মনোজ, রমলা আর তাদের দুই সন্তান খুকী ও বাবাই গিয়েছিল প্রতিবেশীর বাড়ি – একটু পানীয় জল যদি পাওয়া যায়। দু’ দিন হল বাড়িতে সোনাদানা টিভি ইত্যাদি যা কিছু মূল্যবান সব ডাকাতি, লুঠপাঠ ও অবশিষ্ট যা কিছু ভাঙচুর হয়ে গেছে। যাওয়ার আগে দস্যুরা জলের ড্রামে পেচ্ছাব করে গেছে, জালা ভেঙে দিয়ে গেছে। পুরো আধবেলা নির্জলা থেকে পাঁচজন নারী পুরুষ শিশু রাতের অন্ধকারে পুকুরের ঘোলা জল ধরে এনে কয়েক ঢোক খেয়ে রাতটা কাবার করেছে। পরের দিনের তৃষ্ণা নিবারণের উদ্দেশ্যে অল্প জল চাইতে গেছে প্রতিবেশী শান্তনু মণ্ডলের বাড়ি, যাদের পাতকুয়ো ভাগ্যক্রমে এখনও আক্রান্ত হয়নি।
বাচ্চা
দুটোকে ঠাকুমার কাছে রেখেই যেতে চেয়েছিল তাদের মা বাবা। কিন্তু চালচুলোহীন বাড়িতে একমাত্র
বিনোদনের উপাদান টিভি নেই বলে ওরা থাকতে চাইল না। তাছাড়া দু ঢোক জল যাদি পরের বাড়ি
থেকে এখনই পান করিয়ে আনা যায়, তো সেই দু’ ঢোকই বাড়তি লাভ। সপ্তাহখানেক ধরে একটা ভয়ানক
ভয় ন বছরের মেয়ে আর তিন বছরের ছেলেটাকেও গ্রাস করে রেখেছে। তাই মা বাবার কাছ ছাড়া হতে
চায় না। তাই দিদির ট্যাঁকে ভাই চড়ে মা বাবার সঙ্গ নিয়েছে শান্তনু জ্যাঠার বাড়ির দিকে।
এই
অবস্থা অকারণে হয়নি। যথেষ্ট দোষ ছিল হিন্দুদের পক্ষ থেকে। খেজুরি গ্রামের দুটি ব্লকের
মানুষ ঠিক করেছিল যাঁকে দু’-দু’ বার বিশ্বাস করে ঠকতে হয়েছে, সেই ঘাতককে আর চাই না।
চাই না তাঁর দুধেল গোরুদের চাট। যে দুধেল গোরু অধিকাংশ ভারতবাসীর কাছে ‘গোমাতা’ – দুগ্ধদাত্রী
মাতৃসমা, সেই প্রাণীটি ভারতেরই পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যে সাক্ষাৎ বিভীষিকার নাম, কখনও
বা রূপকে উপহাস হয়ে গেছে। তাদের দুধের নাম হল ভোট যা বরাদ্দ একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক
দলের জন্য, আর সেই দলের নেতা ছাড়া বাকি রাজ্যবাসীর জন্য বরাদ্দ গোরুদের লাথির চাট বা
চোট।
চৌত্রিশ বছরের হার্মাদি অপশাসনের হাত থেকে
মুক্তিকামী মানুষ চেয়েছিল পরিবর্তন। ২০১১-র বিধানসভা ভোটও হয়েছিল কেন্দ্রীয় বাহিনীর
নজরদারিতে। ফলস্বরূপ ক্ষমতায় এল মা-মাটি-মানুষের সরকার। মানুষের আশা ফসলের জমিতে ফসল,
বন্ধ কল-কারখানার তালা খোলা, নতুন কর্ম সংস্থান, অনুপ্রবেশে লাগাম, স্বচ্ছ ও হিংসাহীন
ভোট। পরিবর্তে পেল একটা নিষ্ফলা পরিত্যক্ত কারখানার কঙ্কালের অবশেষে বন্ধ্যা জমি, চিট
ফান্ডের প্রতারণা, প্রায় প্রতিটি সরকারি কাজ উদ্ধারে কাটমানির বাধ্যবাধকতা, সিন্ডিকেটের
জুলুমবাজি, সরকারি চাকরির বিলোপ ও তার পরিবর্তে নগণ্য টাকায় ‘সিভিক’, ‘প্যারা’ ইত্যাদি
নামধারী ঠিকার কাজ, বিভিন্ন ‘শ্রী’-যুক্ত ভিক্ষা প্রকল্প, সম্প্রদায় বিশেষের দ্বারা
এনতার গণধর্ষণের পর নারকীয় হত্যার ঘটনা যা মিডিয়া শত চাপা দিলেও সোশাল মিডিয়ায় সক্রিয়
