শক্তিমান ভারতে ক্ষয়িষ্ণু বাঙালী => ভাস্কর সিন্হা

 

শক্তিমান ভারতে ক্ষয়িষ্ণু বাঙালী

  ভাস্কর সিন্হা

সূচনা

ভোরের আলো নদীর জলে পড়ে প্রথমে যেন লাজুক আঙুলের মতো কেঁপে ওঠে, তারপর ধীরে ধীরে টেনে দেয় এক দীর্ঘ রূপালি রেখা। সেই রেখা গিয়ে মিলিয়ে যায় কুয়াশার আড়ালে ঢাকা গঙ্গার বাঁকে, যেখানে আকাশের ধোঁয়াটে বুকে ঝুলছে সূর্যের গোলক। সেই সূর্য যেন আজকের ভারত—দগ্ধ অথচ দীপ্ত, শক্তিশালী অথচ অবিরাম দৌড়ে থাকা। সে ছুটছে মহাকাশের অজানা গ্রহে, ছুটছে অর্থনীতির বাজারে, ছুটছে কূটনীতির কংক্রিট করিডরে। তার চোখে আছে বিজয়ের দীপ্তি, তার বুকের ভেতর গর্জে উঠছে আত্মবিশ্বাসের অগ্নি।

কিন্তু সেই সোনালি আলো ঢেউ পেরিয়ে, স্রোত ভেদ করে, কাঁকড়াবিছের গর্ত পেরিয়ে যখন বাংলার তীরে এসে পড়ে—তখন যেন তার উজ্জ্বলতা ধীরে ধীরে নিভে আসে। স্রোতের গতি মন্থর হয়, জলের বুক ভারি হয়ে আসে, পাড়ে কাদা থকথকে। সোনালি রং ফিকে হয়ে মিশে যায় কাদার ধূসরতায়—যেন দীপ্তি এসে আটকে গেল ক্লান্তির ফাঁদে।

ভারত আজ মহাকাশের বুকে পতাকা গেঁথে দিয়েছে, চাঁদের মাটিতে নিজের ছায়া ফেলেছে, জি–২০-এর টেবিলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতির ঘোড়া লাগামহীন ছুটছে—দিল্লি থেকে দুবাই, বেঙ্গালুরু থেকে বোস্টন—ভারতীয় মেধা ও পুঁজির পদচিহ্ন পড়ছে পৃথিবীর প্রতিটি কোণে। প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা, শিল্প, বাণিজ্য—সবখানে ভারত নিজের ক্ষমতার গল্প লিখছে সোনালি অক্ষরে।

কিন্তু এই শক্তিমান রথের অন্তরে, তার সবচেয়ে গভীর বৌদ্ধিক হৃদয় ছিল যে বাংলা—সে আজ যেন হাঁপাতে হাঁপাতে বেঁচে আছে। তার কণ্ঠস্বর ক্লান্ত, চোখে জেগে আছে পুরনো গৌরবের ধূসর স্মৃতি, কিন্তু হাত ফাঁকা। যে বাংলা একদিন ভারতের আধুনিকতার ভাষা বানিয়েছিল, নবজাগরণের আগুন ধরিয়েছিল, স্বাধীনতার স্লোগান লিখেছিল, আজ সেই বাংলা যেন নিজের আয়নায় নিজেকে চিনতে পারছে না।

এ যেন এক বুড়ো শিল্পী—যার একসময় হাতের তুলিতে পৃথিবীর রঙ বদলে যেত, আজ তার আঙুল কাঁপে, তুলিতে রঙ শুকিয়ে গেছে। ভারত যখন দৌড়াচ্ছে আধুনিকতার ট্র্যাক ধরে, বাংলা তখন সেই ট্র্যাকের ধারে বসে শ্বাস নিচ্ছে গভীর, যেন কোনো একদিন সেও আবার দৌড় শুরু করবে—কিন্তু কবে? কেউ জানে না।

এই বৈপরীত্য শুধু অর্থনীতির নয়, এটি আত্মারও—যেখানে একদিকে শক্তি, সাফল্য, বিশ্বজয়ের স্বপ্ন, আর অন্যদিকে ক্লান্তি, অবহেলা, ভুলে যাওয়া প্রতিভা। ভোরের সোনালি রেখা বাংলার তীরে এসে নিভে যাওয়া শুধু এক দৃশ্য নয়—এ হলো আমাদের সময়ের প্রতীক, যেখানে শক্তিমান ভারতের বুকের ভেতর ক্ষয়িষ্ণু বাংলার স্পন্দন ক্ষীণ হয়ে আসছে।

এ গল্প শুরু হয় সেই প্রশ্ন দিয়ে—কেন? কেন গোপাল, ধর্মপাল, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি, সত্যেন্দ্রনাথ বসুদের পর এই মাটিতে আর জন্ম নিচ্ছে না সর্বভারতীয় নেতৃত্ব, সেই মেধার বিস্ফোরণ যা একসময় দেশকে বদলে দিত? আর যদি এই প্রশ্নের উত্তর আমরা আজ না খুঁজি, তবে আগামী প্রজন্মের ভোরের আলো হয়তো বাংলার তীরে এসে আর কোনো রূপালি রেখাই তুলবে না।

 

সারসংক্ষেপ

গোপাল কৃষ্ণ গোখলে একদিন ইতিহাসের বুকের ভেতরে এক লাইন খোদাই করেছিলেন—"What Bengal thinks today, India thinks tomorrow"। তখন এই বাক্য ছিল জীবন্ত সত্য; তখন বাংলা ছিল চিন্তার অগ্রদূত, বিদ্রোহের ভাষা, স্বপ্নের জন্মভূমি। গোপাল, ধর্মপাল, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি, মেঘনাদ সাহা—তাঁরা কেবল নেতা বা চিন্তাবিদ ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন এক জাগ্রত যুগের প্রতীক। তাঁদের মস্তিষ্কে জন্ম নেওয়া ভাবনা সারা উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ত, নদীর স্রোতের মতো অপ্রতিরোধ্য হয়ে।

কিন্তু আজ? সেই উক্তি উচ্চারণ করলে কি আর কণ্ঠে সেই দৃঢ়তা আসে? বাংলার আকাশে কি এখনো ততটা বজ্রগর্জন শোনা যায়, যতটা শোনা যেত বিদ্যাসাগরের কলমে, নেতাজির বক্তৃতায়, রবীন্দ্রনাথের গানে? মনে হয় যেন বাংলার গৃহে প্রদীপ এখনো জ্বলছে, কিন্তু শিখা ছোট হয়ে এসেছে; আলো আছে, তবে সেই উষ্ণতা নেই।

এই প্রবন্ধে আমরা সেই আলো-অন্ধকারের ভিতর দিয়ে হাঁটব। দেখব—কোথায় হারিয়ে গেছে সেই বৌদ্ধিক নেতৃত্বের স্রোত, কোন শিকড়ে মরচে ধরেছে নবজাগরণের গাছের, আর কেন শক্তিমান ভারতের বুকের ভেতর বাংলার স্বপ্নক্ষেত্র আজ অনুর্বর হয়ে পড়েছে।

আমরা যাব ভূরাজনীতির গভীরে—যেখানে সীমান্তের কাঁটাতারের ওপারে নীতি আর অবিশ্বাসের জট, বাণিজ্যের সম্ভাবনা আর শরণার্থীর দীর্ঘশ্বাস একসাথে মিশে থাকে। আমরা দেখব সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের ছবি—যেখানে নাট্যমঞ্চে বাণিজ্যিকতার হাত, সাহিত্যপত্রিকায় পাঠকের অভাব, আর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির বিষবৃক্ষ শিকড় গেড়ে বসেছে।

