৬
সুমুর থেকে সিয়াচেন
২৬-২৭শে জুলাই ২০২২
ভাগ্যিস
২৫ তারিখেই নুবরা উপত্যকায় মোটামুটি যা কিছু করণীয় বলে জানতাম, সেগুলো সেরে নিয়েছিলাম।
কারণ ২৬ তারিখে তুরতুক ও নিয়ন্ত্রণ রেখা থেকে ফিরে এসে স্যান্ডডিউনে সময় কাটানো কোনওভাবেই
সম্ভব ছিল না। সাতসকালে হোটেলের বিল মিটিয়ে তাই গাড়িতে মালপত্র নিয়েই উঠেছিলাম। তুরতুক
থেকে ফিরে এসে উঠলাম নুব্রা উপত্যকারই পরতাপুরে একটি সেনা ছাউনির অফিসার্স মেসে। বর্ডার
রোডস্ নয়, খাস আর্মির তত্ত্বাবধানে।
পরতাপুর
জায়গাটার
নাম যে পরতাপুর এবং দেশের প্রতিরক্ষায় যে তার বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ভূমিকা
আছে, সেসব নিয়ে ক্লান্ত শরীরে আর মাথা ঘামাইনি। শুধু ছবির মতো পটচিত্রে সাজানো গোছানো
কটেজ দেখে মুগ্ধ মন খারাপ হয়ে গেল, আগামীকাল ভোরেই এটা ছেড়ে যেতে হবে। এমন জায়গা পেলেই
রাতবিরেত না মেনে আমি কষে কাচাকুচি, শ্যাম্পু, ত্বক পরিচর্যা, মিরর সেলফি ইত্যাদি সেরে
ফেলি। ঝাঁচকচকে ঘরের ভেতরেও বৃষ্টির টুপটাপ। ছবি তুলে কোয়ার্টর মাস্টারকে জানানোর পর
ঠেকজোড়া ব্যবস্থা হল। কিন্তু অমন সুন্দর কক্ষে মিলিটারি কেতায় প্রভূত খাদ্য সহযোগে
প্রকৃতির স্পর্শ মন্দ লাগল না। তেমন ঠাণ্ডা তো নেই। প্রসঙ্গত লে-র দিকে বৃষ্টিপাত প্রায়
শূন্য, সব পাথুরে। কিন্তু নুব্রা উপত্যকার বালিয়াড়ি উট ইত্যাদি সহকারে মরূসদৃশ্য পরিবেশেও
কিছুটা স্নিগ্ধ সবুজের ছোঁয়া আছে।
বৃষ্টির সঙ্গে সহাবস্থান করেই আরেকটা দিন পরতাপুরের
স্বপ্নালু আর্মির Field Workshop-এর এই Ofiicers’ Mess-এ কাটাতে পারলে সিয়াচেন দেখার
জন্যও ঠাঁইনাড়া হতে হয় না। মেসের দায়িত্বে থাকা কর্নেল ও ক্যাপ্টেনকে নিজের ইচ্ছা জানালামও।
কিন্তু পরের দিন অন্যদের বুকিং ছিল বলে ২৭ জুলাই সকাল সকাল প্রাতঃরাশ সেরে গাড়িতে সেই
আবার সব মালপত্র তুলেই সিয়াচেনের উদ্দেশে রওনা হতে হল।
সুমুর হয়ে সিয়াচেন:
সিয়াচেন বেস ক্যাম্প:
ইস্! গতকাল গোটা ইউনিটের কম্যান্ডিং অফিসার কর্নেল
(নাম মনে নেই) নিজে এক ঝলক এসে আমাদের খোঁজ খবর নিয়ে গেছেন, পরের দিন বুকিং হয়নি
বলে মেসের দায়িত্বে থাকা ক্যাপ্টেন চারবার ফোন করে দুঃখপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু আমার
চেকপোস্টে এসে যে প্রশ্ন জাগল, সেটা আগের দিন মাথাযতেই এল না? আসলে কার্গিল যুদ্ধে
পরতাপুরের ভূমিকা ভুলেই গিয়েছিলাম।
বেড়ানোর ব্যাপারে আমাকেই সজাগ থাকতে হয়। যাঁর সবকিছু
নখদর্পণে, সেই মহাশয় তো “স্যর আইয়ে, ঠ্যারিয়ে” বলে না বসালে যোগাযোগ থাকলেও কাজে
লাগাবেন না, অফিসের কাজে ইছাপুর থেকে বাবুঘাট কিংবা শিগিগুড়ি থেকে কালিম্পং নিজের
বাইকে যাতায়াত করবেন, গাড়ির দরজা খুলে না বসালে অফিসের কাজের জন্যও গাড়ি চাইবেন না।
ইস্! “কুছ ভী চাহিয়ে তো বতা দিজিয়ে গা ম্যাডাম”-এর উত্তরে আমার মাথায় কেন এল না