বিপন্ন সম্প্রদায়ের জাগ্রত কিছু মানুষের সৌজন্যে ভেসে ওঠে, অপরাধীকে সুরক্ষা দিয়ে নির্যাতিতা
বা তার পরিবারকে হাজতে পুরে পুলিসি নির্যাতন, প্রতিনিয়ত চলা অত্যাচার মাত্রা ছাড়িয়ে
মাঝেমধ্যেই দাঙ্গা, জঙ্গী সম্প্রদায়কে ধর্মীয় ভাতা, চাকরিতে সংরক্ষণ প্রদান – ইত্যাদি
ইত্যাদির সঙ্গে লাগোয়া বাংলাদেশ থেকে অবাধ ... অবাধ অনুপ্রেবেশ। সেখান থেকে প্রাণ হাতে
করে পালিয়ে আসা বাঙালী হিন্দুদের ভারতের মাটিতে হিন্দু বাঙালীর জন্য তৈরি রাজ্যেও নাগরিকত্ব
দিতে আপত্তি, কিন্তু সুদূর মায়ানমার থেকে দস্যুতা করে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব
দেওয়ার তৎপরতা। বলতে গেলে দশ বছরের মহাভারত। আর সবচেয়ে বড় পরিবর্তন যেটা হয়েছে, তা
হল বাংলার বুদ্ধিজীবীদের মেরুদণ্ডের পুরোপুরি আরবীকরণ।
তাই
পশ্চিমবঙ্গের বিপন্ন মানুষরা চেয়েছিল ‘আসল পরিবর্তন’। কেন্দ্রীয় বাহিনীর নজরদারিতে
২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন হওয়ায় ভোটদানে গোলমালের অবকাশ প্রায় ছিল না। আসল পরিবর্তনের
লক্ষ্যে ভোটও কম পড়েনি। খেজুরি ব্লক এক ও দুইয়ের গ্রামবাসীদের সিংহভাগ তাদের প্রত্যাশামতো
পেয়েছে জম্বু জনতা দল-র নেতা অসিত রায়কে। ফলত ব্লক দুটির পঞ্চায়েত সমিতি দু’টিও জেজেডি-র
দখলে। এটাই অপরাধ একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের চোখে, যারা বিগত চার দশক ধরে তোষণের সুবিধা
লাভ করার সাথে সাথে গত দশ বছর উপরি পাওনা স্বরূপ শোষণের অধিকারও লাভ করে আসছে।
সত্যিই
তো। বিদেশী নারা ‘জয় বাংলা’-র রাজ্যে এর চেয়ে বড় অপরাধ আর কী হতে পারে? জেজেডি জেতায়
সবকটি আসন দখল করতে চাওয়া শাসক দল বেজায় খেপে গেছে। তাদের তাদের সর্বেসর্বা নেত্রী
তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান ভরসাই অবিভক্ত মুসলিম ভোট। শুধু তো খেজুরি নয়, সারা
রাজ্যেই বিপুল, প্রায় সমতুল্য সংখ্যক মানুষ জেজেডি-কে ভোট দিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত
সত্তর লক্ষ ভোটের ব্যবধানে তৃণমূলেরই জয় হয়েছে। একটি ‘ডেমোক্রেটিক সেকুলার ফ্রন্ট’
নামধারী ‘ধর্মনিরপেক্ষ' মুসলিম দলের সঙ্গে বামেরা জোট বাঁধলেও তারা এমএফসি-র মুসলিম
ভোটে কিছুই প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং বাম দলের হিন্দুদের অনেকেই তাদের ভাষায় ‘হিন্দু
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজ’ জেজেডি-কে হারানোর জন্য মেটেফুলকেই ভোট দিয়েছে; সেই মেটেফুল
যারা সিপিএম-কে বধ করে ক্ষমতায় এসে তাদের রক্তশূন্য ছিবড়ে করে দিয়েছে।
সামান্য
গণনার কারচুপি সন্দেহ করা হলেও নিরপেক্ষ নির্বাচনেরই রায় অনুযায়ী সম্প্রদায় বিশেষ তো
