ছোটগল্প
এ'বছর শীতে মোতিহারিতে বেজায় ঠান্ডা পড়েছে। মাথা মুখ ঢেকে শিপ্রার ছোট জা,
শুচিতা আঁতুড়ঘরের সামনে অপেক্ষা করছে সঙ্গে শাঁখ হাতে বিধবা ননদ রেবতী।
ভোর হয়ে এসেছে। নবজাতকের কান্নার শব্দে বাড়ির পুরুষ আর বাচ্চারাও জেগে উঠল,
ব্যস্ত হয়ে পড়ল সকলে। বন্ধ দরজা খুলে
দাই-মা বেরিয়ে এসে বলল “লকশ্মী'জী…”
আত্মীয়াদের একজন বললেন, “আহা! এবারেও মেয়ে। আমি ভেবেছিলাম, এবারে বউমার
খোকা হবে।”
কেউ সান্ত্বনা জানিয়ে, কেউ বা টীকা-টিপ্পনী কাটতে কাটতে সরে পড়ল। অসন্তুষ্ট
বিধবা ননদ উঠে দাঁড়ালেন।
“ছোটবউ, ওদের গরম-জল, কাপড়-চোপড়, আগুন-মালসা দাও আর এই শাঁখটা তুলে রাখ।”
পুত্র গরবে গরবিনী শুচিতা বলল “মেয়ে নিয়ে যে শতেক খোয়ার দিদি, না'হলে আর
কী? মানুষ করতে তো একই রকম কষ্ট।”
মেমবউ, সংসারে ব্রাত্য খুড়তুতো-জা শেলী প্রায়ই শিপ্রার কাছে আসে। দিদির
হাতের খাবার-দাবারের বড় ভক্ত সে। তার আধো আধো বাংলায় সে সকলের মন জয় করে নিয়েছে।
শিপ্রার ছোট মেয়েটা এই মেম-কাকিমার বড় ন্যাওটা। শেলী-কাকিমার পিয়ানো শুনতে খুব
ভালবাসে সে। ঊষা লগ্নে জন্ম তার, তখন আকাশে ছড়িয়ে পড়ছিল অরুণের আভা। বাবা, প্রসাদ
নাম রাখলেন অরুণিমা। পরিবারের লোক মুখ বেঁকিয়েছিল, কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন -ওই তো
কালো মেয়ে।
প্রসাদ হাসেন, বলেন “তাতে কী! রাতের কালো দূর করে ও যে প্রভাত নিয়ে আসে।”
নিঃসন্তান শেলীর সঙ্গে এক অসমবয়সী হৃদ্যতা গড়ে উঠতে থাকে অরুণিমার। সুযোগ
পেলেই অরু বসে পড়ে পিয়ানো বাজাতে। এক হাতেই তাকে পিয়ানোতে সুর তুলতে দেখে আশ্চর্য
হয়ে যান শেলী।
প্রথম সন্তান উমাকে খুবই আদরে গড়ে তুলছিলেন উন্নত মানসিকতার মানুষ, প্রসাদ।
সাহেব-শিক্ষিকার কাছে পড়াশোনা, সেলাই-ফোঁড়াই, আদব কায়দায় সাবলীলভাবে বেড়ে উঠছিল সে
কিন্তু বাংলার বাইরে থেকেও বাংলার সংস্কৃতি এই পরিবারের মজ্জায়-মজ্জায় জড়িয়ে ছিল।
ভোরবেলা মেয়েদের নিয়ে স্তোত্রপাঠে বসেন প্রসাদ। ছোটকন্যা, কোকিলকণ্ঠী অরুণিমার
স্বর আলাদা করে তাঁর কানে বাজে, মনে বড় আনন্দ জাগে।
ভর ভরন্ত সংসারকে ভাসিয়ে দিয়ে অকালে চলে গেলেন, সুস্থ-সবল-নিরোগ প্রসাদ।
শিপ্রার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।
ছোট দুটো মেয়ে নিয়ে কোথায় যাবে সে? পেটের চিন্তায় তাদের পড়াশোনা, গান-বাজনা
মাথায় উঠল। দাদারই অন্নে প্রতিপালিত ছোট ভাইয়ের
হাব ভাব বদলে যেতে সময় লাগল না। শিপ্রাকে ভিটে ছাড়া করতে মন্থরা-শুচিতার কল-কাঠি
নাড়া বিশেষ সফলতা পেল।
কলকাতা থেকে শিপ্রা'র দাদা এসে বোন আর ভাগ্নীদের নিয়ে গেলেন বটে কিন্তু বিনোদ আর শুচিতাকে শাসিয়ে গেলেন যে শিপ্রা কিন্তু কখনই তার সম্পত্তির ভাগ
ছেড়ে দেবে না। শ্যাওলার মতো, ভাসতে
ভাসতে জীবন-স্রোতের ধারায় প্রবাহিত হয়ে দাদার সংসারে স্থিতু হলো শিপ্রা। বেঁচে থাকার তাগিদে এই জীবন-সংগ্রাম কিন্তু তার পরিণতি কী?
