গানের ওপারে -- কৃষ্ণা দাস সেন

 

গল্প

গানের ওপারে

কৃষ্ণা দাস সেন

 

আজ জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রণেনবাবুর স্ত্রী তরুলতা। অসহায় সাক্ষী রণেনবাবু। দীর্ঘ চল্লিশ বছরের সঙ্গী তরু তাঁকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। রণেনবাবু শুধু অসহায় ভাবে দেখছেন। কানে বাজছে ডাক্তারের ক'দিন আগের কথা, 'আপনার স্ত্রী কী ভালবাসতেন?' রণেনবাবু আকাশ-পাতাল হাতড়ান। 'ভালো তো অনেক কিছুই বাসত। সংসার, স্বামী, ছেলে, বৌমা – সবাইকেই তো ভালবাসত। এখন কোনটা ছেড়ে কোনটা বলবো বলুন!' ডাক্তার মাথা নাড়েন। 'না না! এসব নয়। একেবারে নিজের, নিজস্ব করে ভালোবাসা।' সেটা কী? হাসপাতালে ছেলে, বৌমা, তিনি কেউই উত্তর দিতে পারলেন না ডাক্তারের কথায়। ডাক্তার রণেনবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু বললেন, 'আপনিও জানেন না আপনার স্ত্রী সত্যি সত্যিই একান্তভাবে কী ভালবাসত? এটা তো আপনারই জানার কথা মশাই!' রণেনবাবু মুখ নীচু করে থাকেন। কই, তরু তো কোনদিন আলাদা করে কিছু নিজের ভালোলাগা মন্দলাগা বলেনি! বরং উনি যা চেয়েছেন বা চাননি তাতেই সায় দিয়েছে তরু। তাই আকাশপাতাল ঢুঁড়েও কিছুই সমাধান করতে পারলেন না।

রণেনবাবু বড় অসহায় হয়ে পড়েছেন। সদ্য অবসর গ্রহণের পর তরু তাকে এভাবে ছেড়ে চলে যাবে! এটা কি করে হয়? তিনি থাকবেন আর তাঁর জীবনে তরু থাকবে না! এটা তাঁকে মানতে হবে?

আজ সকালে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিয়েছে তরুকে। শেষের যে ক'টা দিন থাকে, বাড়িতেই থাকুন তিনি। সেই থেকে স্ত্রীর পাশ থেকে রণেনবাবু ওঠেননি। এখন গভীর রাত। ঘুম নেই রণেনবাবুর চোখে। আজ স্ত্রীর সামনে বসে তাঁর মনে যেন তাঁদের সারা জীবনের পথ পরিক্রমা শুরু হল। অতীত  সারি দিয়ে  সামনে এসে দাঁড়াল।

নিজের বিয়ের পর বাসরঘরে যুবক রণেন সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে পাশে নিয়ে বসে আছে। মন উৎফুল্ল।  হালকা মেজাজে চারদিকে সে তাকাচ্ছে। জমেছে সুবেশা তরুণীদের জমজমাট আড্ডা। অনুরোধ এল নতুন বরকে গান গাইতে হবে। 'গান' কথাটা শুনে রণেন বিরক্ত ! সবেগে মাথা নেড়ে জানাল, 'না না ! আমি ওসব গান-ফান জানি না!'  তার রূঢ় প্রত্যাখ্যানে সবাই একটু থমকে গেল। পাশে নতুন বউয়ের দিকে রণেন তাকিয়ে দেখল সেও যেন সংকুচিত, বিব্রত। কিন্তু গানের ব্যাপারে রণেন একবগ্গা। গান একেবারেই পছন্দ করেনা, গাওয়া তো দূর। ইতিমধ্যে সবাই বরকে ছেড়ে নতুন বউকে এবার চেপে ধরে গান গাওয়ার জন্য। তরু বোধহয় নিজের বরের খামতি ঢাকতে চাইল পরপর কয়েকটি গান গেয়ে। তরুর গাওয়া গানের সবাই তারিফ করল একমাত্র রণেন ছাড়া। তার চুপ করে থাকা দেখে সবাই ভাবল, নিজের বউএর তারিফ করতে নতুন বর লজ্জা পাচ্ছে। এদিকে রণেন রীতিমতো ক্ষুব্ধ বউয়ের ওপর! মোটেই পছন্দ হয়নি ঘটনাটা। কিন্তু বাধ্য হয়ে পরিস্থিতি বুঝে চুপ করে থাকতে হল।