আমরা থামব বাংলাদেশের কোটাবিরোধী আন্দোলনের মোড়ে—যেখানে ঢাকার রাস্তায় তরুণেরা মেধার স্বীকৃতির জন্য দাঁড়িয়েছে, আর পাশের রাষ্ট্র ভারত, নীরব কূটনীতির আড়ালে, মানবিক সংহতির সুযোগ হারিয়েছে। দেখব, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কীভাবে নিজেকে আঞ্চলিক সীমানায় বেঁধে ফেলেছে, প্রবাসী বাঙালীরা কতটা উজ্জ্বল হলেও মূল ভূখণ্ডের নীতি নির্ধারণে কতটা প্রান্তিক থেকে গেছেন, আর নারী নিরাপত্তার অভাবে কীভাবে আমরা অর্ধেক সম্ভাবনা নিজেরাই মাটিচাপা দিচ্ছি।

এই যাত্রায় বেদনা আছে—কারণ আমরা দেখব হারানোর গল্প; আশা আছে—কারণ প্রতিটি ক্ষয়ের মধ্যেই থাকে পুনর্জন্মের বীজ। আমরা খুঁজব সেই সম্ভাবনার পথ, যেখানে বাংলা আবার হয়ে উঠতে পারে ভারতের চিন্তার কেন্দ্র, নতুন স্বপ্নের উত্থানক্ষেত্র।

শেষ পর্যন্ত এই প্রবন্ধ শুধু এক বৌদ্ধিক বিশ্লেষণ নয়; এটি এক আয়না—যেখানে আমরা দেখব আমাদের অতীতের দীপ্তি, বর্তমানের ফিকে রং, আর ভবিষ্যতের সম্ভাবনার ছায়া-আলো। যদি আমরা চাই, এই আয়নায় আবার ফিরিয়ে আনা যায় সেই মুখ, যেটি দেখে গোখলে একদিন বলেছিলেন—"What Bengal thinks today, India thinks tomorrow"। আর যদি না চাই, তবে একদিন হয়তো এই উক্তি বইয়ের পাতায় থেকে যাবে নিছক এক সুন্দর, কিন্তু মৃত, উদ্ধৃতি হয়ে।

 

ভূমিকা

কলেজ স্ট্রিটের ধুলোয় পায়ের শব্দ মিলিয়ে যায়, যেন পুরনো সময়ের হারানো প্রতিধ্বনি। একসময় এই রাস্তায় হাঁটলেই বুকের ভেতর কেমন এক গরম হাওয়া বইত—বইয়ের দোকানের সারি, হাতে কাগজ-কলম, আর তর্কের উত্তাপ ভাসত বাতাসে। আজ সেই উত্তাপে কেবল ধুলো জমেছে। কফিহাউসের দেওয়ালে ঝুলে আছে বহু পুরনো দিনের হাসির প্রতিধ্বনি—যা একসময় নেতাজি, সত্যজিৎ, সুকান্তদের টেবিল থেকে ছড়িয়ে যেত আড্ডার শব্দে, তর্কের ঝড়ে। এখন সেই দেয়াল শুধু স্মৃতি ধরে রেখেছে, নতুন ইতিহাস লেখার আগুন নয়।

প্রেসিডেন্সির সিঁড়ি নীরব, অথচ এই সিঁড়িই ছিল একসময় বিদ্রোহের ঘরানা শেখার পাঠশালা। এখানে বিদ্যাসাগরের কলমে জন্ম নিয়েছিল বিধবা বিবাহের আইন, সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ল্যাবরেটরিতে জন্মেছিল নতুন বিজ্ঞান, আর প্রান্তরের ওপার থেকে রবীন্দ্রনাথের কলমে এসেছিল বিশ্বমানবতার বীজবপন। সেই নীরবতা একসময় ঝড় ডাকত, যা কাঁপিয়ে দিত কেবল বাংলা নয়, সমগ্র ভারতকে। আজ সেখানে শূন্যতার শব্দ, যেন ইতিহাসের দরজায় তালা পড়েছে।

বাংলা একদিন ছিল ভারতের বৌদ্ধিক রাজধানী—এক এমন ভূমি যেখান থেকে নারীশিক্ষা আন্দোলনের প্রথম মশাল জ্বালানো হয়েছিল, সমাজ সংস্কারের প্রথম ঘোষণাপত্র লেখা হয়েছিল, জাতীয়তাবাদের প্রথম স্লোগান শোনা গিয়েছিল। এই মাটি থেকে ছড়িয়েছিল কবিতা, শিল্প, বিজ্ঞান, রাজনীতি—যা গোটা উপমহাদেশের দিকনির্দেশ করত।

কিন্তু এখন? দিল্লির সংসদ ভবনের ঝলক, মুম্বাইয়ের অর্থনৈতিক ব্যস্ততা, বেঙ্গালুরুর প্রযুক্তি-পার্কের আলো—সব মিলিয়ে যেন বাংলার আকাশে এক দীর্ঘ ছায়া পড়েছে। কলকাতার রাস্তায় সেই স্লোগান নেই, যা একসময় স্বাধীনতার ডাক দিত; বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সেই তর্ক নেই, যা একদিন রাজনৈতিক মানচিত্র বদলে দিত।

প্রশ্ন তাই স্বাভাবিকভাবেই ওঠে—কেন গোপাল, ধর্মপালের পর কলকাতা সর্বভারতীয় নেতৃত্ব হারিয়েছে? কেন আজকের তরুণেরা আর সেই স্বপ্ন দেখে না, যা একসময় দেশকে জ্বালিয়ে তুলত অদম্য উদ্দীপনায়? তাদের চোখে আছে অনিশ্চয়তার ভয়, কর্মসংস্থানের খোঁজ, প্রবাসে পাড়ি দেওয়ার তাগিদ—কিন্তু নেই সেই আগুন, যা অন্যায়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দিত, নেই সেই কলম, যা নতুন পথের মানচিত্র আঁকত।

এই প্রবন্ধে আমরা খুঁজব সেই হারানো উৎস, সেই নীরব নদীর স্রোত—যেটি একদিন ভারতের বুকে বহত গর্বে, আর আজ বালুচরে এসে আটকে আছে। আমরা দেখব, কীভাবে ইতিহাস, ভূরাজনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা আর রাজনীতি মিলিয়ে তৈরি করেছে এই ক্ষয়; আর দেখব, কোথা থেকে শুরু করলে আবার জেগে উঠতে পারে সেই বাংলা, যে একদিন ছিল ভারতের মস্তিষ্ক ও হৃদয়—একসাথে।

 

সংশ্লিষ্ট সাহিত্য পর্যালোচনা

বাংলার ইতিহাস, রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে যারা লিখেছেন, তাঁদের লেখার ভেতর দিয়ে যেন আমরা হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পাই—কোথায় দীপ্তি ছিল, কোথায় ভাঙন ধরল, আর কোন পথে আবার তা ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। এই যাত্রায় প্রথমেই সামনে আসেন সুশোভন সরকার। তাঁর Modern India গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন, উনিশ শতকের বাংলা ছিল কেবল এক প্রদেশের ভৌগোলিক সীমানা নয়—এটি ছিল সমগ্র ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মানচিত্রের উত্তর তারকা। তাঁর ভাষায়, বাংলার চিন্তা, সংস্কার ও সাহিত্য তখন এমন এক অগ্নিশিখা ছিল, যা দিল্লি-মুম্বাইয়ের আকাশে গিয়ে আলো ফেলত। নবজাগরণের মশাল প্রথম জ্বলে উঠেছিল এখানেই, আর সেই আলোয় স্নান করেছিল গোটা উপমহাদেশ।

সুমিত সরকার তাঁর From Plassey to Partition and After-এ ইতিহাসের গভীরে নেমে দেখিয়েছেন নবজাগরণের জন্মসূত্র। তাঁর বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয়, উপনিবেশিক শোষণ বাঙালীর বুক থেকে রক্ত শুষে নিলেও, সেই চাপ থেকেই জন্ম নিয়েছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণি—যারা ছিল শিক্ষিত, সচেতন এবং পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত। এই শ্রেণিই বিদ্যাসাগরের কলমে বিধবা বিবাহ আইন, বঙ্কিমের উপন্যাসে জাতীয়তাবাদের বীজ, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় মানবতাবাদ, আর নেতাজির বিপ্লবে রাজনৈতিক আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিল।