কতদিন যে তাকে দাদা-বৌদির গলগ্রহ হয়ে থাকতে হবে! বাড়ি বসেই জামাকাপড় সেলাই
করে, প্রতিবেশী-বাচ্চাদের পড়িয়ে, সেই আয়ের অর্থ দাদা-বৌদির হাতে তুলে দেয় শিপ্রা।
দেওরের সঙ্গে লড়াই করে সম্পত্তির ভাগ নেওয়ার গরজ নেই তার।
দুঃখের দিন লম্বা হলেও কেটেই যায়।
উমার বিয়ে স্থির হলো এক শিক্ষিত, বড় পরিবারে। অরুণিমার জন্যে তাঁর বিয়ের বেগুনি বেনারসি বার করে দিয়েছেন মা। জীবনে
প্রথমবার শাড়ি পরে সেই কালো মেয়ে বিয়েবাড়ি আলো করে, প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে।
বড় সুন্দর দেখতে অরুকে, গায়ের রঙ একটু চাপা বটে কিন্তু তার মুখের গড়ন, লাবণ্যে
ফর্সা হার মেনে যায়।
গোলাপজলে বরযাত্রীদের অভ্যর্থনার ভার পড়েছে তার ওপরে।
“ইউ হ্যাভ ড্রেঞ্চড মি…”
ঘাড়ের পাশে এক ভরাট আওয়াজ পেয়ে ফিরে তাকাল অরু। সুন্দর চেহারার পুরুষটির
চোখেমুখে মুগ্ধতা। বর্ষাকালের মৌরলা মাছের মতো উচ্ছল মেয়েটা চোখ তুলে তাকাবার সাহস
আর উত্তর দেওয়ার ভাষা দুটোই হারিয়ে ফেলল।
অরুর ডাক পড়ল আয়োজিত জলসায় গান শোনাতে।
‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে…’
বৃষ্টিভেজা কদম-বকুলের সুবাসে ভারী বাতাসে অরুণিমার মাদক কণ্ঠ ভেসে বেড়িয়ে
এক মোহময় মায়াজাল সৃষ্টি করল। অরু'র নজর গেল
বিহ্বল সেই চোখ দুটোর দিকে। সেই দৃষ্টি সরছে না অরুণিমার ওপর থেকে।
“বুল শিট! লার্ন সাম ইংলিশ সং-স।” বোঝা গেল বাংলা গান সেই সাহেবের চটি চাটা
গোলামের পছন্দ হয়নি।
উমার বিয়ের মাস পুরলো না, পার্থসারথির বাড়ি থেকে অরুণিমার সঙ্গে পার্থর
বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এল উমার স্বামী,
পার্থ'র মাসতুতো দাদা সঞ্জয়।
“ও’তো খুবই ছোট দাদা, সবে হায়ার-সেকেন্ডারী দিল… এখনই বিয়ে? জীবনের ও বোঝে
কী?' ম্রিয়মাণ শিপ্রা মুখ খুলল।
“তাছাড়া, পার্থ তো বয়েসে অনেকটাই বড়।”
“উমা আর সঞ্জয়ের বয়েসেও তো বিস্তর ফারাক শিপ্রা।” বৌদি চন্দ্রা সোচ্চার
হলেন।
“ছেলেটা সুন্দর, সুউপায়ী, দাবী দাওয়া নেই… সবথেকে বড় কথা, বাড়ি বয়ে সম্বন্ধ
এসেছে। হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেল না।”
বিয়ের দিন এগিয়ে এল, অজানা ভয় আর উত্তেজনায় বিবশ হয়ে পড়ল অরুণিমা।
-পড়াশোনা তো হলো না, গান’ও কি থাকবে?
