আসাতেই ফেরা

 

আসাতেই ফেরা

পৌষালী

 

বিকেলের রঙটা যেন সবসময়ই একটু অন্যরকমের হয় সবার যেন ফেরার তাড়া থাকে মেঘেদের দলগুলোও যেন এদিক ওদিক সারাদিনের ঘোরাঘুরি শেষে আকাশের বুকে ফিরতে চায় পাখিদেরও সারাদিন ডালে ডালে উড়ে উড়ে শেষে নীড়ে ফেরার তাগিদ রাখাল বালকও গরুগুলো নিয়ে ঘরে ফেরায় মত্ত সূর্যও যেন ঝুপ করে ডুবে যাবে আবার পরের দিন নতুনকরে আসার জন্য একমাত্র শুধু প্রান্তরেরই ফেরার কোনো তাড়া নেই সারাটা দিনই বারান্দায় কেটে যায় সবুজের চারপাশে এই বিকেলের সময়টাই যা একটু সামনের পার্কে এসে হাঁটাহাঁটি করে, কখনো বসে বসে বাচ্চাদের খেলা দ্যাখে যখন ইচ্ছে হয় ওর তখনই ঘরে ফেরে ওর যে ফেরার কোনো তাড়া নেই ওর ঘর আছে কিন্তু ঘরে অপেক্ষা করার মতো কেউ নেই শুন্য ঘরে কলরব নেই, চুড়ির আওয়াজ নেই, অপেক্ষার গন্ধ নেই, দায়িত্বের ঝোলা ব্যাগ হাতে ধরিয়ে দেওয়ার মতো কেউই নেই তাই প্রান্তরের যখন ইচ্ছে হয় ঢিমে তালে নিঃশব্দ পায়ে ঘরে ফেরে ফিরেই তো ওই মুড়ি কচকচানি আর রোজের রুটিনের শশা যদিও রুটিন একদমই প্রান্তরের কোনকালেই পছন্দ ছিল না কখনো কোনো বাঁধা ছকের মধ্যে নিজেকে বেঁধে রাখেনি  কিন্তু এখন এই ধূসর বিকেলের শুকিয়ে যাওয়া নদীতে শরীর আর আগের মতো ভাসতে, ডুবতেও চায়না পাড়ে বসে শুধুই শেষ রজনীর জন্য এক দামি অপেক্ষা করা ছাড়া আর কি' বা আছে শরীরের জন্যই এখন এই রুটিনের দ্বারস্থ হতে হয়েছে ওকে না হলে তো নিজের শরীরকে নিজেকেই টেনে টেনে দেখতে হবে সন্ধ্যের দিকে স্টার আনন্দে সারা বিশ্বের খবর গেলা আর ঠিক রাত নটা হলেই ডাক্তারের রুটিন মতো গলাধঃকরণ করা  রান্নার মেয়েটা দুটো যা পদ রান্না করে ওই কোনোরকমে খেয়ে নেয় কোনোরকমে দিনটা কাটিয়ে নেওয়া নিয়ে কথা কোনদিনও বেশি কিছু চাওয়া ছিলনা অল্পেতেই হাসিখুশি থাকার ছেলে প্রান্তর এখন রাতের বেলা খাবার পর বারান্দায় পায়চারি করে একটু সবুজের গন্ধ নেয় চাঁদটা ঠিক প্রান্তরের বারান্দাতেই আলোটা ফেলে ওই চাঁদের আলোটা প্রান্তরের খুবই মন ভালো রাখার জায়গা ওই চাঁদের এক কণা আলোতেই তো তৃণাঞ্জনার মুখটা দেখতে পায় সেই তৃণাঞ্জনা...     

         সারাটা দিন, রাত বড়ই একঘয়েমি করেই কেটে যায় প্রান্তরের রিটায়ার করেছে সাত বছর হল রিটায়ারের আগেও একাই কাটিয়েছে পুরো জীবনটা কখনোই কারোরই সাহচর্য পায়নি আর পাবেই বা কি করে ! তো জেনেশুনে বুঝেই এই একাকী নিঃসঙ্গ জীবন বেছে নিয়েছে কাউকেই জড়াবেনা নিজের জীবনের মুহূর্তের সঙ্গে ঠিক করেই নিয়েছিল

