ছোটগল্প
তীরের ওপারের আলো
১
কলকাতার
শীতের রাত। কলকাতার বুকে নেমে এসেছে যেন এক অদৃশ্য অর্কেস্ট্রা—হাওয়ায় ঠান্ডার সুর,
রাস্তায় কুয়াশার ছায়া, আর আকাশে ঝুলে থাকা ম্লান চাঁদের আলো। শহরের বাতাসে যেন ধাতব
শীতলতা, যা ত্বক ছুঁয়ে যায় কিন্তু মনের ভেতর ঢুকে হাড়ে হাড়ে কেঁপে ওঠায়। সড়কের
ধারে পুরনো কাস্ট আয়রনের ল্যাম্পপোস্টের আলো কুয়াশায় মিশে সোনালি কুন্ডলী পাকিয়ে
ছড়িয়ে পড়ছে। দূরে কোথাও হর্ন বাজছে, হাওয়ার সঙ্গে ভেসে আসছে গরম দুধ চায়ের গন্ধ।
মাঝেমাঝে দোকানের ভিতর থেকে শোনা যাচ্ছে কড়াইতে তেল ছিটকে ওঠার শব্দ আর রেডিওতে বাজছে
পুরনো এক বাংলা গান— "একা একা ভেবো না, আমি আছি তোমার পাশে…"
কিন্তু
গান যতই সান্ত্বনা দিক, তার মনের অস্থিরতা আর কাটছে না। মীরা সদর স্ট্রিটের গলিতে দাঁড়িয়ে
ব্যাগের ফিতেটা শক্ত করে ধরে আছে। কালো চামড়ার সেই ব্যাগে রয়েছে ল্যাপটপ, কিছু কাগজ,
আর ব্যাগের গোপন স্থানে রাখা পেপারস্প্রে—যেটা তার বন্ধু শর্মিলা কয়েক মাস আগে উপহার
দিয়েছিল, বলেছিল, "শহরটা যেমন সুন্দর, তেমনই খামখেয়ালি, সাবধান থাকবি।"
সেদিন
অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় সাড়ে নয়টা। সাধারণত মীরা রোজ হাঁটতে হাঁটতে বাসস্টপ
থেকে বাড়ি পৌঁছয়, কিন্তু আজ অদ্ভুত একটা অস্থিরতা বুকের ভেতরে জমে আছে। সামনের মোড়ে
দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা ছায়া—তাদের হাত পকেটে, দৃষ্টি ঠান্ডা কিন্তু তীক্ষ্ণ, যেন
গলির প্রতিটি নড়াচড়া মাপছে। আলো-অন্ধকারে তাদের মুখ ঠিক স্পষ্ট নয়, কিন্তু চোখের
দৃষ্টিতে যেন ঠান্ডা ছুরির ধার।
পিছন
থেকে হঠাৎ একটি কণ্ঠস্বর, “দিদি, ট্যাক্সি লাগবে?”
মুখ ফিরিয়ে
দেখে, এক ট্যাক্সিচালক দাঁড়িয়ে। গলায় কথার সুর নরম, কিন্তু চোখের কোণে এক অদ্ভুত
ইঙ্গিত। মীরার মেরুদণ্ড দিয়ে হালকা শিরশিরে ঠান্ডা নেমে গেল। কিছু না বলে হাঁটার গতি
বাড়ায়, কাঁধের ব্যাগটি বুকে চেপে ধরে।
চারপাশে
কেবল পায়ের শব্দ—তার নিজেরই—গলির দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে যেন আরও জোরে বাজছে। মনের
মধ্যে একটা অদৃশ্য আতঙ্ক: আজ কি নিরাপদে বাড়ি পৌঁছতে পারবে?
গলির
শেষে বড় রাস্তার আলো চোখে পড়তেই বুকের ভেতর সামান্য স্বস্তি এল। ঠিক তখনই পাশের গলি
থেকে বেরিয়ে এল অরিত্র—অফিসের সহকর্মী, “এই সময়ে একা?”