তবে পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর The Nation and Its Fragments-এ আমাদের এক তিক্ত সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করান। তিনি বলেন, বাঙালী জাতীয়তাবাদ ছিল দ্বিমুখী—একদিকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে বিভাজনের বীজ। এই দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়েই ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ, ১৯৪৭-এর দেশভাগ, আর ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মতো ঘটনাগুলি ঘটেছে। পার্থ দেখিয়েছেন, বাঙালী আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে একসাথে সাহসী ও দ্বিধাগ্রস্ত—যা আজও রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সিদ্ধান্তে প্রতিফলিত হয়।

বাংলাদেশের প্রসঙ্গে বদরুদ্দীন উমর ও সিরাজুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাস্তবতাকে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। বদরুদ্দীন উমর রাজনৈতিক মেরুকরণ, দুর্নীতি ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর দুর্বলতাকে চিহ্নিত করেছেন সামাজিক ক্ষয়ের প্রধান কারণ হিসেবে। সিরাজুল ইসলাম দেখিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী আশার উচ্ছ্বাস ধীরে ধীরে কীভাবে বাস্তবের কঠিন দেয়ালে আটকে গেছে—যেখানে যুবশক্তি হয় রাজনীতির হাতিয়ার, নয়তো প্রান্তিক বেকার সেনা।

আর গায়ত্রী স্পিভাক (In Other Worlds) আমাদের মনে করিয়ে দেন এক গভীর সত্য—নারীর মুক্তি ছাড়া কোনো সমাজ পূর্ণ বিকাশ পায় না। তাঁর লেখায় উঠে আসে, নারীর কণ্ঠস্বরকে প্রান্তিক করে রেখে কোনো জাতি তার বৌদ্ধিক বা সাংস্কৃতিক শক্তিকে পূর্ণতা দিতে পারে না। বাংলার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই স্বীকৃতির ওপর—নারীর নিরাপত্তা ও নেতৃত্ব ছাড়া নতুন নবজাগরণ অসম্ভব।

এইসব লেখার ভেতর দিয়ে আমরা দেখি—ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি ও সংস্কৃতির প্রতিটি স্তরেই বাংলা একদিকে শিখরে উঠেছে, অন্যদিকে গভীর খাদেও নেমেছে। এসব গবেষণা শুধু অতীতের দলিল নয়, এগুলো একেকটি আয়না—যেখানে আমরা আমাদের গৌরব, ক্ষয়, ভুল ও সম্ভাবনাকে একসাথে দেখতে পাই। আর সেখান থেকেই শুরু হয় এই প্রবন্ধের যাত্রা—কোথায় হারিয়ে গেল বাঙালীর সর্বভারতীয় নেতৃত্ব, আর কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় সেই দীপ্তি, যা একদিন গোখলে উচ্চারণ করেছিলেন, "What Bengal thinks today, India thinks tomorrow"

 

রচনাপ্রণালী

এই প্রবন্ধ সাজানো হয়েছে ৮টি প্রধান অক্ষ বরাবর—

১. ভূরাজনীতি ও বাংলা

২. বাংলাদেশে কোটাবিরোধী অভ্যুত্থান

৩. ভারতের অবস্থান ও বিপন্ন বাঙালী

৪. ভারত-বাংলাদেশে বাঙালীর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

৫. বহির্বাংলার বাঙালী

৬. পশ্চিমবঙ্গের ভূমিকা

৭. নেপথ্যের ইতিহাস

৮. বাংলায় নারী নিরাপত্তা

প্রতিটি অংশে ঐতিহাসিক পটভূমি, বর্তমান প্রেক্ষাপট, রূপক, ও সমাধানের সম্ভাবনা থাকবে।

 

 

বিশদ আলোচনা

 

১ | বাংলা ও বাঙালীর ওপর ভারত ও প্রতিবেশী দেশের ভূরাজনীতির প্রভাব

মানচিত্রে বাংলা যেন এক অনন্য সাঁকো—দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের নোনা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে, উত্তরে হিমালয়ের শীতল হাওয়া এসে স্পর্শ করে মাটি, পূর্বে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দোরগোড়া, আর পশ্চিমে ভারতের গভীর উপত্যকা ও সমতলভূমি। এই ভূগোল বাংলাকে দিয়েছে সম্ভাবনার নীল দরজা, কিন্তু সেই দরজার গায়েই ঝুলে আছে বিপদের লাল পতাকা।

১৭৫৭ সালের পলাশীর সেই কালো বিকেলটা মনে পড়লেই বোঝা যায়, ভূরাজনীতি কেবল মানচিত্রের রেখা নয়—এটি ভাগ্যের লেখাও। নবাবের পতন ছিল শুধু একটি যুদ্ধের সমাপ্তি নয়, বরং এক বৃহৎ ভূরাজনৈতিক সমীকরণের অবসান। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাকে দখল করেছিল শুধু সোনালি জমি বা রাজস্বের লোভে নয়, বরং এই কৌশলগত অবস্থানের জন্য—যেখান থেকে তারা গোটা উপমহাদেশের বাণিজ্য, রাজনীতি এবং প্রশাসনের লাগাম এক হাতে ধরে রাখতে পারে। কলকাতা পরিণত হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানীতে, আর গঙ্গার মোহনা হয়ে উঠেছিল বিশ্ববাণিজ্যের এক প্রধান দরজা।

কিন্তু ইতিহাসের স্রোত বাঁক নিল স্বাধীনতার পরে। রাজধানী সরে গেল দিল্লিতে, আর পশ্চিমবঙ্গের ভূরাজনীতি হলো আরও জটিল। ভারতের দীর্ঘতম আন্তর্জাতিক সীমান্ত—৪,০৯৬ কিলোমিটার—বাংলাদেশের সঙ্গে ভাগ করছে বাংলা। প্রতিদিন এই সীমান্ত পেরোচ্ছে মানুষ—কখনো আত্মীয়তার টানে, কখনো জীবিকার খোঁজে, আবার কখনো রাজনৈতিক আশ্রয়ের আশায়। পেরোচ্ছে পণ্য—বৈধ-অবৈধ উভয়ই; আসছে চোরাচালানের মাল, যাচ্ছে কৃষিজ ফসল ও বস্ত্র। আর পেরোচ্ছে গল্প—যুদ্ধ, বন্যা, নির্বাচন, বন্দরনগরীর নতুন নীতি, কিংবা গ্রামীণ মাটির আক্ষেপ।

সীমান্তের কাঁটাতারের ওপারে ঢাকার রাজনৈতিক পালাবদল, চট্টগ্রামের বন্দরনীতির পরিবর্তন, কিংবা সিলেটের আকস্মিক বন্যা—সবই কলকাতার বাজারদর থেকে শুরু করে রাজ্যের রাজনৈতিক বক্তৃতায় পর্যন্ত ঢেউ তোলে। যেন এক অদৃশ্য দড়ির দুই প্রান্তে বাঁধা দুটি ভিন্ন রাষ্ট্র, যার এক প্রান্তে টান পড়লেই অন্য প্রান্তে কেঁপে ওঠে।

এবার উল্টো দিকটা দেখা যাক—ভারতের সীমান্ত নীতি, শুল্ক কাঠামো, বর্ডার হাটের অনুমতি বা বিএসএফের নিয়মাবলী—এসব সরাসরি প্রভাব ফেলে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে। এক মৌসুমে আম বা পেঁয়াজ রফতানির অনুমতি বন্ধ হলে, বাংলাদেশের বাজারে দাম বাড়ে, জনমনে অসন্তোষ জমে, আর সেই অসন্তোষের রাজনৈতিক প্রতিধ্বনি ফিরে আসে সীমান্তের এই প্রান্তে।

এইসব মিলিয়ে ভূরাজনীতির চাপ বাঙালীর দীর্ঘমেয়াদি সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক পরিকল্পনায় এক ধরনের অস্থিরতা ঢুকিয়ে দিয়েছে। কখনো রাজনৈতিক টানাপোড়েন, কখনো নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ, কখনো বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা—সব মিলে ভবিষ্যৎ ভাবনার জায়গা সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে।

