ছোটগল্প
অধ্যাপক ও অভিসারিকা
।।১।।
সূচনাতেই
স্বীকার করা ভালো, পশার জমাইতে যে যৌবন প্রয়োজন, তাহা বহুপূর্বেই অভিসারিকাটির
দেহবল্লরী ত্যাগ করিয়াছে। এই পেশার অ-নবীন পরিণতি: নিজ গর্ভজাতিকা ও তাহার সমবয়সী
কয়েকটি নারীর শারীরিক নিরাপত্তা, ব্যবসায়িক বিপণন, ও মনোকষ্টকালে-মানসিক-বিনোদন -
তাহারি উদ্যোগে তাহার দিনগুলি কাটে। দীর্ঘ পেশাজীবনের লব্ধ সুনাম এখনো তাহাকে
খুঁজিয়া ফেরে, গ্ত কয়েকবছরে তাহার দূরভাষ সংখ্যাটি পরিবর্তিত হয় নাই, কিন্তু বহু
প্ররোচনা, অনুরোধেও সে নিজে অধুনা কোনো পুরুষকে আর শয্যায় সঙ্গদান করে না। ইহার
দুইটি মাত্র ব্যতিক্রম আছে। এক বিশেষ ধনকুবের-পুত্র, যিনি নিজেও অল্পবয়সে
লক্ষ্মীদেবীর আশীর্বাদ লাভ করিয়াছেন, তিনি একটি রাত্রে একটিই শয্যায় দুই প্রজন্মকে
একত্রে জন্মদিনের পোষাকে পাইতে যে পরিমাণ মোহর কবুল করেন, তাহা নিছক নীতি বা
সম্পর্কের ছুৎমার্গের অজুহাতে গ্রহণ না করার অপরিণামদর্শিতা - মা ও মেয়ে - উভয়ের
নিকটই চূড়ান্ত মুর্খামির পরিচয়, এবং প্রারম্ভিক আলোচনায় তাহারা উভয়েই স্থির করে,
এই একটি সম্মতিদানে যদি তাহাদের মাসিক সকল ব্যয় নিছক চারি ঘন্টার অত্যাচার সহিলে
আয় করিয়া ফেলা যায়, তাহা হইলে তাহাতে নিজেদের নিংড়াইয়া ও নিংড়াইতে দেওয়াই শ্রেয়। এ
পাপ (যদি অংশগ্রহণে ইচ্ছুক ও পারদর্শী সকলকেই সুখী করা এই বিনিময়বিন্যাস আদৌ পাপ
গোত্রবাচ্য হয়) গোপন থাকিবার নহে, তাই আরো কিছু পুরাতন মুগ্ধ ভক্তদের একই সেবা দান
করিতেও জননী-দুহিতাযুগলকে স্বীকৃত হইতে হইয়াছিল, যদিও দেশজ অর্থনীতি, উপভোগের
অন্যান্য উপাদানের উপস্থিতি ও বয়স্ক কসবীটির দেনাপাওনা আলোচনার অনমনীয়্তা নিশ্চিত
করে এই বিশেষ পরিসেবাটি নিতান্ত প্রতুল বা সহজপ্রাপ্য নহে। ধনকুবেরপুত্র যে
বিনিময়মূল্য নিরূপণ করিয়াছিলেম তাঁহার প্রথম ত্রিসমমিলনের নিমিত্ত, তাহা হইতে একটি
নয়া পয়সাও কসবীটি কাহারো নিকট কখনো কম লয় নাই, ইহা মানুষের আদালতে হয়তো প্রমাণ করা
সম্ভবপর হইবে না, কিন্তু ওপরওয়ালা ও তাহার নিজ কন্যাটি অবগত আছে, শরীরকে
ক্ষুধানাশের উপায়রূপে ব্যবহারে যাহারা বাধ্য হয়, তাহাদেরও আছে নিজস্ব নীতিবোধের এক
স্বনির্মিত সীমানা।
দ্বিতীয়
যে পুরুষটি এখনো নির্বাধ পদক্ষেপে তাহার নিভৃত নিকেতনে পদার্পণ করিতে পারেন,
তাহাকে, আরো বহু মানুষের ন্যায়ে, আমরাও অধ্যাপক পরিচয়েই চিনিব। শারীরিক দিনক্ষয়ের
বিচার করিলে হয়তো বা তিনি অভিসারিকার অগ্রজাত, কিন্তু একবস্ত্রে অপরিকল্পিত
দেশত্যাগের সময়ে কে আর জন্মের শংসাপত্র বহিয়া বেড়ায়! এই আশ্রয়দাতার দেশে তাঁহার
সুনাম নিছক পান্ডিত্যের নিমিত্ত নহে, শিক্ষাকে সার্বজনীন ও সহজলভ্য করিবার জন্য
তাঁহার দীর্ঘ প্রয়াস সকল সরকারী দফতর ও বিবিধ বাণিজ্যিকসভায় বহুস্বীকৃত।
