অনামিকার
পাঁচটি কবিতা (হিন্দী)
অনুবাদ: শ্রীপর্ণা
বন্দ্যোপাধ্যায়
১
সম্পর্ক
ও ছিল একেবারে অচেনা।
ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক বলতে শুধু এটুকুই –
যে নতুন পাড়ায় আমরা দুজনেই
একই
দোকানের গ্রাহক ছিলাম!
ও আমার আগে থাকতেই বসেছিল –
টফির বয়ামে ঠেসান দিয়ে
স্টুলের রাজসিংহাসনে।
আমার চেয়েও বেশি ক্লান্ত
দেখাত তাকে। তবুও ও হাসল।
ঐ হাসিতে না কারণ ছিল,
না ব্যাকরণ, না সূত্র, না অভিপ্রায়।
সে ছিল ভ্রমের হাসি।
ও তারপর হাতও বাড়াল,
আর আমার শালের কোণা ধরে
একটা সূতো সোজা করে দিল
যেটা বাসের কোনও পেরেকে লেগে
ভ্রূকূটির মতো কুঁচকে গিয়েছিল।
মুহূর্তের জন্য মনে হল: ওর সেই ঝুঁকে পড়া কাঁধের সঙ্গে
আমার টলমল করা মাথার
যেন অনেক পুরোনো ভগ্নীত্ব।
২
প্রেম ইন্টারনেটে
শাস্ত্রীয় প্রেমীদের মতো মনযোগ সহকারে
ও আমার মাথা টিপে দিতে পারে না,
বেনী বেঁধে দিতে পারে না,
কলসীতে জলও ভরাতে পারে না,
হ্যাঁ, ভৃঙ্গরাজের পাতাও ঘষে দিতে পারে না
আমার পায়ের ফাটাতে;
কিন্তু ও আমার বিকটতম ক্ষণেও
চমৎকার চুটকি পাঠিয়ে হাসাতে পারে!
কত অমূল্য বইয়ের ভাস্বর অংশ
ফরওয়ার্ড করতে পারে।
নিতে পারে মক ইন্টারভিউ
প্রকৃত সাক্ষাৎকারের আগে!
আমাকে পরামর্শ দিতে পারে,
ঝরঝরে শানিত ব্যাঙ্গের মুক্ত বর্ষণ
করতে পারে আমার ওপর।
আমার ত্রুটি দর্শাতে পারে
স্বাধীন নিরপেক্ষতা নিয়ে।
রামমোহন ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর,
কার্ভে ও জ্যোতিবা ফুলের মতো ধৈর্য নিয়ে
ও আন্দোলন চালাতে পারে
যা আমারই নবজাগরণে নিবেদিত!
কাঁসা পেতলের কারিগরের মতো
একাগ্র তন্ময়তা নিয়ে
আমার সত্তার দম্ভের ওপর
ও করতে পারে কারুকার্য!
ঘরে বেশি ভিড়ভাট্টা হলে
পাক্কা ধুরন্ধরের মতো
থাকতে পারে পর্দার নিভৃত আড়ালে!
আমার বিদ্যুতের বিল হারিয়ে গেলে
আবার সবজান্তাসুলভ মগ্ন ক্ষিপ্রতায়
চোখ বুজে দিব্যি বলে দিতে পারে –
“দেখো তো দালানের টেবিলের বাঁদিকে রাখা
বইয়ের ওপর, কাল যখন সব্জি সাঁতলাতে সাঁতলাতে
ঐ বই থেকেই উদ্ধৃতি শোনাচ্ছিলে,
তখন মাঝ পথেই –
বিদ্যুতের দর বেড়ে যাওয়ায়
নাকি কান্নার একটা ব্রেক নিয়েছিলে।
যখনই আমার চাকরি টালমাটাল,
যখন আমি মার খাচ্ছি,
বা গালাগালির মেঘভাঙা বর্ষণ
আমাকে লাথি মেরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে
মাঝরাস্তার কাদায় –
ও আমাকে এমন একটা এসএমএস করতে পারে
যা আমার ডুবন্ত মনটাকে
অন্ধকার কূপ থেকে যেন কপিকলের মতো
এক ঝটকায় টেনে তুলে আনে!
কথাও যে হতে পারে উড়ো জাহাজ,
আর শব্দ হতে পারে আরবি ঘোড়া –
তা তো ওর কথাই আমাকে শিখিয়েছে!