বেস ক্যাম্প থেকে আরেকটু এগোনোর ইচ্ছা প্রকাশের কথা। আসলে বেস ক্যাম্পের অধিক এগোনো
যায় বা দরকার হয়, ভাবিইনি। ধরে নিয়েছি, সেখানেই হিমবাহ ও যুদ্ধক্ষেত্রের আরম্ভ।
যাইহোক, সিয়াচেন বেসক্যাম্পে War Memorial
ও বরফে ঢাকা পর্বতচূড়া দেখা আর কিটকিটে মিষ্টি চা ও মোমো খাওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু করার
ছিল না। ক্যাম্পের সুবেদার বেশ গপ্পবাজ মানুষ। জানালেন, সিকিমে নাথুলায় যেমন ‘বাবা
মন্দির’ আছে এক সৈনিকের স্মৃতিতে, এখানেও তেমনি আছে আরেক বাবা মন্দির আরেক মৃত সৈনিকের
স্মৃতিতে। তাঁর ‘ওপি বাবা’। নাথুলার হরভজন সিং কিংবা সিয়াচেনের ওপি বাবা -- এঁরা কেউ
পরমবীর বা মহাবীর চক্র পাওয়া যোদ্ধা নন। কিন্তু তাঁদের বিদেহী আত্মা সেনা ও সাধারণ
মানুষকে বিপদ থেকে রক্ষা করেন, এই বিশ্বাস অনেকের কাছে আষাঢ়ে গল্প শোনালেও দুর্গম ও
সুকঠিন পরিস্থিতিতে জীবন মরণের মাঝখানে দাঁড়ানো উর্দি পরা মানুষগুলোর মনোবলের একটা
মস্ত উৎস।
সিয়াচেন শুনলেই মানসচক্ষে তুষারাবৃত পাহাড়ে
বরফে পা ডুবিয়ে হাঁটার দৃশ্য ভেসে ওঠে। কিন্তু এখানে এত গরম যে কিছুই মেলাতে পারছিলাম
না। তবে একটা সেতুর ওপারে সুদূরে মিলিয়ে যাওয়া পীচ রাস্তাটা ধরে কিছুদূর এগোলে হয়তো
দেখা মিলত আসল সিয়াচেনের; মানে গ্লেসিয়ার বলতে যা বুঝি তার। সুবেদার ভদ্রলোক নিজে এসেছিলেন
সঙ্গে। আমার হাহুতাশ বাড়িয়ে বললেন, “পরতাপুরমে স্যরকো একবার সির্ফ বোলনা থা না। একদম
ব্যাটেল ফিল্ড তক দিখা দেতেঁ।” কালো রাস্তায় তৃষিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বাবা মন্দির
বা স্মৃতিসৌধ দেখে ফেরার পথ ধরতে হল।
সেই পথেই আর একটি মেমোরিয়াল জাতীয় সুন্দর সংগ্রহশালা।
রাষ্ট্রীয় প্রতীক অশোক চক্রের ঠিক নীচে বসে ছবি তোলাব বলে সিঁড়ির ধারিতে ঘষটে ঘষটে
এমন জায়গায় চলে গেছি, সে সিঁড়িতে পা দিয়ে নামার চেষ্টা করতে হাড়গোড় ভাঙার গ্যারেন্টি
ছিল। সেখানে এক সৈনিক সিয়াচেনে হওয়া ইন্দো-পাক যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে একটা দামী
কথা বলল, “এয়সে তো দোনো তরফ কী সিপাহী রোজ় মিলতে, জ়রুরত পড়নে পর হম এক দুসরে সে রেশন
ভী মাঙগকর খা লেতে হ্যায়। জংগ তো তব হোতা জব উপর সে অর্ডার আতী হ্যায়।”
‘ব্যাটেল ফিল্ড্ সেফফি পয়েন্ট’ দেখে হাসি
পেল, দীর্ঘশ্বাসও পড়ল। যুদ্ধও ‘পর্যটন পণ্য’ হয়ে গেল তাহলে! একটা আর্মি জিপসিতে কয়েকজন
বয়স্ক মানুষের সঙ্গে আমাদেরও বসিয়ে ছাউনিতে ফিরিয়ে আনা হল। ঐ পেটমোটা সুবেদার ভদ্রলোকই
ব্যবস্থা করে নিজে পদব্রজে এলেন। শামিয়ানার নীচে বসে তাঁকে দেখে ভূত দেখার মতো অবাক
হয়ে গেলাম। অক্সিজেনের স্বল্পতা ও ঝলসানো গরমে যেখানে আমার অষ্টাদশী কন্যাও হাঁটতে
গিয়ে কেঁদে-রেগে একাকার, সেখানে গায়ে গরম ও ভারী ইউনিফর্ম পরে এই প্রৌঢ় সৈনিক কি যানবাহন
ছাড়া উড়ে চলে এলেন? কী দিয়ে তৈরি এরা?
