ছোটগল্প
কাগজের কাকাতুয়া
অলভ্য ঘোষ
-- থাক আপনি মিষ্টি খাবেন।
ছিপছিপে ছোকরাটি একগাল হাসে।
-- চাকরি পাওয়া মানে ভগবান লাভ। কি বলেন দাদা?
-- হ্যাঁ দাদা অনেক কষ্ট করেছি; এবার---------
উচ্ছ্বাসে গলার স্বর আটকিয়ে আসছিল; চোখ ভিজে যাচ্ছিল।
হাত মুঠো করে সৌরভের মত শূন্যে আস্ফালন করার ইচ্ছে হচ্ছিল রথীনের।নিজেকে সংবরণ করে
বাড়ি ফিরেছিল।বাড়িতে তখন খুশির হাট, ঘরে ঢোকার সাথে সাথে মুখে একটা রসগোল্লা ভরে
দিয়েছিল রথীনের বোন। হাসতে গিয়ে রসগোল্লা গলায় আটকে বিষম খেয়েছিল রথীন।এরপর
পাড়ায় মিষ্টি বিতরণের পালা,শুভঙ্করদের বাড়ি যখন মিষ্টির বাটি হাতে নিয়ে
ঢুকেছিল,শুভ তখন বিছানায় শুয়ে তার নতুন গল্পের খসড়া লিখছিল।বেশ কয়েকটা ছেড়া
পাতা বিছানার ওপর এদিক সেদিক ছিটানো ছিল। রথীন ঘরে ঢুকেছিল ঠিক সেই সময় ঘরে
দ্বিতীয় ব্যক্তির অবস্থান অনুভব করে শুভ ঘুরে তাকিয়েছিল।
-- কখন এলি!
-- এইতো!
-- হাতে ওটা কি?
-- মিষ্টি! চাকরিটা শেষ অবধি হল শুভদা!
একটা ভুল বানানে হিজিবিজি কাটতে কাটতে শুভ বলেছিল--- ভেরি গুড! তাহলে মাস্টার মশাই আপনারা এখন গুরু দায়িত্ব।মানুষ গড়ার কারিগর মুখের কথা নয়-
মিষ্টির বাটি টা বিছানার উপর রেখে রথীন ঝপ করে তার
পাশেই বসে পড়েছিল।শুভ বাটি থেকে একটা রসগোল্লা টপ করে মুখে তুলে নিয়েছিল। আঙুলে
লেগে থাকা রস চাটছিল সে।
-- আচ্ছা হেঁয়ালি ছাড়া তুমি কি কথা বলতে পারো না।তুমি
কি ভাবো এই ভাল ভাল কথা বললেই তোমার কবি কবি ইমেজটা বজায় থাকে।
শুভ হেসেছিল-- থাকে না বুঝি? কি করবো কথা তো আর বলে কয়ে মুখ থেকে বেড়ায় না। আমার নতুন গল্পটা পড়েছিস ?
-- এই সব ছাইপাঁশ পড়ার সময় আমার নেই।
-- পড় পড় নতুন দিগন্ত পাবি।
-- ছাড় তোমার দিগন্ত।কিছু গালভরা কথা-পাতার পর পাতা
নিজেকে জাহির করে চলেছ।
-- জাহির করার মতো কোন এলিমেন্ট আমার আছে বলে তোর মনে
হয়।
-- মানুষের যখন সবকিছু হারিয়ে যায় নিজেকে নায়ক করে
তুলে ধরে সম্মোহিত হয়। আত্ম-ত্রাণ; স্বস্তি খোঁজে।
-- এই যে, তুই তোর উচ্ছ্বাস প্রদর্শন করছিস মিষ্টিতে;
ঠিক এমনটাই?
আর একটা রসগোল্লা মুখে পুরেছিল শুভ।
রথীন বলেছিল, তুমি কি বলতে চাইছ।
-- আসলে স্থির কোন মতাদর্শ নেই।আদর্শ মরীচিকার মত প্রতি
মেয়ের মাথায় পাল্টায়।আর নিজের চোখে ধরা পড়া অপরের দোষ গুলো আসলে সযত্নে লালিত
পালিত নিজের চারিত্রিক ত্রুটি গুলোর প্রতিফলন। তাই নারে?
