চোর
অরূপম মাইতি
‘বাজার’, ‘বাজার’ বলে এগিয়ে আসছে অতুল।
নন্দীপাড়ার রাস্তায় চার চাকা ঢোকে না। সারা দিন পাড়া শান্ত থাকে। অতুলের গলা সব
বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছে। অতুলের ডাক শুনে,
মিশমি
বারান্দায় বেরিয়ে এলো। এখান থেকে রাস্তা আরও ভালো দেখা যায়। শর্মিলা ভিতরের ঘর
থেকে বলে উঠল
মিশমি নীচে যা,
সবজি
নিয়ে আয়।
পাড়ার সব বাড়ির
সঙ্গে মিশমিদের যোগাযোগ বিশেষ নেই। তবে কেউ কথা বললে, এড়িয়ে যায় না। মিশমি বলল
কি লাগবে, বলে দাও। আমি যাচ্ছি।
অতুল আর একটু এগিয়ে আসুক, নামব নীচে।
অতুল একটু থামছে,
একটু
এগোচ্ছে। মিশমির বাড়ি থেকে একটা ল্যাম্প পোস্ট আগে, ডান দিকে একটা গলি। অতুল গলির মুখে ভ্যান দাঁড় করিয়েছে।
শর্মিলা, মিশমির পাশে এসে দাঁড়ালো।
দেখ মাসি, বনির পিসি, অতুলের ভ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে...
শর্মিলা বলল, হুমম, দেখছি তো। তাতে কি হয়েছে?
ভাল করে দেখ, দুটো টমাটো তুলে
কোঁচড়ে ঢুকিয়েছে।
কই দেখলাম না তো...
মানসী খুব চটপটে। চোখের নিমেষে তুলেছে। তুই কেন, অতুল নিজেই বুঝতে পারেনি।
সেকি রে!
তবে আর বলছি কি...ঠিক করে দ্যাখ, আরও কিছু ঝেঁপে দেওয়ার ধান্দা করছে...
মিশমির কথা শেষ হতে না হতে, শর্মিলা স্পষ্ট দেখল, মানসী একটা বড় শসা, একটা করলা আর দুটো মাঝারি বেগুন তুলে কোমরের কাছে, শাড়ির খাঁজে লুকিয়ে ফেলল।
হ্যাঁরে, ঠিক বলেছিস। পটাপট
সবজি তুলছে। অতুল বুঝতেও পারছে না।
মানসী প্রায় এটা করে। আমি দোতলা থেকে দেখি বলে চোখে পড়ে
যায়।
তুই কিছু বলবি না?
কি বলব, যে সবজি বেচছে, তারই হুঁশ নেই। আমি বললে, ফালতু ঝগড়া লেগে যাবে।
ঠিক আছে, থাক বলে কাজ নেই।
গলির মুখে, অতুলের বেচাকেনা শেষ।
ট্রলি ভ্যান নিয়ে এগিয়ে আসছে। মিশমির হাতে ব্যাগ আর টাকা ধরিয়ে দিয়ে, শর্মিলা বলল, এবার যা।
বনির পিসে, ভোলা ট্রেনে হকারি
করত। কথাবার্তা একটু অন্য রকম। রাজনীতির লোকদের নজরে আসে। লকডাউনের বছর খানেক আগে, ভোলার উন্নতি হয়। হাওড়া-পাঁশকুড়া লাইনে, ভোলা সাধারণ হকার থেকে হয়ে ওঠে ইউনিয়নের নেতা। তার কার্ড
নিয়ে আর একটা ছেলে হকারি করতে শুরু করে। ভোলা তার থেকে ভাগ পায়। সন্ধেবেলা ভোলা, লাভের অংশ বুঝে নিতে,
রামরাজাতলা
স্টেশনে বসে থাকত।
লকডাউনে ট্রেন বন্ধ হয়ে যায়। হকারদের মাথায় হাত পড়ে। সে
সময়, ভোলারও কপাল পোড়ে। সংসার
চালাতে হিমশিম খেত। শালার সঙ্গে জুড়ি বেঁধে বাড়ি করেছিল বলে, মাথার ওপরে ছাদের চিন্তা ছিল না। একতলায় ভোলা আর মানসী
থাকে। মানসীর ভাই, অজিত থাকে দোতলায়।
দুই পরিবারের হাঁড়ি কিন্তু আলাদা।
মিশমিকে সবজি বেচতে পারলে, অতুল খুশি হয়। মিশমি সেটা বোঝে। অবলা কথা মেয়েদের মন বুঝতে পারে। মিশমিও কথা
বলে হাসি মুখে।
কিরে অতুল, মানসীকে ইচ্ছে করে সবজি চুরি করতে দিলি?