মায়ের স্নেহভরা আঁচলের আশ্রয় ছেড়ে অরুণিমা গিয়ে পৌঁছল পার্থসারথির পরিবারে। পার্থ তার ছোটবয়েসে বাবাকে হারিয়েছে,
জননী চৈতী দেবীই সর্বময়ী কর্ত্রী।
“দ্য নাইট ইজ ইয়াং বেব।”
অরুর পাখির মতো দেহটাকে দু’হাতের বেড়ে নিয়ে, চিরন্তন কাম-নদীতে অবগাহন স্নান সেরে নিল পার্থ, অরুণিমার শরীরের উত্তাপকে
শুষে নিল তার প্রতিটি রোমকূপ।
নববিবাহিতা স্ত্রী’কে নিয়ে পুণে’র কর্মস্থলে ফিরল পার্থ।
শহরের বাইরে, এক রম্য পরিবেশে তাদের আবাসন। যেদিকেই চোখ যায়, অগুন্তি টিলা,
রহস্যময় চড়াই উৎরাইয়ের পথ এঁকে বেঁকে চলে গেছে কোন্ অজানার সন্ধানে। ছোটবেলায়,
মতিহারির বনে বাদাড়ে কাটানো সময়টা যেন অরুণিমাকে ফিরিয়ে দিলেন ভগবান। জংলা ঝোপ ঝাড়
ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, বিশাল আমলকি, সেগুন, ইউক্যালিপটাস গাছের মাঝে মাঝে। চাঁদের
আলোতে ভেসে যাচ্ছে চতুর্দিক, কী অভিজাত নির্জনতা।
“চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে…”
মনের আনন্দে গলা খুলে দেয় অরু।
সেই জঙ্গল-প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ে অরুর সুরেলা কণ্ঠ। মন ভ'রে উঠল অরুণিমার,
কলকাতা ছেড়ে আসার দুঃখ মুহূর্তেই দূর হয়ে গেল। আজ বাবা থাকলে কত খুশি হতেন।
“হোয়াট’স দ্য ম্যাটার, হোয়াট মেকস ইউ সো হ্যাপী?” চাবুকের মতো আছড়ে পড়ে পার্থর গুরু গম্ভীর স্বর।
-এই লোকটা কখনো বাংলা বলে না, বাঙালি তো?
উত্তেজিত অরু যখন চোখ বড় বড় করে জানাল তাদের বাড়ির অদূরের ইউক্যালিপটাস
বনের কথা, পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে যে তাদের কী রূপ…
পার্থ তখন তার প্রিয়ার শরীরের আনাচে কানাচে, চড়াই উৎরাইয়ে ভ্রমণ করে চলেছে।
চাঁদের আলোয় ধোয়া উপত্যকায় হারিয়ে যেতে যেতে সে বলে, “আই ওন মাই প্রাইভেট ইউক্যালিপটাস-ভ্যালী,
নো নীড ট্যু লূক এলসহোয়্যার।”
অচেনা-অজানাকে আপন করে নেওয়ার সহজাত একটা ক্ষমতা আছে অরুণিমার কিন্তু তার
এই পাতি বাঙালি আচরণ পার্থর একদমই পছন্দ নয়, সে চায় অরু তার স্বামীর পদমর্যাদা অনুযায়ী চলুক।
অরু বুঝতে পারে না, অসুবিধেটা কোথায়? মানুষের চেয়ে বেশী রহস্যময় কিছু তো এই
পৃথিবীতে নেই’ই। পার্থ বিরক্ত হয়,
অরুণিমার মেলামেশায় কোনও বাছবিচার নেই, নেই কোনও সামাজিক-অর্থনৈতিক ভেদাভেদ জ্ঞান।
“পড়াশোনা শুরু করি? আমার সময় কাটে না।”
“হোয়াই, আরন্ট ইউ স্যাটিসফায়েড উইদ মি? অন্য পুরুষের ছোঁয়া চাই?
