গ্রন্থালোচনা : উৎসব (ছোটগল্প সংকলন) ।। শ্রীপর্ণা বন্দোপাধ্যায় ।। পত্রপাঠ প্রকাশনী ।। মূল্য: ₹ ২৩৫/-
আলোচনা : চন্দ্রকান্ত পাল
বইমেলা থেকে বই কেনার সামর্থ্য স্কুল বা কলেজে পড়ার সময় ছিল না, তবুও পড়েছি স্কুলের ও আমাদের মফঃস্বল শহরের একটা গ্রন্থাগারে সদস্য হয়ে। বন্ধুদের বাড়িতে বা স্কুলে ওদের থেকেই চেয়ে শুকতারা, চাঁদমামা, আনন্দমেলা, বাঁটুল / নন্টে-ফন্টে / হাঁদা-ভোঁদা / বেতাল/ রিপ কাৰ্বি / ম্যানড্রেক / বাহাদুর / ফ্ল্যাশ-গর্ডন পড়তাম। যে বাড়িতে খবরের কাগজ পড়তে যেতাম, সেখানে একটা দুটো পূজাবার্ষিকী পড়ার সুযোগ জুটে যেত। এরপর কলেজে উঠে টিভি আর খেলা গল্পবই পড়ার জগৎকে অনেকটা দূরে সরিয়ে রেখেছিল। আর একটু বড় হয়ে কেরানি হবার সুযোগে, বই মেলা দর্শন আর বই কেনার শখ পেয়ে বসল; বই পড়া ততটা নয়।
প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় উপনীত হয়ে হঠাৎ পাঠ প্রতিক্রিয়ার আবেদন দু একটি প্রকাশনী ও ব্যক্তিবিশেষের কাছে পেয়ে তা নিছক কথার কথা ভেবে সময়ের ফল্গুধারায় নিমজ্জিত করে দিয়েছি। কটাই বা বই আর পড়ে উঠি, বেশির ভাগটাই তো বইয়ের তাক ভরানোর প্রতিযোগিতা। কিন্তু স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে আলোচ্য বইটির ক্ষেত্রে আর গাফিলতি খাটল না। বইটি চটজলদি পড়ে দায় চোকাতে গিয়ে রীতিমতো ডুবে গেলাম।
২০২৩ সালে আমার এখনও
পর্যন্ত কেনা দুইটি বইয়ের মধ্যে দুটিই শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। পত্রপাঠ প্রকাশনী
থেকে প্রকাশিত শ্রীমতি শ্রীপর্ণা বন্দোপাধ্যায়ের লেখা মোট পনেরোটি গল্পের সংকলন “উৎসব”
(নভেম্বর, ২০২২-এর প্রথম মুদ্রণ, মাত্র মূল্য ২৩৫ টাকা) পড়ে সততই মুগ্ধ হলাম। গল্পগুলো
কয়েকটি বাদে কোনো না কোনো উৎসব ঘিরে। তবে তা কখনও সরাসরি, কখনও ব্যঞ্জনায় অথবা ব্যাঙ্গ
হিসাবে। সূচী অনুযায়ী আমার পাঠ খুব সংক্ষেপে নিজের প্রতিক্রিয়া নিচে দিলাম।
১) “উৎসব” গল্পে লেখিকা পারিবারিক জীবনে ব্যক্তিত্বের
টানাপোড়েন খুবই মুন্সিয়ানার সাথে উপস্থাপিত করেছেন। চরিত্র চিত্রণ যেমন বাস্তব, সামাজিক
রীতিনীতির প্রতি শ্লেষটাও তেমনি মর্মভেদী। এক বৃদ্ধের মৃত্যু ও শ্রাদ্ধ বাসর কীভাবে
উৎসবের চেহারা পেতে পারে, তা দরদী পর্যবেক্ষণ ও মরমী উপস্থাপনের নাম 'উৎসব'।
২) “ঘূর্ণাবর্ত” গল্পে উচ্চশিক্ষার দিনগুলিতে যুবক যুবতীদের
সাথে ঘটে চলা কিছু ঘটনা লেখিকা অত্যন্ত সুনিপুণ ভাবে অবতারণা করেছেন। ছাত্রছাত্রীদের
ক্যাম্পাস জীবন নিয়ে অনেক গল্প উপন্যাস সিনেমা ধারাবাহিক ইত্যাদি আছে। কিন্তু সেগুলো
থেকে ঘূর্ণাবর্তর জাত আলাদা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাপটে প্রেম, পড়াশুনো ও রাজনীতির
এই ত্রিবিধ ঘূর্ণাবর্ত অত্যন্ত উপভোগ্য কিন্তু গভীরভাবে ভাবার মতো বিষয় তুলে এনেছে।
আর এখানেই উৎসব অন্যান্য ক্যাম্পাস প্রেমের গল্পের থেকে অন্য উচ্চতায়।
৩) “সভাঘরে” গল্পে এক লেখিকা তার কর্মজগৎ ও সন্তান প্রতিপালনের
মধ্যের দ্বন্দ কে সার্থক ভাবে তুলে ধরেছেন। কতগুলো ডিটেইলিং-এর মাধ্যমে মেয়েদের কত
চিন্তা ও অতিরিক্ত দায়িত্ব নিতে হয়, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। সর্বোপরি প্রশ্ন তুলেছেন
একটি চিরাচরিত প্রবাদে-- মেয়েরা কি সত্যিই মেয়েদের শত্রু? তাহলে কাদের ভরসায় মেয়েরা
সন্তানের দায়িত্ব দিয়ে তারা বাইরের জগতে পা রাখে?