বাংলা আজ যেন এক নদী, যার বুকের মাঝখানে জমে উঠেছে বালুচর। যতই সেখানে ঘর বাঁধা হোক, যতই গাছ লাগানো হোক, স্রোতের প্রথম বড় ঢেউ এলে সব ভেঙে গিয়ে মিশে যায় জলে। এই বালুচরের মতোই বাংলার উন্নয়নের স্বপ্ন বারবার গড়ে ওঠে, আবার ভেঙে পড়ে—কখনো প্রতিবেশী দেশের রাজনৈতিক সংকটের কারণে, কখনো আন্তর্জাতিক কূটনীতির দাবা খেলায়, কখনো নিজের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার ভারে।

তবুও, এই ভূরাজনৈতিক চাপে এক ধরনের সম্ভাবনাও লুকিয়ে আছে—কারণ যে সাঁকো দুই প্রান্তকে যুক্ত করে, সেটি যদি মজবুত হয়, তবে সে পথ দিয়ে শুধু পণ্য নয়, সংস্কৃতি, শিক্ষা, প্রযুক্তি—সবই আদান-প্রদান হতে পারে। প্রশ্ন হলো—আমরা কি সেই সাঁকো মেরামত করতে প্রস্তুত, নাকি তাকে ভেঙে পড়তে দেখেই অভ্যস্ত হয়ে যা

 

২ | বাংলাদেশে কোটাবিরোধী অভ্যুত্থান: কারণ ও গতিপ্রকৃতি

ঢাকার আকাশে মেঘ জমেছিল শুধু বর্ষার জন্য নয়, সেই মেঘের ভেতরে ছিল এক অদৃশ্য ভার—রাজনৈতিক অস্থিরতার ঘন ছায়া। জুলাই ২০২৪, গ্রীষ্মের শেষ আর বর্ষার শুরুতে, শহরের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যেন এক নতুন তাপের উনুনে ফুঁসছিল। গেটের সামনে তরুণ-তরুণীরা প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে, কণ্ঠে বজ্রের মতো স্লোগান—"আমরা মেধার স্বীকৃতি চাই!" স্লোগানটি বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, যেন লাল-সবুজ পতাকার বুকে মিশে যাচ্ছিল এক নতুন সময়ের ডাক।

মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য ৩০% কোটা—একসময় ছিল সম্মান ও ত্যাগের প্রতীক। সেই কোটা মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারকে বাঁচিয়ে রাখার এক নীরব প্রতিজ্ঞা ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে, সেই প্রতীক রাজনৈতিক ক্ষমতার লাঠিতে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদপুষ্ট গোষ্ঠী এই সুবিধা পেয়েছে বছরের পর বছর, আর তাতে মেধা ও পরিশ্রম বারবার পিছিয়ে পড়েছে।

এই প্রজন্ম যুদ্ধ দেখেনি—তারা ট্যাংকের গর্জন শোনেনি, শরণার্থী শিবিরের ধুলো গায়ে মাখেনি। কিন্তু তারা প্রতিদিন যুদ্ধ করছে বেকারত্বের সাথে, দুর্নীতির সাথে, এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার সাথে। তারা দেখে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি হাতে থাকা সত্ত্বেও চাকরির বিজ্ঞপ্তি কেবল এক শ্রেণির জন্য খোলা। তারা প্রশ্ন তোলে—কেন সুযোগের সমান দরজা সবার জন্য খোলা থাকবে না? কেন জন্মের পরিচয়ে মেধা খাটো করে দেখা হবে?

প্রথমে আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ—প্ল্যাকার্ড, মানববন্ধন, গান, কবিতা, আলোচনাসভা। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে হাত মেলাচ্ছে মানুষ, পোস্টার ঝুলছে চায়ের দোকানের দেয়ালে। কিন্তু ধীরে ধীরে দমনের চাকা ঘুরতে শুরু করল। লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস, গ্রেফতার—প্রতিটি পদক্ষেপ যেন নতুন করে আগুন ঢালল তরুণদের রক্তে।

তারপর এল ডিজিটাল যুগের সবচেয়ে ভয়ংকর অস্ত্র—ইন্টারনেট বন্ধ। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব—সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল, যেন শহরের কণ্ঠস্বর কেটে দেওয়া হয়েছে। অথচ এই নীরবতা আন্দোলন থামাতে পারেনি, বরং তার শিকড় আরও গভীরে ঢুকে গেল। রাতের আঁধারে হোস্টেলের ঘরে মোমবাতির আলোয় মিটিং, ছেঁড়া কাগজে লিখে গোপনে বার্তা পৌঁছানো, এক শহর থেকে আরেক শহরে স্লোগান বহন করে নিয়ে যাওয়া—সব মিলিয়ে যেন এক গোপন স্রোত বয়ে যাচ্ছিল।

সামাজিক মাধ্যমে #ReformQuota হ্যাশট্যাগ যখন আবারও ফাঁক গলে বেরিয়ে আসতে লাগল, তখন প্রবাসী বাঙালীরাও সাড়া দিল। লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, সিডনি, টরন্টো—যেখানেই বাঙালী তরুণ আছে, সেখানেই পোস্টার উঠল, ছবি ছড়াল, প্রতিবাদ ধ্বনিত হল। আন্দোলন তখন ভৌগোলিক সীমা ছাড়িয়ে এক বৈশ্বিক চেতনার আকার নিল।

অবশেষে সরকারের কিছুটা ছাড় এল, কিন্তু সেই ছাড় ছিল আংশিক, অর্ধেক প্রতিশ্রুতির মতো। আন্দোলন থামল না, তবে গতি বদলাল—রাস্তাঘাটের ঝড় গিয়ে জমা হল মানুষের মনে। অসমাপ্ত থেকে গেল বহু চাওয়া, বহু সম্ভাবনা।

তবুও, এই অভ্যুত্থান প্রমাণ করে দিল—বাংলাদেশের তরুণেরা আর নিঃশব্দ প্রজন্ম নয়। তাদের স্বপ্ন নিভে গেলে, শহরের বাতিগুলোও অন্ধকার হয়ে যাবে; তাদের কণ্ঠ স্তব্ধ হলে, দেশের ভবিষ্যতের সুর থেমে যাবে। আর যতদিন তাদের রক্তে এই অস্থির, জেদি, তীব্র স্পন্দন থাকবে, ততদিন নতুন ভোরের সম্ভাবনা—যতই ক্ষীণ হোক—মুছে যাবে না।

 

৩ | বাংলাদেশ অভ্যুত্থান ও বিপন্ন বাঙালীর প্রতি ভারতের অবস্থান

১৯৭১ সাল—সীমান্তের কাঁটাতারে তখন রক্তের গন্ধ। বাংলাদেশ জন্ম নিচ্ছে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের বুকে। সেই সময় ভারত শুধু প্রতিবেশী রাষ্ট্র ছিল না, ছিল শ্বাস নেওয়ার জন্য একমাত্র উন্মুক্ত জানালা। শরণার্থীর ভিড়ে ভেঙে পড়া সীমান্তে খাদ্য পৌঁছেছিল ভারতীয় ট্রাকের চাকা ঘুরে, আশ্রয় মিলেছিল সীমান্তবর্তী গ্রামে, নিরাপত্তার হাত ধরেছিল ভারতীয় সেনার গর্জন। সেই দিনগুলোর স্মৃতি এখনো বাংলাদেশের মানুষের চেতনার ভাঁজে জ্বলজ্বল করে—যেন গভীর রাতের আকাশে এক চিরস্থায়ী নক্ষত্র।