সাচ আ লং টাইম, ইউ ডিডন্ট লার্ন আ ওয়ার্ড অফ ইংলিশ। আজ পড়াশোনা করতে কলেজে
গিয়ে ছেলেদের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করবে, তারপরে বলবে চাকরি করতে যাব। সেখানে তো
আরও মজা। বাইরে খেতে যাবে, রাত করে বাড়ি ফিরবে, তারপরে শুরু হবে ট্যুরে যাওয়া।”
অবাক অরু পার্থর সুন্দর মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে, তার চোখের পলক পড়ে না। এই
সৌন্দর্যের মুখোশ আড়াল করে রেখেছে কী ভয়ংকর এক বিভীষিকাময় চেহারা!
-এ কেমন মানুষ, কার সঙ্গে সংসার করছি, বিছানা ভাগ ক'রে নিচ্ছি?
পুরুষ মানুষের সঙ্গ বিশেষ পায়নি অরু কিন্তু এই ধরনের চেহারা তো তার সামনে
কখনো আসেইনি।
“আর, তুমি যখন অফিসের কাজে বাইরে যাও…”
কথাটা শেষ করার আগেই সপাটে এক চড় এসে পড়ল তার গালে। ঘুরে গিয়ে দেওয়ালের
ওপরে আছড়ে পড়ল, মা-বাবার প্রাণাধিক প্রিয়, অন্ধকার মিটিয়ে প্রভাতের আলো নিয়ে আসা,
অরুণিমা।
নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল অরুণিমা। মা’র কথা মনে পড়ল, কত কষ্ট করে
বড় করে তুলেছেন তাদের দু'বোনকে। দিদি ভালো নেই, বিয়ের পরে পরেই খবর এসেছিল।
অতি শিক্ষিত স্বামী আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন-গ্রাম্য শাশুড়ির অত্যাচারে অতিষ্ঠ
উমা।
শারীরিক নির্যাতনের কোনও সীমা-পরিসীমা নেই কিন্তু মানিয়ে রয়েছে তো সে, সহ্য
করে। সে’দিক থেকে দেখতে গেলে পার্থ তো সোনার সোনা। কী ভীষণ ভালবাসে অরুকে, চক্ষে
হারায় তবে, তাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না অরুণিমা।
এক অন্তরঙ্গ মুহূর্তে পার্থসারথি তার স্ত্রীকে বলেছিল, “তোমার ভালো লাগা না
লাগার কথা বলবে আমাকে।”
অরু কিছুই বলেনি, সে যে তার মা'র কাছেই কখনও এক গ্রাস ভাত চেয়ে খায়নি। মনে
হয়েছিল, প্রিয়তম মানুষটাকেই যদি মুখ ফুটে বলে বোঝাতে হয় তার ভালো-মন্দ লাগার কথা,
তাহলে তো দূরত্ব ক্রমশ বেড়েই চলবে। পার্থ কেন বুঝে নেবে
না তার প্রিয়ার মনের কথা? অরু তো সহজেই বুঝে ফেলে পার্থ কী চায় না চায়।
অনভিজ্ঞ অরুণিমার অবশ্য জানা ছিল না যে এই সমস্যাটা সব পুরুষেরই। তারা
নিজেরাই বুঝে ওঠে না, তারা কী চায়। নারীই ঠিকঠাক বুঝতে পারে তার প্রিয়তম
মানুষটিকে।
কৈশোর থেকে যৌবনের সিঁড়িতে পা রাখতেই বিবাহিতা বন্ধুদের কাছে শুনেছিল অরু,
