গল্প
নারী দি বস!
রীতা রায়
যা
কাঠখোট্টা! তাঁর সাথে প্রেম? ইম্পসিবল! তা সত্বেও চ্যালেঞ্জটা একসেপ্ট করলো অনুন্তিকা
ওরফে অনু। অফিসের বন্ধুরা বলল, কেউ যদি রাগী 'বস'কে বশ করতে পারে তো অফিসকর্মীরা একটু
স্বস্তিতে অফিস করতে পারে নইলে সারাক্ষণ টেনশন -- পান থেকে চূন খসেছে কী অমনি তলব,
ছাটাইয়ের হুমকি। সময় হিসেবেও পাক্কা। একচুল নিয়মের হেরফের হওয়ার উপায় নেই। একমিনিট
লেট এলেই রেজিস্টার খাতায় ঢ্যাঁড়া পড়ে যাবে। অফিস তো নয় যেন জেলখানা! চাক্কি পিসিং
পিসিং… তবুও সুনাম জুটছে না কারোরই। জীবনের সব রোমান্স শুকিয়ে আমসি, রোবটের মতো মেশিন
চালিত মনে হয় নিজেদের। শুধু কাজ আর কাজ। তার ওপর কোনো সুন্দরী মডার্ন মেয়ে হলে তো কথায়
নেই। দোষ করুক আর না করুক সর্বক্ষণ মেজাজ তিরিক্ষে। নাঃ, এর থেকে রেহাইয়ের উপায় একটা
বের করতেই হবে।
কানাঘুষো
শোনা যায়, কোন এক সুন্দরী মেয়েকে নাকি বস বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন আর মেয়েটা তৎক্ষণাৎ
নাকচ করে দিয়ে 'টাকলা মাকলা' বলে যাচ্ছেতাই ভাবে অপমান করেছিল। মাথায় চুল নেই তাই টাকলা
বলেছে সেটা মানা যায়, তাই বলে মাকলা! এরকম মেধাধারী উচ্চপদস্থ অফিসারকে কোন হিসেবে মাকাল
ফলের সাথে তুলনা করলো? মাকাল ফলটি থুড়ি বসবাবুটি রাগ করবেন না তো কী করবেন? তবু যে
উনি মেয়েটির বিরুদ্ধে মানহানি মামলা ঠুকে দেননি, এই যথেষ্ঠ। ইচ্ছে যে একেবারেই হয়নি
তা নয়। কিন্তু কেস চলাকালীন বারবার কোর্টে হাজিরা দেওয়া ও উকিলের জেরায় বারে বারে টাক
প্রসঙ্গ উঠলে তাঁর সুখ্যাতি বাড়বে না, বরং তাঁর টাককে ইন্সাল্ট করা হবে। আর পরিচিত
মহলে তাকে নিয়ে শুরু হবে মস্করা। সেই থেকে শুধু সুন্দরী মেয়ে নয়, পৃথিবীর যত সুন্দর
জিনিস সবকিছুর প্রতি তাঁর বিরক্তি। অলিখিত জেহাদের মতো চারপাশের সমস্ত সৌন্দর্যপ্ৰিয়
মানুষদের পদানত করতে বা পিষে ফেলতে পারলেই যেন মনের ঝাল মেটে। কার দোষ কার ঘাড়ে? কার
শাস্তি কারা ভোগ করছে? নিজে তো যন্ত্র হয়েইছে, অফিসকর্মীদেরও যন্ত্র বানিয়ে ছেড়েছে।
এরকম বসের সাথে প্রেম? নামুমকিন!
কিন্তু,
নামুমকিনকে মুমকিন করে দেখানোর জেদ যখন একবার চেপেছে তখন আর পিছু ফেরা কেন? অনেক ভেবেচিন্তে
অনু একটা উপায় বের করল। চুলে খুবসে তেল ঠেসে, মুখে একটু আধটু কালিভুষী মেখে, শাড়িটাড়ি
পরে মোবাইলে ছবি তুলে, নাম পাল্টে ফেসবুকে একটা নতুন আই-ডি খুলে ফেলল আর বসকে ফ্রেন্ড
রিকোয়েস্ট পাঠাল। দিন যায় দিন যায়… বস আর একসেপ্ট করে না। মনে হয় নজর এড়িয়ে গেছে। অপেক্ষা
করছে শুধু নয় নিজের প্রোফাইল ইতিমধ্যে ঠাকুর-দেবতা আর প্রকৃতির ছবি দিয়ে সাজিয়ে ফেলেছে।
দিন পনের পরে একসেপ্ট করেছে দেখে ভাবল এক পা এগোনো গেল। তারপর অনেক কলাকৌশল খাটিয়ে
মেসেঞ্জারে কখনো সখনো মেসেজ বিনিময়, ধীরে ধীরে হোয়াটস্যাপ।
তারপর
বসকে প্রায় বশ করার সাধ্যসাধনা। যেখানে যত টাকমাথা মহান ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ বা
মহাপুরুষ আছেন, ছবিসহ তাঁদের কোনো মেসেজ পেলেই ফরওয়ার্ড করে দিচ্ছে অনু। তা দেখে প্রথম
দিকে বস তো ভীষণ চটে যাচ্ছিল বিদ্রূপ ভেবে। ফোনে তুমুল ঝগড়াও চললো কদিন। অনুকে ব্লক
করতে যাবে এমন সময় অনু খুব সুন্দর করে ধরতে গেলে প্রেমপত্রের আকারে গুছিয়ে বিষয়টি এমন
বোঝালো যে বশীভূত মন্ত্রের মতো কাজ হল। মানে বোঝাতে চাইলো যে টাক মাথা থাকলেই যে মাথা
গরম করতে হবে তা কিন্তু নয়, অনেক টাকমাথা লোক মাথা ঠান্ডা রেখে মহান মহান কার্যসিদ্ধি