মীরা
হালকা হাসল, কিন্তু সেই হাসিতে স্বস্তি আর অব্যক্ত ভয় মিশে ছিল, “হ্যাঁ, রিপোর্ট শেষ
করতে দেরি হয়ে গেল।”
অরিত্র
সঙ্গে হাঁটতে লাগল। প্রধান রাস্তায় পৌঁছেই চারপাশের ভিড়, বাসের হর্ন, দোকানের ঝলমলে
আলো যেন এক অদৃশ্য সুরক্ষা বলয় গড়ে তুলল। কিন্তু মীরা জানত, এই বলয় সাময়িক—এক পা
বাইরে গেলেই অন্ধকার আবার তাকে ঘিরে ধরতে পারে।
২
মীরার
শিকড় নদিয়ার এক গ্রামে। ছেলেবেলায় শীতের রাতে উঠোনে কুয়াশার চাদর মেলে থাকত, আর
চুলোর ধোঁয়া উঠত ধীর গতিতে আকাশে। কাকিমারা গোল হয়ে বসে পিঠে বানাতেন, আর গল্প করতেন—পুরনো
দিনের, হারিয়ে যাওয়া মানুষের, আর অনন্ত অপেক্ষার।
কিন্তু
সেই গল্পের ফাঁকেই হঠাৎ ফিসফিস করে বেরিয়ে আসত অন্য কথাও— "রাতের পর মেয়েমানুষ
একা বাইরে বেরোবে না"
"স্কুল তো ঠিক আছে, কিন্তু মেয়েকে বেশিদিন পড়ানো ঠিক নয়"
মীরা
ছোটবেলায় এসব বুঝত না, কিন্তু বড় হতে হতে দেখতে পেল, এই কথাগুলো শুধু সতর্কবার্তা
নয়—এগুলো ছিল লোহার শিকল, যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু প্রতিদিন শক্ত করে আঁকড়ে
ধরে।
পাশের
বাড়ির রত্না দিদি ছিল তার প্রিয়। রত্না দিদি নার্স হতে চেয়েছিল, সাদা অ্যাপ্রন পরে
মানুষের সেবা করার স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু পনেরো বছর বয়সে তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।
সেই দিন থেকে রত্নার বইপড়া বন্ধ, স্কুলে যাওয়া বন্ধ, আর স্বপ্নও বন্ধ। মীরা দেখেছে,
কীভাবে একসময়ের হাসিখুশি দিদি ধীরে ধীরে চুপচাপ হয়ে গেল, চোখের ভেতর জমে উঠল এক অদৃশ্য
কষ্ট।
গ্রামের
মেয়েদের জন্য ভয় যেন নিত্যসঙ্গী—কখনো বাল্যবিবাহ, কখনো পারিবারিক সহিংসতা, কখনো প্রতিবেশীর
কটূক্তি। অসুখ হলেও রাতে পুরুষ সঙ্গী ছাড়া ডাক্তার দেখাতে যাওয়া মানা। আর এইসব নিয়ম
ভাঙতে চাইলেই কানে আসে কথার বাঁশি, "মান-সম্মান বলে কিছু আছে তো!
ট্রেনটা
নদিয়া ছুঁয়ে যাচ্ছিল। জানালা দিয়ে মীরার চোখে পড়ছিল ধু ধু মাঠ, সরু ডোবা, সাদা
বক, আর দূরের কুঁড়েঘর। শীতের কুয়াশা পাতলা হয়ে এসে রেলের হাওয়ার সঙ্গে তার গালে
লেগে ছিল। এই পথই তো তার শৈশব—এই পথেই ছুটে এসেছে পিঠেপুলির গন্ধ, পেঁপের বাগান, ঝিঁঝির
ডাক, আর গোপনে বেড়ে ওঠা এক দুঃসাহসী স্বপ্নের বীজ। তবু সেই স্বপ্নকে বারবার কেটে দিয়েছে
অদেখা এক কাঁচি—নাম তার ‘নিয়ম’, পদবী- ‘সমাজ’।
স্টেশন
থেকে নামতেই রত্না দিদি এসে জড়িয়ে ধরে, “আয়রে, শহুরে মেয়ে! কতদিন পর এলি!”
মীরার চোখে পড়ে—দিদির হাসি আগের মতোই, কিন্তু চোখের কোলটা একটু টলে গেছে। পাশেই দাঁড়িয়ে
দিদির মেয়ে পিয়া—সাতাশ-আটাশে, শাড়ি পরা, কাঁধে একটা ব্যাগ। পিয়ার চোখে একটা চেনা
তেজ—যেটা মীরা নিজের কিশোরী বয়সে দেখেছিল আয়নার মাঝে।
পথে হাঁটতে
হাঁটতে রত্না দিদি বলল, “এবার স্কুলে পিয়ার চাকরির কথা হয়েছে। ইন্টারভিউ ডাকা হয়েছে।
তবে গ্রামের লোক জন বলছে, এত পড়াশোনা করে কী হবে, বিয়ে তো করতেই হবে!”
মীরা
হেসে বলল, “বিয়ে ইন্টারভিউয়ের পরেও তো করা যায়, এমন কী তাড়া!”