কি বলছ? মানসী পিসি তো দাম
দিয়ে কিনল।
বনির পিসি বলে,
মানসী
পাড়ার সবার পিসি। সেই দেখে, অতুলও পিসি বলে।
পটল বেছে, ঝুড়িতে তুলে, মিশমি বলল, মানসী পিসি কিসের দাম দিয়েছে?
কেন, পটলের! দরদাম একটু
বেশি করে বটে, তবে দাম দিয়ে দেয়।
মিশমি এবার বেগুন বাছতে শুরু করল। তুই একটা গাড়োল! যখন ওজন
করছিলি, সেই ফাঁকে মানসী সবজি
সরিয়েছে। তুই বুঝতে পারিসনি।
অতুল এবার হেসে ফেলল। তুমি কি করে জানলে?
আমি দোতলা থেকে স্পষ্ট দেখেছি। আমি একা নই, শর্মিলা মাসিও দেখেছে।
মিশমি ঘাড় ঘুরিয়ে ওপরে তাকালো। শর্মিলা কটমট করে দেখছে।
চারপাশ শান্ত বলে, মিশমির সব কথা, শর্মিলা শুনতে পাচ্ছে। ইঙ্গিতে বলছে, কী
দরকার ফালতু ঝামেলায় জড়িয়ে। যে যা করছে করুক না, বাপু।
সবজির দাম কেটে, টাকা ফেরত দিতে গিয়ে,
অতুল
বলল, আমি যে বুঝি না,
তা নয়।
বুঝি সব। বললে, ঝগড়া বাঁধবে। তাই কিছু বলি
না। আমার নাম খারাপ হবে। রামরাজাতলা বাজারে,
সবজি
নিয়ে বসলে, বেচাকেনা ভাল হয় না। ঘুরে
ঘুরে বেচলে, ব্যবসা একটু ভাল হয়।
সে তুই যা ভাল মনে
করিস। তবে চুরি আমি দু’-চক্ষে দেখতে পারি
না। তাছাড়া, তোর ক্ষতিও তো হচ্ছে। মিশমি
বাড়ি ঢুকে যায়। অতুল আর নন্দীপাড়ায় আসে না। মিশমি অতুলের কথা ভাবে। তবে অতুলের
খবর নেওয়ার কোন উপায় নেই বলে, মনের উদ্বেগ মনেই
থেকে যায়। অতুলের বদলে, নতুন দু’-তিন জন ফেরিওয়ালা সবজি নিয়ে নন্দীপাড়ায় ঢুকতে শুরু করে।
তারা খুব চৌকস। তাদের চোখে ফাঁকি দিয়ে সবজি চুরি প্রায় অসম্ভব। মানসীর হাতসাফাই
বন্ধ হয়ে যায়। যদিও অতুলের আসা বন্ধ হওয়াতে,
মিশমিরও
আর মানসীকে লক্ষ্য করতে ইচ্ছে করত না।
মিশমিদের
ছোট পরিবার। মেসো বড়-বাজারে একটা পাইকারি দোকানে কাজ করে। ফিরতে রাত হয়। ট্রেন
থেকে নেমে, রেললাইনের ধারে, চোলাইয়ের ঠেকে গলা না ভেজালে চলে না। মাসি মেনে নিয়েছে। আগে
প্রতিবাদ করত। এখন আর কিছ বলে না।
এটা ছাড়া, কেশবের আর কোন দোষ
নেই। উল্টে সে বেশ মিশুকে। পরোপকারীও বটে। আম্ফানে, সেনবাবুদের বাগানের আমগাছ ভেঙে গোটা পাড়া অন্ধকারে ডুবে গেছিল। তখন