-- তোমার অলস মস্তিষ্কের আঁকা বাঁকা কথার অর্থ
বিশ্লেষণের ধৈর্য বা সময় কোনটাই আমার নেই।
কথা কেটে শুভ বলেছিল, এক হাত পাঞ্জা হবে নাকি ?
পাঞ্জা লড়া শুভ আর রথীনের পুরনো খেলা ছিল।রথীন যেদিন
শুভকে ডান হাতে হারাত, বাম হাতে পাঞ্জায় নিজে পরাজিত হতো।শুভ কখনও বয়সে বড়
কব্জির জোরের সুবাদে ক্ষমতার অপব্যবহার করেনি।পাঞ্জা লড়ার রথীনের উৎসাহে
বিন্দুমাত্র ভাঁটা পড়ুক শুভ চায়নি কখনো।আসলে সেদিন সে চাওয়ার মধ্যে একটি
সমান্তরাল পৃথিবীর বাসনা লুকিয়ে ছিল।কিন্তু রোজ রোজ শুভর নকল হারা রথীন ধরে
ফেলে;সকল উচ্ছ্বাস তখন লজ্জায় নেমে এসেছিল।
রথীনের তখন বলার ইচ্ছে হচ্ছিল, কব্জির পাঞ্জা ছেড়ে শুভময় জীবনের পাঞ্জা যদি লড় তুমি হেরে যাবে। কারণ সরকারি চাকরি নিশ্চিন্ত ভবিষ্যৎ তোমার নেই।
-- ওখানে গেলে টয় ট্রেনে চড়িস; ভাড়াটা একটু বেশি; তবে
টয় ট্রেন ছাড়া দার্জিলিং দেখা পানসে।
শুভর সামান্য কথায় রথীনের ভীষণ রাগ হচ্ছিল।অপদার্থ
মনে হচ্ছিল তাকে।
-- আচ্ছা শুভদা তোমার এই আঁতলামি কথাবার্তা ছাড়া আর
কিছু বলতে জানো না তুমি।আমি তো কবি নই।আমার পানসে তিতকুটে এসবে কি যায় আসে।
-- কাকাতুয়া-কাকাতুয়া। মনে আছে আমার কাছ থেকে; এই পাখি বানিয়ে নেয়ার জন্য
তুই আমায় ছোটবেলায় কত জোড় জুলুম করতিস। চুলের মুঠি ছিঁড়ে ফেলে দিতিস। একবার চোখে
আঙ্গুল ঢুকে ফুলে ঢোল। তোর সে কি ভয় বাড়িতে জানলে মা মারবে।আমি অবশ্য সকলকে
বলেছিলাম পেনের খোঁচা খেয়েছি। সেই দিনগুলো কি আর ফিরে পাব বল।আর ক’দিনের মধ্যেই
তুই নিজেই একটা পাখি হয়ে যাবি---যাযাবর পাখি।
শুভর হাত থেকে পাখিটা ছিঁড়ে; বিছানার উপর ফেলে দিয়েছিল রথীন।
-- অনেক হল এবার এসব খামখেয়ালি ছেড়ে একটা চাকরি
বাকরির চেষ্টা করো দেখি।এই সব ছাই পাস লিখে কি হবে! দেশের অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত।
নিম্ন মেধার।সেখানে লিখে কখনো বিপ্লব আনা যায় না। তুমি কি মনে কর তোমার কলমের জোরে
সবাই পাল্টে যাবে-রেনেসাঁ হবে।
-- কখনোই না;কাউকে পাল্টে দেওয়ার মতো শক্তি আমার
নেই।কিন্তু আমরা যদি নিজেদের বদলাই।তাহলেই তো সমাজ টা বদলে যেতে বাধ্য তাই না!আমরা
তো সমাজের সারি সারি ইটের দেয়ালের এক একটা ইট তাই না।সেই ক্রমের একটা ইট নড়ে গেলে
কি হবে বলতো?গোটা দেওয়াল টাই নড়বড়ে হয়ে যাবে।বহু যত্নে নির্মিত বহুদিনের সিস্টেম ও
ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য।
-- চালিয়ে যাও। একাডেমী তোমার জন্য পুরস্কার নিয়ে বসে
আছে। নোবেল এই চাঁদপুর কলোনিতে এলো বলে।মোড়ের মাথায়;হরির চায়ের দোকানটার পাশে
ঢালাই এর রক টা ওখানে তোমার মূর্তি বসবে।
-- তারপর কাকে হাগবে আর কুত্তায় মুতে যাবে।এই সব একই
কথা বলতে তোর বিরক্ত লাগে না।জীবনটাকে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখবি না বস্তুটা কি?গড়পড়তা
বাঁধা ছকে গা ভাসিয়ে দিবি।
-- শুভদা আমার জীবন ল্যাবরেটরির এক্সপেরিমেন্ট এর
গিনিপিগ নয়।যে তাকে নিয়ে কাঁটা ছেঁড়া করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করব?