রত্না
দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “তাড়াটা মেয়েদের পিছনেই লাগে রে। ঘড়িটা যেন তাদের জন্যই দ্রুত চলে।”
বাড়ির
উঠোনে চুলোর ধোঁয়া সোজা আকাশে ওঠে যাচ্ছে। পিঠের গন্ধে উঠোন ভরে গেছে। আড্ডা জমতেই
রত্না দিদি আলতো গলায় বলল, “মনে আছে, ছোটবেলায় কী বলতাম? নার্স হব? স্বপ্নটা যে কোথায়
হারাল…”
মীরা হাত চাপা দিল দিদির হাতে, “হারায়নি। অন্য রূপে আছে—পিয়ার চোখে। মনে আছে, তুই
বলতিস, সাদা অ্যাপ্রন পরে মানুষের সেবা করবি? এখন পিয়া শিক্ষিকার অ্যাপ্রন গায়ে দেবে—সাদা
না হোক, তার ভেতর আলো আছে।”
পিয়া
হাসল, “আলোর কথাটাই তো সবাই ভুলে যায় খালি। মা বলে, রাত্তিরে একা স্কুল থেকে ফিরিস
না। কাকা বলে, মেয়েদের এত দূর চাকরি করা ঠিক না। পাড়ার বৌঠান বলে, ‘মেয়েমানুষ বেশি
পড়লে সংসার ভাঙে।’ আমি ভাবি, সংসারের বাঁধন যদি পড়াশোনায় দুর্বল হয়, তবে সে সংসারই
দুর্বল যেন।”
মীরার
বুকের ভেতর ছোট্ট এক আগুন জ্বলে উঠল। এই আগুনই তো তাকে বারবার শহরে টেনে তোলে, অজস্র
কাগজ, ফাইল, সাক্ষাৎকার, টালমাটাল মধ্যরাত—সব সামলে দাঁড়াতে শেখায়।
৩
পরদিন
দুপুরে পিয়ার স্কুল থেকে ফেরার কথা। কিন্তু প্রায় বিকেল হতে চলল, কোথাও দেখা নেই।
রত্না দিদি উৎকণ্ঠায় ফোন করল এক বান্ধবীকে—খবর এল, পিয়াকে পঞ্চায়েত ভবনে ডাকা হয়েছে।
অভিযোগ—“স্কুল শেষে ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে চায়ের দোকানে দাঁড়ায়, বেশি কথা বলে।”
মীরা
মুহূর্তে বুঝে ফেলল, বিষয়টা ‘চা’ না, ‘বেশি কথা’।
পঞ্চায়েতে
পৌঁছে দেখল, দু’তিনজন জ্যাঠা-দাদা রোয়াবে বসে। মাঝখানে ধূসর টেবিল, পাশে একটা রেজিস্টার,
আর তার পাশে চিরচেনা কাশি-বদনাম-ভ্রুকুটি।
একজন
বলল, “মেয়েরা বেশি মেলামেশা করলে নাম খারাপ হয়।”
মীরা
ঠান্ডা গলায় বলল, “নাম খারাপ হয় কার? যে ‘ভ্রু কুঁচকে’ দেখছে, তার? নাকি যে পড়ে, কাজ
করে, নিজের পথে হেঁটে ভবিষ্যত গড়তে চায়, তার?”
পিয়ার
চোখে জল এসে গিয়েছিল। রত্না দিদি অস্থির। মীরা ব্যাগ থেকে প্রেস-কার্ড বার করে টেবিলের
ওপর রাখল—খসখসে শব্দে কাগজটা জেগে উঠল, “আমি শহরের এক পত্রিকায় কাজ করি। শিক্ষিকার
প্রার্থীকে চায়ের দোকানে দাঁড়ানোর অভিযোগে ডাকা হয়েছে—এই খবর মুদ্রিত হলে কার ‘নাম’
খারাপ হবে, একটু ভেবে দেখবেন।”
চুপসে
গেল আড্ডা। কাশি দেওয়া লোকটা বলল, “আচ্ছা, আমরা তো আর খারাপ চাই না। গ্রামকে রক্ষা
করাই আমাদের দায়িত্ব।”
মীরা মৃদু হাসল, “গ্রাম রক্ষা মানে মেয়ে-ছেলের বোকা বোকা বিভাজন না। রক্ষা মানে প্রত্যেকের
নিরাপত্তা—মেয়েদেরও। মেয়েরা চায়ের দোকানে গেলে নাম খারাপ হয়, ছেলেরা গেলে হয় না—এই
সমীকরণের কোনো অঙ্ক নেই। আছে শুধু ভয়।”
শেষে
সুর নরম হল। পিয়াকে কিছু না বলে ছেড়ে দেওয়া হলো। রত্না দিদি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বাড়ির
উঠোনে ফিরে পিয়া মীরার দিকে তাকিয়ে বলল, “মাসি, তুমি না থাকলে আজ কাঁদতেই বসতাম।”
