চেনা অচেনা মুখ -- শমিতা ব্যানার্জী

 গল্প

চেনা অচেনা মুখ

শমিতা ব্যানার্জী

 

সুন্দর সুপুরুষ মানুষটিকে সবার পছন্দ হবে৷ বয়স সত্তর হলেও দেখে বোঝা যায় না মেরিন ইঞিনিয়ার ছিলেন, দুই কন্যা সুপ্রতিষ্ঠিত৷ স্ত্রী কনভেন্ট স্কুলে পড়াতেন, সদ্য রিটায়ার করেছেন৷

বাবা বাইরে বাইরে থাকার দরুন মেয়েদের সঙ্গে বাবার অলিখিত একটা দূরত্ব আছে যা এতদিন মিসেস সেন উপলব্ধি করেও যেন করেননি৷ ওনার দুই মেয়েই এখন চাকুরীরতা, অতিমারীর ফলে অফিস তাদের এখন বাড়িতেই, অনেকটা সময়ই যে যার ঘরে কাটাচ্ছে। বুঝতে পারছেন মেয়েরা বাবাকে একটু এড়িয়েই চলে৷ বাবা বাইরে থাকলেই যেন তারা বেশি স্বছন্দ৷ অথচ বাবা তাদের যথেষ্টই স্নেহ করে, বিষযটা ঠিক ভাল লাগে না মিসেস সেনের!

এতদিন চাকুরী করেছেন, বাড়ি সামলেছে গৃহপরিচারিকা। ওনার সেই সময়ও ছিল না৷ ভোরবেলা উঠে মেয়েদের রেডি করে নিয়ে বেরোন স্কুলে, ফিরে আবার মেয়েদের নিয়ে বসা, নিজের পড়াশুনো, খাতা দেখা, প্রশ্ন করা — কাজ কম ছিল? মেয়েরা বড়ো হওয়ার পর বাইরে পড়তে গেল, কিন্তু ততদিনে স্কুলে ওনার অনেক দায়িত্ব বেড়েছে। ফলে সময় তখনও পাননি সংসার দেখার৷ সেন বাড়ির প্রায় সবটাই চলে সেই দিদির তত্ত্বাবধানে, সব গুছিয়ে করেন। এছাড়াও আরও একজন ঠিকে পরিচারিকা রোজ আসে। দিদি বাড়ির একজন হয়ে উঠলেও মিসেস সেন তার সঙ্গে পরিমিত দূরত্ব রেখে চলেছেন৷

এখন অখণ্ড অবসর, সংসারের খুঁটিনাটির হাল ধরলেন তিনি৷ আর অচিরেই বুঝতে পারলেন পরিচারিকাটির প্রতিটি বিষয়ে মিস্টার সেনের সজাগ দৃষ্টি — তার খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, পরিশ্রম। চট করে দেখে তাকে পরিচারিকা হিসেবে বোঝাও মুশকিল। চেহারার ছাপটুকু ছাড়া তার পোষাক পরিচ্ছদ, দামী স্মার্ট ফোন কোনও কিছুই যেন মিসেস সেনের থেকে কোনও অংশে কম নয়৷

 

ওনার দুই কন্যাও দিদিকে তেমন পছন্দ করে না, তবে হাবেভাবে না বুঝিয়ে করে নিজেরাই নিজেদেরটুকু করে নিতে যথাসম্ভব চেষ্টা করে৷ মিসেস সেন কী যেন একটা বুঝতে চেষ্টা করেন, কিন্তু পারেন না৷

সেনেদের যেমন বড় পরিবার, তেমনি পরিচিত মহল। ফলে লোকজনের আসা যাওয়া লেগেই থাকে, তিনি রিটায়ার করাতে আরও যেন সেই যাতায়াত আর আড্ডার পরিবেশ বেড়েছে৷ তেমনই একদিন তিনি নিমন্ত্রিত হলেন পাশের ফ্ল্যাটের কিটি পার্টিতে। অনভ্যস্ত, বেশীক্ষণ ভাল লাগল না।

