মুকুটের ওজন
সমরেশ মণ্ডল
যখন নাতির হাত ধরে স্কুলে পৌঁছলাম,সবাই কনফারেন্স হলে পৌঁছে গেছে। হাসিমুখে
এটেনডেন্ট মহিলাটি নাতির হাত ধরে ওর দায়িত্ব নিয়েই,
আমাকে বলল,
কনফারেন্স রুম চারতলায়, আস্তে আস্তে চলে যান।
আমি মাধব গুপ্ত, বাহাত্তর, রিটার্ড
হেডমাস্টার।এখনো প্রেসার, সুগার নেই। নিজস্ব দাঁত। রাত্রে ঠিকঠাক ঘুম হয়। এক তলায় উঠে থমকে দাঁড়ালাম। যেতেই পারি তবু ডাক্তারের কথা মনে পড়ল: 'পারলেও সব শক্তকাজ থেমে থেমে করবেন। বিশেষ করে। সিঁড়ি
ভাঙা।' আরো ৪-৫টি সিঁড়ি এগিয়ে থমকে দাঁড়াই। নিচে থেকে মার্চ করার মতো দু
জোড়া পায়ের শব্দ উঠে আসছে পিছন থেকে। পিছন না ফিরেও বুঝতে পারি একটি চেনা দম্পতির মুখ। ওদের সঙ্গে প্রায় দেখা হয়। বিশেষ করে মেয়েটির সাথে। ওরা ওদের মেয়েকে নিতে আসে।কথা হয়নি কখনো। আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল ছেলেটা,মেয়েটি কাছে এসে থেমে গেল।
'আমার সাহায্য লাগবে না।' মেয়েটিকে
বলি।যার এক বছরের বেশি চেনামুখ, সুন্দর দাঁতের
সারি। চমৎকার
হাসলো। পা বাড়িয়ে পরের ধাপে পৌঁছতে, আরো এক ধাপ এগিয়ে, বাঁ পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে,
আমার বাঁ হাত ঘাড়ের উপর দিয়ে ওর বাঁ কাঁধে টেনে নিল:
'উঠুন! মনে করুন আমি আপনার স্টিক!'
অদ্ভুত
এক ফুলের গন্ধ,ক্লোরোফর্মের কাজ করতে আরম্ভ করলো,
পালকের মতো হয়ে গেল আমার হাঁটু,গোড়ালি, বুড়ো আঙুল। স্নিগ্ধ
তরুণ করে তুলল বেদনার অঞ্চল গুলো। এখন কিন্তু দ্রুত সিঁড়ি ভাঙা যায়।তবু এক এক যুগ থেমে থেমে যেতে ইচ্ছা করছে। সারা জীবনের ভদ্রতা বোধ জাগ্রত হয়।বলি:'তোমার দেরি হচ্ছে।কনফারেন্স রুমে চলে যাও। আমি ঠিক পৌঁছে যাব।আমি তো
প্রক্সি দিতে এসেছি।
'ভাববেন
না, ওকে তো পাঠিয়ে দিয়েছি।আপনি নিশ্চিন্তে উঠুন।'
'আমার কিন্তু কোন সমস্যা হতো না'
'জানি! জীবনে কারো সাহায্য নেননি কখনো।'
'তুমি চেনো আমাকে?
'ওকে বলেছি। আপনি আমার মায়ের পরমগুরুস্থানীয় শিক্ষক।বহুজনকে মানুষ করেছেন।'
এতক্ষণ যে পালক হয়ে উঠছিলাম এখন হঠাৎ ভারী লাগতে লাগলো। আমার অদৃশ্য মুকুটের ওজন এত
বেড়ে গেল শুধু নরম কাঁধ নয় শক্ত রেলিংও ধরতে হল।এক পা এক পা
করে গুনতে লাগলাম ঠিক কত
দূরে কনফারেন্স হল!