বটেই, ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালীরাও সেই সম্প্রদায়টির করা যথেচ্ছাচার, যখন তখন হিন্দু নারী
ও শিশুকন্যাদের পাইকারি হারে ধর্ষণ, গণধর্ষণ করে নৃশংস থেকে নৃশংসতম হত্যা, অপহরণ,
ধর্মান্তকরণ, বেআইনি ধর্মীয় ভাতা, ওবিসি-এ জাতি-শ্রেণীর আমদানি করে পুলিস প্রশাসনসহ
যাবতীয় সরকারী চাকরিতে নিরানব্বই শতাংশ বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষণ, পুরুষ মানুষের
যখন তখন বৌকে ঘাড়ধাক্কা দেওয়ার আর যখনতখন পরপুরুষের শয্যায় হালালা করিয়ের ঘরে ফেরানো
ইত্যাদি ধর্মীয় স্বাধীনতা বেশ সোৎসাহে সমর্থন করেছে। অনেক বুদ্ধিজীবী তো শিকারীদের
শিকার সাজিয়ে তাদের পক্ষ অবলম্বন করে রীতিমতো সাফাই দেন; জাতীয়তাবাদী যে কোনও ভাবনাই
তাঁদের কাছে ফ্যাসিজ়ম।
সমস্ত
খবর তো মূলস্রোতের মিডিয়াতে আসে না। থাকে শুধু উন্নয়ন ও জয় পরাজয়ের খবর। তাছাড়াও সুমন
চৈতালীর প্রেম, হসরতের নকল বিয়েও তো কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে কাটমানি ও চিট ফান্ড কাণ্ডগুলোতে
শাসকদলের স্পষ্ট যোগাযোগ সামনে এনেছে মিডিয়া। তারপরেও পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা-সংস্কৃতিমনস্ক
আদর্শবাদী ও রাজনীতি সচেতন কাফেরদেরও একটা অংশ এই অনুপম মাৎসন্যায়কেই নির্বাচিত করেছে,
কারণ জেজেডি-কে আটকানো বেশি জরুরি। তারা দেশে সবার জন্য সমান আইন আনতে চায়, সন্ত্রাস
দমন করতে চায়, শত্রু দেশগুলোর সামনে নতজানু হতে চায় না, সর্বোপরি হিন্দু নামক ভারতের
মূল কিন্তু বিলীয়মান বাসিন্দাদের এবং তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি বাঁচানোর চেষ্টা করে। সঙ্গে
বেসরকারীকরণ, অর্থনৈতিক উদারীকরণ, বাঙালী সংস্কৃতি নষ্ট করা ও মূল্যবৃদ্ধির জন্য পিণ্ডি
চটকানোর সুযোগ তো আছেই। মানে নিজের কন্যা অপহৃতা হলে কেন্দ্র সরকারকৃত মূল্যবৃদ্ধির
দোষ আর কী, রাজ্যের প্রশাসনিক অপদার্থতা নয়!
কিন্তু
গ্রামবাংলার কোটি কোটি মানুষ বাঁচতে চেয়ে আসল পরিবর্তন চেয়েছিল। জেজেডি-র ভূমি স্তরের
নেতাকর্মীরা খেটেওছিল প্রাণ লড়িয়ে। তারই ফল ভোগ করছে এরা। দুধেল গাইরা জমির ফসল কেটে
তুলে নিয়ে কিংবা নষ্ট করে চাষ বন্ধ করে দিচ্ছে, ঘরে লুঠপাট ভাংচুর, জল ও বিদ্যুতের
সংযোগ নষ্ট করে দেওয়া, মেয়েদের শ্লীলতাহানি থেকে গণধর্ষণ, মারধর, ভিটেমাটি দখল নেওয়া,
গোরু ছাগল তুলে নিয়ে যাওয়া, এমনকি পানীয় জলের টিউবঅয়েলগুলো পর্যন্ত নষ্ট করে দেওয়া।
কিঞ্চিয়া নামে একটি গ্রামের বাড়িগুলো তো অত্যাচারে পুরুষশূন্য হয়ে গেছে। সব ঝোপঝাড়
বন জঙ্গল, হোগলা বনে লুকিয়ে প্রাণে বেঁচে আছে, না মরেছে কে জানে? সেখানে মেয়েরা কোনওক্রমে
বাচ্চা ও পড়ে থাকা গৃহপালিত পশুদের কীভাবে রক্ষা করছে, নষ্ট ফসল, চুরি যাওয়া পুকুরের
মাছ ছাড়া কী খেয়ে বেঁচে আছে – সে খবরই বা কে রাখে?