সাপ্লাইয়ের বাবুদের ঘেরাও করা থেকে, থানায় বারবার যাওয়া, কেশব এক ডাকে হাজির। মেসোর সাথে মিশমিও সে সময়, পাড়ায় খুব মিশেছে। যেসব বাড়ির সঙ্গে পরিচয় বিশেষ ছিল না
তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।
এর মধ্যে, আর একদিন মিশমির চোখে মানসীর চুরি ধরা পড়ে। সেনবাবুদের
বাগানের পরে, দোতলা একটা বাড়িতে দুটো তলা
মিলিয়ে মোট চারটে ফ্ল্যাট। চারটে ফ্ল্যাটেই ভাড়াটে থাকে। একতলার বাঁ দিকের
ফ্ল্যাটে বিমলবাবু থাকেন। ভদ্রলোক আলঝাইমারে ভুগছেন। কথা বিশেষ মনে রাখতে পারেন
না। দুই মেয়ে বিবাহিত। ছোট মেয়ের শ্বশুরবাড়ি, পাশের পাড়ায়। বড় মেয়ে কলকাতায় থাকে। ছোট মেয়ে বাবা-মায়ের দেখাশোনা করে।
বিমলবাবুর স্ত্রীরও ভালোই বয়স। রান্না করতে কষ্ট হয়। ছোট মেয়ে হোম সার্ভিসে
মাসকাবারি ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মাসের শেষে এক লপ্তে খাবারের দাম মিটিয়ে দেয়।
লকডাউন থেকে হোম
সার্ভিসের ব্যবসা বেড়েছে। নন্দীপাড়ার অনেক বাড়িতে দু’-বেলা খাবার নেওয়া শুরু করেছিল। তাদের অনেকে এখনও খাবার
নেয়। বিমলবাবুর ফ্ল্যাটের উল্টো দিকে,
অনুপমাদের
বাড়িতেও গণেশ হোম সার্ভিস থেকে খাবার আসে। অনুপমা একমাত্র মেয়ে। বিয়ের পরে
হিন্দমোটরে শ্বশুরবাড়িতে থাকে।
বিমলবাবুদের ভাড়া বাড়ি, কোমর সমান একটা মোটা পাঁচিল দিয়ে রাস্তা থেকে আলাদা। ফেরিওয়ালা থেকে শুরু করে, অনেকেই প্রয়োজনে,
পাঁচিলের
ওপরে বসে বা জিনিসপত্র রাখে। বিমলবাবুকে খাবার দিয়ে, হোম সার্ভিসের ছেলেটা, পাঁচিলের ওপর স্টীলের
তৈরি খালি ফুড কন্টেনার সেট রেখে, অনুপমাদের বাড়িতে
ঢুকেছে।
সেটের ওপরের ছোট বাটিতে কিছু টাকাও ছিল। মানসী নিশ্চয় আগে
থেকে সব লক্ষ্য করেছে। মিশমি, চান করে বেরিয়ে
ব্যালকনিতে জামাকাপড় মিলছিল। চোখে পড়েছিল,
মানসী
বাড়ির গেট থেকে হোম সার্ভিসের ছেলেটাকে লক্ষ্য রাখছে। যা ভেবেছিল ঠিক তাই হল।
ছেলেটা, অনুপমাদের বাড়িতে ঢুকে
যাওয়ার পরে, মানসী বিদ্যুৎ গতিতে বেরিয়ে
এলো বাড়ি থেকে। তারপর এদিক-ওদিক দেখে,
চিলের
মত ছোঁ মেরে পাঁচিলের ওপর থেকে কন্টেনার সেট তুলে নিয়ে বাড়ির ভিতরে ধাঁ। সব দেখে
মিশমি তো অবাক। অস্ফূটে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো। বাপরে, এসব কি!