নতুন শ্বশুরবাড়িতে এসে তরু খুব হাসিখুশি। শ্বশুরমশায়ের স্নেহভরা 'তরুমা কোথায় গেলি একটু আয় না মা' বা 'তরুমা, একটু চা করে দে তো মা' -- এমন সব আদরের ডাকে নতুন বৌমা উচ্ছসিত। শ্বশুরমশাই যা বলেন তরু এক পায়ে খাড়া। গদগদ হয়ে রাতে স্বামীকে বলে, 'জানো,  ভাবিনি আমার বাবাকে ছেড়ে এসে এখানে অমন একজন বাবা পাব। আমি সত্যিই ভাগ্যবতী।' রণেন কেমন রেগে যেত। 'ও! শ্বশুরমশাইকে পেয়ে ভাগ্যবতী? বর পেয়ে নয়?'  তরু স্বামীকে জড়িয়ে ধরত, 'ধ্যাত! কি যে বল! বাবা তো বাবাই, আর তুমি হলে আমার স্বামী। অমন বাবার ছেলে তুমি। আমার স্বামী ভাগ্য কি কম?’ বলে তরু স্বামীর বুকে মাথা রাখত। সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে অমন বিগলিত অবস্থায় পেলে কোন স্বামীর না আত্মশ্লাঘা হয়? যুবক রণেনেরও হয়েছিল। তাই তো ভেবেছিল, সে যা বলবে তাই তার তরু মেনে নেবে। মেনেও নিয়েছিল তরুলতা। 

রণেনবাবু অস্থির হয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। তাকালেন আকাশের দিকে। তারা ভরা আকাশ! মনে হল কতদিন এমন আকাশের দিকে তাকাননি! সারা আকাশ জুড়ে এমন তারার ফুল ফুটতে দেখেননি! সম্মোহিতের মত আকাশের দিকে তিনি তাকিয়ে রইলেন, তাকিয়েই রইলেন! হঠাৎ একটা গম্ভীর গলার স্বর ভেসে গেল, 

'আকাশ ভরা, সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ,/তাহারি মাঝখানে -- আমি পেয়েছি তার স্থান,/ বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান…'

রণেনবাবু বসেছিলেন চেয়ারে। উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়লেন। শিহরিত হলেন! এ কার গলা! এ তো তাঁর বাবার উদাত্ত কণ্ঠস্বর! এবার কানে এলো একটি মিষ্টি মেয়েলি গলার সেই গম্ভীর গলার সঙ্গে মেশানো স্বর -- 'কান পেতেছি, চোখ মেলেছি, ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি, জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান/ বিষ্ময়ে তাই জাগে আমার গান।'