মনোজরা
বেশ কিছুক্ষণ হল গেছে। হয়তো আলোচনায় মত্ত হয়ে গেছে। চারদিকে জেজেডি করুক বা না করুক,
প্রায় সব হিন্দু বাড়িগুলোতে হাহাকার। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল। খুব অসহিষ্ণু ভাবে ও
জোরে জোরে। মনোজের মা অঞ্জনা দেবী উঠে গিয়ে দরজা খোলার আগেই দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ল জনা
আষ্টেক পুরুষ। বিভিন্ন বয়সী। কয়েকজনের মাথায় জালি টুপি। ছেলে ছোকরাদের পরণে জিন্স্
প্যান্ট।
প্রৌঢ়া
কিছু বোঝার আগেই সবকটা শিকারী হায়নার চেয়েও হিংস্রভাবে তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। যে যেভাবে
ইচ্ছা যেখানে খুশি নিজেদের প্রত্যঙ্গ দিয়ে ছিন্নভিন্ন করার চেষ্টা করতে লাগল। আসলে
যৌনতা নয়, নারীকে অসম্মানেই আনন্দ। আর হিন্দু নারীকে ধর্ষণ ও যৌন নিগ্রহে সোজা জন্নত
প্রাপ্তি ও বাহাত্তর হুরের সঙ্গে ফুর্তি করার লাইসেন্স। যারা এসব গালগল্প বিশ্বাস করে
না, তারাও নিজেদের সংখ্যাবৃদ্ধি ও সাম্প্রদায়িক ক্ষমতায়নের স্বার্থে এইসব আজগুবি কুসংস্কার
ও হিংস্রতায় প্রশ্রয় দেয়, অংশগ্রহণও করে সুবিধামতো।
অঞ্জনাকে
যাতা কাণ্ড করার পর এক বোতল কীটনাশক জোর করে মুখে ঢেলে সামনের দাওয়ার গা ঘেঁষা নালিতে
ছুঁড়ে ফেলে দিল। যাওয়ার আগে কয়েকটা লাথি মেরে চলে গেল।
মনোজরা
ফিরছিল। সাত আটজন নানা বয়সী লোককে দল বেঁধে পাশ দিয়ে যেতে দেখল। তাদের মধ্যে একটা ছেলে
একজন বয়স্ককে “আব্বু” বলে সম্বোধন করায় ভয়ে সিঁটিয়ে গেল মনোজ আর রমলা। ভয় পেয়ে গেল
নয় বছরের খুকীও। কিছু না বুঝলেও বাবার কোলে উসখুস করে উঠল বাবাই।
দলটার
একজন বলল, “যেতে দে। আজ অনেক মস্তি হয়েছে। আর – দাঁড়াবে নি।”
আরেকজন
বলল, “যাবে আর কোথায়? দু দিন পরে মা মেয়ে দুজনের মাংসই তো আমাদের পাতেই পড়বে। যেমন
রহিম চাচা আর নুরুল বাপ-বেটায় আজ সেম মাগীকে এক সাথে....” ছেলেটা অশ্লীলভাবে খ্যাকক্যাক
করে হাসতে লাগল। কথাগুলো রমলাদের শুনিয়ে ইচ্ছা করেই জোরে জোরে বলা যেন।
পুলিস
এদের কিচ্ছু করে না। এদেরই তো যুগ চলছে। আক্রান্ত অত্যাচারিতরা অভিযোগ জানাতে গেলে
তাদেরকেই মারধর করে, হাজতে পোরে, কিংবা ড্রাগ পাচারের কেস দিয়ে এমন ফাঁসায়, যে তারা
কোনও অপরাধ না করেও গারদে বা জেলে পচতে কিংবা পালিয়ে ঘরছাড়া হতে বাধ্য হয়।
বাড়ির
উঠোনে পৌঁছে আর্তনাদ করে ওঠে স্বামী স্ত্রী একসাথে। মা নর্দমায় মুখ থুবড়ে পড়ে কেন?