কিছুপক্ষপূর্বে কয়েক দশকের প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ও শিক্ষাদানের দায়িত্ব সমাপন করিয়া
তিনি অবসর লইয়াছেন।
নারীটি
অনেকবার ভাবিয়াছে, পুরুষটির জন্য নিয়ম আর ভাঙ্গিবে না, কারণ প্রতিসপ্তাহে ঐ
শুক্রসন্ধ্যার সাহচর্য্যের বিনিময়ে যে কণকমূল্য মাসান্তে তাহার উপার্জন ঘটে, তাহার
কয়েকগুণ সে মাত্র একটি ত্রি-মিলনে আয় করিতেই পারে। কিন্তু দুইটি চেতনা তাহাকে
নিরস্ত করিয়াছে। প্রথমতঃ যে মানুষটি শহরের বাহিরে পেশাসফর না থাকিলে বিগত তিনদশক
ধরিয়া নিয়মিত তাহার ভগ্নগৃহে কাঙ্খী হইয়া ছুটিয়া আসিয়াছেন, সদ্য কৈশোরের
অপাপবিদ্ধতায় প্রথম পরিচিত হইয়া যিনি তাহার দেহের প্রতিটি রোমকূপকে এত সন ধরিয়া
সন্তর্পণে আশ্লেষ করিয়াছেন, কখনো তাহার বার্ধক্যের উল্লেখ করেন নাই, স্থূলতায়
অঙ্গুলিনিদেশ করেন নাই, তাহার ক্কচিৎ মনখারাপের কালে পরিষেবার মানহ্রাস লইয়া
অভিযোগ করেন নাই; তাহার জ্ঞান-ও-অনুসন্ধানমতে বিগতপত্নী হইবার পরে, অন্ততঃ এদেশে,
অন্যনারী গমন করেন নাই, এবং যাঁহাকে কন্যাবান্ধবীদের কাউকে উপঢৌকন দিলে নীরবে
প্রাপ্য অর্থ রাখিয়া প্রস্থান করিয়াছেন একাধিকবার, তাহাকে সে কোন অধিকারে ফিরাইবে?
দ্বিতীয় কারণটি আরো সঙ্গোপন - সে কখনো তাহা প্রকাশ করে নাই কাহারো নিকট। সচেতনে যে
অতীতের সহিত সে দূরত্ব রচে প্রত্যহ, সেই অর্ধবিস্মৃত বিভূমি, তাহার মানুষ ও ভাষার
সহিত বিগতপ্রৌঢ়ত্ব এই সামান্যার শেষ যোগ এই অধ্যাপকের উচ্চারণ, তাঁহার মৌখিক কথনের
টানটুকু তাহাকে টানিয়া লইয়া যায় তাহার নিজের জন্মের জেলাটিতে। অধ্যাপক অবশ্যই সেই
উপনগরে কখনো বাস করেন নাই যেথা হইতে তাহাকে একবস্ত্রে, একরাত্রের প্রস্তুতিতে
উচ্ছিন্ন হইতে হইয়াছে, কিন্তু সে ভূমিখন্ডের আঞ্চলিক বাকবৈশিষ্ট্যগুলি তিনি যে
সহজেই রপ্ত করিয়াছেন, তাহার কারণ, সেটি তাঁহার “মাতৃ”-ভাষা, তাঁহার জননী সেই
স্থলেই জন্মিয়াছিলেন। এই শহরে তাহার মাতৃভাষা উচ্চারিত হয় নিরন্তর, কিন্তু তাহার
প্রাণস্পর্শী সেই উপভাষাটি উপভোগের অবকাশ আর নাই।
কিন্তু
বুদ্ধিমান অধ্যাপকটি কেন বহুব্যবহৃতা বৃদ্ধাতেই এখনো বদ্ধ হইয়া আছেন? তাঁহার
পরিচিত সকলেই জানে, তিনি বিচক্ষণ, বাস্তববাদী, কঠোররূপে বৈষয়িক। তাঁহার পেশা- ও
ব্যক্তিজীবনে বহুবার দৃষ্ট হাইয়াছে তাঁহার সৌন্দর্য্য-”সংগ্রহ” ও যৌবন-সংশ্রব
করিবার দক্ষতা। অন্যদেশে ভ্রমণকালে বহু পতঙ্গ তাঁহার ব্যক্তিত্বের লেলিহান আকর্ষণে
পুড়িয়া শান্তিলাভ করিয়াছে, তাহাদের অনেকেরই অর্থ, শিক্ষা, ভগবদ্দত্ত রূপ, বয়সোচিত
যৌন আবেদন, শীলনসঞ্জাত রূচি, স্বভাবজ পেলবতা ও সর্বোপরি আগ্রহ - সবকিছুই চিরস্থায়ী
সম্পর্কনির্মাণের নিমিত্ত প্রতুল ছিল। তাঁহার সান্নিধ্যলাভকালে কেহ কেহ কিঞ্চিৎ