রণেনবাবু স্তব্ধ! সে কোন সুদূর অতীতের কথা। বাবা রাগসঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন। কালক্রমে বাবা রাগসঙ্গীতকে মাথায় রেখে রবীন্দ্রসংগীতে মন প্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন। তাঁর একান্ত ইচ্ছে ছিল একমাত্র ছেলে রনিও তাঁর সাথে বসুক। গানকে ভালবাসুক! কারণ ওর গলায় সুর আছে। কিন্তু এই ব্যাপারে রণেন বাবার ধারেকাছেও ঘেঁসল না। মাকে ছেলেবেলায় হারিয়েছে যে ছেলে তার অস্বাভাবিক জেদ তো  ছিলই, উপরন্তু মা হারা ছেলের ওপর বাবাও রূঢ় হতে পারতেন না। নিজের দুঃখ নিজের কাছেই  রাখলেন। ছেলে উপযুক্ত হতে ভালো চাকরিতে ঢুকলে বিয়ে দিলেন। বিয়ের পর তার নব বিবাহিত স্ত্রী তরু যখন বাবার সাথে তন্ময় হয়ে গান গাইত, তখন তা দেখে রণেন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠত। স্ত্রীর প্রতি অস্বাভাবিক একটা রাগ দেখাত। কিন্তু তরু শশুরমশাইকে এড়াতে পারতনা। তাছাড়া তরুও গানের জগতে ঢুকতে পেয়ে আনন্দ সাগরে ভাসত। বাপের বাড়িতে তরু এই সুন্দর জগৎটাই তো ছেড়ে এসেছিল। তার এই তন্ময় হয়ে গান গাওয়া রণেন সহ্য করতে পারত না।  রণেনের মায়ের গানের প্রতি কোন আকর্ষণ ছিল না। তিনি ভাবতেন, গানের জগতে ঢুকে তাতেই মেতে থেকে তাকে অবহেলা করছে স্বামী। এই অলীক ধারণাগুলো যেমন রণেনের মাকে কষ্ট দিয়েছিল, ঠিক তেমনই রণেনকেও দিত। মনে হত, 'ওই সময়টা তরু তো আমাকে দিতে পারতো।' স্ত্রী উপেক্ষা করছে ভেবে অকারণ রাগে স্ত্রীর ওপর রণেন ক্রমশঃ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। সারাক্ষণ গুনগুন করা স্ত্রীকে সে একদিন কঠিন গলায় বলল, 'তুমি জানো, গান আমার একটুও ভালো লাগে না। তাই তুমি আমায় অথবা গান – যে কোনো একটা বেছে নাও। দুটো একসঙ্গে চলবে না, চলতে পারেনা! তোমার অবহেলা আমি সহ্য করব না।' শুনে তরু কেমন দিশাহারা হয়ে তাকাল!  আজ মনে পড়ছে রণেনবাবুর, তরুর কী অসহায় সেই দৃষ্টি ছিল!  সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না স্বামীর এত রূঢ় কথা! কিন্তু রণেন প্রচন্ড জেদি। আর কোনদিন রণেন তরুকে গান গাইতে দেখেনি। এই দীর্ঘ চল্লিশটা বছর তরু গান গাওয়া তো দূরের কথা, গানের নামও উচ্চারণ করেনি। 

মনে পড়ছে, তাঁদের নিজেদের প্রত্যেক বিবাহবার্ষিকীতে যখন বন্ধুবান্ধব ও তাদের স্ত্রীদের নিয়ে জমাটি আড্ডা বসত, তখন সবাই তরুকে বলতো একটা গান গাইতে। আড্ডা জমে যাবে। তরু লজ্জা লজ্জা মুখে বসে থাকত। যতই সবাই অনুরোধ করুক না কেন, মুখে আলগা হাসি নিয়ে সে চুপ করে থাকত। দেখে তখনকার রণেন আত্মতৃপ্তি লাভ করত। যাক, তরু তাকে বেশ সমীহ করে। হুঁ! তার কথার দাম দেবেনা মানে? সে তো বলেই দিয়েছে তরুকে, যে কোন একটা বেছে নিতে হবে – হয় স্বামী নয় গান। এরকম কড়া নির্দেশ কোন বউ মানবে না শুনি? রণেনের খুব তৃপ্তি হত।

স্বামীর ঐ সাংঘাতিক চাওয়ায় তরু দ্বিধাহীন ভাবে এক কথায় গান ছেড়ে দিয়ে স্বামীকে বেছে নিয়েছিল। তখন টগবগে যুবক রণেনের খুব আনন্দ হলেও আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বুঝতে পারছেন রণেনবাবু, কি অমূল্য রতন তিনি হারিয়েছেন। তখনকার রণেন বোঝেইনি তরুর শুধু শরীর রইল তার কাছে, চিরকালের জন্য মন রইল অধরা। এখন তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছেন। বুঝতে পারছেন অকারণ জেদে তিনি শুধু কর্তৃত্ব দেখিয়েছেন তরুর ওপর।  তিনি অন্যায় করছেন। 