গায়ে সূতো পর্যন্ত নেই। অপরিসর ঘরোয়া নালি বলে অঞ্জনাদেবী ভেতরে ঢুকে যাননি, কিন্তু
নিজে থেকে ওঠার ক্ষমতাও নেই।
রমলা
ছুটে গিয়ে ডাকল, “মা, আপনার কী করে এমন হল? উঠে বসুন, আমি ধরছি। ওগো এসো না।”
নগ্ন
মাকে জড়িয়ে ধরতে প্রবল অস্বস্তি হচ্ছিল বলে মনোজ একটা কাপড় খুঁজছিল। মায়ের নোংরা আধভেজা
সায়া ছাড়া দাওয়াতে আর কিছু পড়ে ছিল না। রমলা মেয়েমানুষ, একা পারবে না। বাধ্য হয়ে নগ্ন
মাকেই জড়িয়ে নালীর ওপর বসিয়ে দিল। কিন্তু আর কিছুতেই ওঠানো গেল না।
বাচ্চা
দুটো হতভম্ব হয়ে দেখছে বড় মানুষ ল্যাংটো হলে কেমন দেখায়। ঠাকুমাকে ঐ অবস্থায় দেখে খুকী
কেঁদে ফেলল। রমলা দাওয়ায় পড়ে থাকা সায়াটার দিকে একবার তাকাল। তাতে রক্তের ছিটে ছাড়াও
পুরুষালি ক্লেদ ভড়ভড় করছিল। তারপর ভাঙা দরজা পেরিয়ে ছুটে ভেতরে গিয়ে দড়িতে আর ভাঙা
আলনায় ঝোলানো নিজেরই একটা ব্লাউজ আর একখানা সায়া এনে শাশুড়ীকে পরানোর চেষ্টা শুরু করল।
মনোজের সাহায্যে পরিয়ে ফেলল যাহোক তাহোক করে। ব্রাউজের দুটো হুক কোনওমতে লাগানো গেল।
শায়াটা পেটের ওপর থেকে আঁটা হল। কিন্তু প্রৌঢ়াকে কিছুতেই নালি থেকে ওঠানো গেল না।
পাড়ায়
খবর ছড়িয়ে পড়েছে। থানায় যেতে যদিও ভরসা পায় না সাধারণ মানুষ, তবু অনেকেই বলল এক্ষুণি
এফ আই আর করতে। থানা বেশ দুরে। নালিশ নেবে তো, নাকি ভাগিয়ে দেবে? কিন্তু এফআইআর মানেই
তো প্রথম নালিশ।
থানা
যথারীতি জেনারেল ডায়রি লেখাতে প্ররোচনা দিলেও দলে তারক নামে একজন আএসএস করা ছেলে ছিল।
বলল, “আমরা এফআইআর না নেওয়া পর্যন্ত যাব না। যদি গিয়ে দেখেন কিছু হয়নি, অ্যাকশন নেবেন
না। কিন্তু ইম্মিডিয়েট হাসপাতালে দিতে হবে যাকে, তাকে গিয়ে অন্তত দেখে আসুন। এফআইআর
ছাড়া তো কেসই দাঁড়াবে না।”
“তোমরা
একটু বেশি বোঝ না? বসে থাকো ডিউটি অফিসারের জন্য।”
ইচ্ছাকৃত
দেরি করে থানার ভুঁড়িদার মেজোবাবু খৈনির টিপ মুখে ফেলে এল সরেজমিন দেখতে। ততক্ষণ অঞ্জনাদেবীর
অবস্থা শোচনীয়। অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে নালি থেকে ওঠানো যায়নি। বৌমার পরানো সায়া ব্লাউজে
কোনওক্রমে লজ্জা নিবারণের পরেও নালিতেই পা ঝুলিয়ে বসে আছেন।
মনোজ
কান্না ভেজা গলায় বলল, মাকে আগে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। মাকে ফলিডল খাইয়েছে। মরতে
বসেছে। অথচ তখন থেকে গোঙাচ্ছে, আর একই কথা বলে যাচ্ছে। মুসলমানে ইজ্জত নিয়েছে, আমি
আর হিন্দু নেই।”
“কিন্তু