মীরা বলল, “কাঁদবি কেন? গলা পরিষ্কার করে কথা বলবি। ভয়কে শব্দে আঘাত কর, দেখবি ভয়ের
গায়ে কোন চামড়া নেই।”
৪
শর্মিলার কথা মীরার স্মৃতিতে
বারবার ফিরে আসে। রাতের ল্যাবরেটরিতে গবেষণার সুযোগ হারিয়ে ফেলেছিল সে, শুধু পরিবার
বলেছিল বলে—“মেয়েরা রাতে বাইরে যায় না।” আজ সে প্রাইভেট টিউশনি করে, কিন্তু চোখে
তার অপূর্ণতার ছায়া রয়ে গেছে।
শহরের নিশা—কল সেন্টারের কর্মী।
গভীর রাতে শিফট শেষ হলে রাস্তায় একা পড়ে যায়। “দিদি, অফিস থেকে বেরোতে রাত দেড়টা
বাজে। সেই সময়ে রাস্তাটা যেন শত্রুর মতো লাগে,” বলেছিল নিশা।
আর দক্ষিণ ২৪ পরগনার সালমা—ষোলো
বছর বয়স, কিন্তু বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে গেছে। চোখে অনিচ্ছা, কিন্তু কণ্ঠে কোনো আওয়াজ
নেই। সে চায় স্কুলে পড়তে, কিন্তু জানে, বাড়ির সিদ্ধান্তের বিপরীতে কিছু বললে তার
চলাফেরার স্বাধীনতাও কেড়ে নেওয়া হবে।
এই তিন জীবনের তিনটি ছবি—তাদের
প্রেক্ষাপট আলাদা, কিন্তু ভয়ের ছায়া এক।
৫
প্রতিটি গল্প মীরার ভেতরে
আগুনের মতো জমতে লাগল। সাংবাদিকতার পেশায় থাকা অবস্থায় অনেক ঘটনা সে কাভার করেছে,
কিন্তু এবার যেন এই গল্পগুলো ব্যক্তিগত হয়ে গেল।
রাত জেগে রিপোর্ট লিখতে লিখতে
সে ডায়েরিতে লিখল— “আইন চাই, কিন্তু শুধু আইন নয়। চাই মন বদলানো, চাই রাস্তায় আলো,
চাই নিরাপদ শহর ও গ্রাম, চাই হাসি ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি।”
কয়েকদিন পর কলকাতায় ফিরে মীরা
নিশার সঙ্গে দেখা করল। কফি-শপে নয়—নিশার ইচ্ছে, অফিসের বাইরে, রাত সাড়ে বারোটায়, যেখানে
সে সাধারণত রাইড নেয়।
ছোট্ট ব্যাগ, হাতে কার্ড-অ্যাক্সেস, আঙুলে একটা রুপোলি আংটি। নিশা বলল, “দেখুন, আমি
ভয় পাই না—না হলে এই শিফট করতাম না। কিন্তু ভয় আমাকে প্রতিদিন চিনতে শেখায়: কোথায় দাঁড়াব,
কার দিকে তাকাব, ট্যাক্সিতে উঠলে দরজা খোলা রাখব কি না, ড্রাইভারের আয়নাতে কাজলের দাগও
দেখছি কিনা…”
মীরা প্রশ্ন করল, “কোনো অভিযোগ
করেছ?”
নিশা হাসল, “কমপ্লেন? করেও দেখেছি। থানা জিজ্ঞেস করেছে—‘কত রাত্রে বেরিয়েছিলে? একা
ছিলে কেন? কাপড় কেমন ছিল?’ বুঝলেন তো, অভিযোগটা তখন আমাকেই করা হচ্ছে।”
“তবু লিখেছ?”
“লিখেছি। কেস চলছে। কোর্ট ডেট পেলেই, অফিস থেকে ছুটি, কোর্টের জন্য দৌড়। কিন্তু আমার
ব্যাগের ভেতর একটা পেপারস্প্রে ঢুকে গেছে। এটুকু আত্মরক্ষা যদি অপরাধ হয়, তবে আমি প্রতিদিন
সে অপরাধ করি।”
মীরার মনে হল, নিশার কণ্ঠে
যে খসখসে দৃঢ়তা, সেটাই শহরের রাতের প্রকৃত সারাংশ—আত্মরক্ষা, আত্মসম্মান, আর ঘাড় সোজা
করে জীবন দেখা।
৬
দক্ষিণ ২৪ পরগনার সেই গ্রামে
সালমার সঙ্গে দেখা। মাথায় ওড়না, কপালে ঘাম, চোখে অবুঝ ভয়। সালমার বাবা-মা কথা বলল,
“দেখুন বৌদি, মেয়ের বয়স তো হলো। ছেড়ে দিলে ছোঁড়ারা মাথায় উঠবে। ভালো পরিবারে সমন্ধ—মেয়ের
ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত।”
মীরা জিজ্ঞেস করল, “সুরক্ষা
মানে?”