কাঞ্চনের কৃপালাভও করে নাই, একথা মিথ্যা। কিন্তু তাহাদের কেহ তাঁহাকে এই সামান্যার
ন্যায় শোনে নাই, তাঁহাকে দেয় নাই সেই নির্বিচার সাহচর্য্য, যা তাঁহার ভাবনা ও
মুখকে করিতে পারে অনর্গল, জঙ্গম, সৃজনে কলঃস্বনা।
জীবনে
যতই শ্রোতৃবর্গের শ্রদ্ধা তাঁহার পদপ্রান্তে সমুদ্রতরঙ্গের ন্যায় ভাঙিয়া পড়িয়াছে,
ততই অধ্যাপক উদ্বিগ্ন হইয়াছেন, কেহই তাঁহাকে বুঝিল না। তাঁহার বাচনশৈলী যতই তাঁহার
জন্য জিনিয়া আনিয়াছে স্বীকৃতির পুরষ্কার ও পুরষ্কারের স্বীকৃতি, ছিনিয়া আনিয়াছে
ভাবুক ভবিষ্যৎদ্রষ্টার শিরোপা, ততই তিনি নিভৃতে নিজ বাকপটুত্বের অভাব ও বক্তব্যের
অসারতায় দৃঢ়তর বিশ্বাস করিয়াছেন। প্রাত্যহিক প্রত্যাশা যখন তাঁহাকে প্রতিষ্ঠা
করিয়াছে সেই প্রজ্ঞার আধাররূপে যিনি আশু ও সুদূর ভবিষ্যতের সমস্ত সমস্যার নিদান
দিতে সক্ষম, তখন তাঁহার হৃদয়ের গভীরতম আলয়ে বিচরণ করিতে থাকা নিরাপত্তাহীনতা তিনি
উজাড় করিয়াছেন এক প্রায়-নিরক্ষর রূপোপজীবিনীর সান্নিধ্যে, কারণ তাঁহার ন্যায় সেও
সার্থকভাবে শিখিয়াছে ছিন্নমূল হইবার স্মৃতিকে কীরূপে অর্গলরুদ্ধ করিয়া
স্বাভাবিকতার অনন্ত অভিনয় করিতে হয়। তবে ইহা তিনি অনায়াসে লাভ করেন নাই। তিনি
খেয়াল করিয়াছেন বণিতার দুর্বলতা, অনুধাবন করিয়াছেন বিশেষ উচ্চারণটানের প্রতি তাহার
অনুক্ত টান। কর্মজীবনে অনেক দুরূহ প্রকল্পে, অনেক অমিত্রকে তিনি সহযাত্রীতে পরিণত
করিতে পারিয়াছিলেন তাঁহার বক্তব্যটিকে শ্রোতাদিগের উপযুক্ত শব্দবন্ধে প্রকাশ
করিবার ক্ষমতায়, এস্থলেও তিনি সেই পেশালব্ধ পেশ-করিবার-দক্ষতাটিকে প্রয়োজনকালে
ব্যবহার করিয়াছেন। দেহ-সাহ্চর্য্যের সময়্টুকুতে তিনি কি বিষয়ে বলিবেন, কি ভাষায়
বলিবেন, কতটুকু আলোচনা করিয়া অন্য মানুষটির মানসিক বিপন্নতাকে উন্মোচিত করিয়া হঠাৎ
শারীরিক আশ্লেষে তাহাকে টানিয়া মানসিকরূপে-উন্মুখ-কিন্তু-শারীরিক-ক্ষুধায়-তৃপ্ত
করিয়া পরের মিলনের প্রতীক্ষা করাইবেন, তাহার জন্যে প্রতিবার তিনি ভাবিয়াছেন,
প্রস্তুতি লইয়াছেন। এখন আর সেই স্তরের প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়ে না, কারণ এখন
অভিসারিকার চিন্তনের আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকিতে তাঁহাকে কাহারো সহিত
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে হয় না। পরস্পরের নিরাবরণ নীরবতাকে উভয়েই এখন আত্মস্থ
করিয়াছেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁহার বাচনে মুগ্ধ হইয়াছে বটে, কিন্তু তাহার
পশ্চাতের পরিশ্রম ও প্রস্তুতিকে নিজ তূণীরে যোগ করিবার উদ্যোগ করে নাই। আচার্য্যকে
সঠিকভাবে অনুসরণ করিলে তাহাদের কাহারো কাহারো দিন ও নিশাযাপন আরো ‘রমণীয়’ হইতে
পারিত, এ সিদ্ধান্ত ভুল নহে।
।।২।।
আজিকার