হাসপাতালে দিলে তো প্রমাণ লোপাটও হতে পারে। ফরেন্সিক পরীক্ষা যাতে হয়, তার ব্যবস্থা
যেন হয়।” বলল তারক।
এদিকে আঞ্জনা বিশ্বাসের মুখ দিয়ে হাল্কা
গ্যাঁজলা ওঠার মতো অবস্থা। বিকারের ঘোরে বিধর্মীর হাতে সম্ভ্রম যাওয়া, আর হিন্দু না
থাকা, অখাদ্য কুখাদ্যের সঙ্গে বিষ খাওয়ানো – অসংলগ্নভাবে বলে গেলেন। মেজোবাবু লাঠি
হাতে যেন পাগলী দর্শনে এসেছে, এইভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে, যেন কিছুই হয়নি ভাব করে চলে
গেল।
মনোজ ও রমলা বাচ্চা দুটোকে সঙ্গে নিয়েই ছুটল
ব্লক হাসপাতাল। ওদের ফেলে যেতে সাহস হয় না। সেখানে কিছুক্ষণ বারান্দায় ফেলে রেখে এক
বোতল স্যালাইন দিল। তারপর খেজুরি দুইয়ের ব্লক হাসপাতাল সঙ্গীন অবস্থা দেখামাত্র বলল,
“তমলুকে নিয়ে যান। এখানে স্টমাক ওয়াশ করার ব্যবস্থা নেই।”
সঙ্গে কিছু প্রতিবেশী গিয়েছিল। তাদের একজন
তারককে ফোন করল। তারকের ফোন ব্যস্ত ছিল। বার কয়েক চেষ্টার পর তারক ফিরতি কল করে বলল,
“হ্যাঁ বলো গৌরাঙ্গদা। অসিতদার সঙ্গে কথা বলছিলাম। একজন এমএলএ বলে কথা। কিন্তু রাজ্যের
অরাজকতা তাকেও ঠুঁটো জগন্নাথ করে রেখে দিয়েছে। বিধানসভা আমাদের, দুটো ব্লক সমিতিও আমাদের,
অথচ...”
গৌরাঙ্গ বলল, “ওসব সবাই জানে। এক্ষুণি একটা
অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে পারবে? এখানে বলছে সবকটাই নাকি বেরিয়ে গেছে। মসীমার
অবস্থা খুব সিরিয়াস। এখনই তমলুকে নিয়ে যেতে হবে। বিষ আছে না...”
“দাঁড়াও দেখছি।”
মিনিট পঁয়তাল্লিশের মধ্যে তারক ও ইন্দ্রজিত
নামে সঙ্ঘের আরেকটি ছেলে ব্যক্তিগত মালিকানার অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নিয়ে চলে এল।
সঙ্গে সঙ্গে মনোজ এবং সঙ্গে তারক ও ইন্দ্রজিত
ছুটল আর্ধমৃত বাহান্ন বছরের বৃদ্ধাকে নিয়ে তমলুক হাসপাতাল। রমলাও যেতে চাইছিল। কিন্তু
রয়ে গেল খুকী ও বাবাইকে অরক্ষিত ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে।
পথ
অনেকটা। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বের হচ্ছে। মনোজ গামছা দিয়ে মার মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে। ওদিকে
তারক রোগীর পায়ের তলা হতের তালু ঘষে চলেছে।
তমলুকে ভর্তি করতেই কত ফ্যাকড়া। পুলিস কেস
শুনে নিতেই চায় না। তারপর ইন্দ্রজিত খেজুরি ব্লকের থানায় ফোন করে কী সব বলে হাসপাতাল
কর্মীর কানে মোবাইল ধরিয়ে বলল, “শুনুন নিজের কানে।”
“হ্যালো স্যার...”