কিন্তু সময় বদলেছে। ২০২৪ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলনের দিনে, ঢাকা জুড়ে যখন তরুণেরা মিছিল করছিল, গলায় স্লোগান তুলছিল—"আমরা মেধার স্বীকৃতি চাই!"—তখন ভারতের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি সংযত, অনেক বেশি মাপা। সরকারি ভাষ্য ছিল সংক্ষিপ্ত ও সোজাসাপ্টা—"বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়"। প্রকাশ্যে ছিল নীরবতা, আড়ালে চলছিল সীমান্ত নিরাপত্তা শক্ত করা, বাণিজ্যের স্থিতি রক্ষা, আর প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক বার্তা আদানপ্রদান। যেন চোখে চোখ রেখে কথা বলা এড়িয়ে, পাশ কাটিয়ে যাওয়া।

এমন অবস্থান রাজনৈতিক দিক থেকে বোধগম্য—প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। সীমান্তে স্থিতি বজায় রাখা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা অক্ষুণ্ণ রাখা, অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা—এসবই ভারতের কৌশলগত অগ্রাধিকার। কিন্তু কৌশল আর হৃদয়ের হিসাব এক হয় না। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের চোখে ভারতের এই সংযম যেন নরম শক্তির (soft power) প্রদীপে হঠাৎ কুয়াশা জমিয়ে দিল।

তারা মনে রেখেছে ১৯৭১-এর ভারতকে—যে ভারত গানের ভাষায়, আশ্রয়ের উষ্ণতায়, কাঁধে হাত রেখে বলেছিল, "তুমি একা নও"। সেই স্মৃতির পাশে ২০২৪-এর নীরব ভারত দাঁড় করালে ব্যবধান স্পষ্ট হয়ে যায়। নীরবতা শুধু কূটনীতির ভাষা নয়, কখনো কখনো তা আবেগের দেয়ালও তোলে।

যদি ভারত চাইত, এই সময়ে সে মানবিক কূটনীতির হাত বাড়িয়ে দিতে পারত। প্রকাশ্যে না হোক, সাংস্কৃতিক কূটনীতি—যৌথ সাহিত্য উৎসব, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিনিময় কর্মসূচি, গবেষণার দ্বিপাক্ষিক চুক্তি—এসব দিয়ে এক অন্য ধরনের বার্তা দেওয়া যেত। বলার প্রয়োজন ছিল না—"আমরা তোমার সাথে আছি"—বরং কাজের ভেতরেই সেই বার্তা পৌঁছে যেত।

কূটনীতির হিসাব-নিকাশে বাংলাদেশ ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ—নিরাপত্তা, জলবণ্টন, বাণিজ্য, আঞ্চলিক রাজনীতি—সবখানে। কিন্তু বাঙালীর হৃদয়ের সেতু শুধু কাগজে কলমে গড়ে ওঠে না, তার ভিত তৈরি হয় ভাষা, সংস্কৃতি ও অভিজ্ঞতার মিলন থেকে। এই অভ্যুত্থানের সময় যদি ভারত সেই সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত প্ল্যাটফর্মকে সক্রিয় করত, তবে হয়তো দুই বাংলার আবেগীয় বন্ধন আরও মজবুত হতো।

কূটনীতির প্রয়োজনীয় সংযম আর হৃদয়ের উষ্ণতার সমন্বয় করা সহজ নয়, কিন্তু অসম্ভবও নয়। ১৯৭১ দেখিয়েছিল, যখন রাজনীতি ও মানবিকতা একসাথে হাঁটে, তখন ইতিহাস পাল্টে যায়। ২০২৪-এর অভ্যুত্থান হয়তো সেই মাত্রায় ছিল না, কিন্তু এর ভেতরেও ছিল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা—যা দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন অর্থ দিতে পারত।

ভারত যদি এই সুযোগে সেই সম্ভাবনাকে ছুঁয়ে দিত, তবে হয়তো আজকের আলোচনায় বাংলাদেশের তরুণেরা বলত—"হ্যাঁ, আমরা জানি—আমরা একা নই।"

 

৪ | ভারত ও বাংলাদেশে বাঙালীর সাম্প্রতিক অবস্থা ও ভবিষ্যতের দিশা

পশ্চিমবঙ্গ

একসময় ভারতীয় উপমহাদেশে শিল্প-সংস্কৃতির অগ্রদূত ছিল পশ্চিমবঙ্গ। কলকাতার ট্রামলাইন দিয়ে যেমন বয়ে যেত সুরেলা গানের স্রোত, তেমনি হুগলির ঘাটে ভিড় করত বাণিজ্যের নৌকা। বাঙালী তখন গর্ব করে বলতে পারত—এ শহর স্বপ্ন বানায়, স্বপ্ন বিক্রি করে, আর স্বপ্ন বাস্তবেও রূপ দেয়।

কিন্তু আজ সেই শহরের শিল্পযন্ত্রের চাকা থমকে আছে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের রাজনৈতিক ক্ষত এখনও বিনিয়োগকারীর মনে তাজা, যেন পুরনো শিকড়ে ঢুকে থাকা কাঁটা। সেই কাঁটার ভয়েই নতুন শিল্প গড়তে কেউ এগোয় না। উচ্চশিক্ষার মান ক্রমেই খসে পড়ছে—প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার তহবিল কমছে, রাজনীতিকরণে একাডেমিক স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ফলে কর্মসংস্থানের হাহাকার। প্রতিভাবান তরুণেরা দিল্লি, বেঙ্গালুরু, মুম্বাই কিংবা বিদেশের পথে হাঁটছে—শুধু কাজের জন্য নয়, স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার জন্য। শহরের ক্যাফেগুলোয় হয়তো এখনো কবিতার বই হাতে তরুণ বসে থাকে, কিন্তু তার পরের স্টপেজ বিমানবন্দর।

 

বাংলাদেশ

বাংলাদেশের ছবিও সমান বৈপরীত্যপূর্ণ। এখানে রাজনৈতিক মেরুকরণ জাতীয় এজেন্ডাকে ছিঁড়ে ফেলেছে যেন দুটি বিপরীত স্রোত। একদিকে উন্নয়নের ঘোষণা, অন্যদিকে প্রতিনিয়ত সংঘাত, দুর্নীতি ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব।

জলবায়ু পরিবর্তনের ঢেউ এখানে সবচেয়ে তীব্রভাবে আঘাত করছে—উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ত পানি চাষের জমি গ্রাস করছে, ঘরছাড়া করছে হাজার হাজার মানুষ। তারা নতুন করে আশ্রয়ের সন্ধানে শহরে ভিড় করছে, তৈরি করছে নতুন সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ।

অর্থনীতির প্রাণভোমরা গার্মেন্টস শিল্প—যা দেশের ৮০% রপ্তানি আয় বহন করে—তাতে অতিনির্ভরতা অর্থনীতিকে একপেশে ও ঝুঁকিপূর্ণ করেছে। এক ধাক্কায় আন্তর্জাতিক চাহিদা কমে গেলে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে।

 

মিল

দুই বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতির আত্মীয়তা এখনও জীবিত। দুর্গাপূজার ঢাকের তালে কিংবা একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদ মিনারের সামনে—একই আবেগ, একই শব্দ, একই গান। নদীর ওপারে থাকলেও মনের ভাষা একই সুরে বাজে।

কিন্তু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা দুই বাংলাকে আলাদা করেছে। সীমান্তের কাঁটাতার শুধু মাটির নয়, মনেও গড়ে তুলেছে অদৃশ্য প্রাচীর। যোগাযোগ কমেছে, যৌথ উদ্যোগ সীমিত, বিনিময়ের পথ রুদ্ধ। ফলে ভাষার বন্ধন থাকলেও সেই বন্ধন যেন ধীরে ধীরে শুধু আনুষ্ঠানিক হয়ে উঠছে।

 

ভবিষ্যতের দিশা

যদি এই দুই বাংলার সম্ভাবনা ফিরিয়ে আনতে হয়, তবে দরকার সাহসী ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ—

  • যৌথ শিক্ষা উদ্যোগ: দুই বাংলার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ছাত্র-শিক্ষক বিনিময়, যৌথ গবেষণা প্রকল্প, এবং অনলাইন একাডেমিক প্ল্যাটফর্ম।
  • সীমান্ত বাণিজ্যের সম্প্রসারণ: বর্ডার হাটের সংখ্যা ও সক্ষমতা বাড়িয়ে গ্রামীণ অর্থনীতি সক্রিয় করা।
  • প্রযুক্তি ও গবেষণায় সহযোগিতা: আইটি, নবায়নযোগ্য শক্তি, কৃষি প্রযুক্তি—এই খাতে দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্ব।