৪) “বিনিময়” গল্পটি এক প্রচলিত পৌরাণিক গাঁথার একটি অংশ
বিশেষ, কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ ও চরিত্র বিন্যাসে। ভাষা মানানসই। খুব সুন্দর
ডিটেইলিং যা পুরুষ লেখকদের মাথায় আসবে না।
৫) “শ্রী ক্ষেত্রে” গল্পটি আগে কোথাও পড়েছি, কিন্তু মনে
করতে পারছি না। শ্রীপর্ণা দেবীর আরও দু-একটি বইয়ে দেখেছি গল্পগুলো কবে কোথায় প্রকাশিত,
উল্লেখ ছিল। খুব গুরুত্বপূর্ণ ইম্প্রেসিভ নথি সেটা। কিন্তু বর্তমান বইটিতে তেমন কিছু
না থাকায় আমিও মনে সঠিক করতে পারছি না আনন্দবাজারে নাকি অন্য কোনও রবিবাসরীয়তে। যাই
হোক, ঘটনার যেমন খুঁটিয়ে বর্ণনা, তেমনি রোমাঞ্চের ঘনঘটা ও শেষে টানটান উত্তেজনার তৃপ্তিদায়ক
পরিসমাপ্তি পাঠক মনে ছাপ ছেড়ে যাবেই।
৬) “বিপক্ষ” গল্পে এক উঠতি খেলোয়াড়ের জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত,
সাফল্য, ব্যর্থতা, মানসিক উত্থান-পতন অত্যন্ত সাবলীলতার সাথে ফুটিয়ে তোলা ছোট গল্পের
সেই "শেষ হইয়াও হইল না শেষ"-এর মত করে রেশ টুকু রেখে যায়। ক্রিকেট সংক্রান্ত
খুঁটিনাটির বেশ গভীরে জ্ঞান আছে বোঝা যায় টেকনিক্যাল বিষয়ের উত্থাপনে। তবে সব ছাপিয়ে
গল্পটির মানবিক আবেদনই মন ছুঁয়ে গেল।
৭) “পুজোর বোনাস” গল্পে আমাদের বাংলার, পশ্চিমের এক শহরের
সহজ অথচ দুর্বোধ্য জীবনযাত্রা অত্যন্ত সহজ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আঞ্চলিক বাংলাভাষার
ওপর দখল সমৃদ্ধ করেছে গল্পটির সংলাপগুলোকে। হয়তো পরিস্থিতি কঠিন, কিন্তু সরস ভঙ্গীতে
উপস্থাপিত বলে উপভোগ্য।
৮) “বেতন” গল্পের বিষয় বস্তু হল জীবনযাপনের টানাপোড়েন
ও মহামারীকালে সম্পর্কের উত্থান-পতন সম্পর্কিত। করোনা ও লকডাউনের ফলে আর্থসামাজিক দিক
দিয়ে পৃথক অবস্থানের মানুষেরা কীভাবে প্রভাবিত, তা দুটি নারী চরিত্রের মধ্যে ফুটিয়ে
তোলা হয়েছে। তবে শেষে রয়েছে এক গা ছমছমে চমক।
৯) “ক্লাব হাউসের টিকিট” গল্প সামাজিক অবক্ষয় ও সমাজে
তার সার্বিক প্রতিফলনের একটি খন্ডচিত্র। এক অবসরপ্রাপ্ত আম্পায়ারের করুণ কাহিনী। এখানেও
খেলা সংক্রান্ত ধ্যানধারণার পরিচয় পাওয়া যায়।
১০) “বিজয়া” গল্পে আবহমান কাল জুড়ে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিশ্বাসের
অমর্যাদা করার একটি বলিষ্ঠ লেখনী। আবার স্নেহ ভালোবাসা দায়িত্ববোধেরও যুগপৎ পরিচয়।
অত্যন্ত সাবলীল ও স্মার্ট এই উপস্থাপনা।
