দোয়া -- আব্দুস সাত্তার বিশ্বাস

 

গল্প

দোয়া
আব্দুস সাত্তার বিশ্বাস


            পৌষ মাসের সকাল। বিরাট উনানে তিনখানা তাওয়া চাপানো রয়েছে। তাতে ঠিলি ঠিলি রস ঢেলে কছিম সেখ রস জ্বাল করছে। তার নিজের হাতে তৈরি খেজুরের রস। জ্বালানি হিসেবে রয়েছে---পাট কাঠি, গমের কাঠি, রাইয়ের খড়, খেজুরের শুকনা বাগড়া, শুকনা ভ্যাট, শুকনা পিঠ্যালু, আতার শুকনা ডাল, শুকনা বাঁশ, বাঁশের কঞ্চি ও আরও কত কী! উনান থেকে একটু দূরে সব ডাঁই দিয়ে রাখা রয়েছে এবং কালো পলিথিন দিয়ে ঢাকা আছে। যাতে হঠাৎ বৃষ্টি হয়ে বৃষ্টির জল ঢুকে পচে নষ্ট হয়ে না যায়। পাট কাঠি, গমের কাঠি আর রাইয়ের খড় বাদে সব গুলোই আদাড়ে জিনিস। বন থেকে সংগ্রহ করেছে। সংগ্রহ করেছে গরম কালে। বন কেটে। বাড়ির আশেপাশে কত বন-জঙ্গল না! এগুলো ছাড়াও রয়েছে শুকনা পাতা। আমপাতা, জামপাতা, কাঁঠালপাতা এবং বাঁশপাতা। এগুলো বাগান ঝাঁট দিয়ে সংগ্রহ করেছে। বাড়ির কাছেই ফারুকদের বাগান। আম বাগান, কাঁঠাল বাগান এবং বাঁশ বাগান। তার মধ্যে জাম গাছও রয়েছে। সারা শীত ভর রস জ্বাল দিতে হবেনা! জ্বালানির টান পড়লে পাবে কোথায়? ফলে যখন যেটা প্রয়োজন ডাঁই থেকে টেনে নিয়ে কছিম সেখ আখার ভিতর ভরে দিচ্ছে। আর গনগনে আগুনে তা পটপট করে পুড়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বদাম বদাম শব্দও হচ্ছে। বোম ফাটলে যেরকম শব্দ হয়। কছিম সেখ তখন চোখ বুঁজছে। একে বলে গিঁট ফাটা। বাঁশ ও কঞ্চি পোড়ার সময় গিঁট ফাটে। এটা হল সেই গিঁট ফাটার শব্দ। বাঁশ ও কঞ্চি যখনই পুড়ছে তখনই শব্দ হচ্ছে।

একটু দূরে মণি বসে রয়েছে। মণি তার একমাত্র ছেলে। একটা বেসরকারি স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ে। ক্লাসে সে ফার্স্ট বয়। আজ রোববার বলে স্কুলে যায়নি। পড়া করে বসে রয়েছে। শরীরে রোদের উত্তাপ নিচ্ছে আর রস জ্বাল করা দেখছে। দেখতে দেখতে হঠাৎই তার চোখ দুটো কছিম সেখের কপালে চলে যায়। কপালে সে একটা দাগ দেখতে পায়। দাগটা সে এর আগেও অনেকবার দেখেছে। কিন্তু ও বিষয়ে কোনদিন কোন কথা জিজ্ঞেস করেনি। আজ জিজ্ঞেস করল, 'আব্বা?'

কছিম সেখ জ্বাল ঠেলতে ঠেলতে বলল, 'কী হল বুল, মণি!'

মণি ওখান থেকে উঠে এসে বলল, 'তুমার কপালে ওডা কাটা দাগ না? পড়্যা গেলছিলে? কীসে?'

'পিঠ্যালুর খুঁচে।'

'সে কী! ছোটবেলায় পিঠ্যালু বনে খুব খেলাধুলা করতে নাকি!'

'না রে! সে এক করুণ কাহিনী!'

'আমি শুনবো। তুমি বুলো!'

'সেই কবেকার কথা! অ তুই শুন্যা কী করবি?'