উর্বীর খেপচুরিয়াস মেজাজ অক্সিজেন দিয়ে শমিত
করতে হল। আহ্লাদী মেয়েটা শরীরে কষ্ট হলে মাঝেমাঝে বছর ছয়েকের শিশু হয়ে যায়। গপ্পুড়ে
সুবেদার আমার মেয়েকে অনেক বোঝালেন, “বেটী, ফৌজমে আ যাও। পাপাকা ইজজ়ত দেখ রহে হো না।
কোই ভী প্রাইভেট কম্পানিমে জাওগী তো ইয়ে নহী মিলনেওয়ালা।” ভদ্রলোক শেষে বললেন, “স্যর
মেমোরিয়াল শপ সে কুছ লেকর যাইয়ে।”
আমি ততক্ষণে বেশ গদগদ। আমাকে ‘ম্যাডামজী’-র
বদলে ‘দিদি’ বলেছেন, কলকাতা গিয়ে আমার হাতে ঠিকঠাক চা খেতে চেয়েছেন (আমার “চায়ে
খুব মিষ্টি” কথাটা কী করে জানি কানে গিয়েছিল), সর্বোপরি আমার মেয়েকে ভালো ভালো কথা
বলে কাউন্সেলিং করেছেন। স্যরের সদ্য অক্সিজেন দিয়ে দাঁড় করানো মেয়েকে নিয়ে ফেরার
তাড়া থাকলেও ‘দিদি’ শপিংএর গন্ধে ভাইয়ের কথা রেখে সিয়াচেন শপে ঢুকে পড়লেন। মেয়ের
সেনা সংক্রান্ত কিছুতেই রুচি নেই। ওর জন্য একটা টি শার্ট কিনে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটালাম।
সুমুর উষ্ণ প্রস্রবণ:
সুমুর শহরের দিকে ফেরার রাস্তায় একটু এগিয়েই
গাড়ি থামাতে হল। আমার কন্যা বমি করে একটু সুস্থ হল। এতক্ষণ অক্সিজেন নিয়েও খিটখিটে
ছিল। কিছুটা এগিয়ে আবার গাড়ি থামাল চালক। সরু নালা লাফিয়ে পার করে একটা সবুজ বাগানে
আমাদেরও ডাকল। দু’জন মহিলার খাবার দোকান। মিনিয়েচার আকারে একখণ্ড অপুর্ব নিসর্গ, খুদে
বাগান, খুদে নালা।
রিগজ়িন গিয়েই গল্প জুড়ল। এই গ্রামে ওর শ্বশুরবাড়ি।
ক্ষেত থেকে ব্রকোলি আর টমেটো তুলে এনে ম্যাগি করে খাওয়াল ওরা। তিনজনের মাত্র ১০০ টাকা,
আর অসামান্য স্বাদ! ড্রাইভারের ফেরার তাড়া নেই। অবশ্য ফিরবে কোথায়? আমাদের সঙ্গেই তো
সপ্তাহ খানেক ধরে ঘুরছে। থাকছে সেনা ছাউনির গাড়ি চালকদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরে। একটু
পরে একটা স্কুলবাস একটি বাচ্চা মেয়েকে নামিয়ে দিয়ে যেতেই সে ছুটে এসে রিগজ়িন-এর গলা
জাপটে ধরল।
রিগজ়িং-এর বৌ সরকারি চাকরি করে। মেয়ে ঐ দোকানের
মালকিনদের কাছেই থাকে স্কুল থেকে ফিরে। ২০ দিন পর বাবাকে দেখে আর ছাড়ল না। বাবার গলা
জড়িয়ে আমাদের সঙ্গেই সুমুর পর্যন্ত এল। গাছের আপেল আর এপ্রিকট পেড়ে দিতে বললাম হোটেলের
ছেলেটাকে। হাসিমুখে কচি কচি দু হাত নাড়িয়ে মেয়ে মায়ের বাড়ি চলল বাবার গলা জড়িয়ে।
সুমুর
গেস্টহাউস:
লাদাখের অন্যান্য বাড়িতে তেমন কিছু চোখে না
পড়লেও সুমুর এ.ও. গেস্টহাউসের অন্দরসজ্জা অনুরূপ তিব্বতী আঙ্গিকে বলে মনে হল। ডাইনিং
টেবল-চেয়ার যেমন আছে, তেমনি মেঝেতে বাহারি জাজিমের ওপর পাতা আসনে বসে অনুচ্চ জলচৌকিতেও
থালা রেখে ভারতীয় তথা এশীয় শৈলীতে খাওয়ার আয়োজনও। আমরা দ্বিতীয়টাই বেছে নিলাম। ব্যবস্থাপনা
যেমন পরিচ্ছন্ন, খাবারের স্বাদও তেমনি অসামান্য। কে বলবে এই রাজ্যে খাদ্যাভাবে কুকুররা
মানুষকে ছিঁড়ে খায়?
সকালে জলখাবার পর্যন্ত পড়ল ৩০০০ টাকা। এ ছাড়া
জল, নরম পানীয় এগুলো সর্বত্রই হিসাবের বাইরে।
পূর্ববর্তী পর্ব : ৫।। হুন্দর থেকে তুরতুকের পথে পরবর্তী সংখ্যা : ৭ ।। গন্তব্য প্যাংগং