তাদের বরেরা অনেক সাধ্যসাধনা করে বউয়ের মান ভাঙাতে। তার আগে নাকি স্বামীর কাছে ধরা
দিতে নেই, খেলো হয়ে যেতে হয়। সে রসাস্বাদনের সুযোগ তো অরুণিমার ভাগ্যে জুটলো না।
অনেক কথা বলে যাওয়ার পরে জবাব জোটে এক হুঁ বা হাঁ’য়ে।
অরু’র মান ভাঙাবার পরিস্থিতি তো আসেনি আজ অবধি, অরুকেই সামলাতে হয় স্বামীর
রাগ-অভিমানের পাহাড়।
অরুণিমার বিস্ময় ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে বিহ্বলতায়। আশা ভঙ্গের বেদনা
মনের মধ্যেই দমিয়ে রেখে, নিজের কাজ করে যায় সে।
পার্থর হৃদয়ে অরুণিমা’র জন্যে ভালবাসা হয়তো আছে কিন্তু তার প্রকাশ, কীভাবে
যেন বদলে গেছে, অবজ্ঞা আর অবহেলাতে।
পার্থর মা এলেন, ছেলের কাছে।
মা আর ছেলে অদ্ভুত এক ইংরেজি টানে কথা বলে, অরু'র কিছুই বোধগম্য হয় না।
বিয়ের পরেই শাশুড়ি’মা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁকে 'মা' সম্বোধন করাটা তাঁর পছন্দ নয়।
বেঁচে গিয়েছিল অরু। বাবা বলে ডাকার কেউ তো ছিল না, মা’র জায়গা অন্য কাউকে দিতে
পারবেও না সে।
কাজকর্ম সেরে, বাড়ির পেছনের বাগানে গিয়ে বসে থাকে অরু।
জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর, দু'একদিনের মধ্যেই বোধহয় পূর্ণিমা।
অরুকে ডাকতে এসে, তাকে অন্ধকার বাগানে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে যান তার
শাশুড়ি'মা, চৈতী।
ছেলেকে বলেন, “কী ডাকাত মেয়েমানুষ! ভূতের ভয় না’হয় নেই, কিন্তু সাপ-খোপ,
বিষাক্ত পোকামাকড়! তোমার বউ তো অস্বাভাবিক পার্থ।”
পার্থর ডাকাডাকিতে ঘরে ঢোকে অরু।
-সব কাজ সেরে আমি যদি নিজের মতো থাকতে চাই, অন্যায়টা কী? জংলি ফুলের গন্ধ,
চাঁদের আলো যদি আমাকে মাতাল করে, তাতে অসুবিধেটা কোথায়?
“অস্বাভাবিক নয় মা, সেয়ানা ঘুঘু। নিশ্চয়ই কারোও সঙ্গে দেখা করতে যায় ও। এর
আগেও দেখেছি আমি। বুঝতে পারিনি।”
স্তব্ধ অরুণিমা জানলার পাশে চুপ করে বসে থাকে। এই চক্রব্যূহ থেকে বের হবার
পথ তার জানা নেই, চোখের জল শুকিয়ে গেছে। হৃদয় হয়েছে পাথর।
বিদেশের কনফারেন্স সেরে পার্থ বাড়ি ফিরল, চৈতী ফিরে গেলেন কলকাতায়।
অনেকদিনের অদর্শনের পরে, তীব্র কামনাতে তার স্ত্রী’কে আবরণ মুক্ত করল
পার্থ। বিছানাতে অরুণিমা শীতঘুমে যাওয়া পশুর মতো আচরণ করে।
“তুমি এরকম নির্জীব থাক কেন বিছানায়, কার কথা ভাব বল তো?”