থাকতে না পেরে,
মিশমি
শর্মিলা মাসিকে ভিতর থেকে ডেকে নিয়ে এলো। হোম সার্ভিসের ছেলেটা ততক্ষণে চিৎকার
জুড়ে দিয়েছে। মানসীও বেরিয়ে এসেছে। আর পাঁচজনের সঙ্গে সেও গলা মিলিয়েছে। দিব্যি
বলছে, এসব কি হচ্ছে? পাড়াটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। এমন
তো আগে কোন দিন হয়নি।
মিশমি আর শর্মিলা,
অবাক
বিষ্ময়ে, সে দৃশ্যও দু’-চোখ ভরে দেখল। মিশমির সহ্য হচ্ছিল না। কিছু বলতে যাচ্ছিল।
শর্মিলা পাশ থেকে হাত ধরে টেনে বাধা দিল। তুই কিচ্ছু বলবি না। খুব সেন্সিটিভ
ইস্যু। কোথা থেকে কি হয়ে যাবে! থাক, কোন দরকার নেই।
একদিন দুধ কিনে ফেরার সময়, বড় রাস্তার মুখে, মানসীর সঙ্গে দেখা।
মিশমি আর থাকতে পারেনি। মুখ খুলে বলে ফেলেছে
আচ্ছা, পিসি, তোমার স্বামী তো
ট্রেনের হকার ছিল। সেও এক ফেরিওয়ালা। ফেরিওয়ালার স্ত্রী হয়ে আর এক ফেরিওয়ালার
জিনিস চুরি করতে, লজ্জা করল না!
মানসী, মিশমিকে দেখে হাসতে
শুরু করেছিল। মিশমির কথা শেষ হওয়ার আগে,
মানসীর
পিছনে, নন্দীপাড়ার ভিতর থেকে পুরানো
খবরের কাগজ, বই-খাতার এক ফেরিওয়ালা ‘কাগ--জ, খাতা-বই-কাগ--জ’ বলতে বলতে বেরিয়ে
এলো। ওদিকে মিশমির পিছনে, মেসো হাজির। মর্নিং
ওয়াক সেরে ফিরছে। সব মিলিয়ে এমন পরিস্থিতি হল, মিশমি আর কিছু বলার জায়গায় থাকল না। মনের রাগ মনে পুষে, মেসোর পিছন ধরে হেঁটে বাড়ি ফিরল।
সেই থেকে মানসী,
আর
মিশমির মুখ দেখে না। রাস্তায় দেখা হলে,
মুখ
নামিয়ে নেয়। প্রায় মাস তিনেক পরে, অতুল আবার
নন্দীপাড়ায় দেখা দিল। এর মধ্যে তার অনেক উন্নতি হয়েছে। আগের মত আর ময়লা জামাকাপড়
পরে না। গায়ে হাফ-হাতা শার্ট, পরনে ঢোলা ট্রাউজার।
সবজির ট্রলির বদলে চৌকো বাক্সের মত রেলিঙ দেওয়া সাইকেল ট্রলি ভর্তি স্টীল আর
অ্যালুমিনিয়ামের বাসন নিয়ে ফেরি করতে বেরিয়েছে।
মিশমি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে, অতুলকে দেখে অবাক। শর্মিলা মাসিকে রান্নাঘর থেকে ডেকে নিয়ে
দেখাল। অতুলের মুখে আর আগের মত ‘বাজার’, ‘বাজার’ ডাক নেই। তার বদলে হাঁকছে ‘বাস--ন, পুরানো বা--ন’। নন্দীপাড়ার মানুষ
আগে থেকে চিনত অতুলকে। এত দিন পরে দেখতে পেয়ে ঘিরে ধরল তাকে। বাসন মেয়েদের পছন্দের
জিনিস। তার ওপর, পুরানো জামাকাপড় আর
চুলের বদলে বাসন বেচছিল অতুল। দেখতে দেখতে জমে উঠল ব্যবসা।
এক সময়, অতুল মিশমিদের বাড়ির
নীচে এসে দাঁড়ালো। মিশমিকে দেখে হেসে বলল, কিগো, বাসন নেবে না?
মিশমি জানতে
চাইল, কিরে, এত দিন কোথায় ছিলি? মানসীর জন্য সবজি
বেচা ছেড়ে দিলি নাকি?
অতুল
ঠোঁটে আঙুল দিয়ে মিশমিকে চুপ করতে বলে।
শর্মিলাও বারণ করে। কী দরকার? আবার কেন পুরানো কাসুন্দি
ঘাঁটছিস?