এগুলো বাস্তবায়ন না হলে একদিন ভাষার বন্ধনও শিথিল হয়ে যাবে, সাংস্কৃতিক ঐক্য থাকবে শুধু স্মৃতিতে। কিন্তু যদি এই পথ আমরা বেছে নেই, তবে দুই বাংলাই আবার মিলিত হতে পারে স্বপ্ন, সৃজনশীলতা ও নেতৃত্বের এক নতুন মঞ্চে—যেখানে সীমান্ত কেবল মানচিত্রে থাকবে, মনের মধ্যে নয়।

 

৫ | বহির্বাংলায় বাঙালীরা এই পালাবদলে কতখানি প্রভাবিত

লন্ডনের ব্রিক লেনের সরু গলিতে এখনো ধোঁয়া ওঠা বিরিয়ানির হাঁড়ি, সঙ্গে মশলার গন্ধে ভরে ওঠা বাতাস; পাশে দোকানের ভেতরে ঝুলছে “শুভ নববর্ষ” লেখা লাল ব্যানার। নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে শরতের বিকেলে ছোট্ট একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে ভেসে আসছে রবীন্দ্রসঙ্গীত—সুরের ভেতরে ঢেউয়ের মতো বাজছে স্মৃতি। টরন্টোর ড্যানফোর্থে শীতের বরফের ওপর পায়ের শব্দ তুলে এগিয়ে যাচ্ছে পয়লা বৈশাখের রঙিন মিছিল—সামনে ঢোল, পেছনে শাড়ি-পাঞ্জাবিতে মোড়া মুখ, যার প্রতিটি হাসিতে মিশে আছে প্রবাসের ব্যস্ততা ও শেকড়ের টান।

এই প্রবাসী বাঙালীরা দূরে থেকেও শেকড় আঁকড়ে ধরে আছেন। তাঁদের রান্নাঘরে এখনো রোজানার ভাত-ডাল-ভাজি, তাঁদের বসার ঘরে এখনো দেয়ালে ঝুলছে রবীন্দ্রনাথের ছবি বা বাংলাদেশের গ্রামীণ দৃশ্যের তেলরঙ, তাঁদের সন্তানেরা বিদেশি স্কুলে পড়লেও শিখছে “আমার সোনার বাংলা” কিংবা “ধনধান্যে পুষ্পভরা”। কিন্তু রাজনৈতিক পালাবদলের ঝড় যখন মূল ভূখণ্ডে বয়ে যায়, সেই ঢেউ তাঁদের গায়ে এসে কেবল ভিজিয়ে দেয়—ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে না। তাঁদের প্রভাব যেন সমুদ্রের ওপারে দাঁড়িয়ে বাতাস ছোঁয়ার মতো—শুনতে পাওয়া যায়, কিন্তু প্রবাহ থামানো যায় না।

অর্থনৈতিকভাবে তাঁরা শক্তিশালী। বিদেশের কঠোর পরিশ্রম থেকে উপার্জিত অর্থ পাঠান রেমিট্যান্স হিসেবে; গ্রামে স্কুল গড়ে দেন, দাতব্য প্রকল্পে অর্থ দেন, রোগীর চিকিৎসার খরচ তোলেন, বইপত্র পাঠান লাইব্রেরিতে। অনেক প্রবাসী দেশে এসে ছোট ব্যবসা শুরু করেন, অথবা গ্রামের রাস্তা সংস্কারের খরচ বহন করেন। এই অবদান অস্বীকার করার নয়—এগুলো বাংলার গ্রামীণ জীবনে নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটায়।

তবে নীতি প্রণয়নের টেবিলে তাঁদের কোনো চেয়ার নেই। যে সিদ্ধান্তগুলো দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে—শিক্ষানীতি, শিল্পনীতি, বিদেশনীতি—সেসব আলোচনায় তাঁদের উপস্থিতি নেই। অনেকে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হতে চান না—একদিকে মাতৃভূমির জটিল রাজনীতির অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে প্রবাসের কাজ ও সংসারের ব্যস্ততা। তাঁদের জীবন প্রায়শই দুই ভাগে বিভক্ত—দিনে বিদেশি মুদ্রার হিসাব, রাতে হোয়াটসঅ্যাপে দেশের খবর।

সরকারও তাঁদের প্রায়শই ব্যবহার করে কূটনৈতিক নরম শক্তি হিসেবে। বিদেশে বাংলাদেশের বা পশ্চিমবঙ্গের সাফল্য তুলে ধরার অনুষ্ঠানে তাঁদের ডাক পড়ে, তারা সাংস্কৃতিক দূতের মতো কাজ করেন। কিন্তু বাস্তব পরিবর্তনের অংশীদার হিসেবে তাঁদের খুব কমই সামনে আনা হয়। নীতি-নির্ধারণের আসনে তাঁদের অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি যে প্রভাব ফেলতে পারে, সেই সুযোগ খুব কমই মেলে।

ফলে, এই পালাবদলে তাঁদের অবদান রয়ে যায় নৈতিক সমর্থন ও সাংস্কৃতিক সেতুতে। বিদেশের মাটিতে তাঁরা বাঙালীত্বের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখেন, মাতৃভূমির সংকটে অর্থ পাঠান, সোশ্যাল মিডিয়ায় আওয়াজ তোলেন, কিন্তু কাঠামোগত পরিবর্তনের চাবি তাঁদের হাতে থাকে না। তাঁদের ভূমিকা শক্তিশালী—কিন্তু সীমিত; আবেগে গভীর—কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রান্তিক।

তবুও, প্রবাসী বাঙালীর এই সেতু ভেঙে গেলে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ভাষা ও সংস্কৃতির সম্পর্ক আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই, প্রবাসীর প্রভাবকে শুধু অনুষ্ঠানের মঞ্চে সীমাবদ্ধ না রেখে, দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ করা দরকার—যাতে এই নীল সমুদ্রপারের বাঙালীর হৃদয়ের স্পন্দনও মাতৃভূমির ভবিষ্যতের সঙ্গে একসূত্রে বাঁধা থাকে।

 

৬ | সাম্প্রতিক পালাবদলে পশ্চিমবঙ্গের ভূমিকা

যে পশ্চিমবঙ্গ একসময় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নাড়ি ছিল, আজ সেই রাজ্য যেন এক পুরনো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ছায়া দেখছে—অস্পষ্ট, ধুলোমাখা, যেখানে ইতিহাস আছে, কিন্তু তার কোনো জীবন্ত প্রতিধ্বনি নেই। একসময় এই ভূমি থেকে গর্জে উঠত স্লোগান, জ্বলত বিপ্লবের আগুন, সাহিত্য আর রাজনীতি মিলেমিশে তৈরি করত এক অদম্য চেতনা। আজ সেই আগুন যেন ভিজে কাঠের মতো—ধোঁয়া আছে, কিন্তু শিখা নেই।

সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের ঘটনায় শিল্প বিনিয়োগের ওপর যে আস্থা ছিল, তা ভেঙে পড়েছে একেবারে মাটিতে। যে জমিতে নতুন শিল্পগড়ে হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হওয়ার কথা ছিল, সেখানে এখন নীরব ধানক্ষেত কিংবা ঝোপঝাড়। বিনিয়োগকারীর চোখে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রতীক—যেখানে যে কোনো প্রকল্প শুরু হলেই তার ভাগ্য নির্ধারণ হবে আন্দোলন, অবরোধ ও অবিশ্বাসের টানাপোড়েনে।