-- জীবন পরীক্ষা নিরীক্ষার বাইরে হলে সমাজের খোয়ারে
আটকা পড়ে।ঘোঁত ঘোঁত করে বিচার বিবেচনা শূন্য হয়ে সমাজের উচ্ছিষ্ট খেয়ে শুয়োরের
মত বেঁচে থাকে।
-- জীবন খুব ছোট।এত সময় নেই জীবন নিয়ে বসে বসে
ভাবার।ফাস্ট লাইফ।আমাকেও ব্যালেন্স করে তার সাথে তাল মিলিয়ে ছুটতে হবে।
-আমি সেকেলে-ব্যাকডেটেড।তবে এটুকু জানি সিস্টেম আমাকে
দিয়েই শুরু হয় এবং আমাতেই তার
শেষ।ধর্মতলায় হাজার মোড়। যদি একটি মোড়ে পথ অবরোধ হয়। অন্য মড়েও তার প্রভাব সমান
ভাবে পড়ে।ব্যক্তি পাল্টালে সমষ্টি পাল্টে যেতে বাধ্য। আসলে একটা কনজিউমারিজম,একটু
স্বচ্ছন্দ একটু নিরাপত্তার আশ্রয়ে জীবনের বৃহৎ উদ্দেশ্যগুলোকে আমরা ভ্রূণে তেই
হত্যা করি।এই যেমন তোর অ্যাম্বিশন ছিল পিএইচডি রিসার্চ এর। তুই চাকরিতে স্বস্তি
খুঁজছিস।
রথীন চুপ করে ছিল;সে বিরক্ত হচ্ছিল। সে সেই মুহূর্তে
নিশ্চিত ছিল যে শুভ তাঁকে হিংসে করছে।ফুঁসে উঠেছিল-
-- ধর্মতলার মোড়ে অবরোধ হলে লাঠি চার্জ হবে। তুমি অন্য দশজনের থেকে; আলাদা বেহেভিওর করলে মহাপুরুষ নয় পাগল নির্বাচিত হবে।জ্ঞান দেওয়া বা শোনা কোনটাই আমার ধাতে সয় না। আমি চললাম।
তারপরে দুই চার দিনের মধ্যেই সকলকে বিদায় জানিয়ে
ট্যাক্সিতে চড়ে বসেছিল রথীন লাগেজ সমেত।বাবা বলেছিল হাওড়া পর্যন্ত ছেড়ে আসবে। ওই
মানা করেছিল,শরীরটা তার বিশেষ ভালো ছিল না। রথীন মনে মনে বলেছিল;সংসারের জন্য বাবা
অনেক করেছে এবার তার বিশ্রামের সময়।ট্যাক্সিতে উঠে পিছনে ফেলে আসা স্মৃতি উল্টে
পাল্টে দেখার সময় বোনের মুখটা প্রথমেই মনে পড়েছিল রথীনের।নিজের বিয়ের আগে বোনের
বিয়েটা দায়িত্ব নিয়ে দিতে হবে তাকে।কনের সাজে পিউ এর মুখটা পরিষ্কার দেখতে
পাচ্ছিল রথীন। ছোটবেলায় পিউ অঙ্কে ভীষণ
কাঁচা ছিল; হোম-ওয়ার্কের একটার পর একটা অঙ্ক রথীন কে দিয়ে করিয়ে নিত সে।রথীন বলত
নিজে না করলে শিখবি কি করে।
ছোটবেলায় পিউ বলতো দাদা চাকরি পেলে আমাকে একটা
বেনারসি শাড়ি কিনে দিস।টিউশনির পয়সায় বিয়ের লাল বেনারসি কিনে দেবার ক্ষমতা
রথীনের ছিল না।জানালার ধারে পড়ার বই খুলে পিউ শুভ দের বাড়ির দিকে চেয়ে বসে
থাকত। কতদিন রথীন মাথায় গাট্টা মেরেছে। শুভর প্রতি ওর দুর্বলতা ছিল।শুভকে রথীনের
বাবা খুব পছন্দ করত। রথীনের বাবার পছন্দ আর পিউয়ের মনের শূন্যতার স্থানে শুভ অনায়াসে জায়গা করে নিয়েছিল।কিন্তু
সম্পর্কের ভিত ছিল দুর্বল। কত অজুহাতে পিউ শুভকে বোঝাতে চেয়েছিল তার ভালোলাগা;শুভ
এড়িয়ে গিয়েছিল। আসলে শুভদা লোকটা রথীনের মনে হয় একেবারে অনুভূতি শূন্য;অন্য এক