মিশমি মজার ছলে বলে, তোকে বেশ চকচকে
দেখাচ্ছে। কি ব্যাপার রে?
অতুল উত্তর দেয়, এখন আর মহাজনের থেকে ধার নিয়ে
ব্যবসা করি না। এই সাইকেল ট্রলি, বাসন সব নিজের পয়সায়
কেনা। যা লাভ হয়, সব ঘরে থাকে।
বাহ, বেশ তো উন্নতি করেছিস।
অতুল আর কথা বলার সুযোগ পায় না। খদ্দের এসে যায়। বাসনের দর
জানতে চায়। তাদের সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মিশমি ঘরে ঢুকে যায়। তার মন পড়ে থাকে
রাস্তায়। থেকে থেকে অতুলের গলা শোনা যায়। ড্রেসিঙ টেবিলের আয়নার সামনে গিয়ে থমকে
দাঁড়ায় মিশমি।
প্রশ্ন করে নিজেকে। মনের মধ্যে কেন এমন হচ্ছে? কি সম্পর্ক তার সঙ্গে
অতুলের? নিছক দোকানদার-খদ্দের ছাড়া
তো আর কিছুই নয়। সবজি রোজ দরকার হয়। সেই সুযোগে দেখা হয়। কথা বলার সুযোগ থাকে।
বাসন তো রোজ লাগে না। কেনার দরকার কম থাকে বলে কথা আর দেখা হওয়ার সুযোগও কম থাকে।
সে কি তাহলে অতুলকে মিস করছে?
এক সময়
মিলিয়ে যায় অতুলের গলার স্বর। মিশমি বাড়ির কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করে। দিন, মাস, বছর কাটে। অতুল আবার
উধাও হয়। নন্দীপাড়ার রাস্তায় অতুলের মত কেউ আর ‘বাস--ন, পুরানো বা--ন’ ডাকে না। শর্মিলার কপাল
পোড়ে। মিশমির মেসোর মৃত্যু হয় লিভারের অসুখে। সস্তার চোলাই ভালোবাসার প্রতিদান
দেয়। মিশমি সংসারের জাঁতাকলে বেশি করে জুড়ে যায়।
পেটের খিদে বড় বালাই। তার জন্য অনেক কিছু ছাড়তে হয়।
মিশমির খুব ইচ্ছে ছিল সরকারি চাকরি করবে। সে ইচ্ছে জলাঞ্জলি দিয়ে, নামতে হল চটজলদি রোজগারে। পড়াশোনায় ভাল ছিল, কপাল জোরে জুটে যায় কয়েক বাড়ি টিউশন। মেসো কিছুই রেখে
যায়নি। উল্টে লোকের কাছে ধার রেখে গেছে। শর্মিলা মাসি হঠাৎ করে বুড়িয়ে গেছে। কথা
বলে কম। কিছু বললে, শূন্য দৃষ্টিতে
তাকিয়ে থাকে। মিশমি ভয় পায়। মাসি চলে গেলে,
তার যে
নিজের বলে আর কেউ থাকবে না। সেই কোন ছোটবেলায়, মাসির সংসারে থাকতে শুরু করেছিল। বাবা-মা, ছ’-মাসের আগে-পিছে, মারা যাওয়ার পরে,
মাসিই
ছিল একমাত্র আশ্রয়।
টিউশন, দোকান-বাজার আর সংসারের
কাজের স্তূপের নীচে চাপা পড়ে, মিশমি কখন যেন
সম্পূর্ণ বদলে যায়। সখ-আহ্লাদ দূরের কথা,
সে যে
এক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব, সেটাও কখন যেন চলে
যায় অন্তরালে। নিজস্ব বলে কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। একদিন রাস্তায় সাইকেল রেখে, ব্যাগ আর ফর্দ নিয়ে নীলমণির মুদির দোকানে, ঢুকতে গিয়ে শুনতে পায় মানসী পিসির গলা। নীলমণি দেখেছে, মানসী একটা হলুদ আর একটা চানাচুরের প্যাকেট, ব্যাগে ঢুকিয়েছে। সে কথা বলাতে, নীলমণির ওপরে চোটপাট করছে। নীলমণি ব্যাগ দেখাতে বলতে, মানসী গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করছে। বলছে, তুই মুদির দোকানি।
কাকে কি বলতে হয়, জানিস না। আমি কি চোর?
