ্নবী অঊর আনসারুল ভী আসবে। মানে থাকবে।”
“ওনারা নিজে বলেছেন এ কথা?”
“বলছেন উনারাই। কিন্তু আমি ড্যাম শিওর উনাদের বলাচ্ছে
আনসারুল। এক বেটী কো ফুসলাকে অপহরণ করকে শাদী কর লিয়া। উসকে বাদ পুরে সসুরালকা মালিক
বন বৈঠা। অউর অব দুসরী বেটী কী প্রপার্টি পর ভী নজ়র ডাল রহা সালা মাদার...।” অরিজিত
ক্ষোভে ফেটে পড়তে গিয়েও শোকে হাহাকার করে উঠল। “করোনার বহানায় আমি বন্দী থাকলাম। বৌকে
হসপিটালে দাখিল করে দেখতে ভী পারলাম না। অন্তিম সংস্কারও করতে পারলাম না। ডাক্তার মার্ডার
করে এখন করোনা বলে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। দেবীমার পূজা সময়ই বাবুয়ার মা চলে গেল। হাউজ়িংকা
জান থী স্যর। বেটুকে সেফ কাস্টডিতে রেখে ভাবলাম আহিস্তা আহিস্তা সামহাল লেঙ্গে। লেকিন...!
আমি তো এতোদিন সসুরজীদের হার্টলেস ভাবতাম। আব সমঝমে আয়া ওলোগ ভী ভিকটিম আছে।”
অংশুমান চ্যাটার্জী তাঁর সহকর্মী, উর্ধ্বতন, অধস্তন,
বন্ধু, পরিচিত সবার কাছে একজন মুশকিল আসান ট্রাবেল শ্যুটার। মহিলা কর্মীরাও নিজেদের
পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যার কথা শুনিয়ে সাহায্য, নিদেন মানসিক বল পান। তিনি অরিজিতের
ছুটি মঞ্জুর, কাজের দায়িত্ব লাঘব, দরকারে বর্তমান প্রধান কার্যালয় থেকে ওর সুবিধাজনক
স্থানে বদলির ব্যবস্থা সিনিয়ার অ্যাডমিন এও হিসাবে নিজের প্রশাসনিক এক্তিয়ার থেকে করে
দিতে পারেন। কিন্তু সম্পর্ক বিশ্বাস ও জমি লুণ্ঠণ প্রতিহত করার উপায় তাঁর কাছে নেই।
প্রথম প্রকাশ : বঙ্গদেশ পত্রিকায় ৮ই নভেম্বর ২০১৯।