'তাও আমি শুনবো! তুমি বুলো!'

কছিম সেখ বলল, 'তোর ত্যাখন ছ'মাস বয়স। তখন আমি এ্যাকবার গাছ থাক্যা পড়্যা গেলছিনু। তোর দুলু ফুপু যেখ্যানে বাড়ি কর‍্যা বাস করছে ওখ্যানে পিঠ্যালুর একটা বিরাট জঙ্গল ছিল। ওই জঙ্গলে চাড্ড্যা খেজুর গাছ ছিল। দুট্যা ছোট দুট্যা বড়ো। চাড্ড্যা গাছই আমি লাগাতুক। চাড্ড্যা গাছেই রস খুব ভালো পড়তোক। এ্যাকেবারে ঠিলি উভর‍্যা যাতোক। তার মধ্যে যে গাছ দুট্যা বড়ো ছিল অর মধ্যে একটা গাছ থাক্যা আমি পড়্যা গেলছিনু।'

'কীভাবে পড়্যা গেলছিলে? কোমরে দড়ি বাঁধা ছিল না?'

'রস পাড়ার সময় কোমরে দড়ি বাঁধতে হয় না। তাই দড়ি বাঁধা ছিল না। সেদিন খুব জাড় আর মহ্যা। হাত বার করতে পারছিনু না। হাত জম্যা যাচ্ছিলো। কিন্তু রস তো পাড়তেই হবে। জ্বাল করতে হবে। কতো কাজ। আমি রস পাড়তে গেলছিনু। গায়ে খালি একটা জামা, জাড়ে আমার ভিতর কাঁপছিল। আমি পেথমে ছোট গাছ দুট্যার রস পাড়্যা একটা বড়ো গাছে উঠ্যাছিনু। উঠ্যা পাবঠিতে পা রাখ্যা যেই দাঁড়ালছিনু অমনি পা পিছল্যা গেলছিল। সারারাত মহ্যা পড়্যা পাবঠি ভিজে ছিল। আর খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি কর‍্যা আমার পাও...ফলে আমি নীচে পড়্যা গেলছিনু। ওই সময় মহাসেন জঙ্গলে পায়খানা ফিরতে আস্যাছিল। আস্যা আমি পড়্যা যাওয়ার শব্দ শুনতে পাইয়্যা বুল্যাছিল, 'ধমাক কর‍্যা কী পড়লো রে কছি, গাছ থাক্যা পড়্যা গেলি নাকি! কী হলো, কথা বুলছিস ন্যা ক্যানে? কথা বুল! কছি, ও কছি!' তারপর আমার কাছে আস্যা দেখ্যাছিল, আমি গাছের গোড়ায় পড়্যা আছি, পিঠ্যালুর খুঁচে আমার কপালডা কাট্যা গেলছে, কপাল দিয়্যা রক্ত ঝরছে। উ ত্যাখন আকাবাকি কর‍্যা আমাকে কোলে তুলে লিয়্যা চিৎকার আরম্ভ কর‍্যাছিল, 'কে কুঠে আছিস রে, দৌড়্যা আয়! কছি গাছ থাক্যা পড়্যা গেলছে। দৌড়্যা আয়।' আশপাশের মানুষ দৌড়্যা আস্যাছিল ও আমাকে চ্যাংদোলা কর‍্যা বাড়ি আন্যাছিল এবং উসরায় শুইয়্যা দিয়্যাছিল। আমাকে দেখ্যা তোর মা, 'ওগো, তুমার কী হলো গো! তুমি আভানে আমাধের কী হবে গো! কে আমাধের দেখবে গো! ...' বুল্যা কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে গড়াগড়ি গেলছিল। বাড়িতে প্রচুর লোক জম্যা গেলছিল। আমি কথা বুলতে না পারলেও সব বুঝতে এবং শুনতে পাছুনু, কে কী কথা বুলছে এবং আমাকে লিয়্যা কে কী করছে। মহাসেন হাপিজুলের ভ্যান ডাক্যা আমাকে হাসপাতালে লিয়্যা গেলছিল এবং আমি যতোদিন হাসপাতালে ছিনু আমার কাছে ছিল। আমি তার উপকার কুনুদিন ভুলবো না। যে জায়গা থাক্যা আমি পড়্যাছিনু আমার বাঁচার কুনু কথা ছিল না। না হলে মর‍্যা যাওয়া আজ আমার কতোদিন হয়্যা যাতোক। হাঁড়-মাংস মাটির সাথে সব মিশ্যা যাতোক। আমার নামডাও পৃথিবী থাক্যা মুছ্যা যাতোক। কেহু মুনে রাখতোক না। মাঝে থাক্যা একটা জিনিস হতোক, তুই বাপ হারা হতিক। বাপের স্বাদ তুই কুনুদিনই পাতিকন্যা। হ্যাঁ রে মণি, হ্যাঁ।'