“ভর্তি নিয়ে নিন। এখনও হুদো হুদো রেপ হলেও
মার্ডার হয়নি একটাও। তবে ওদের টাইট দিতে হবে। আমাকে দিয়ে তারক মুখার্জী নামে একটা আরএসএস-এর
ছোকরা নানা বোলচাল দিয়ে এফআইআর নিইয়েছে। ভর্তি করলেই যে বাঁচবে তার তো মানে নেই। খরচ
তো আছে। বুঝলে কিছু?” থানার ওসি স্বয়ং কথা বলছে। মেজবাবু তার নির্দেশেই নির্যাতিতার
জবানবন্দী নিতে এসেছিল।
“হ্যাঁ। আর একটু খুলে মানে ইয়ে..... হ্যাঁ
স্যার বুঝেছি।”
“কী বুঝেছেন। পেশেন্টের আবস্থা সংকটজনক।
ভর্তি করার অর্ডার পেয়ে গেছেন তো?”
মালদার অঞ্জনা বিশ্বাসের ঘটনাটা অনেক দূর
ছড়িয়েছে। সেই সঙ্গে আশপাশের কিঞ্চিয়া, বাড়াতলা, কলাগাছিয়া অঞ্চলের ঘোলাবাড় সহ বেশ কিছু
গ্রাম – সর্বত্র এই বিধ্বংসী জেহাদী হামলার জেরে আড়াইশোর ওপর মানুষ ঘর ছাড়া। কেউ কেউ
সপরিবারে পালিয়ে গেছে দূরে। আর কিঞ্চিয়ার পুরুষরা তো পরিবারের বদলে জঙ্গলে সাপখোপ বিছের
সঙ্গে সহবাস করছে।
আশপাশের
হিন্দু গ্রামগুলো যেগুলো ততটা আক্রান্ত হয়নি তখনও, সেখানকার হিন্দুরা দলমত নির্বিশেষে
একত্রিত হয়ে সঙ্ঘবদ্ধ হতে থাকল। তাদেরও কারো কারো বাড়ির মেয়েকে তুলে নিয়ে বা ফুসলে
নিয়ে গিয়ে বোরখা ঢাকা বাচ্চা পয়দা করার যন্ত্রে পরিণত করা হয়েছে। কাউকে বা তিন বার
গড়গড় করে তালাক বলে দেনমোহর ছাড়াই ঘাড় ধাক্কা দেওয়া হয়েছে। হয়েছে নাবালিকাকে গণধর্ষণ
করে চিঁড়েখুঁড়ে পুড়িয়ে খুনের মতো ঘটনাও। কিন্তু সেগুলো আকছার ঘটলেও সমাজের চোখে ছিল
‘বিচ্ছিন্ন’, সমবেত ব্যাপার নয়। এই সমবেত হামলা হলে, তখন মানুষের টনক নড়ে।
দলমত
নির্বিশেষে হিন্দুরাও নামল প্রতিরোধে। রাতে তো বটেই দিনে দুপুরেও গ্রামের হিন্দু যুবকেরা
টহল দেওয়া শুরু করল। জেজেডি নেতৃত্ব ও মূলত সঙ্ঘ পৌঁছে গেল মার খাওয়া মানুষগুলোর কাছে
সাহায্যের হাত নিয়ে। ত্রাণ বণ্টন থেকে, চিকিৎসা করানো, পানীয় জল বিতরণ – মানে ঐ পরিস্থিতিতে
যতটুকু করা সম্ভব। কারণ প্রবল বাধা আসতে লাগল দুষ্কৃতীদের তরফ থেকে। খেজুরির জেজেডি
বিধায়ককে কার্যত নিশ্চল করে রেখেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। স্থানীয় প্রশাসন মাঝে মাঝে লাঠি
হাতে একটু আধটু গর্জন করলেও সেগুলো যথাস্থানে বর্ষণ করে না।
কিন্তু
সমস্ত হিন্দুরা, এমনকি শাসক শ্রেণীর হিন্দুরাও সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধে নেমেছে দেখে পুলিসের
নিজেদের কর্তব্য স্মরণে এসেছে। টহল দেওয়া, দাঙ্গা আটকানোয় কিছুটা সক্রিয়তা দেখাচ্ছে।
দু একজনকে গ্রেফতার করেছে, দু’দিন বাদে ছেড়েও দিয়েছে।