গ্রহের মানুষ। সেখানে এ গ্রহের জীবের বাস্তবিক পা রাখা সম্ভব নয় বলে রথীনের মনে
হয়।অবশ্যই শুভর কাছে নিজের অবহেলার মোর ঘুরতে গিয়ে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলতে
কখন যে অনেক দূরে পৌঁছে গেছে পিউ সে কিছুই বুঝতে পারেনি। শুভর প্রতিশোধ পরায়ণতা,
নিজের দর বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য দিব্যেন্দু, সজল, উৎপল একটার পর একটা ছেলের সাথে
সম্পর্কে জড়িয়েছে পিউ।কিন্তু ওরা সবাই একটু হাসি, একটু চাউনি,একটু গায়ে ঢলে
পরলে মজে যেতে পারে,অবজ্ঞা করতে পারে শুভ একাই। রথীন জানে সেই জন্য তাই পিউর মনে
ওদের সকলের থেকে আলাদা হয়ে রয়েছে শুভ দা। কারো অহংকার যে অন্যকার অলংকার হতে পারে
এটাও শুভ দা বুঝতে পারে না।রথীন ভাবে কেমন লেখক কে জান; বোনের মনের কথা টা বুঝতে
পারে না।কতভাবে পিউ শুভকে ভালোবাসে এই কথাটা বোঝাতে চেয়েছে।শুভ ভেসেছে নিজের তৈরি
জীর্ণ কল্পনার ভেলায়।যা রথীনের মায়ের কাছে প্রশংসার অযোগ্য।
পুরনো মাদুলির মতো পুরনো কথা-গুলোয় রথীনের হৃদয় টনটনানি আবার চাগাড় দিয়ে উঠেছিল।কেউ তো ধোয়া তুলসী পাতা নয়।বিয়ের আগে একটু আধটু সম্পর্ক কক্ষচ্যুতি অনেকের ঘটে। ও নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে বাকি জীবনটা মজবুত করার চেষ্টা করা উচিত বলে রথীনের মনে হয়।
রথীনের চাকরি পাবার পর পিউ এর বিয়ে হয়।সরু গোঁফ বছর পঁয়ত্রিশের দিব্যেন্দু, মোটা চশমা পরে মাথায় টোপর।বিয়ের কিছুটা কাল অবধি গোবেচারা ছিল দিব্যেন্দু,বউয়ের কথায় ওঠাবসা-গ্যাংটকে হানিমুন ,বৌয়ের হাসি কিংবা হাঁচি সবটাই ছিল সুখকর উপভোগ্য।এখন শোনা যাচ্ছে ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। মালতী, শেফালী, জুই, সঙ্গের গোপন সম্পর্ক ভুলিয়ে দেবার জন্য বাড়ির লোকে ওয়াহিদা রেহমান মার্কা বউ ঝুলিয়ে দিয়েছিল গলায়।আড়ালে আবডালে কানা-ভুসোয় কান না দিয়ে রথীন পিউকে সজাগ করে দিয়েছে।নিজের সম্পত্তি নিজে বুঝে নাও।
বাইরে থেকে বোঝা কঠিন ওদের প্রাণ নেই।
রথীন চাকুরী পেয়েই বোনের বিয়ে দিয়েছে। দিব্যেন্দুকে সোনার বোতাম দেবে বলেছিল। সে মোটা সোনার চেন চেয়েছে।
দাদার কাছে জামাই এর আবদার ছিল, আর একটা স্কুটার দেবেন। আপনার বোনের এ বাড়ি আসা যাওয়ার সুবিধা হবে আর কি।
বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকায় আর কি বা দেওয়া সম্ভব ছিল। গাড়ি, মোটা সোনার চেইন,বোতাম সবটা রথীন দিয়েছিল ।রথীনের মা বাবা দুজনেই রথীনকে নিয়ে গর্বিত।মাকে ছোট থেকেই রথীন দেখেছে খুব বদমেজাজি।আখের পান থেকে চুন খসলেই স্বামীকে পর্যন্ত ছেড়ে কথা বলতেন না।শ্বশুর শাশুড়ি রীতিমতো বোবা হয়ে থাকতো।মায়ের চাপেই তাদের যৌথ পরিবার দু’খন্ড হয়েছে, ঠাকুমা বাবার কাছে খেত, ঠাকুরদা কাকার আন্ডারে। মেয়েকেও বীজমন্ত্র দিতে ভোলেননি তিনি।