বলতে বলতে কছিম সেখের কণ্ঠস্বর ভারি হল এবং মণির দিকে তাকিয়ে দেখে বলল, 'এ কী মণি, তুই কাঁদছিস!'

মণি বলল,'হ্যাঁ আব্বা, আমি কাঁদছি। তুমি মর‍্যা গেলে আমি কাকে আব্বা বুলতুক? কার কোলে চড়তুক? কে আমাকে জামা, জুতা, বই, খাতা কিন্যা দিতোক? কে আমাকে আদর, যত্ন করতোক? কে আমাকে... তাই আমি কাঁদছি আব্বা, তাই আমি কাঁদছি! ...' তারপর বলল, 'আব্বা, কাজডা তুমি ছেড়্যা দ্যাও! দিয়্যা অন্য কাজ করো। না হলে আমার খুব ভয় করছে। যতি আবার---'
   কছিম সেখ মণির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, 'রস লাগান্যা কাজডা আমিও করতে চাই ন্যা রে বাপ, আমিও করতে চাই ন্যা। এ কাজডা খুব ভালো না। কখুন কী হয় বুলা যায়না। কিন্তু না কর‍্যা কী করবো বুল! রস না লাগালে যে খাতে পাবোনা। তোকে পড়হাতে পারবো না।  তোর ইস্কুলের ব্যাতন দিতে পারবো না। আবার যতি বাপের কিছু থাকতোক রস লাগাতুক না। অথে খাট্যা খুট্যা খাতুক। কিন্তু তাও নাই। আমাকে তাই রস লাগাতেই হয়। আবার যতি অন্য কাজ জানা থাকতোক তাও হতোক। কিন্তু তাও জানা নাই। এ্যাখন তুই বুল, কী করবো!'

মণি বলল, 'আমাকে মানুষ করতে তুমি কতো কষ্ট করছো! বড় হয়্যা আমি তুমাকে কাজ করতে দিব না। আমি রস পাড়ব, তুমাকে বস্যা খাওয়াবো।'

কছিম সেখ অমনি মণিকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল, 'মণি, বাপ আমার, রস পাড়ার কথা একদম বলিস না। আল্লাহ তোকে বড়ো করুক, আল্লাহ তোকে মানুষ করুক, তুই মুন দিয়্যা ল্যাখাপড়া কর। ল্যাখাপড়া কর‍্যা তুই মানুষ হো। তুই মানুষ হলে আমার কুনু দুঃখু থাকবেনা, আমার কুনু কষ্ট থাকবেনা। সব দুঃখু, সব কষ্ট ভুল্যা যাবো। যতি বাঁচ্যা থাকি। আর মর‍্যা গ্যালে গেনু! কিন্তু তুই গাছে চড়বি না, কথা দে।'


শব্দার্থঃ
ঠিলি - সরু মুখ একপ্রকার ছোট হাঁড়ি। মহ্যা - কুয়াশা; পাবঠি - পায়ের পাতা থেকে হাঁটু পর্যন্ত মাপের বাঁশ, যা খেজুর গাছে বাঁধা থাকে। আকাবাকি - তাড়াতাড়ি; উসরা - মাটির ঘরের মেঝে বা বারান্দা; আভানে - বিহনে; পাছুনু - পারছিলাম; গাছ লাগান্যা - রস সংগ্রহ করা ; উভর‍্যা - ছাপিয়ে যাওয়া।


Post a Comment

Previous Post Next Post