১১) “ঘোষণা” গল্পে একটি ঐতিহাসিক ঘটনার প্রবাহ, বাঁক ও
সর্বোপরি তার চমকপ্রদ কিন্তু করুণ সমাপ্তি এই কাহিনীর মূল উপজীব্য। গল্পের শেষে সূত্র
নির্দেশ থেকে জানা যায় এই রাজবংশ ও কয়েকটি চরিত্র ঐতিহাসিক হলেও ঘটনার বিবরণ ও নাটকীয়
চরিত্রগুলি কাল্পনিক। অথচ এমন নিপূণ ও মানানসই ভাষায় তার বর্ণনা যে মুগ্ধ না হয়ে
উপায় নেই। একটি কুপ্রথার মর্মান্তিক ও চমকিত করার মতো পরিণতি মনে দাগ কাটতে বাধ্য।
১২) “ব্যবচ্ছেদ” গল্পে লেখিকা এক হৃদয়ের মানসিক উত্থান-পতন
অত্যন্ত পটু হাতে বর্ণনা করেছেন। মূলত প্রেমের আখ্যান যা গদ্যরূপে প্রকাশিত হলেও প্রকাশভঙ্গী
অনেকটা কাব্যিক।
১৩) “ফেরা” গল্পে
বৃহন্নলাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি খন্ড চিত্র উপস্থাপিত করেছেন লেখিকা। তাদের আসল জীবন
ও জীবিকা নিয়ে লেখা গল্প। গল্পে আশ্চর্য কুশলতায় অশ্লীলতা এড়িয়ে শুধু ইঙ্গিতে তুলে
ধরেছেন গোপনতম বিষয়।
১৪) “প্রত্যাশা” গল্পের বিষয় বস্তু হল স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কে
কর্ম ও পারিবারিক জীবনে একে অপরকে স্বীকৃতি দেওয়ার অভাবের টানাপোড়েন সম্পর্কিত।লেখিকার
কম্পিউটার সংক্রান্ত জ্ঞানেরও পরিচয় মেলে এই সামাজিক গল্পে।
১৫) পরিশেষে “হোলি” গল্প আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা ও তার ভঙ্গুর
সামাজিক মূল্যবোধের প্রেক্ষিতে দাঁত চেপে সয়ে যাওয়া এক হতভাগিনীর কাহিনী, যদিও অধিকাংশ
গল্পের মতোই এটিও শেষ হয়েছে চমক দিয়ে।
প্রতিটি
গল্পই তার স্বীয় মাধুর্যে স্বতন্ত্র, সত্যই পাঠকের অন্তরাত্মায় ঘা দেয়। আবার সবকটি
গল্পের মধ্যেই লেখিকার সেই বিষয়ে সংক্রান্ত সম্যক জ্ঞান বা অনেকটা ধ্যানধারণার পরিচয়
পাওয়া যায়। ক্রিকেট হোক বা কম্পিউটার, পুরীর রাস্তাঘাট হোক বা আন্তর্জাতিক বিমানের
রুট। গল্পগুলো কী নিয়ে উল্লেখ করলেও কোনও সারসংক্ষেপ দিলাম না। তাতে সদ্যপ্রকাশিত বইটির
চমক নষ্ট হতে পারে যদিও ইতিমধ্যে বহু পাঠক গল্পগুলো বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় হয়তো পড়ে
ফেলেছেন। তবু দুই মলাটে নিজেরাই আবিষ্কার করুন, কারণ না পড়লে লেখিকার গল্পবিন্যাসের
মুন্সিয়ানা ও ভাষার কারুকাজ ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বোঝাতে গেলে উদ্ধৃত করতে হয়,
আর উদ্ধৃতি দিতে গেলে প্রায় পুরো বইটাই তুলে দিতে হয়।