বেরিয়ে করিডোর পেরিয়ে নিজের ফ্ল্যাটের দরজার কাছে এসে বেল বাজাতে গিয়ে থমকালেন। চাপা কথার আওয়াজ — মিঃ সেনের গলা, সঙ্গে মহিলাকন্ঠ। ভ্রূ কুঁচকে স্বর বুঝতে চেষ্টা করে অবাক হলেন। কী-হোলে চাবি পুরে নিজেই নিজের অস্বস্তি ঢাকতে সজোরে দরজা খুললেন। দেখলেন পরিচারিকাটি ওনার বেডরুম থেকে চকিতে বেরিয়ে গেল৷

দরজা বন্ধ করে নিজের আভিজাত্যকে মুঠোয় ভরে পা বাড়ালেন নিজের ঘরের দিকে৷ ঘরে মিঃ সেন শুয়ে বই পড়ছেন, কোথাও কিছু নেই, তবু কেমন লাগছে মনটা। ঘরে একটা মৃদু গন্ধ পেলেন। চেনা গন্ধ, নিজেরই অপছন্দের অব্যবহৃত সেন্ট যা পরিচারিকা সীমাকে দিয়েছিলেন৷ কিন্তু নিজের আভিজাত্য আর ভদ্রতাবোধের বাইরে এসে কিছু প্রশ্ন তুললেন না৷ চুপচাপ নিজের কাজ সারতে লাগলেন৷ 

বুকের গভীরে ফুটে উঠছে জমে থাকা নানা সময়ের কিছু ছবি। একটা সময়ে বিরাট বাড়ি ছিল, বিয়ের পর তিনি সেই বাড়িতেই উঠেছিলেন, মিঃ সেন জাহাজে চলে যাওয়ার পরও তেমন একা লাগতো না। এত সদস্যসংখ্যা, কোথা দিয়ে যে আড্ডা গল্পে সময় কেটে যেত। সেই বাড়িতেই পেছনের দিকে ছিল পরিচারক/পরিচারিকারদের থাকার ঘর। বাড়ির সদস্যরা ওদিকে প্রায় যেতেনই না বলা চলে। অভিজাত বনেদি বাড়িতে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু খুব অদ্ভুত লাগত যখন দেখতেন মিঃ সেন ছুটিতে বাড়ি এলে সুযোগ পেলেই চলে যেতেন তাদের ঘরে, সময় কাটাতেন, ফিরতেন খুশি মুখে। এছাড়াও ওনার চোখ সবসময়ই কোন না কোন গৃহপরিচারিকার দিকে, তাদের বিষয়ে ছিল গভীর আগ্রহ। বাড়ির বাকিরা সযত্নে এড়িয়ে যেতেন বিষয়টা, মিসেস সেন নিজেও ভদ্রতাবশত কোনদিনই কিছু বলেননি এ বিষয়ে।

কালের নিয়মে এখন সেই বাড়ি ভেঙ্গে ফ্ল্যাট উঠেছে, সদস্যরাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছেন নানা দিকে। নিজেও স্কুলের কাছাকাছি ফ্ল্যাটে উঠে এসেছেন। ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন স্কুল, সন্তান সব নিয়ে। পুরোনো বাড়ির অনেক কথাই ভুলে গেছিলেন, আজ আবার ফিরে গেলেন সেইসব দিনে। অসহনীয় এক ঘৃণা ফুটে উঠল চোখের তারায়, বুঝলেন সেনের সেই স্বভাবের পরিবর্তন এত বছরেও হয় নি। আর তখনই উপলব্ধি করতে পারলেন যেন মেয়েদের বাবাকে এড়ানোর কারণ।

কিন্তু ঐ নোংরা ঘাঁটতে নারাজ মিসেস সেন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন, বুক ভরে শ্বাস নিলেন, তারপর আবার আভিজাত্যের মোড়কে মুড়ে নিজেকে গুছিয়ে নিলেন।


Post a Comment

Previous Post Next Post