সন্ধ্যাটিতে নারীটি অনেক বেশি উৎকন্ঠিত হইয়া আছে অন্যান্য শুক্রনিশির তুলনায়। নগর
আজ হিংস্রভাবনার বিষে নীল হইয়া উঠিয়াছে, ধর্মীয় বিদ্বেষের বারুদের স্তুপে আর একটি
অচিন্তিত মন্তব্যের অপেক্ষা, দাঙ্গা দ্বারে উপস্থিত, যে কোন মুহূর্তে তাহা লেলিহান
হইয়া উঠিবে। বিষবাষ্প একদিনে পুঞ্জীভূত হয় না, ক্রমে ক্রমে বাড়িয়াছে, আর তাহার
ভাবনায় একটু একটু করিয়া, একটি একটি করিয়া ত্রিশ বৎসর পূর্বের ঘটনা ভাসিয়া উঠিয়াছে।
অবশেষে, যখন মঙ্গলবার রাত্রে তাহার কন্যার এক বান্ধবী আসিয়া জানাইল, এক তৈলকূপ-এর
অধীশ্বর নিজের হারেমের জন্য আরো কয়েকটি নারীদেহ সংগ্রহ করিতে ব্যগ্র, তখন সে
প্রচন্ড জিদ ধরিয়া স্বীয় অপত্যাকে সম্মত করাইয়া দেশ হইতে দূরে পাঠাইয়াছে। নিজ
কন্যার আন্তর্জাতিক সফরের প্রশাসনিক স্বীকৃতি আদায়ে তাহার ব্যয়িত হইয়াছে একটি দিন,
আর বিদেশগমনের সমস্ত জোগাড়ে তাহার পরে মাতা-দুহিতার আরো সার্ধদিবস (যেসকল সরলমতি
পাঠক বিশ্বাস করেন, 'ওদের' পাস্পোর্ট্-ভিসা নাই বা থাকিতে নাই, তাঁহারা অবগত
থাকুন, দেশের সীমানা আইনসঙ্গতভাবে পার হইবার পূর্ব অভিজ্ঞতা তাহাদের একাধিকবার
হইয়াছে। দেশের নাগালের বাহিরে পলাইবার উপায়টি চিরকালই ব্যয়বহুল হইলেও সুনির্দিষ্ট;
দ্বেষের ন্যায়ই তাহার বিস্তার সর্বব্যাপ্ত, সে পন্থা কদাচ অস্পষ্ট হইলে
আর্থ-রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারীদের বিড়ম্বনার কারণ ঘটে।) কন্যা বিমানে চড়িয়াছে
দ্বিপ্রহরে, সে য্খন থমথমে শহর পার হইয়া নিজ বাসকক্ষে ফিরিয়াছে, চারিদিকে
আরক্ষাবাহিনীর বুট্ কুচকাওয়াজ করিয়া নৈঃশব্দ্য চুরমার করিতেছিল, কিন্তু
শস্ত্রধারী সান্ত্রী রাজপথে বিরল হইলে যাহাদের যাপনের কিঞ্চিৎ সুরাহা হয়, তাহার
সকলেই নিজনিজ গহ্বরে লুকাইয়াছে। দূরদর্শনের যে সংবাদ চ্যানেলগুলিতে সকলের অস্থির
মনোযোগ ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, তাহারা যে পাঁচনটি জনগনেশকে গলাধঃকরণ করাইতেছিল, তাহাকে
ঘৃণাসন্দেশ বলিলেই নামকরণটি উপযুক্ততর হয়। প্রৌঢ়া দেখিয়া শুনিয়া ক্রমশঃই নিঃসন্দেহ
হইতেছিল যে কন্যাকে একেবারে সঠিক সময়ে নিরাপদ হারেমে প্রেরণ করা গিয়াছে। বিপদের
একটি বিশেষ ঘ্রাণ থাকে, যা একমাত্র সেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়া যাইবার পরেও টিকিয়া
থাকা মানুষদেরই নাসাযন্ত্রে ধরা পড়ে, সেই মৃত্যুগন্ধই তাহার অবচেতনে বারংবার ধাক্কা
দিতেছিল। তাহার পূর্বজ্ঞান তাহাকে বলিতেছিল পরের কয়েকটি দিন তাহার সন্তানের
নিমিত্ত সুখের সময় নহে, এবং সমস্ত মানসিক অপমান, শারীরিক ব্যথা, ও যৌনলাঞ্ছনার
জন্য দুহিতাটি তাহাকেই দায়ী করিবে, অশ্রাব্য গালিগালাজ শ্রবণ তাহার পেশাগত জীবনে
নৈমিত্তিক হইলেও নিজ অপত্যার মুখে তাহা শুনিলে এখনও তাহার কষ্টই হয়।
অধ্যাপক