– কষ্ট কইরা
স্বামী যা রোজগার করে সেটা সঞ্চয়ের চেষ্টা চরিত্র কইরো।বারো ভূতের সেবা কইরে টাকা
উড়াইয়া দিও না।
রথীনের ভয় বোনের সংসার না ভাঙ্গে। রথীনের মনে আছে; মাসের শেষে বাবার মাহিনার টাকাটা মা গুণে হাতে নিতেন; কম হলে রক্ষাকালী।কাজের শেষে সংসারের চাপে পার্ট টাইমার হিসেবে আরো দুই জায়গায় কাজ করতে হত রথীনের বাবাকে।রথীনের ইচ্ছে ছিল আরও পড়াশোনার।রথীনের মা বলেছিল;
-- কতদিন আর বই মুখে কইরা বইসা থাকবি। টাকা কামাই করবি
কবে। কাজ কায়েমের চেষ্টা চরিত্র কর। সংসারের দিক্যা এবার নজর দেও।
রথীনের মাসতুতো দাদা ধীরেন স্কুল সার্ভিস কমিশনের উচ্চ পদস্থ কর্মচারী।তাকে অনুনয় বিনয়ের শেষ রাখেনি রথীনের মা। শেষ অবধি তার করুণায় রথীনের চাকরি টা হয়েছিল।পার্টি পলিটিক্স অনেক দাদার লাইন খালি হাতে চাকরি হয় না।ধারদেনা করে বাবা টাকা জোগাড় করে দিয়েছিল।চাকরি পাবার পর সেই টাকা শোধের ভারও ছিল রথীনের ওপর।মায়ের অনেক দিনের বাসনা ছিল ভারী সীতার হার চড়বে তার গলায়। সেই আশাও পূর্ণ করেছিল রথীন।রথীন নিজেকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছিল; কার করুণা নয় তার যোগ্যতায় সে চাকরি পেয়েছিল।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাশ তার কলোনিতে কতজন আছে?সার্টিফিকেট টা বাবা দেয়ালে বাধাই করে ঝুলিয়ে রেখেছিল কত দিন।বাড়িতে যে আসত ওটার দিকে চেয়ে বলতো ছেলেটার ক্ষমতা আছে।কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে বাবার উৎসাহ প্রতিবেশীদের কটাক্ষে মৃয়মান হয়ে গিয়েছিল।ওটার ওপর জমে চলেছিল মাকড়সার জাল, আর ধুলো।
মা কতোই না তিরস্কার করেছে রথীনকে।পাশের বাড়ির কাকিমাকে বলত, লেখাপড়ার চাইতে মোট বওয়া অনেক ভালো দিদি।আপনাগো পোলা কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি করে। দুটো পয়সা আনে ঘরে। আমারটারে দেখেন ; রাতদিন বই মুখে কইরা কি যে হাতি ঘোড়া পড়ে কিছুই বুঝিনা।"
পাশের বাড়ির কাকিমার কাছে মায়ের অভিযোগ গুলো শুনতে শুনতে;রথীনের ইচ্ছে করত টেবিলের উপর রাখা বই গুলোতে আগুন লাগিয়ে দিতে।
রথীনের বাবা ভীষণ সাধাসাধি সাত কথায় রা পড়ে না গোছের মানুষ। বউ এর কাছে সবসময় জুজু হয়ে থাকেন। দোকান, হাট , বাজার রিটায়ারমেন্টের পর ঘর ঝাঁটা থেকে বাসন মাজা সবটাই বাবাকে করতে হয়।