হিংস্র হয়ে ওঠে পার্থ, নিষ্ঠুরভাবে যন্ত্রণা দিতে থাকে তার প্রাণাধিকাকে।
চুপ করে থাকে অরুণিমা, না বলা বাণী চোখের জলের ধারায়, দীর্ঘশ্বাসে বয়ে যায়।
-তুমি ছাড়া আর কোনও পুরুষের কথা আমার কখনো মনেও আসেনি পার্থ। তোমার ভালবাসা
কেবল শরীর কেন্দ্রিক কিন্তু সেই আনন্দ নিতেও তো কিছু মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন।
সম্ভোগ পূর্ব কিছু খুনসুটি, কিছু আদর ছাড়া দৈহিক মিলন! সে যে বড়ই যান্ত্রিক,
বৈবাহিক-ধর্ষণ ছাড়া আর কোনও নামেই তাকে সম্ভাষিত করা যায় না।
কিছুই বলা হয় না।
সংকোচ করতে করতে কখন যেন একটা অলঙ্ঘ্য বাধার প্রাচীর তৈরি হয়ে গেছে তাদের
মধ্যে।
সম্পর্কটা এখন শুধুই খাদ্য-খাদকের।
অফিসের পার্টী ছিল। পছন্দ করে কেনা সানসেট-পিংক লিপস্টিক লাগিয়ে প্রথমবার
পার্থর সঙ্গে বেরিয়েছিল অরুণিমা। আগে খেয়াল করেনি পার্থ, রাস্তার লোকজন তাদেরই
দিকে তাকিয়ে আছে দেখে তার টনক নড়ল। তাকিয়ে দেখার মতোই
অভিনব জোড়া তাদের, কিন্তু পার্থর তো পছন্দ হয় না। তার স্ত্রীয়ের সৌন্দর্য
শুধুমাত্র তার উপভোগের, একান্ত ব্যক্তিগত।
“এরকম কটকটে রঙ মেখে সঙ সেজেছ কেন, কার মন ভোলাতে? আমার তো নয় নিশ্চয়ই! ইউ
লূক লাইক দ্য ব্রথেল ফিমেল'জ।”
অরু’র চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়েছিল, রুমাল দিয়ে ঘষে ঘষে লিপস্টিকের দাগ তুলে
ফেলতে চেষ্টা করেছিল সে।
একবার, প্রাণের বন্ধু নীহারিকাকে চিঠি লিখে সব জানিয়েছিল অরু, পার্থর
ব্যবহারের বিষয়ে।
উত্তর দিয়েছিল রিকা।
“তোর গালটা টিপে দিলাম অরু। খুব ভাগ্যবতী রে তুই। তোকে ভীষণ ভালবাসে
পার্থদা, এইরকম ভালবাসা সহসা দেখা যায় না। আমার বর যেন এমন করেই ভালবাসে আমাকে।
আমার প্রতি এতটুকুও মনোযোগের অভাব আমি সহ্য করতেই পারব না।”
“কী দেখছ কী বারান্দায় দাঁড়িয়ে?” পার্থর বলার ধরনটা নিষ্ঠুর।
“দেখ আকাশটা কী ভয়ংকর সুন্দর!”
-মেঘের পরে মেঘ জমেছে
হাত বাড়িয়ে টুপটাপ নেমে আসা বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে ছুঁয়ে দিল অরু।
“কচি খুকির মতো বৃষ্টিতে ভিজছো কেন? তোমার আচরণে বোঝা যায় না বয়েসটা
বাড়ছে।” তীক্ষ্ণ চোখে পাশের বাড়ির বারান্দার
দিকে তাকায় পার্থ। কেউ নেই বারান্দায়,
ভাগ্যিস। পাশের বাড়ির ভদ্রলোককে নিয়ে কুৎসিত
ইঙ্গিত করে পার্থ।
-এ কেমন ভালবাসা কে জানে,
কী ভেবে যে ব্যথা দিলে এ প্রাণে!