আজ আসিবেন না, এমন একটি সম্ভাবনা তাহার মনে একবার আসিয়াছিল, এবং তাহা নিতান্ত
অযৌক্তিক নহে। অধ্যাপক নিজ বাহন লইয়া তাহার দর্শনে আসেন না, এবং তাঁহার নিয়মিত
ট্যাক্সি-চালকটি প্রায় ত্রিশ বৎসর ধরিয়াই তাঁহাকে এই কসবী-সঙ্গ ত্যাগ করিতে
ঠারেঠোরে তাঁহাকে উপদেশ দিতেছে। চালকটি অধ্যাপকের বেতনভোগী নহে, যেকোনো অজুহাতেই
সে অধ্যাপকের সফরসঙ্গী হইতে অস্বীকার করিতেই পারে, কিন্তু শুক্রসন্ধ্যায় তাঁহাকে
এই মহল্লায় পৌঁছাইয়া সে অস্বস্তি ও বাহনসহযোগে দ্রুত পলাইয়া যায়, আবার শনিবার ঊষায়
তাহার গাড়িটি নির্দিষ্ট সময়ে অধ্যাপকের অপেক্ষায় থাকে। দুইবার মাত্র সে কসবীটির
দ্বারে নিজ যানটিকে আনিয়াছিল, দুইবারই কসবির অনুরোধে অধ্যাপক তাহাকে পাঠাইয়াছিলেন,
মাতৃত্বদায়িত্ব-গ্রহণে-অস্বীকৃতা দুই যুবতীর সম্মান-ও জীবন-রক্ষার জন্য। কসবি ও
চালক উভয়ের ফোনেই পরস্পরের নম্বর সঞ্চিত আছে, তাহা দুজনেরই গোচরীভূতও, কিন্তু
তাহারা অধ্যাপকের শারীরিক চাহিদার জন্য পরস্পরস্পৃষ্ট, নিজেদের মধ্যে তাহাদের কোনও
ভাব-ভালবাসা নাই। সেই চালকটি আজো এই পাড়ায় অধ্যাপককে আনিতে রাজি হইবে, তাহা সন্দেহ
করিবার যথেষ্ট কারণ ছিল।
।।৩।।
তাহার
পরেও অধ্যাপক আসিলেন। যথাসময়ে সেই পরিচিত পন্থায় তিনি দ্বারে টোকা দিলেন। আজ তিনিও
বিমনা, ঘোষণা করিলেন সমস্ত নিশীথের পরিবর্তে তিনি দ্বিতীয় যামেই স্বগৃহে
প্রত্যাবর্তন করিবেন। কথাকটি শুনিয়াই তাহার প্রতীতি জন্মাইল, আজ আর উভয়ের কারোরই
বিবস্ত্র হইবার প্রয়োজন হইবে না। আজ কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সে তাঁহার প্রতি একটি
অনাস্বাদিত আকর্ষণ অনুভব করিল, কিন্তু সেই ভাবটি পলকমাত্র তাহার মুখে খেলা করিয়াই
অন্তর্হিত হইল। অধ্যাপক নিশ্চুপে শয্যার একপ্রান্তে বসিয়া রহিলেন - আজ তিনি শুধু
নির্বাক নহেন, কেমনতর এক নিস্পন্দ আচ্ছাদন তাঁহাকে আবৃত করিয়া রাখিয়াছে। সঙ্কুচিত
পুরুষ ও পৌরুষকে জাগাইয়া যাহার পেশাজীবন চলিয়াছে, তাহারও আজ ইচ্ছা হইল না, অপর
মানুষটির এই সুপ্তি ভাঙাইতে, তাই অন্য অনেক ধীর দিনে সে যেমন শারীরিক খুনসুটির
মাধ্যমে পরিস্থিতির পরিচালনা করে, আজ সেও প্রথার ব্যত্যয় করিয়া তাঁহার পার্শ্বে
বসিয়া নিজ নিঃসঙ্গতাকে তাঁহার নৈঃশব্দ্যে নিবিড় করিয়া দিল। কোথাও আজ দুজনের
উৎকণ্ঠা একবিন্দুতে মিলিবার উপক্রম হইয়াছে।
এইরকম
চুপ করিয়াই কাল অতিবাহিত হইতে পারিত, কিন্তু দুইজন মানুষই জানিতেন আজিকার
পরিস্থিতিতে কথা না বলিলে অতীতের যে পলায়নকান্ড হইতে উভয়েই সততঃ পলায়ন করিবার
প্রয়াসী, সেই দুঃখ, লজ্জা, ও সর্বোপরি ভয় আজ তাঁহাদের ধরিয়া ফেলিবে, তাঁহাদের
এতদিনের দৌড় বিফল হইবে। প্রয়োজন তাই আশু কথোপকথনের।
।।৪।।
“মাস্টারমশাই,
এ দেশেও কি এবার দাঙ্গা হবে? আবার দাঙ্গা হবে?”