একদিন ও বলল, প্রাচীন ওয়েলসে চাষীরা
বলদের মনোরঞ্জনের জন্য তার সামনে হাঁটত,
নত হয়ে গানবাজনা করতে করতে চলত
যাতে বদল প্রসন্ন হয়
এবং ক্ষেতে প্রফুল্ল পদচারণায় উড়ে চলে!
মাটিতে বলদের হাওয়ায় ভেসে চলাফেরায়
ফসল মিষ্টি হয়, বুঝলে ম্যাডাম!
আর বলদের সঙ্গে জবরদস্তি হলে মাটি রুষ্ট হয়!
জোয়াল যারই কাঁধে থাক,
তার কিন্তু বিনীত অনুনয় প্রাপ্য,
নিঃসন্দেহে প্রাপ্য, তাই না?"
৩
কিছু তো
কিছু তো হোক।
কোনও পাতা কোথাও দুলুক,
জীবনে কিছু ঘটা দরকার এবার –
বললে বোঝার মতো কোনও কথা,
চললে পৌঁছোনোর মতো,
করলে হয়ে যাওয়ার মতো কোনও তরঙ্গ।
হে ভগবান, হচ্ছে কী এই
ঠোঁট চলছে লাগাতার?
শব্দের সঙ্গে অর্থ যেন লুকোচুরি খেলছে,
কথা কোথাও পৌঁছোতে পারছে না!
যাকেই দেখো, সেই চড়ে আছে –
কেউ কারও কাঁধে, কেউ বা নিজেরই মাথায়!
সবাই সওয়ার, সবাই চলেছে কোথাও না কোথাও
কোত্থাও না পৌঁছে।
ঠিক যেমন জার নিকোলাই
কোনও ফরমান জারি করেছেন –
“যে কৃষক খাজনা দিতে পারেনি,
যাক সেখানে, কে জানে কোথায়?
আনা হোক তাকে, কে জানে কাকে?"
কী আনতে বেরিয়েছিলাম ঘর থেকে, আমি ভুলে গেছি।
লুকোচুরি খেলতে গিয়েই আমি পেয়েছি
মাটি থেকে পেটেন্টেড বীজ।
ওখানে কোথাও মাটিতে
একেবারে মাটিতে মিশে গেছে যাবতীয় স্বপ্ন।
গোদানের আগে হাল চাষীরা
করে ফেলেছে আত্মদান।
আত্মহত্যা তো একটা হত্যাই ছিল ধারাবাহিক!
সুদূর পশ্চিম থেকে চলছে অগ্নিবাণ:
ঈশ্বর – থেকে অদৃশ্য।
সর্বত্র ট্রাফিক জ্যাম –
রাস্তার সঙ্গে নিজের যাবতীয় ঠিকানার
সম্পর্ক গেছে ছিন্ন হয়ে।
শত বর্ষ ধরে বিকল পড়ে আছে
বাড়ির গুরুজনরা ল্যান্ড লাইনের মতো।
আমিও দিয়ে ফেলি ভুলভাল সিগন্যাল।
দূর থেকে যেই ডায়াল করুক
আমার তরফ থেকে পায়
সর্বদা ব্যস্ত থাকার মিথ্যে বার্তা!
কীসের ব্যস্ততা!
কিন্তু রিসিভার অফ থাকলে কিছুই হয় না
কিংবা সার্বজনীন বাক্সের সঙ্গে
নিজের সংযোগ ছিন্ন হয়ে গেলে
এমনটা হয়, হয় না –?
ক্রমাগত ব্যস্ত থাকার ভুল সিগন্যাল আসতে থাকে।
কিছু তো হোক!
কোথাও কোনও পাতা তো দুলুক!
জীবনে কিছু ঘটা দরকার এবার!
বললে বোঝার মতো কোনও কথা,
চললে পৌঁছোনোর মতো,
করলে হয়ে যাওয়ার মতো তরঙ্গ!
তল্লাশি
উনি বললেন, “হ্যান্ডস আপ!”
আমার প্রতিটি অঙ্গ বিদ্ধ করে
উনি আমার তল্লাশি করলেন!
আমার অনুসন্ধান করে কী পেলেন তিনি?
সামান্য স্বপ্ন আর চাঁদ পাওয়া গেল –
সিগারেটের রাংতা প্রমাণ,
দেশলাই প্রমাণ আশা, এক অসমাপ্ত চিঠি
যা ও ডিকোড করতে পারেনি,
কারণ তা সিন্ধু সভ্যতার সময়ে
আমি লিখেছিলাম –
এক অভেদ্য লিপিতে –
নিজের ধরিত্রীকে –
"হ্যালো ধরণী, কোথাও চলো ধরণী,
কলুর বলদ হয়ে কতদিন আর একই বৃত্তে ঘুরপাক খাব?