সব শুনে মানসী আর চুপ থাকতে পারে না। পুরানো স্মৃতি আর
ন্যায়-নীতি বোধ মুহূর্তের মধ্যে ঝলসে ওঠে মাথার মধ্যে। বলে ওঠে, পিসি, তোমার কিন্তু এরকম স্বভাব আছে। আমি নিজে দেখেছি, তুমি অতুলের ভ্যান থেকে সবজি চুরি করেছিলে।
বাস আর যায় কোথায়। গরম কড়ায়, তেল পড়ল। মানসী হাত তুলে মারতে যায় মিশমিকে। দোকানে আরও দু’-তিন জন খদ্দের দাঁড়িয়ে, এতক্ষণ সব দেখছিল। তারা এবার মানসীর আক্রমণ থেকে মিশমিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে।
মানসী কিন্তু থামে না। সমানে চলতে থাকে তড়পানি। মা-মাসি উদ্ধার করে নেমে আসে
অতুলের প্রসঙ্গে। বলে, অতুল তোর কে হয়? ভাতার? আসছে না, দেখা হচ্ছে না বলে,
বুক
ফেটে যাচ্ছে? কত কি দেখব? দরদ উথলে উঠছে! দেখ
গিয়ে, তোর প্রাণের অতুল এখন জেলে।
মেয়ে পাচারের অভিযোগে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। বিশ্বাস না হয়, যা টিভি খুলে দেখগে যা।
জোঁকের
মুখে যেন নুন পড়ল। মিশমি মুহূর্তের মধ্যে ঠাণ্ডা। কি বলছে মানসী? এসব কি সত্যি না কি
বানিয়ে বলছে। মিশমি হাতের ফর্দ, নীলমণির হাতে গুঁজে
দিয়ে বলল, তুমি সব দিয়ে রাখ। আমি পরে এসে নিয়ে যাব। একটা কাজ আছে। আমি
আসছি।
বাড়িতে ঢুকে, হ্যাণ্ডব্যাগ, ছাতা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে, টিভি অন করে, রিমোটে চ্যানেল বদলে
নিউজ চ্যানেল খুলল। বিজ্ঞাপনের বিরতির পর শুরু হল বিতর্ক সভা। মিশমি এক দৃষ্টিতে
তাকিয়ে থাকল পর্দার নীচে স্ক্রল করে চলে যাওয়া খবরের দিকে। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচটা খবর চলে
যাওয়ার পরে এলো সেই খবর: ‘রাজ্য পুলিশের জালে নারী পাচারকারী –
হাওড়ার
এক গোপন আড্ডা থেকে দশ জন মহিলা সহ গ্রেপ্তার মূল অভিযুক্ত অতুল সামন্ত – পুলিশের ধারণা ফেরিওয়ালার রূপ ধরে অভিযুক্ত অতুল হাওড়ার
বিভিন্ন এলাকা থেকে মেয়েদের ফুঁসলিয়ে পাচার করত – পুলিশ এই চক্রের গোড়ায় পৌঁছতে আরও কিছু ব্যক্তিকে সন্দেহজনক তালিকায় রেখেছে - ’
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না মিশমির। মনে পড়ছে
পুরানো এক স্মৃতি। অতুল একদিন বলেছিল, চল পালিয়ে গিয়ে সংসার পাতি। কি মাসির সংসারে
পড়ে আছ দিনের পর দিন?
মজা
মনে করে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল মিশমি। বুক নিংড়ে একটা কষ্ট বেরিয়ে আসতে চাইছে।
মানুষ চিনতে এত ভুল করল মিশমি!
ভাগ্যিস তার মানসী
পিসি চোর।
সম্পাদকীয় টীকা: লেখকের আনুমতিক্রমে গল্পের নাম ‘ফেরিওয়ালা’র পরিবর্তে ‘চোর’ করা হয়েছে। আর শেষে ‘ভাগ্যিস তার মানসী পিসি চোর’ বাক্যটি সংযুক্ত
করা হয়েছে। অন্যান্য সম্পাদনা নিয়মমাফিক।