শুষ্ক
পান্ডিত্য জানে কোনটা তার জ্ঞাত, অভিজ্ঞতাসঞ্জাত প্রজ্ঞা জানে কী তার অজানা।
বিরসস্বরে অধ্যাপক কহিলেন, “যেভাবে সবাই আগুনে ঘি ঢালছে, আমি খুবই অবাক হবো যদি
আগামী ক’দিনে বড়সড় দাঙ্গা না বাঁধে। আমি মনেপ্রাণে একদমই চাই সুচেতনা জেগে উঠুক,
কিন্তু লক্ষণগুলো বড্ড বেশি চেনা ঠেকছে এবারে!”
“আমি
তবে কোথায় যাবো মাস্টারমশাই, সারাটা জীবন তো শুধু পোড়া কপাল, দালাল, আর এইসব
দাঙ্গাবাজদের থেকে পালিয়ে বেড়ালুম, আর যে আমার অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।”
বহুদর্শিনী প্রৌঢ়ার কন্ঠেও অশ্রুর আর্দ্রতা ফুটিল। সে আত্মসম্বরনের চেষ্টা
করিতেছিল।
অধ্যাপক
তাহার পৃষ্ঠে আশ্বাসের হাত রাখিবার প্রয়াস করিলেন। কিন্তু তিনি যখন আবার মুখ
খুলিলেন, তাঁহার কন্ঠেও হতাশা ও দুশ্চিন্তা ফুটিল। “আমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলুম
এদেশেই আমি পাকাপাকিভাবে থাকবো, একেই মাতৃভূমি বলে ভাববো, ধর্ম আর ভাষার ব্যবধান
অতিক্রম করে এখানকারই একটি মেয়েকে বিয়ে করে পারিবারিক জীবন কাটাবো, তখন এই দেশ, এই
অবস্থা আমার কল্পনাতেও ছিল না। সবকিছু কীভাবে চোখের সামনে পালটে গেল, … কোথা থেকে
এল এত এত ঘৃণা! … চারদিকে এত হিংসা … অথচ আমি তো পারতাম অন্য কোনো দেশে থাকতে, …
থাকতে চাওয়া উচিৎ ছিল … অন্য কোথাও, অন্য কোনো দেশে।”
প্রৌঢ়া
কহিল, “আমার সারাজীবন কোনো ব্যাপারেই কোনো উপায় ছিল না, মাস্টারমশাই, কোনোখানেই
কোনোদিন নিজেনিজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার পাই নি, এমনকি নিজের শরীর বা রুজির
উপায়ের ওপরও নয়। সবকিছুই আমার ওপরে অন্যরা চপিয়ে দিয়েছে।“ খরিদ্দারের তীব্র
শারীরিক অত্যাচার ব্যতীত এই প্রথম সে এদেশে কোনো একক পুরুষের সান্নিধ্যে রোদন
করিল।
আজ
গৃহ হইতে নির্গত হইবার সময়ে অধ্যাপক মনেমনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন যে আর তিনি এক
অশিক্ষিতা মুঢ়ার সম্মুখে নিজভাবনা অনাবৃত করিবেন না। তিনি আসেন তাৎক্ষণিক শারীরিক
উত্তেজনার সন্ধান ও প্রশমনের নিমিত্ত, মনের এস্থলে কোনোই ভূমিকা নাই। কিন্তু এইসকল
কথা ও ক্রন্দন কেমন করিয়া অধ্যাপকের স্বগতকথনের স্বভাবকে আজ পুনর্বার
অনিচ্ছাসত্বেও অনর্গল করিয়া দিল। তিনি বলিতে থাকিলেন, “তোমার জীবনটা ছারেখারে
গিয়েছে, সেটা মেয়ে তোমার দুর্ভাগ্য। কিন্তু আমি আমার এই জীবন তিলে তিলে গড়ে
তুলেছি। ছোটবেলা থেকে পড়াশুনো করেছি দেদার, বরাবর ফল করেছি দুর্দান্ত। আমি জীবিকা
হিসেবে অনেক কিছুই বেছে নিতে পারতাম, সুযোগ বা উপায়ের অভাব ছিল না আমার। আমি আজ যা