বাবা-মা একসঙ্গে বলল, “স্বামী থাকবে, সংসার থাকবে, খাওয়াবে, ডাক্তার দেখাবে…”
মীরা বলল, “এই সব তো এখনই হচ্ছেঃ স্কুলে শিক্ষক আছে, মিড-ডে মিল আছে, স্বাস্থ্যকেন্দ্র
আছে। মেয়েরা যত বেশি পড়বে, তত বেশি নিজের পায়ে দাঁড়াবে—তখন সুরক্ষা বাইরে নয়, তার
ভেতরেই থাকবে।”
সালমা একবার আড়চোখে তাকাল
মীরার দিকে। সেখানে নিঃশব্দে একটি কথা জন্ম নিচ্ছিল—“আমি কি পারি?”
মীরা সূক্ষ্ম হেসে বলল, “পারবি। তবে পাশে দরকার একজন প্রাপ্তবয়স্ক—যে শুনবে, থামাবে
না।”
সেই প্রাপ্তবয়স্ক হল—গ্রামের আশা কর্মী বিপাশা আর এক স্কুলশিক্ষক, উজ্জ্বলদা। পঞ্চায়েতে
বসল সবাই। কেউ কেউ বলল, “আইন! ১৮ বছরের আগে বিয়ে বেআইনি।“ কেউ বলল, “বদনাম! বাড়ি ফিরেই
গসিপ।“
শেষে মীমাংসা—সালমার বিয়ে এক বছর স্থগিত। স্কুলে পড়বে। নথিভুক্ত হলো সিদ্ধান্ত। কোটার
বহির্ভূত এক চিঠি লিখে রাখল পঞ্চায়েত—“শিক্ষা অব্যাহত।”
মীরা দেখল, ছোট্ট এক কাগজে
বড়ো এক জয়। গাছের পাতায় হাওয়া লাগার মতো হালকা, কিন্তু টেকসই।
৭
শহরে ফিরে সম্পাদকীয় বৈঠকে
মীরার প্রতিবেদন নিয়ে আলাপ। সম্পাদক বললেন, “হেডলাইন চাই শাণিত তরবারির মতো। ‘মধ্যরাতে
রাস্তায় নারী’—এমন কিছু।”
মীরা দৃঢ়, “হেডলাইন কাটবে, কিন্তু মর্যাদা কাটা যাবে না। আমরা ভয় বিক্রি করব না—সমাধান
বলব। পাঠককে শুধু কাঁপাবো না—ভাবাবো, নড়াবো।”
এবার সে আলাপ করল ‘মহিলা সহায়তা
ডেস্ক’-এর এএসআই সুপর্ণা বসুর সঙ্গে। সুপর্ণা বললেন, “মামলা নিতে গড়িমসি—এটা বদলানো
জরুরি। থানার ভেতরকে নারী-বান্ধব করতে হবে। অভিযোগকারীকে যদি প্রথম প্রশ্নেই সন্দেহ
করা হয়, সে আর ফিরবে না।”
মীরা জিজ্ঞেস করল, “কী চাই?”
সুপর্ণা: “ফাস্ট-ট্র্যাক শুনানি, বডি-ওয়ার্ন ক্যামেরা, পাড়ায় পাড়ায় আলো, গণপরিবহনে
জরুরি বোতাম—এগুলো নীতি-পালনের মতো নয়, জীবন বাঁচানোর মতো।”
প্রতিটি বাক্য মীরার খাতায়
ঢুকে গেল। সে বুঝল—আইনের কাগজে কালি আছে, দরজায় পলিশও আছে; কেবল চাবিটা বারবার হারিয়ে
যায়। সে-ই তো খুঁজতে হবে—নীতিতে, ব্যবস্থায়, আর আচরণে।
৮
একদিন সন্ধ্যায় শর্মিলার বাড়ি।
শর্মিলা দরজা খুলে হেসে বলল, “আয়, আমার রান্না তোর কলকাতার রেস্তরাঁকে হার মানাবে!”