পার্থর বদলি হয়েছে, বেঙ্গালুরু যেতে হবে। জিনিসপত্র গোছগাছের সময়ে
জানলাগুলোকে পেরেক ঠুকে ঠুকে বন্ধ করে দিচ্ছে পার্থ।
প্রশ্ন জাগে অরুর মনে, কিন্তু সে এতদিনে বুঝে গিয়েছে তার স্বামীর স্বভাব।
কোনরকম জিজ্ঞাসাবাদ পছন্দ করে না সে। বউকে তো বাড়ি সাজাবার এক আসবাব মনে করে
পার্থসারথি মজুমদার।
কবিগুরুর লেখা মনে পড়ল।
-সে আমার সম্পত্তি নয়, সে আমার সম্পদ।
তার স্বামীর জীবনে কোনদিনই সম্পদ হয়ে উঠতে পারেনি অরু, সম্পত্তি হয়েই থেকে
গেছে। কোত্থাও যায় না তাকে নিয়ে, কেউ আসেও না
তাদের বাড়িতে। কড়া নজরদারি সর্বদা। বারান্দার দরজায় তালা, বেরনো বন্ধ।
অফিসে বেরবার সময়ে বাইরে থেকেও তালা দিয়ে যায় সে। চার দেওয়ালের মধ্যেই বন্ধ
থাকে অরুণিমা।
যা আগে ছিল না, এখন খাবারের ওপরেও রেশনিং হয়ে গেছে। রান্না করবে অরু, পার্থ
হাতে করে যা দেবে সেটুকু খেয়েই তৃপ্ত থাকতে হবে তাকে, ফ্রিজে তালা পড়ে যায়। ফোন তো
কবে থেকেই বন্ধ।
পার্থর চোখে এক হিংস্র পশুর ছায়া দেখতে পায় অরুণিমা, ভয়ে তার বুক কেঁপে
ওঠে।
মালপত্র সব ট্রাকে তোলা হয়ে গেছে। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। অরুণিমা তো এখনও
তো রাত পোশাকেই। আলমারি তো নেই, শাড়ি কোথায় পাবে, চেঞ্জ করবে কীভাবে?
শূন্য ঘরগুলোতে অশরীরী আত্মার মতো ঘুরে বেড়ায় অরুণিমা। পার্থ চলে গেছে। সে নিশ্চয়ই আসবে অরুকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। তার ভালবেসে
বিয়ে করা বউ, যাকে মুহুর্ত চোখের আড়াল করতে বুকের পাঁজর ভেঙে যায় তার।
কী তেষ্টা! একটা বোতলেও জল নেই। অ্যাকোয়াগার্ড মেশিনটাও তো খুলে নিয়েছে।
-পার্থ আমার সঙ্গে কেন এরকম করছে? আমি তো ওর সব কথা শুনে চলি, কোনও
প্রতিবাদ করি না, কখনো।
রান্নাঘরের সিংক, বাথরুমের কল কোথাও থেকেই জল পড়ছে না, তেষ্টায় বুক ফেটে
যাচ্ছে অরুর।
-মা, তুমি কোথায়? আমি তোমার কাছে যাব।
বাবা এসে দাঁড়ালেন অরুর সামনে।
পার্থসারথি’র বদলির পরে, কোম্পানি-কোয়ার্টারটা অ্যালট করা হয়েছে সিনিয়র
সুপারভাইজার কার্ত্তিক বিশ্বনাথনের নামে।
তাঁর মালপত্র এসে পৌঁছেছে।
তাঁরা এসে পড়বেন, দেরি নেই।
রুটিন চেক আপ করতে মজুমদার সাহেবের ফ্ল্যাটের তালা খোলা হলো। পার্থসারথিকে
দেওয়া চাবির কথা কারোও মাথায় এল না।
বাড়ির জানলাগুলো খোলা যাচ্ছে না, সব পেরেক ঠুকে ঠুকে বন্ধ করা।
বারান্দায় বেরবার দরজাগুলোতে তালা দেওয়া। সেই তালার চাবি তো নেই, ভাঙতে
হবে। অন্ধকার ঘর আলোকিত হতেই মূর্ছিত এক
মহিলাকে পাওয়া গেল। তার চেহারা কেউ কখনো
দেখেনি বললেই চলে। আন্দাজ করা হলো, ইনিই মিসেস পার্থসারথি।
ওই বাড়িতে বসবাস করতে রাজি হলেন না মিসেস বিশ্বনাথন্। সাময়িক ভাবে রেস্ট
হাউসে থাকার ব্যবস্থা করা হলো।
কিন্তু পার্থসারথি কোথায়?