         বিশ্বভারতীতে এম..- ফাইনাল ইয়ারের সময় তৃণাঞ্জনা ওর হাতে বিয়ের কার্ডটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, সামনের মাসে আমার বিয়ে সব কাছের বন্ধুদের একমাস আগে থেকেই বলছি বিয়ের দশদিন আগে গুরু বডি ফেলে দিস কিন্তু কাজ করতে হবে আমার বিয়ে বলে কথা তৃণাঞ্জনা এরকমই ময়ূরাক্ষীর জলের মতো স্বচ্ছ যাকে অন্তরে বাইরে পুরোটা পড়া যায় কোনো রাখ ঢাক নেই ভীষণ সাবলীল কথাবার্তা সরল, সহজ মনের মানুষ ওর কাছে বন্ধুত্বের সংজ্ঞা পুরো আলাদা ছিল বিপদের সময় যে পাশে এসে হাতটা শক্ত করে ধরবে, যে নিজে দোষ না করেও বন্ধুর দোষটা নিজের ঘাড়ে নিয়ে বন্ধুকে বাঁচিয়ে দেবে সেই নাকি আসল প্রিয় বন্ধু সুখের সময় যারা থাকে তারা বন্ধু নয় তারা নাকি সুবিধা ভোগী হয় প্রান্তরই নাকি ওর একমাত্র প্রিয় বন্ধু আর বাকিরা সবাই সুবিধা ভোগী   ভালো করে বুঝে গেছে প্রান্তর নাকি নিঃস্বার্থ ভাবে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব যাপন করে অথচ বোকা মেয়েটা প্রান্তরের মনের জমিটা দেখল না কখনো সেই কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের প্ৰথম দিন থেকেই তৃণাঞ্জনাকে দেখেই ওর জমিতে ভালোবাসার চারাগাছ পুঁতেছে তৃণাঞ্জনা কলেজের প্ৰথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত ওকে একজন যথার্থ প্রকৃত বন্ধু বলেই ভেবে গেল যাকে সব কিছু শেয়ার করা যায়, যার কাছে আব্দার করা যায়, যে ওর সবরকম পাগলামো সহ্য করবে, সারাবছর কলেজে ঠিকঠাক ক্লাস না করেও নিশ্চিন্তে নামের রেজিস্টারে ওর নামটা থেকে যাবে, ক্লাসের সব নোটশ থাকবে ওর হাতের মুঠোয় কিন্তু তার বাইরে কি একজন প্রকৃত বন্ধু পাগলের মতো ভালোবাসতে পারে না? বন্ধুর বাইরে আর একটু কি অন্য ভাবে ভাবতে পারে না?সারাটা জীবন শুধুই বন্ধুত্বের তকমা গায়ে লাগিয়েই থাকবে? সত্যি তৃণাঞ্জনা কখনোই বুঝতে পারেনি প্রান্তরের রোদেলা অনুভূতির কথা, না হলে হঠাৎ করেই হাসতে হাসতে বিয়ের কার্ডটা হাতে ধরিয়ে দিত না তৃণাঞ্জনার বিয়ে হয়ে গেল প্রান্তরেরও জীবনের থেকে সমস্ত চাওয়া পাওয়া সব বন্ধ হয়ে গেল এম. . পাশ করার পর বেনারসে হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়ে চলে এল বেনারসেই জীবনের বাকি সবুজ অধ্যায় এক্কেবারে একা কাটিয়ে দিয়েছে আজ এই গোধূলিতে পুরো একাকী নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছে তৃণাঞ্জনার স্মৃতি নিয়ে কাউকেই তৃণাঞ্জনার সঙ্গে ভাগ করতে পারবে না বলে তাই আর কাউকেই জীবনে আনেনি সাতষট্টি বছর বয়স হয়ে গেল, সেই কোন আঠেরো বছর বয়সে কলেজের প্ৰথম দিন থেকেই মনে ধরে রেখে দিয়েছে তৃণাঞ্জনাকে আজও মন থেকে ছাড়তে পারেনি

           রবিবার করে বেনারসে দশাশ্বমেধ ঘাটে গিয়ে বসে থাকে আগের রবিবার যাওয়া হয়নি পায়ে টান ধরেছিল বলে আজ রবিবার ঠিকই করে নিয়েছে একটুক্ষণের জন্য হলেও যাবে দশাশ্বমেধ ঘাটে প্রচুর লোক থাকে আজ যেন একটু কম মনে হচ্ছে প্রান্তর আস্তে আস্তে ধীর গতিতে ঘাটের এক একটা সিঁড়ি নামছে হঠাৎ পা থমকে গেছে দূরে একজন বসে আছে, খুব চেনা লাগছে পিছন দিক থেকে কে বসে আছে!!

 

কাছে গিয়েই চমকেছে বুকে যেন চোরা হিমস্রোত বয়ে গেল তৃণাঞ্জনা বসে আছে জড়োসড়ো হয়ে পাশে লাঠি, চশমা রাখা খালি চোখে সূর্যাস্তের আবেশ চোখে মুখে মেখে নিচ্ছে  প্রান্তর নিজের বাঁদিকের বুকে হাতটা চেপে পিছন থেকে খুব মিহি স্বরে ডাকল, তৃণাঞ্জনা...

