ফেরা
পায়েল চট্টোপাধ্যায়
সূর্যমুখী
ফুলের মত
নরম রোদে পিঠ দিয়ে বসে আছে সুনয়না। রিকশার
নীল ম্যাড়ম্যাড়ে শতচ্ছিন্ন
আবরণটা তুলে দিতে বললাম। রিকশায়
সুনয়নাকে তুলে দিয়ে অপেক্ষা করতে বলে আমি মিষ্টি আনতে গিয়েছিলাম। সুনয়না
আমার জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল প্রায় কুড়ি বছর আগে। তখন ওর গালে গোলাপি
আভা খেলত। ওর নরম হাতে টুপটাপ জীবন ঝরে পড়ত বৃষ্টির মত করে।
তারপর ওর
বাবা ওকে নিয়ে চলে যায় আসামের এক উপত্যকা অঞ্চলে। আমিও আটকে পড়লাম অন্য উপত্যকায়। সময়ের নিয়মে জীবনের ঢেউ ওর নাম মুছে দিলেও একটা দাগ বোধহয় থেকে গিয়েছিল। কিন্তু নিজের ভেতরের দাগ সব সময় কি চেনা যায়?
আমিও চিনতে পারতাম না, এত বছর পরে ওকে হঠাৎ করে না দেখলে।
-''কষ্ট হচ্ছে না তো রোদে?''
সুনয়না
আমার দিকে ফিরে তাকাল। ওর চোখে আস্ত একটা জলটুঙ্গী দেখতে পেলাম আমি। আলগা গলায় কথা বললো সুনয়না, ''মাধু ভালো আছে?"
সুনয়নার
মাসতুতো দিদি মাধু আমার স্ত্রী। একদিন হঠাৎ জলমাখা, মরা একটা সকালে সুনয়না ফোন করেছিল। ওর বাবা চলে গেছে। আশ্রয়হীন সুনয়না আশ্রয় চেয়েছিল। সুনয়নার বাবা নাকি অত্যাচার করত ওকে। মাধুর কাছে এসব বলেছিল। আমার ভেতরে একটা পোকা তখন ফড়ফড় করে উড়ছে। ''থাকুক এখানে,
না তো
আর বলা যায় না।" মাধুই বলেছিল।
আজ আমি সুনয়নাকে স্টেশন থেকে আনতে এসেছি। ওকে শুকনো রজনীগন্ধার মত দেখতে লাগছে।
-''রিক্সাটা আসতে চালাও।''
রাস্তায়
পাথরের মত
ছড়িয়ে রয়েছে গর্ত। উথাল-পাথাল করা রাস্তায় বারবার সুনায়নার কোমর ছুঁয়ে দিচ্ছে আমার হাত। সুনয়না
উদাসীন, নির্লিপ্ত। গলায় টনসিলের ব্যথার মতো আমার অস্বস্তিটা এমন বাড়ছে কেন?
-''ব্যাস ব্যাস,
এখানেই থামাও।"
রিক্সাওয়ালাকে টাকা দিয়ে সুনয়নার ফোনের দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। ফোনের স্ক্রিনে একটা মুখ। কিশোর। আমার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইছে। অবিকল আমার ছেলেবেলার মুখ। একটা ফোন এল। সুনয়না
কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছে।ঝোড়ো হাওয়ার মত
স্মৃতি ঝাপটা মারছে আমায়।
সুনয়নার
বাবা কথা দিয়েছিল ওর আর
আমার সন্তানকে পৃথিবীতে জন্মাতে দেবেন না। আসামের অচেনা কোন উপত্যকায় দুটো মানুষকে পাঠাতে খরচ করতে হয়েছিল মোটা টাকা। তবে ওর ফোনের স্ক্রিনে এ কাকে দেখলাম? বড়লোক মাধুর গ্ল্যামারের টানে যে সুনয়নাকে জলের দাগের মতো মুছে ফেলেছিলাম, সেই সমুদ্রের
ঢেউয়ের মতো এমন গ্রাস করতে আসছে নাকি!
''ছেলে ফোন করেছিল, চল বাড়ির
ভেতরে যাবে না?''