পেটের পাকস্থালী ধুয়ে বিষ বার করে, বোতল বোতল স্যালাইন দিয়ে কোনওক্রমে মৃত্যুটা আটকানো গেল। কিন্তু অবস্থার উন্নতি তো দূর, সংকটও কাটল না। এদিকে হাসপাতালে বিল হয়ে গেছে এক লক্ষ বিশ হাজার টাকা। সরকারি হাসপাতালে এত টাকা!? ভেতর থেকে কলকাঠি নাড়ার ইঙ্গিত খুব স্পষ্ট। কিন্তু ঝগড়া করে, হিসাব চেয়েও লাভ হল না। বিল না মেটালে রোগীকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতেও দেবে না। বাহান্ন বছরের মহিলাকে নিয়ে যমে মানুষে টানাটানি।
মনোজ
মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। হাও হাও করে কাঁদছে সে। পরিবারে বৃদ্ধা মায়ের দায়িত্বটা কারও
কারও কাছে বোঝা মনে হতে পারে, কিন্তু সব হারানো মানুষটার কাছে নয়। পুত্রবধূ রমলাও সাশ্রু
চোখে ভগবানকে ডেকে চলেছে নিরন্তর, “মাকে ফিরিয়ে দাও ঠাকুর।” নাতি নাতনীসহ সংসারের অনেকটা
দায়িত্বই তো শাশুড়ী মা পরম যত্নে সামলাতেন। সেই সঙ্গে এই পৈশাচিকতার বিহিত করানোর জেদ
যেন অনেককেই পেয়ে বসেছিল।
কলকাতার
ভালো কোনও জায়গায় নিয়ে গেলে হয়তো যম এবারের মতো ছেড়ে দিতেও পারে। মস্তিষ্কের বিকার
যাচ্ছে না। সেটাও হয়তো কলকাতার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন, এমন হাসপাতালে দিলে সেরে যেতে
পারে।
শেষ
পর্যন্ত গেরুয়া পার্টি ফান্ড থেকে পাওয়া সাহায্য এবং মূলত সঙ্ঘ মিলিয়ে রোগিনীকে তমলুক
মহকুমা হাসপাতালের বিল মিটিয়ে কলকাতার এএমআরআই বা আমরি-তে ভর্তি করা হল। গ্রামের দরিদ্র
কিন্তু সংগঠিত মানুষরাও করেছে যথাসাধ্য।
বড়
হাসপাতালের চিকিৎসায় অঞ্জনাদেবী শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠলেও মানসিক স্থিতি ফিরে পাননি।
বিচারও তো পাননি। বিচার তো দূর, পুলিস দায়সারা কেস ফাইল করলেও এবং দোষীদের সনাক্ত করা
গেলেও গ্রেফতারেই গা করছিল না। তাদের চাকরি ও উপরি হারানোর ভয় আছে। কিন্তু স্থানীয়
হিন্দুরা সমবেত হয়ে থানা ঘেরাও করায় একজনকে গ্রেফতার করল, তাও আবার জামিনযোগ্য ধারায়।
তারক ইন্দ্রজিতদের চাপে জামিন অযোগ্য কেস দিলেও এ রাজ্যে তো কামদুনির পিশাচরাও ফুটবল
খেলে, সংসার করে সংখ্যা বাড়ায়, ফুর্তিও করে। বাকি সাতজনকে গ্রেফতার না করানোর ক্ষোভ
শুধু মনোজ রমলাদের নয়, এলাকার সমস্ত হিন্দুদের।
বাড়ি
ফিরেছেন অঞ্জনা। মা বাবা ঠাকুমাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় খুকী ও বাবাই মামাবাড়ি খড়গপুরের
কাছে গিয়ে ছিল এই মাস খানেক। খড়গপুর দলের খাস রাজ্য সভাপতির অঞ্চল শহর বলেই হয়তো কিছুটা
শান্ত। বাড়ি ফিরছে বলে বাচ্চাদুটো দারুণ খুশি।
কিন্তু
কোথায় ফিরল? বোঝা যাচ্ছে বাড়িতে কিছু লোক নির্নম বেপরোয়াভাবে পাথরবৃষ্টি করে সব প্রায়
ধ্বংসস্তূপ করে রেখেছে। গ্রামে পাহারার জন্য আর কিছু চুরি ডাকাতির সুযোগ কমে গেছে।
আর এই বাড়ি থেকে নেওয়ার মতো মূল্যবান ছিলই বা কী? কিন্তু একজন দুষ্কৃতীকে গ্রেফতারির
প্রতিবাদে পাথর মেরে আক্রোশ মিটিয়েছে ‘ওরা’। আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে পাঁচজন মানুষ ভাবতে
লাগল ছাদ কোনটা।