করেছে আর তাদেরকে সে শ্রদ্ধা করে বলেই ফরওয়ার্ড করেছে। আর তাকেও মানে অনিন্দ্যকেও সে
পছন্দ করে বলেই তার সাথে বন্ধুত্ব করেছে। ব্যস! বস মহাশয় তার প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ের
প্রস্তাব দিয়ে ফেলল।
অনুর
শর্ত একটাই, একেবারে শুভদৃষ্টির সময় তাঁরা সামনাসামনি হবে। হলও তাই।
চোখে
চোখ পড়তেই কেমন সব গুলিয়ে গেল অনিন্দ্যর। -- এ কী! আপনি? এরকম কিছু একটা বলতে যাবে, কিন্তু শুভদৃষ্টিতেই চোখের
ইশারায় মেয়েটা বুঝিয়ে দিল যে এত লোকজন বাড়িতে, এখন হাঙ্গামা করা মানায় না।
কী আর করে? প্রেস্টিজ
রক্ষার্থে বিয়ে করতে বাধ্য হল। দেখে নেবে ফুলসজ্জার রাতে। কিন্তু অনু হানিমুন প্যাকেজের দুটো টিকিট হাতে দিয়ে
বলল, "এখন শুয়ে পড়ুন। যা বলার বাইরে গিয়ে মানে হানিমুনে গিয়ে বলবেন। এখানে আত্মীয়স্বজনের
সামনে কোনো হাঙ্গামা করবেন না প্লিজ!"
অনিন্দ্য
ভেবলে যাচ্ছে। রাগগুলো সব মাথায় কিড়মিড় করছে অথচ মুখে কিছু বলার সুযোগই দিচ্ছে না মেয়েটা।
অফিসে তো চোখ তোলার সাহস পেত না। এখন ওই চোখের কারসাজিতেই সব হিসেবে ভুল হয়ে যাচ্ছে।
আচ্ছা, দেখে নেব হানিমুনে। অষ্টমঙ্গলা অব্দি অপেক্ষার পর ওরা পাড়ি দিল বিদেশে হানিমুনে।
দিন
পনেরো কাটিয়ে ফিরল ওরা। এদিকে অফিসের সবাই বেশ উদ্বিগ্ন অনুন্তিকার কথা ভেবে। ওরকম
ডাকসাইটে সুন্দরী মেয়েটার ভাগ্যে কী না জুটলো এক টাকমাথা বদরাগী বর? জুটলো না, সে তো
নিজেই জোটালো। খাল কেটে কুমির আনা একেই বলে। কুমিরের সাথে অফিসে কয়েক ঘন্টা কাটানোই
যখন এত মুশকিল, তখন সারাজীবন ঘর করা… উঃ ভাবা যাচ্ছে না। মেয়েটার কপালে কী আছে কে জানে?
কেন যে ওকে উস্কাতে গেল? সবার ভালো করতে গিয়ে মেয়েটা নিজের জীবন নষ্ট করে ফেলল। প্রেম
প্রেম খেলা খেলতে গিয়ে সে যে একেবারে বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়বে সেটা তো কেউ ভাবেনি। কী
দরকার ছিল এতটা রিস্ক নেবার? যা রাগী বস। এতদিনে হয়তো হাতে ডিভোর্সএর পেপার ধরিয়ে দিয়েছে।
ওইতো
বসের গাড়ির হর্ন। পড়িমরি করে সবাই জানালার ধারে ভিড় করলো। সবার দৃষ্টি নিচে গাড়ির দিকে।
ওই তো স্মার্ট দেখতে অচেনা একজন গাড়ি থেকে নেমে অন্য দিকের দরজা খুলে দিতেই নেমে এলো
অনুন্তিকা। সুন্দর একটা শাড়ি পরেছে, কপালে সিঁদুরের টিপ জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু এ কার
সাথে হাত ধরাধরি করে আসছে অনু। তাহলে কী? বসকে গাড্ডু মেরে অন্য কাউকে… কিন্তু বিয়ের
নেমন্তন্ন তো সবাই খেয়েছে। স্বচক্ষে দেখেছে পরস্পর বিরোধী দুটো মানুষের চার হাত এক
হয়ে যেতে। তাহলে এ কার হাত ধরে আসছে অনু? কাছে আসতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেল সকলেই। মুখে
স্মিত হাসি নিয়ে ভদ্রলোক বললেন, "হ্যালো! কেমন আছেন আপনারা সবাই?"
গলা শুনে সক্কলে একসাথে বলে উঠল, “স্যার
আপনি?”
“হ্যাঁ, বিদেশে গিয়ে
সবার আগে হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করিয়েছি। অনুই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল, ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট
নিয়েই রেখেছিল। বসকে থুড়ি বরকে তার হানিমুন গিফ্ট।”
সবাই হাঁ হয়ে দেখছে,
ভালোবাসার জাদুতে অনিন্দ্য এখন অনিন্দ্যসুন্দর হয়ে উঠেছে। টাক উধাও মানে রাগ উধাও।
এখন অফিসে ও বাড়িতে তারই ওপর বসগিরি করছে অনুন্তিকা ওরফে অনু। একদিন 'নারী দিবস' নয়,
প্রতিদিন ‘নারী দি বস’!