খাওয়ার পর ছোট্ট টেবিলে এল শর্মিলার পুরনো নোটবুক—মলাটের কোণে আঁকিবুঁকি, ভেতরে সমীকরণ।
মীরা জিজ্ঞেস করল, “এগুলো এখনো লিখিস?”
শর্মিলা জানাল, “লিখি। সব না—কিছু। সদ্য একটা অনলাইন কোর্সে ভর্তি হয়েছি। রাত জেগে
পড়ি। বাবা এবার খুব বাধা দেয় না, বয়সে নরম হয়েছে। তুই বলেছিলি না—‘স্বপ্ন ঘুমোয়, মরে
না’? ওটাই মনে রেখেছি।”
মীরা হেসে বলল, “তুই জাগিয়ে রাখিস, আমি আগুন জ্বালাতে সাহায্য করব।”
শর্মিলার চোখে সেই পুরনো আলোর
রেখা দেখা দিল। যে আলো একদিন ল্যাবরেটরি হারিয়েছিল, আজ ঘুম-ভাঙা শহরতলিতে নতুন ছন্দে
ফিরে এল।
৯
কলেজ স্ট্রিটে বইমেলায় মীরা
‘তীরের ওপারের আলো’ সিরিজের পোস্টার দেখল—তাদের পত্রিকা আয়োজন করেছে খোলামেলা আলোচনার।
বিষয়ের শিরোনাম: “নিরাপত্তা কি নারীর অনুগ্রহ—না অধিকার?”
বসে আছে তরুণ-তরুণী, শিক্ষিকা, আইনজীবী, পুলিশ, সাংবাদিক, কয়েকজন অটোচালকও। মীরা সঞ্চালনা
শুরু করল।
এক ছেলে উঠল, বলল, “আমাদেরও
ভয় থাকে—রাতে অটো চালাই, ঝামেলা হয়। তবে মেয়েরা যখন একা, তখন আমরাও নজর রাখি।”
এক অটোচালক সোজা বলল, “ভাই, নজর মানে নজরদারি না—সঙ্গে দাঁড়ানো। এই তফাতটা সবাই বুঝুক।”
হাসি ছড়িয়ে গেল। তারপর নিশা
মাইক ধরে বলল, “আমরা ভয় পাই না—ভয়কে চিনি। তবে ‘ভয়কে মানো’ বলার জায়গায় ‘ভয়কে বদলাও’
বলুন। আমি প্রতিদিন কাজ করি—আমার কাজকে অপরাধ বানাবেন না।”
সুপর্ণা বসু বললেন, “থানাকে
আমরা বদলাচ্ছি—কিন্তু ঘরের কথাও বদলাতে হবে। প্রথম শিক্ষা ঘরেই, প্রথম নিরাপত্তাও।”
শিক্ষক উজ্জ্বলদা যোগ করলেন, “স্কুলে ‘সেফটি কারিকুলাম’ বাধ্যতামূলক করা হোক—শিশুদের
সম্মতি, সীমা, আইনি সহায়তা শেখানো হোক।”
মীরা অনুভব করল—আলোছায়ার
ভেতর দিয়ে শহরটা হাঁটছে, কিন্তু হাঁটছে সামনের দিকে।
১০
ইন্টারভিউয়ের দিন। পিয়ার
চোখে কাজলের সরু রেখা, মুখে গামছার মতো নরম দৃঢ়তা। মীরা বাইরে বসে আছে।
শিক্ষক প্যানেলের জিজ্ঞাসা
— “কেন শিক্ষকতায় আসতে চান?”
পিয়া উত্তর দেয়, “কারণ শিক্ষাই স্বাধীনতা শেখায়। মেয়েদের ঘরে রাখার সবচেয়ে ভালো
উপায় অশিক্ষা—আর আমি সে দরজা বন্ধ করতে চাই।”
“রাতে ফিরতে হবে—কী ভাবে ফিরবেন?”