তার স্ত্রী’কে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। তার মানসিক স্থিতি
সুবিধাজনক নয়, জ্ঞান ফিরলে প্রলাপ বকছে সে। ডাক্তাররা আশ্বাস দিয়েছেন, ঠিক হয়ে
যাবে। সময় লাগবে।
বেঙ্গালুরুর অফিসে খোঁজ খবর নেওয়া হলো, সেখানে যায়নি সে। পার্থসারথির জন্যে
নির্দিষ্ট করা ফ্ল্যাটেও আসেনি কেউ। মালপত্রে ভরা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে,
সোসাইটী-অফিসের সামনে।
গেল কোথায় মানুষটা?
এক অসহায় পুরুষ-মূর্তি বার-বার এসে দাঁড়াচ্ছে পার্থর চোখের সামনে। কী অসহায়
আকুতি তার চোখে।
আবছা হয়ে যাচ্ছে দূরে দাঁড়ানো মহিলার অবয়ব। সেই অবয়ব আবার মাঝে মাঝেই বদলে
যাচ্ছে অরুর চেহারাতে। সারাক্ষণই চোখের সামনে ছায়ারা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাকে ভয়
দেখাতে।
স্ত্রী, চৈতীর আকাশচুম্বী আকাঙ্খার অত্যাচারে জর্জরিত ছিল তার অতি সাধারণ
মানের স্বামী শ্রীকান্ত।
দাম্পত্যের সমতার সম্পর্ককে মুহূর্তের মধ্যে শেষ করে দিয়ে, স্বামীকে তিনি
রূপান্তরিত করেছিলেন এক ভারবাহী পশুতে। সেই পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছিল,
শ্রীকান্তের স্ত্রী'র সন্দেহ প্রবণতার ফলে।
“চাকরি কর, ব্যবসা কর, যেভাবেই হোক অনেক অনেক টাকা এনে দাও আমার হাতে।”
চৈতীর বক্তব্য, সে টাটা-বিড়লার ঢঙে সেই টাকা ওড়াবে, নিজের ইচ্ছেমতো।
আর, রোজগারের জন্যে বাইরে বেরোলেও তো অশান্তির শেষ নেই, কোন্ মহিলার সঙ্গ
করে এসেছে সে, সেই বিবরণী তার মুখ থেকে বার করে তবেই থামবে চৈতী।
স্ত্রীয়ের চাহিদা অনুযায়ী সেই পরিমান অর্থ উপার্জনের ক্ষমতা ছিল না
শ্রীকান্তর, চাপ শুরু হলো। একমাত্র স্থাবর
সম্পদ, শ্রীকান্তের পৈতৃক বাড়ি চৈতীর নামে লিখে দেওয়ার জন্যে। অত্যাচারের মাত্রা বেড়েই চলল।
দিনের পর দিন অন্ধ কুঠুরিতে বন্ধ থাকা, অভুক্ত মানুষটার মনোবল ভেঙে পড়তে
সময় লাগেনি।
আত্মহত্যায় মুক্তির পথ বেছে নিয়েছিলেন তিনি।
ক'দিন ধরে, মানসিক ভারসাম্যহীন এক পুরুষকে দেখা যাচ্ছে মুথা নদীর পাশের
বন্য প্রান্তরে, সংগ্রুন গ্রামের কাছে। গাছের ছায়ায় শুয়ে,
বসে সময় কাটায় নির্বিরোধী মানুষটা।
চোখের দৃষ্টি অস্বাভাবিক, জামাকাপড় ছিন্নভিন্ন, মুখে বিজাতীয়, অর্থহীন
সংলাপ।
গ্রামের ছেলেপুলেরা অতিষ্ঠ করে তুলছিল তাকে। স্থানীয় প্রধানের হস্তক্ষেপে,
তাকে নিয়ে গিয়ে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে গ্রাম পঞ্চায়েতের দপ্তরে।