কিন্তু  কেন এই দীর্ঘ সময় তরু গানের নাম উচ্চারণও করেনি? স্বামীর ওপর অভিমানে? আজ সবটুকু যেন জলের মত পরিষ্কার লাগছে। কারো ভালোবাসার জিনিস জোর করে কেড়ে নিলে বড় যন্ত্রণায় এরকম তীব্র অভিমান জন্মায়! সেইরকম অভিমানেই তরু গানের প্রতি ভালবাসা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল। রণেনের পছন্দতেই নিজেকে অভ্যস্ত করে ফেলেছিল। রণেনবাবু স্ত্রীর সে অভিমান বোঝেননি। ডাক্তারবাবুর কথা মনে পড়ল। 'স্ত্রী কী ভালোবাসে সে তো আপনারই জানার কথা!' নিজেকে বড় অপরাধী লাগল।

রণেনবাবু তাড়াতাড়ি ডাক্তারবাবুকে ফোন করে জানালেন তার স্ত্রী গান খুব ভালোবাসে। ডাক্তারবাবু উৎফুল্ল। শুরু হল তরুর মিউজিক থেরাপি। ভোর থেকে ঘরে বাজতে থাকলো খুব মৃদুস্বরে রবীন্দ্রসংগীত। ডাক্তারবাবু বলেছেন এই শেষ চেষ্টা আর কিছুই করার নেই তাঁর! কারণ রোগীর বাঁচার ইচ্ছা একেবারেই চলে গেছে। সেখান থেকে তাকে ফেরানো খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এবার শুধু একটা চেষ্টা করা যেতে পারে।

        একদিন দুদিন করে কয়েকটা দিন কেটে যায়। আজ দীর্ঘ চল্লিশ বছর পরে অনুভব করলেন তরু তো কিছু অন্যায় করেনি। গানের প্রতি ভালোবাসায় সে মগ্ন হয়েছিল। কিন্তু সংসারের প্রতি কোন অবহেলা সে কোনদিন করেনি।

ছেলেবৌমা চাকরিতে বের হয়। রণেনবাবু ঠায় বসে থাকেন স্ত্রীর সামনে এক অসম্ভবকে সম্ভব দেখার আশায়। যেন ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছেন। বাবার পছন্দের পুরনো রেকর্ডগুলো বিশেষ করে তরু আর বাবার দুজনের প্রিয় রেকর্ডগুলি বাজাতে লাগলেন খুব মৃদুস্বরে। বাবা এগুলো খুব যত্ন করে একটা ট্রাঙ্কে  গুছিয়ে রেখেছিলেন।

বেশ কদিন পরে রণেনবাবু দেখলেন, তাঁর তরুর আঙুল অল্প অল্প নড়ছে। তিনি অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রইলেন। তিনদিন পরে দেখলেন চোখের পাতা নড়ছে তিরতির করে। ডাক্তারবাবুকে উত্তেজিত গলায় জানালেন সব ঘটনা। ডাক্তারবাবু সব কিছু দেখে বললেন, 'উনি সম্ভবত ফিরে আসছেন। একটু আশা করতে পারি আমরা।'

রণেনবাবু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। স্ত্রীর আঙ্গুলগুলো ধরে বসে রইলেন উন্মুখ হয়ে। হঠাৎ তাঁর মনে হল তরুর চোখের পাতাটা আবার কাঁপছে যেন! খানিক পরে তার দুচোখের পাশ দিয়ে দু'ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। রণেনবাবু বড় আদরে সে জল মুছিয়ে দিলেন। অনুভব করলেন তরু তার আঙ্গুলগুলো ধীরে ধীরে মুঠো করার চেষ্টা করছে। রণেনবাবুর মুখ তখন এক স্বর্গীয় আনন্দের আলোয় উদ্ভাসিত। ঠিক তখনই তাঁর বুকের মধ্যে একটা কান্নার ঢেউও উথাল পাথাল করে বলে উঠল, 'ক্ষমা! ক্ষমা করে দাও তরু!' 

ধীরে ধীরে স্ত্রীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেন, 'এবার থেকে তুমি গান গাইবে, আমি শুনবো!'

রণেনবাবুর মনে হল তরু কি একটু হাসল? আনন্দে? 

 

Post a Comment

Previous Post Next Post