তৃণাঞ্জনা পিছন ফিরে ফিকে হয়ে যাওয়া ধূসর চোখে তাকিয়ে দেখছে প্রান্তরের দিকে এই অবেলায় অসময়ে ফেলে আসা সবুজদিনের স্মৃতি আঁকড়ে দুজন দুজনকে নিয়ে পুরো সন্ধ্যেটা দশাশ্বমেধের ঘাটেই কাটিয়ে দিল তৃণাঞ্জনা কাছেই একটা বৃদ্ধাশ্রমে থাকে বছর খানেক হল স্বামী পাততাড়ি গুটিয়ে পরপারে রওনা দিয়েছেএকমাত্র ছেলে বিদেশে থাকে তাই এই শেষের শেষ মুহূর্তটা বৃদ্ধাশ্রমে কাটানোর জন্যই এখানে আসা সাতষট্টি বছর বয়সের দুই প্রিয় বন্ধু আবার সেই হলুদ বসন্তের আঠেরো উনিশ বছরকে যেন গায়ে মেখে নিচ্ছে

বৃদ্ধাশ্রমের পাশেই একটা স্কুল করেছে তৃণাঞ্জনা সেখানে সেইসব ছেলে মেয়েরা পড়ে যারা দেখতে শুনতে বলতে পারেনা তৃণাঞ্জনা ওখানেই দিনের বেশির ভাগ সময়টা কাটায় প্রান্তরকে নিয়েও যায় এখন দুজনে মিলে সারাক্ষণ ওই প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটায় বাচ্চারা বলতে পারে না, শুনতে পারেনা, দেখতেও পায়না কিন্তু তৃণাঞ্জনার স্পর্শ ওরা খুব চেনে তৃণাঞ্জনা এলেই ওরা ছটফটিয়ে ওঠে যতক্ষণ থাকে ওদের সঙ্গে ওরা খুব খুশি থাকে তৃণাঞ্জনা যেন ওই অসহায় বাচ্চাদের একান্তই প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেছে আর এখন প্রান্তরও বাচ্চাদের সঙ্গ দেয়

বেশ কিছুদিন পর প্রান্তর সিদ্ধান্ত নেয় ওর বাড়ি ছেড়ে  তৃণাঞ্জনার সঙ্গে বৃদ্ধাশ্রমে থাকবে একসঙ্গে ওরা ওই বাচ্চাদের আলো হয়ে থাকবে  শেষ রজনীকে ছোঁয়ার মুহূর্তের আগে একবারের জন্য হলেও তৃণাঞ্জনাকে বলবে নিজের মনের কথা এবার অন্তত লাস্ট রাউন্ডে প্রিয় বন্ধুর লেভেল থেকে বের হবে একজন দোসর হবে তৃণাঞ্জনার সব ঠিক হয়ে গেছে আসছে রবিবার বৃদ্ধাশ্রমে শিফট করবে প্রান্তর এই সপ্তাহটা গোছাগুছি করেই কেটে গেল বাড়িটারও একটা হিল্লে করতে হল সময় যে বড়ই অল্প যেটুকু সময় পাওয়া যাচ্ছে আরেকবার নতুন করে জীবনের খেলাঘর একটু বাঁধুক স্বপ্নে বাঁচুক

          কিন্তু অস্তরাগের সঙ্গে যে সূর্যোদয়কে মেশানো যায়না কখনোই সূর্য আর চাঁদের যে বনিবনা হয়না সূর্য গেলেই তবেই চাঁদের আগমন যে আবার, চাঁদ আসবে বলেই হয়ত সূর্যের যাওয়ার একটা তাড়া থাকে কখনোই দুজনে এক হয়না হল না প্রান্তরের খেলাঘর খেলা সাতষট্টি' আর মিঠে রোদেলা আঠেরো'কে মাখা হল না