এসো, আজ কোথাও বাঁক নিয়ে ছুটি
কোনও অগ্নিবাণ হয়ে
এই গ্রহের কক্ষপথ থেকে দূরে!
উনি চিঠি মুড়লেন
আর ছুঁড়ে ফেললেন আমাকে কাল-কুঠুরিতে!
নিজের কলম দিয়ে ক্রমাগত
সেই থেকে খুঁড়ে চলেছি
কালকুঠুরিতে সুড়ঙ্গ!
কান খাড়া করে শোনো –
পৃথিবীর বুকে কী বাজছে!
কোনও লুকিয়ে থাকা সোনা কি?
আর সুড়ঙ্গের দরজায় –
দেখা যায় কি যায় না
এক ক্ষীণ আলো
কী মনোরম কিঙ্কিণী
আর খোলামেলা ঘাসের ময়দান!
হতে পারে কোনও লোকগীতি বয়ে গেছে
গতকাল রাত এই রাত থেকে!
কচি কচি পা উড়ে উড়ে গেছে
শিশির স্নাত ঘাসের ওপর দিয়ে।
আপাতত, শুধু এক ছায়া
শিশিরের ওষ্ঠে থরথরিয়ে বেঁচে আছে!
সৃষ্টির প্রথম অনুভূতি দেখো তো –
কেমন টপটপ করে ঝরে পড়ছে!
৫
বৃদ্ধ দম্পতির
প্রেমালাপ
ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে এল, আর জানলায় কেদারা টেনে বসে পড়ল,
জামার একটা বোতাম খুলে ফেলল অতঃপর,
জামার হাতায় মুছে নিল ঘাম।
ভাবলাম, যদি এমনটাই রীতি হত,
কাজকর্মের কোনও চিন্তা থাকত না,
সারাদিন তুমি বাড়িতেই থাকতে,
শতেক উপমা দিতে,
আমারও মনে হত আমি কিছু একটা হই,
কিছু ভ্রান্তিও জরুরি জীবনে!
কথোপকথন- নদী আর ছন্দ-টন্দ, ফুল-টুল,
পাখি, প্রজাপতি, চাঁদ, হরিণ টরিণ,
পৃথিবীর সমস্ত সবুজ
উপমা থেকেও উধাও হয়ে গেলে আর রইবে কী?
তুমি আমার ভাবনা পড়ে ফেললে
আর মৃদু হাসলে যেহেতু আমি চুল আঁচড়াচ্ছিলাম,
তুমি মজা করে বললে
“রূপসী তোমার ঘন কেশদাম...!”
আমিও হেসে বললাম,
“আচ্ছা তাহলে এত দিনে বোঝা গেল?
কথাটা বললেও কখন, না যখন চিরুণি চালালেই
এই মেঘে সাদা সৌদামিনী ঝিকিয়ে ওঠে
নববধূসুলভ উৎসাহে।”
“এই রূপোর সূতোগুলোকে অভিনন্দন,” তুমি বললে,
এটাই তোমাকে দেবে তোমার নতুন সত্তায় প্রবেশের ভিসা –
সেখানে আকাশ খোলামেলা হবে,
রোদ হবে খুব মৃদু আর বইবে প্রসন্ন বাতাস।
আড়চোখে দেখবে আমাকে অম্লমধুর নাশপাতি --
সময় ও জলবায়ুর ঝড়ঝাপটা নানাভাবে সহ্য করে
একই শাখায় টিকে থাকা,
একসাথে একই গন্ধে স্নাত!
'কুমারসম্ভব'এর উজ্জ্বল পায়রা
মাথার ওপর ঘুরপাক খাবে,
এধার থেকে ওধার লাল লাল চোখ নাচিয়ে।
"আচ্ছা, ঢের হয়েছে, এবার থামো,
আর এত উড়ো না, আমাকে দালান অব্দি যেতে দাও,
তিনবার ফোটালাম, ফুটে ফুটে জল শুকিয়ে গেল,
এবার কী বলবে বলো তো কেটলি রানী –
কী বকুন্তুরে গপ্পবাজ এই দুই প্রাণী!"
অনুদিত : ১০.০৫.২০২২