“গ্রামটা আলো চায়। স্কুল শেষ হলে একসঙ্গে কয়েকজন ছাত্রীকে নিয়ে ফিরব, পথের আলো কম
হলে পঞ্চায়েতকে বলব—আলো লাগান। রাস্তায় আলো না থাকলে, মানুষের মনে আলো থাকে না।”
বাইরে এসে পিয়া মীরার হাত
ধরল, “আমি ভয় পাই না। ভয় থাকলে তার সঙ্গে হাত মেলাই না—উচ্চস্বরে কথা বলি।”
সেদিন সন্ধ্যায় খবর এল, পিয়া নির্বাচিত। রত্না দিদির চোখে জল। “আমার সাদা অ্যাপ্রন
ও-ই পরল।”
১১
রাত একটা। মীরার ফোন বেজে
উঠল—নিশা। হাঁপাতে হাঁপাতে, “দিদি, রাইড ক্যানসেল করে গেছে, বাইরে পাঁচজন দাঁড়িয়ে আছে।
ভয় পাচ্ছি।”
মীরা আর কথা বাড়াল না। অরিত্রকে ফোন করল—“উবের বুক করো ওই লোকেশন থেকে। আমি আসছি।”
তিনজন তিন জায়গা থেকে ছুটল। মীরা পৌঁছে দেখল, নিশা দোকানের শেডের নিচে। পাঁচজনের ভিড়
নেই—মীরার ফোনে আশপাশের দোকানদার, এক রাতের সিকিউরিটি এসে দাঁড়িয়েছে।
মীরা দৃঢ় গলায় বলল, “এখানে মেয়েরা একা না। দাঁড়াতে হলে মানুষের মতো দাঁড়ান, হুমকি দিলে
পুলিশে খবর দেব।”
দূর থেকে সাইরেন শোনা গেল—প্যাট্রোল কার। ছায়াগুলো গলে অন্ধকারে মিশে গেল। নিশা গাড়িতে উঠে পড়ল।
নিশা কাঁপা গলায় বলল, “আমি হেরে যাইনি, দিদি —আমি ফিরলাম।”
মীরা মাথা নাড়ল, “ফেরাটা-ই তো জয়।”
১২
পরের সপ্তাহে মীরার ফিচার
সিরিজ বেরোল—“তীরের ওপারের আলো”। প্রথম অংশ—শহরের নিশা; দ্বিতীয় অংশ—গ্রামের সালমা;
তৃতীয়—পিয়ার ইন্টারভিউ; চতুর্থ—আইন ও প্রয়োগ; পঞ্চম—সুপর্ণা বসুর ‘পুলিশিং উইথ কেয়ার’।
শেষ পাতায় মীরার কলাম— “ভয়কে নীতিতে ঠেকাও: রাতের শহরে আলো, ফাস্ট-ট্র্যাক আদালত,
নারী-বান্ধব থানা, স্কুলে সেফটি শিক্ষা, গণপরিবহনে জরুরি বোতাম—এই পাঁচ খুঁটিতে দাঁড়াবে
নিরাপত্তার সেতু। আর সমাজ? সে সেতুর ওপর দিয়ে হাঁটা শিখুক মানুষের মতো।”
পত্রিকা অফিসে সেই দিন অচেনা
অনেক ফোন—কেউ বলেন, “এমন গল্প আগে পড়িনি”; কেউ বলেন, “আমার মেয়ের জন্য আলো লাগালাম।
ধন্যবাদ।”
মীরা জানে—সংবাদ কেবল খবর
না; কখনো কখনো তা পথ, ব্রিজ, বাতিঘর।
১৩
আবার নদিয়ার পথে ট্রেন। জানালার
বাইরে ঘুমন্ত গাছ, দূরে গরুর গাড়ি, কাছে আধো আলোয় গা ঢাকা কুঁড়ে। মীরা ডায়েরি খুলে
লিখল— “নিরাপত্তা দয়া নয়—অধিকার। আইন একা যথেষ্ট নয়—আচরণ বদলাও। আলো জ্বালো, রাস্তা
জুড়ে দাও, থানা খুলো, আদালতের ঘড়ি চালাও। আর ঘরে? মেয়েদের ভয় শেখিও না—সীমা শেখাও,
সম্মতি শেখাও, শ্রদ্ধা শেখাও।”
স্টেশন নামতেই রত্না দিদি
আর পিয়া। পিয়ার হাতে নতুন নিয়োগপত্র। আকাশে ঝকমক করছে তারা।
পিয়া বলল, “মাসি, আমি কাল স্কুলে প্রথম ক্লাস নেব—‘ভয়কে চিনে নাও, ভয়কে বদলাও।’”
মীরা হাসল, “শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন, টিচার!”