সব গুছিয়ে ব্যাগ নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে এল রবিবার সকাল সকাল এক বুক সবুজ স্বপ্ন নিয়ে এসেই দ্যাখে আশ্রমের গেটে ভিড় কিছু বুঝতে না পেরে এগিয়ে যায় এগিয়ে গিয়ে দ্যাখে আশ্রমের চাতালে খুব সুন্দর করে তৃণাঞ্জনাকে সাজানো হয়েছে শেষ যাত্রার জন্য ভোর চারটের সময় হার্ট ফেল করেছে কাউকেই একটুও সুযোগ দেয়নি কি বলবে প্রান্তর যাওয়ার সময় একবারো তৃণাঞ্জনা জানান দিল না! এভাবে না বলে চলে গেল? এবারেও বলা হল না প্রান্তরের সেই কথাটা যা কতবছর আগে বলেও বলতে পারেনি! প্রান্তরের গোটা একটা জীবন তৃণাঞ্জনার নামেই তো করে দিয়েছিল আজ এই অবেলায় ওকে পেয়ে ভেবেছিল যে কটা দিন থাকবে তৃণাঞ্জনার প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গে যাপন করবে যাপন করা আর হল না তৃণাঞ্জনাকে এবার নিয়ে যেতে হবে ওর শেষ ঠিকানায় সাতষট্টির কাঁধ এত হাল্কা লাগছে কেন? তৃণাঞ্জনাকে কেন ভার লাগছে না? হয়ত একেবারেই সব ভার নিয়েই চলে যাচ্ছে মুখাগ্নিটা প্রান্তরই করল মুখে আগুন দেওয়ার সময় তৃণাঞ্জনার ঠোঁটে যেন এক চিলতে প্রশান্তির হাসি আগুনের ছোঁয়া যেন যোগ্য হাতেই পড়েছে প্রান্তর কি আরো একবার প্রিয় বন্ধুর সংজ্ঞাটা বুঝিয়ে দিল যে প্ৰথম থেকে কিচ্ছুটি না চেয়ে শুধু দিয়েই গেছে মন প্রাণ ঢেলে দু'হাত ভরে কথায় বলে, শেষ যাত্রায় সাথে যে সাত পা চলে সে নাকি আসল বন্ধু হয় প্রান্তর তো ওর সারাটা জীবনের পথে তৃণাঞ্জনার ছায়াই রেখেছিল আজ আবার নতুন করে আরো একবার প্রান্তর একা নিঃস্ব রিক্ত হয়ে গেল আর কি জন্য বাঁচা?  কিসের জন্য বাঁচা?  সেই তো নেই

যাওয়ার মাঝে কিছু কি মানুষ রেখে যায়না?কিছু কি চিহ্ন ফেলে যায় না? একটা রেশ তো রয়েই যায় ধূপ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তার গন্ধ অনেকক্ষণ থেকে যায় মানুষ চলে যায় কিন্তু তার কাজের মধ্যে সে থেকে যায় মনের চাদরে লেগে থাকে কাজের গন্ধ হয়ে ঠিক তৃণাঞ্জনারও যেমন ওই প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের স্কুল যা ওর একান্ত স্বপ্ন, আশা বাঁচার জায়গা ছিল প্রান্তর আজ তৃণাঞ্জনার জায়গা নিয়েছে প্রান্তর এখন ওই বাচ্চাদের প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেছে এখন ওই অবোধ শিশুগুলো প্রান্তরের স্পর্শে তৃণাঞ্জনাকে খুঁজে পায় ওরা প্রান্তরকে দেখলেই সেই খুশি খুশি মুখে থাকে

প্রিয়জন বড় আপন হয় মনের মানুষ বড্ড যত্নের হয় অন্তরের অন্তর থেকে ভালোবাসলে তার না থাকায়ও তাকে পাগলের মতো ভালোবাসা যায় তার অনুপস্থিতিতেও তাকে নিবিড় ভাবে অনুভব করা যায় সে তো মনের মধ্যেই গেঁথে থাকে তখন ওই স্থূল দেহের কোনই ফ্যাক্টর করেনা দুধের মধ্যে যেমন সর লেগে থাকে ঠিক তেমনি ভাবেই  সূক্ষ্ম দেহে সে লেগে থাকে

সময় সময়েরই মত বয়ে যাবে সময়ের ক্যানভাসে নানান রঙ বদলাবে কত অজানা অচেনা মুহূর্তের আনাগোনা হবে কিন্তু অনুভূতি সে বড়ই বাধ্য, অনুগত, একনিষ্ঠ এভাবেও থেকে যাওয়া যায় রাখা যায় আলতো করে মনের উঠোনে

 

গল্পের শেষটা মিলনান্তক হতেও পারত কিন্তু সব মিলনই যে কাছে,পাশে পাওয়া হবে তা তো নয় কাছে থাকলেই কি আদৌ কাছে থাকা হয় ! হাওয়াকে, রোদকে তো ছোঁয়া যায়না কাছেও রাখা যায়না কিন্তু তাও তো হাওয়ার পরশ পাওয়া যায় রোদের তাপ গায়ে মাখা যায় মিহি সম্পর্কে ভালোবাসারও তাপ, উষ্ণতা লেগে থাকে...

 

 

Post a Comment

Previous Post Next Post