রথীনের পড়াশোনা, চাকরির জন্য অনেক গুলো টাকার খরচ করেছে রথীনের বাবা। চাকরি পাবার পরেও বাবার উপর চাপ কমানোর জন্য রথীন প্রাণপণে টিউশনি করতো।ভীষণ সাত্ত্বিক মানুষ রথীনের বাবা ।সবকাজ সামলেও দুবেলা ঠাকুর দেবতার যত্ন আরতির কোন কমতি রাখতো না।একটাই কামনা ছিল তার ;ঠাকুর ছেলেটার একটা চাকরির বন্দোবস্ত করে দাও।ঠাকুর শেষে মুখ তুলে তাকিয়ে ছিল। রথীনের ঠাকুমার মুখটার ভীষণ অভাব মনে হয় আজকাল।ঠাকুমা তাকে নাড়ু গোপাল বলে ডাকতো। সকলকে বলত—
-আমার নাড়ু বড় হইয়া মস্ত বড় লোক হইব। দেশ বিদেশে ওর
নাম ছড়ায়ে পড়বে।
মুড়ির মোয়াটা নারকেলের নাড়ুটা আঁচলের কোনায় বেঁধে
ঠাকুমা রথীনকে লুকিয়ে লুকিয়ে খাওয়াত।
মা বলত — পরের ধনে পোদ্দারী। ছোট ছেলে তো ফিরেও চায় না।বড় ছেলের মাথার উপর বসে খাচ্ছে;আবার বায়নাক্কার শেষ নাই। আজ অম্বুবাচীর দুধ কলা, কাল একাদশীর লুচি। না পেলেই ছেলে খারাপ।পাড়ায় ছেলের নামে গাল পেড়ে বেড়ায়।
ফোঁকলা গালে খাবি খেতে খেতে ঠাকুমা বলত, বউ গাল পারলাম কই।
আরো চটে উঠত মা, সারাদিন পাড়ায় আমাদের গুণ কীর্তন করে বেড়াও সে খবর রাখি না ভেবেছ।
ঠাকুরমার চোখ দিয়ে রথীন প্রথম লালকমল নীলকমল হবার
স্বপ্ন দেখতে শিখেছিল।
সকাল সকাল ঘুম ভাঙিয়ে চোখ মুখ ধুইয়ে মা বলত, জীবনটা বায়স্কোপ নয়।জগতটারে চেন- পরিশ্রম না কইরলে ফল পাইবা কেমন করে।
চাকরি পাওয়ার পর;হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে টিকিট কেটে বেডিং পত্র যেমন একাই কাঁধে করে বয়ে নিয়ে ট্রেনে উঠেছিল রথীন। আজ সেভাবেই একা একা বাড়ি ফিরে আসতে হচ্ছে তাকে।হাজার হাজার তরুণ-তরুণী, যারা নিয়োগপত্র পেয়েছিলেন এবং চাকরিতে যোগও দিয়েছিলেন, আজ তারা কর্মহীন। অনেকেই ঋণ নিয়ে চাকরির প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, কেউ আবার অন্য চাকরি ছেড়ে এই চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। তাদের জীবনে এখন শুধুই অনিশ্চয়তা। প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না এবং বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের একটি বেঞ্চ বলেছেন, "সম্পূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়াটি বাতিল করা এবং আটকানো হয়েছে।