হয়েছি, সচেতনে, নিজের পছন্দে। এই শহরে, এই রাজ্যে, এই দেশে যে আমি বাস করি, সেটাও
সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়। আমি কোনো শরণার্থী নই, আমি একজন উচ্চশিক্ষিত অভিবাসী। আমি
একজন স্বাধীন পুরুষ, যে অন্য কোনো স্বর্গের সন্ধান পেলে একনিমেষে এইদেশ ছেড়ে চলে
যেতে পারে। আমার এখনও সেই স্বাধীনতা আছে, আর…” তিনি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ
করিলেন, “আমাকে হয়তো খুব শিগগিরি সেটার প্রয়োগ করতে হবে। এই দেশ আর আমার সহ্য হচ্ছে
না, এদেশের মানুষ, এমনকী আমার নিজের ছেলে আর তার দলবলের ধ্যান-ধারণা, দর্শন,
কার্যকলাপ সবকিছুই আমার সহ্যের সীমা ছাড়াচ্ছে।”
অভিসারিকা
জানিতে চাহিল, “কোথায় যাবেন? এর থেকে কি এইবারে আমাদের কারুর এইবারে ছাড় আছে?”
কথোপকথন
অধ্যাপকের ফুস্ফুসে আত্মবিশ্বাস ভরিতেছিল, তিনি গভীর প্রত্যয়ে কহিলেন, “আহ! অত
চিন্তার কিছু নেই, কাল-পরশু তো আর আমাদের কিছু হচ্ছে না। তবে এটা সত্যি, যা করবার
তাড়াতাড়িই করে ফেলতে হবে, বেশি সময় আমাদের হাতে আর নেই।”
চারিচক্ষু
মিলিবার মুহূর্তটিতেই এক আদিম অনুভূতির তরঙ্গ তাঁহাদের যুগপৎ স্পর্শ করিল। তড়িদাহতের
ন্যায় দুটি বহুগমনকারী মানুষ পরস্পরের শারীরিক সান্নিধ্যে আশ্রয় খুঁজিলেন। সেই
সঙ্কটের সায়ংকালে তাঁহাদের সঙ্গমটি ছিল নাতিদীর্ঘ, কিন্তু তীব্র আর তুষ্টিদায়ক সেই
আশ্লেষে সামান্যার সেই সামান্য কক্ষটির বাহিরের বাকি চরাচরের অস্তিত্ব দুজনেই কিছু
লহমা’র নিমিত্ত বিস্মৃত হইতে পারিয়াছিলেন।
সেরাত্রে
বিদায় গ্রহণকালে অধ্যাপক অভিসারিকাকে কহিলেন, “আমি যদি দেশ ছাড়িই, তাহলে ঐ
সি-ফেসিং বাংলোটা তোমার নামে উইলে লেখাপড়া করে দিয়ে যাবো, তুমি, তোমার মেয়ে, তাঁর
বন্ধুবান্ধবরা সেখানে একসঙ্গে হৈহৈ করে কাটাতে পারবে।”
এই
বিষণ্ণ সময়েও সেকথা শুনিয়া প্রৌঢ়া অভিসারিকার মুখে লহমার হাসি ফুটিল। কক্ষ হইতে
নির্গমনকালে তাঁহাদের দুইজনের শরীরেই এক সুখী বেদনা অধিষ্ঠান করিতেছিল।
।।৫।।
অধ্যাপকের
ভবিষ্যৎবাণী এতটাই অভ্রান্ত হইবে, তাহা তিনি নিজেও নিশ্চিত অনুমান করেন নাই।
তাঁহাদের নির্ধারিত সময় সত্যই ফুরাইয়াছিল, আর তাঁহাদের “কাল-পরশু” লইয়া ভাবনাও
ভাবিতে হইল না।
অধ্যাপকের
উগ্রচিন্তক অপত্যটি তাঁহার গাড়িচালকের মস্তিষ্কটি পরিপূর্ণরূপে প্রক্ষালন
করিয়াছিল। সেই সন্ধ্যায় অধ্যাপক তাঁহার ব্যক্তিগত যানে উঠিতেই চালকটি তাঁহার
দাদাবাবুকে চলভাষে জানাইল, “আমরা চলতে শুরু করে দিয়েছি।” অধ্যাপক তাঁহার পুত্রের
কন্ঠ স্পষ্ট শুনিলেন, “আমার বাবা ঐ গাড়িতে আছে তো?” চালকটি সে প্রশ্নের দ্রুত ও
সংক্ষিপ্ত সদর্থক উত্তর দিয়া আলাপটি সমাপ্ত করিল।