রাত গভীর। আকাশে পূর্ণিমা।
মাটিতে শিশির। মীরার মনে হল, এই রাতটা প্রতীক—যেন লম্বা অন্ধকার পেরিয়ে আলোর ছোট্ট
লক্ষ্মণরেখা টানা হয়েছে। সে হাঁটতে হাঁটতে ফোন বের করে অল্প অক্ষরে লিখল— “আমি থামব
না। যতদিন না প্রতিটি নারী নিজের পথের আলো নিজেই জ্বালাতে পারে, ততদিন লিখব, বলব, দাঁড়াব।”
দূরে নদীর কালো জল চাঁদের
রুপালি রেখা কেটে নিয়ে যাচ্ছে। মনে হলো—তীরের ওপার থেকে সত্যিই আলো ভেসে আসছে।
১৪
শহরের শীতকালের সন্ধ্যা। ভিক্টোরিয়া
মেমোরিয়ালের দিক থেকে আসা ঠান্ডা হাওয়া মীরার মুখে লাগছিল। আজ সে বক্তা—‘নারীর নিরাপত্তা
ও সমঅংশগ্রহণ’ বিষয়ে এক মুক্ত আলোচনায়। অনুষ্ঠানটি হচ্ছে এক নামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে।
হল ভর্তি—ছাত্রছাত্রী, আইনজীবী, কিছু পুলিশ অফিসার, শিক্ষক, সাংবাদিক, এনজিও কর্মী—সবাই
জায়গা নিয়েছে। সামনের সারিতে রত্না দিদি, পিয়া, শর্মিলা, নিশা, এমনকি সালমার বাবা-মাও
বসে আছে।
সঞ্চালক মঞ্চে উঠে বললেন,
“আজকের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হবেন মীরা সেন—যিনি ‘তীরের ওপারের আলো’ ধারাবাহিক প্রতিবেদন
দিয়ে আমাদের অনেককে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করেছেন।”
মীরার নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে
করতালির ঢেউ উঠল। সে মঞ্চে গিয়ে দাঁড়াল, মাইক্রোফোনে হাত রাখল, আর চারপাশে তাকাল—এক
মুহূর্তের জন্য চোখে পড়ল প্রত্যেকটি মুখ, যাদের গল্প সে বহন করে এনেছে।
“যে সমাজ নারীর নিরাপত্তা
দিতে পারে না,”—মীরা ধীরে ধীরে বলল—“সে সমাজ তার অর্ধেক স্বপ্নকেই জন্মের আগেই মেরে
ফেলে। শর্মিলার বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন, নিশার গভীর রাতে নিরাপদে বাড়ি ফেরার আশা,
সালমার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে—সবই সেই অর্ধেক স্বপ্নের অংশ।”
“আমরা অনেক সময় ভাবি, আইন
করলেই সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু আইন একা কিছু করতে পারে না, যদি মনোভাব না বদলায়,
যদি রাস্তার আলো না জ্বলে, যদি আদালতের কেস বছর বছর ঝুলে থাকে, যদি থানায় প্রথম প্রশ্ন
হয়—‘আপনি এত রাতে কেন বেরিয়েছিলেন?’”
তার কণ্ঠ দৃঢ় হয়ে উঠল— “নিরাপত্তা
দয়া নয়—অধিকার। এই অধিকার নিশ্চিত করা শুধু সরকারের কাজ নয়—এটা আমাদের সবার দায়িত্ব।
শিক্ষক, পুলিশ, অভিভাবক, সহকর্মী—সবাইকে দাঁড়াতে হবে পাশে। মেয়েদের শেখাতে হবে আত্মরক্ষা,
আর ছেলেদের শেখাতে হবে শ্রদ্ধা।”
“নতুন নবজাগরণ তখনই আসবে,
যখন বাংলার প্রতিটি নারী রাতের শহরে হেসে হাঁটতে পারবে, গ্রামের মেয়েরা ভয় ছাড়া
নিজের ভবিষ্যৎ আঁকতে পারবে। আমরা যদি অর্ধেক আলোয় বাঁচি, তবে আমাদের আগামীও হবে অর্ধেক।”
শেষ বাক্যের সঙ্গে সঙ্গে হলভর্তি
মানুষ হাততালি দিল। অনেকের চোখে জল, অনেকে দাঁড়িয়ে করতালি দিচ্ছে।
১৫
ট্রেন নদিয়ার মাঠ পেরিয়ে
চলেছে। জানালার বাইরে নদীর জল কালো, কিন্তু তাতে চাঁদের আলো সাপের মতো বেঁকে বেঁকে
পড়ছে। মীরার মনে হলো—এটাই প্রতীক। অন্ধকার যতই হোক, আলো তীর পেরিয়ে আসবেই।
রত্না দিদি, শর্মিলা, নিশা,
সালমা—তাদের প্রতিটি মুখে সে সেই আলো দেখতে পাচ্ছে। হয়তো পথ দীর্ঘ, হয়তো লড়াই কঠিন,
কিন্তু আলো আসছে—ধীরে ধীরে, নিশ্চিতভাবে।
ট্রেনের শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে
সে মনে মনে বলল— “ভয়কে নয়, আলোকে উত্তরাধিকার করব আমরা।”