এই প্রথম রথীনের মনে হতে শুরু করে; এটা গোটা সমাজের নৈতিক স্খলন। তাঁর নিজের চরম অধঃপতন। কিন্তু তার জন্য কি সে একা শুধু দায়ী ছিল? রথীনের আবার মনে পড়তে থাকে মা, বোন, বাবা ,এক সারি মুখ রাশি রাশি, আকাঙ্ক্ষা গুলোর কথা।তার মনে হয় সে কি মুখ নিয়ে লোকসমাজে দাঁড়াবে।বিশেষ করে শুভদার সামনে।এতদিন যত টাকা মাইনে পেয়েছে সব টাকা ফেরত দিতে হবে তাকে। কোথা থেকে দেবে সে? বাঙ্কারে লাগেজ তুলে রথীন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল।গুমোট গরমে ভ্যাপসা ঘাম দিচ্ছে। দীর্ঘ পথ একটা পেপার পেলে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যেত। ভাবতে ভাবতেই;জানালা দিয়ে খবরের কাগজওয়ালা কে দেখতে পেল রথীন। খবরটা সারা দুনিয়া জেনে গেছে। খবরটা জানার পর থেকে রথীনের মা কপাল চাপড়িয়ে কাঁদছে।রাজনৈতিক কচকচানি রথীনের আজকাল একদম ভালো লাগে না। তবু মনে হল কে কী বলছে একটু চোখ বুলিয়ে দেখি। সে ভালো করে জানে সে স্বার্থপর। সে ভাল করে অনুভব করতে পারল;তার স্বার্থে আজ আর কোনও নেতা-নেত্রীই কেউয়ই তাঁর পাশে নেই ।শেষের পাতায় খেলাধুলা এড়িয়ে রথীনের মনে হল রাশিফল টা একবার চোখ বুলিয়ে নিই।মা-গুরুদেবের চরণামৃত দিয়েছে রথীন সব সময় একটা ছোট বোতলে করে সাথে বহন করে নিয়ে বেড়ায়।শ্বেত বেড়েলা আর শ্বেত চন্দনের মূল একসাথে লাল কাড়ে বেঁধে গত মাস ছয় হাতে বাঁধছে রথীন। তবুও তার চাকরির সমস্যা দূর হল না।আসলে মানুষ অসহায় আর একটা অদৃশ্য শক্তি মাদারীর ভূমিকায় এমন একটা বিশ্বাস হয় রথীনের।জীবনের কেমিস্ট্রি রসায়ন বিদ্যার চাইতে ও কঠিন।জীবনের গণিত এতটাই কঠিন যে, তা কঠিন ক্যালকুলাসকেও হার মানিয়ে দিতে পারে।খবরের কাগজ ওলট পালট করতে করতে গল্পের পাতাটা রথীনের চোখে পড়ে।“কাগজের কাকাতুয়া” শুভময় বন্দ্যোপাধ্যায় বড় বড় হরফে জাজ্বল্যমান লেখা।চোখ বুলায় রথীন।
মুখস্থ বুলি সম্বল করে, পায়ে বেড়ি বাঁধা কাকাতুয়াটা কথা বলে "রামকৃষ্ণ---রামকৃষ্ণ" ......বন্য সৌন্দর্যে আস্থা হারিয়েছে।ক্লান্ত
ডানায় নীল আকাশ ছোঁয়ার বাসনা ম্লান।'
কাজটা দুমড়ে মুছরে মুঠো করে ট্রেনের জানালা দিয়ে
বাইরে ছুড়ে ফেলে দেয় রথীন;তার হঠাৎ এমন প্রতিক্রিয়ায় সহযাত্রী দু চারজন তার
দিকে চেয়ে রইল। রথীনের সেদিকে কোনও খেয়াল নেই।সে যেন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল শুরভ
দুই আঙ্গুলের মাঝখানে কাগজের কাকাতুয়া টা ঠোঁট
নাড়াচ্ছে।---কাকাতুয়া------কাকাতুয়া। কি ভীষণ বিকৃত সেই স্বর রথীন যেন শুনতে পাচ্ছে।কথাটা
মস্তিষ্কে হাতুড়ি পিটচ্ছে যেন রথীনের। বাড়ি ফেরার পথে চেনা স্টেশন গুলো হারিয়ে
যেতে যেতে রথীনের বমির উদ্বেগ হল।ওয়াক তুলে জানালার গায়ে ঝুঁকে পড়লেও বমি হল
না।সকলে চেয়ে রইল তার দিকে। স্বাভাবিকতার ভান করে রথীন মুখ মুছে নিল;মায়ের হাতে
সেলাই বোনের পারফিউম দেওয়া রুমালে। তাঁর যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল।