ইহার
এক প্রহর পরে দশটি পুরুষ অবশেষে দয়াপরবশ হইয়া অভিসারিকাকে মরিতে দিল। ইতঃমধ্যে সেই
বাররবণিতাকে তাহারই আবাসে বিবস্ত্র, যৌনলাঞ্ছিত, অঙ্গকর্তিত অবস্থায় যতদূর শারীরিক
ও মানসিক ক্লেশপ্রদানের পন্থা তাহারা সম্মিলিতভাবে ভাবিতে পারে, তাহার সবগুলিরই
প্রয়োগ ও পরীক্ষা তাহারা করিয়া লইয়াছে। তাহাদের সুমারী লইলে দেখা যাইত, ইহারা
সকলেই অভিসারিকার কন্যার অপেক্ষাও অল্পবয়স্ক। অধ্যাপকের অপত্যটির নিকট সেই পৈশাচিক
হত্যালীলার সচিত্র বিবরণ প্রেরিত হইলে, তাহার মধ্যে অন্তিম ও নিষ্ঠুরতম চিত্রটি
ছেলেটি নিজ সমাজমাধ্যমে প্রকাশ করিয়া লিখিল, “মায়ের অপমান আর সইব না।” তাহার এই
নারকীয়তাটিতে কোনো ব্যক্তিগত ক্রোধের প্রকাশ ছিল কিনা তাহা আর কখনোই নিশ্চিতরূপে
সিদ্ধান্ত করা যাইবে না, তবে তাহার দলভুক্ত হিংসাপ্রসারকরা সেই পোস্টে তাহার
জয়ধ্বনিতে সমাজমাধ্যম বিদীর্ণ করিয়া দিল। মরণকালে অভিসারিকা এই শান্তিটুকু লইয়া
মরিয়াছিল, যে তাহাকে ছিঁড়িয়া ফেলিলেও এই পশুরা তাহাদের লক্ষ্যের চিড়িয়াটিকে ধরিতে
পারে নাই, সেই যৌবনবতীটি সময় থাকিতে পলাইতে পারিয়াছে। একযুগ পূর্বে একপ্রজন্ম আগের
আরেক একইভাবে মরণাপন্না জননীকেও ঈশ্বর একই করুণা করিয়াছিলেন।
ইতিমধ্যে,
অলিখিত চুক্তি’র অপর দায়টি পুর্ণ করিতে পরিকল্পনামত প্রত্যাবর্তন মার্গের এক
নিভৃততর অঞ্চলে অধ্যাপকের শকটটিতে আক্রমণ করা হইল, অধ্যাপককে তাঁহার যান হইতে
বল্পুর্বক নিষ্কাশন করিয়া, বিবস্ত্র করিয়া জীবন্ত দগ্ধ করা হইল। জীবনের
শেষবিন্দুতে উপনীত হইয়া বিদ্বান ব্যক্তিটি নিশ্চয়ই হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলেন যে যখন
সমাজ স্বাভাবিক ছন্দে চলিতে পারে না, তখন অভিবাসী ও শরণার্থীর পার্থক্যটি নিতান্তই
আভিধানিক হইয়া পড়ে। যে ভূমি একবার ত্যক্ত হইয়াছে, তাহা কালের নিয়মে
অপ্রত্যাবর্তনীয়রূপে অন্যের অধিকারভুক্ত হয়, যে জীবনপথের সন্ধান ও নির্মাণ লইয়া
একবার সিদ্ধান্ত লওয়া হইয়াছে, সেই মার্গ ত্যাগ করিবার সুযোগ জীবন কদাচ দিয়া থাকে।
এই
দুই হত্যাকান্ডের মূল দুই চক্রী - অধ্যাপকের শকটচালক ও পুত্রকে সহজেই নির্মূল
করিতে রাজনৈতিক কান্ডারীদের ভ্রম ও অসুবিধা কিছুই হইল না - দাঙ্গাকালে ক্রুদ্ধ
জনগোষ্ঠী ও নিয়ন্ত্রণাধীন সরকারী শান্তিবাহিনি সেই ছকটি নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করিবার
দায় লইল। ধর্মীয় প্রতিহিংসার মোড়কে সে দেশে যে দাঙ্গাটি সেইবারে শুরু হইয়াছিল,
তাহার অগ্নিতে আরো বহু নিরীহ মানুষও বলি হইলেন। সেই হিংসা যে মানসিক ক্ষত
রাখিয়া গেল, তাহার দাগ প্রজন্মোত্তরেও অনপনোদিত থাকিবে।