শিক্ষাক্ষেত্রেও পতনের চিত্র স্পষ্ট। একসময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি, যাদবপুরের নাম উচ্চারণ করলেই দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা পূর্ণ হতো। আজ সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা কমেছে, ল্যাবরেটরিতে নতুন আবিষ্কারের উত্তেজনা নেই। রাজনীতির প্রভাব এতটাই বেড়েছে যে, মেধার চেয়ে দলে ঘনিষ্ঠতা অনেক সময় বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ক্লাসরুমে তর্ক আর গবেষণার জায়গায় ঢুকে পড়েছে অবিশ্বাস আর দ্বন্দ্ব।

সংস্কৃতি, যা একসময় এই ভূমির সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল, সেটিও ধীরে ধীরে ‘ম্যাস প্রোডাকশন’-এর স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। নাট্যমঞ্চে হালকা বিনোদন প্রাধান্য পাচ্ছে, সেই গভীর ভাবনার নাটক, যা দর্শককে নাড়া দিত, তা আজ বিরল। সাহিত্যপত্রিকায় পাঠক কমছে, ছোট কাগজের প্রাণশক্তি হারিয়ে যাচ্ছে, নতুন কবি বা গল্পকার উঠে এলেও তাদের কণ্ঠস্বর পৌঁছচ্ছে না বৃহত্তর পরিসরে। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রমী শিল্পচর্চার বদলে বাজারি সাফল্যের সমীকরণই প্রধান হয়ে উঠছে।

ফলত, পশ্চিমবঙ্গ আজ আর প্রতিবেশী বাংলাদেশের আন্দোলন বা সামাজিক জাগরণে সক্রিয় অংশীদার হতে পারছে না। যে ভূমি একদিন ভারতীয় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মানচিত্রের কেন্দ্রস্থল ছিল, সেটি এখন আঞ্চলিক সীমানার ভেতর গুটিয়ে গেছে। বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন বা সামাজিক পরিবর্তনের খবর এ প্রান্তে পৌঁছলেও, তা আর জাগায় না সেই যৌথ আবেগ বা একাত্মতার ঢেউ, যা একসময় দুই বাংলাকে যুক্ত করত।

তবুও আশা আছে—কারণ ইতিহাসের সঙ্গে এই মাটির সম্পর্ক এখনও ছিন্ন হয়নি। মেধা, শিল্প, ভাষা—সবই এখনো আছে, কিন্তু সেগুলো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ছাইয়ের নিচে। দরকার শুধু নতুন এক দমকা হাওয়া, যা সেই ছাই উড়িয়ে দেবে। প্রয়োজন এমন এক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতাকে ভেঙে আবার সর্বভারতীয় পরিসরে নিয়ে যেতে পারবে পশ্চিমবঙ্গকে।

যদি এই ভূমি আবার সাহস করে নিজের শিকড়ের দিকে তাকায়, নিজের অতীতের গৌরবকে বোঝে, আর বর্তমানের জটিলতা কাটিয়ে উঠতে পারে—তবে পশ্চিমবঙ্গ আবারও হতে পারে সেই সেতু, যা ভারতীয় শক্তির সঙ্গে বাঙালীর বৌদ্ধিক উত্তরাধিকারকে একসূত্রে বাঁধবে। অন্যথায়, এই রাজ্য কেবল মানচিত্রের এক টুকরো রঙিন প্রদেশ হয়ে থাকবে—যেখানে ইতিহাসের গন্ধ আছে, কিন্তু ভবিষ্যতের কোনো নতুন অধ্যায় লেখা হয় না।

 

৭ | বর্তমান পরিস্থিতির নেপথ্যে অতীতের অবদান

উনিশ শতকের বাংলায় যে নবজাগরণ জন্ম নিয়েছিল, তা ছিল ইতিহাসের এক বিরল সংমিশ্রণ—যেখানে সময়, সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি একসাথে এসে দাঁড়িয়েছিল এক মহাজাগতিক যোগসূত্রে। ব্রিটিশ শাসনের প্রশাসনিক রাজধানী হিসেবে কলকাতার মর্যাদা তাকে দিয়েছিল শক্তি ও প্রভাবের এক অনন্য অবস্থান। ইউরোপীয় শিক্ষার সরাসরি প্রবাহ এসে মিলেছিল বাঙালীর কৌতূহলী মস্তিষ্কে, বণিক শ্রেণির উত্থান এনে দিয়েছিল অর্থনৈতিক জোর, আর নবউদিত মধ্যবিত্তের মধ্যে জন্ম নেয় বৌদ্ধিক জাগরণের অগ্নিশিখা।

এই সময়ে বিদ্যাসাগরের কলমে বিধবা বিবাহ আইন কেবল আইন নয়, সামাজিক বিপ্লবের রূপরেখা হয়ে ওঠে। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে ফুটে ওঠে সাহিত্যিক জাতীয়তাবাদ—যেখানে শব্দ ছিল অস্ত্র, আর কাহিনি ছিল মুক্তির ডাক। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে, কবিতায়, প্রবন্ধে তুলে ধরেন এক বিশ্বমানবতাবাদ, যা ভেদরেখা ভেঙে মানুষকে এক ছাতার নিচে আনার স্বপ্ন দেখায়। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সেই স্বপ্নকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন বাস্তব সংগ্রামে—আধুনিক ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে অমোচনীয় রেখা টেনে দেন।

এই সোনালি যুগে বাংলা হয়ে উঠেছিল ভারতের চিন্তার কারখানা—যেখানে ধারণা জন্মাত, পরীক্ষা হতো, তারপর তা ছড়িয়ে যেত উপমহাদেশের প্রতিটি প্রান্তে। কলকাতার কফিহাউসের টেবিলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনার রুমে, নদীর ধারের আড্ডায়—প্রতিটি কথোপকথনেই থাকত দিকনির্দেশ করার মতো শক্তি।

কিন্তু স্বাধীনতার পরে সেই চিত্র পাল্টে গেল। রাজধানী সরে গেল দিল্লিতে, আর বাংলা হারাল প্রশাসনিক কেন্দ্রের সুবিধা। পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক বিচ্ছেদ কেটে দিল বাঙালীর ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক অর্ধেক দেহ। শিল্পোন্নয়নের অবসান, একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, কর্মসংস্থানের ক্ষয়—সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক ভরকেন্দ্র সরে গেল। ১৯৭০-এর দশকের সহিংস রাজনীতি, নকশাল আন্দোলন ও রাষ্ট্রের কঠোর দমন—সবই মিলিয়ে ভয়, অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার বীজ বপন করল।

সেই সময়ে যে বৌদ্ধিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অবকাঠামো বাংলাকে নেতৃত্বের আসনে বসিয়েছিল, তা ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে লাগল। আজকের স্থবিরতা আসলে সেই দীর্ঘ ক্ষয়ের প্রতিধ্বনি—যেন পুরনো প্রাসাদের ভাঙা দরজা, যেটি একসময় গৌরবে ভরা ছিল, এখন কেবল বাতাসের শব্দে দোলে।

 

৮ | বাংলায় নারী নিরাপত্তা

যে সমাজ নারীর নিরাপত্তা দিতে পারে না, সে সমাজ তার অর্ধেক স্বপ্নকেই জন্মের আগেই মেরে ফেলে। বাংলার নারীরা তুলনামূলকভাবে শিক্ষিত, কর্মক্ষেত্রে দৃশ্যমান, সাহিত্য, শিল্প, সাংবাদিকতা, রাজনীতি—সবখানেই তাঁদের পদচারণা আছে। কিন্তু বাস্তবের মাটিতে এই দৃশ্যপটের ফাঁকে ফাঁকেই লুকিয়ে আছে তীব্র অনিরাপত্তা।

রাতের শহরে নারী একা ফিরতে ভয় পায়—গলির মোড়ে দাঁড়ানো সন্দেহজনক দৃষ্টি, ফাঁকা রাস্তায় পায়ের শব্দ, ট্যাক্সি ড্রাইভারের অদ্ভুত প্রশ্ন—সবই মনের ভেতর অস্থিরতার ঢেউ তোলে। গ্রামে পরিস্থিতি আরও জটিল—প্রথাগত সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, বাল্যবিবাহের হুমকি, পারিবারিক সহিংসতা, এবং নারীর চলাফেরায় সীমাহীন বাঁধা।

আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগে ফাঁকফোকর। থানায় অভিযোগ নিতে গড়িমসি, তদন্তে দীর্ঘসূত্রিতা, আর আদালতে বছরের পর বছর কেস ঝুলে থাকা—সব মিলিয়ে ভুক্তভোগী নারী ন্যায়বিচার পেতে গিয়ে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে নেতৃত্বে তাঁদের উপস্থিতি সীমিত থেকে যাবে। যে নারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা হতে পারত, তিনি হয়তো ভয় বা পারিবারিক চাপে চাকরি ছেড়ে দেন; যে মেয়ে বিজ্ঞানী হতে পারত, সে হয়তো রাতে ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে না পারার কারণে থেমে যায়। এর ফলে বাঙালীর সৃজনশীল শক্তির অর্ধেক অদৃশ্য হয়ে যায়—যেন নদীর একপাশের তীর ভেঙে পড়েছে, আর স্রোত কেবল একদিকে বইছে।

নতুন নবজাগরণের জন্য নারীর নিরাপত্তা ও সমঅংশগ্রহণ অপরিহার্য। কেবল আইন প্রণয়ন নয়—সামাজিক মনোভাবের পরিবর্তন, শহর ও গ্রামে আলোকিত অবকাঠামো, দ্রুত ন্যায়বিচার ব্যবস্থা, এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার। নারী যদি নিশ্চিন্তে রাস্তায় হাঁটতে না পারে, নিরাপদে নিজের স্বপ্ন বুনতে না পারে, তবে যে নবজাগরণের স্বপ্ন আমরা দেখি, তা জন্ম নেবে অপূর্ণ রূপে।

বাংলার ইতিহাসে বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলন, বেগম রোকেয়ার নারীশিক্ষা উদ্যোগ—এসবই প্রমাণ করেছে, নারী যখন এগিয়ে আসে, তখন সমাজের মুখ পাল্টে যায়। আজকের প্রেক্ষাপটে সেই একই সত্য আরও প্রাসঙ্গিক। নিরাপত্তা ও সমঅধিকার নিশ্চিত হলে বাংলার নারীরা শুধু অংশগ্রহণকারী হবেন না, বরং নেতৃত্ব দেবেন—আর সেই নেতৃত্বই হতে পারে আগামী বাংলার নতুন জাগরণের প্রথম আলোকরেখা।

 

ফলাফল

দীর্ঘ আলোচনার শেষে যে ছবিটি চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, তা যেন এক পুরনো কিন্তু ভাঙাচোরা রাজপ্রাসাদ—একসময় যার প্রতিটি বারান্দা আলোয় ঝলমল করত, যার সিঁড়ি বেয়ে উঠতেন বুদ্ধিজীবী, বিপ্লবী আর স্বপ্নদ্রষ্টারা; আজ সেখানে শেওলা, ধুলো, আর নীরবতা।

প্রথমত, ভূরাজনৈতিক চাপ ও ইতিহাসের ভারে বাংলা তার নেতৃত্ব হারিয়েছে। পলাশীর ময়দান থেকে শুরু করে দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ—প্রতিটি রাজনৈতিক ঝড় বাংলাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সীমান্তের কাঁটাতার, শরণার্থীর ভিড়, অভিবাসনের ঢেউ—সব মিলে বাঙালীর রাজনৈতিক শক্তি বারবার ক্ষয় হয়েছে। একসময় যে ভূগোল তাকে দিয়েছিল বৈশ্বিক বাণিজ্যের সোনালি দরজা, সেই ভূগোলই এখন চাপের বোঝা বইছে—যার নিচে বৌদ্ধিক নেতৃত্বের কণ্ঠস্বর প্রায় চাপা পড়ে গেছে।

দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক স্থবিরতা ও শিক্ষার অবনতি মেধা-পলায়ন বাড়িয়েছে। যে কলকাতা একদিন ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণার রাজধানী, সেখানে এখন ল্যাবরেটরিতে ধুলো জমছে, বইয়ের তাক ফাঁকা হচ্ছে, আর শ্রেণিকক্ষে তর্কের বদলে নীরবতা। তরুণেরা মেধার স্বীকৃতি আর কাজের সুযোগের খোঁজে পাড়ি দিচ্ছে বেঙ্গালুরু, মুম্বাই, দিল্লি কিংবা বিদেশে। এই পলায়ন শুধু জনশক্তি নয়, ভবিষ্যতের স্বপ্নকেও শূন্য করে দিচ্ছে।

তৃতীয়ত, প্রবাসীরা নৈতিকভাবে যুক্ত, কিন্তু নীতি প্রণয়নে অনুপস্থিত। লন্ডনের ব্রিক লেন, নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস, টরন্টোর ড্যানফোর্থ—সবখানেই বাঙালী আছেন, উৎসবে পয়লা বৈশাখ পালাচ্ছেন, বইমেলা করছেন, কিন্তু মূল ভূখণ্ডের নীতিনির্ধারণে তাঁদের কণ্ঠস্বর পৌঁছায় না। তাঁরা অর্থ পাঠান, সংস্কৃতির শেকড় বাঁচিয়ে রাখেন, কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ে প্রবেশ করতে পারেন না। ফলে পরিবর্তনের গতি তাঁদের হাতছাড়া থাকে।

চতুর্থত, নারী নিরাপত্তার অভাবে মানবসম্পদ বিকাশ বাধাগ্রস্ত। শহরের উজ্জ্বল আলোয় হোক বা গ্রামের চাঁদের নিচে, বাংলার নারীর চলার পথে এখনো ভয় আছে—হয়রানি, সহিংসতা, আর সামাজিক বাঁধা। এর ফলে অর্ধেক জনগোষ্ঠীর শক্তি অব্যবহৃত থেকে যায়। যে মেয়েটি বিজ্ঞানী হতে পারত, হয়তো পরিবারের চাপে পড়াশোনা ছেড়ে দিল; যে নারী উদ্যোক্তা হতে পারত, নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাড়ি থেকে বেরোল না। এই হারানো সম্ভাবনাই বাংলার ভবিষ্যৎকে অর্ধেক করে দিচ্ছে।

সব মিলিয়ে, ফলাফল যেন এক অসমাপ্ত সিম্ফনি—যেখানে যন্ত্র আছে, সুর আছে, কিন্তু পরিচালক নেই। ইতিহাসের গৌরব এখন স্মৃতির পাতা, আর বর্তমান যেন হিমঘরে রাখা এক ফুল—যার গন্ধ আছে, কিন্তু আর বাড়ে না। তবুও আশার আলো নিভে যায়নি; নদীর শুকনো বালুচরেও মাঝে মাঝে জল ফিরে আসে, প্রাচীন প্রাসাদের ভাঙা দেওয়ালেও রোদ পড়ে। যদি সাহস করে কাদা সরিয়ে স্রোত ফেরানো যায়, যদি ভাঙা প্রাসাদের দরজা আবার খোলা যায়—তবে বাংলা আবার নেতৃত্বের আসনে বসতে পারবে, সেই দীপ্তি নিয়ে, যা একদিন গোটা ভারতকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল।

 

উপসংহার

ভারত আজ বিশ্বমঞ্চে দাঁড়িয়ে উজ্জ্বল আলোকচ্ছটায় মোড়া—মহাকাশযান চাঁদের মাটিতে পতাকা গেড়েছে, অর্থনীতি তৃতীয় বৃহত্তম শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে, কূটনীতির মঞ্চে দৃঢ় কণ্ঠে নিজের অবস্থান জানাচ্ছে। দিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু—তাদের আকাশে স্বপ্নের বিমান উড়ছে অবিরত। কিন্তু এই উজ্জ্বলতার ভেতরে, যেন অদৃশ্য এক ছায়া ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে—যে ছায়া ঢেকে রাখছে একসময়কার বৌদ্ধিক হৃদয়, বাংলা।

বাংলা আজ যেন এক নদী, যার উত্স পাহাড়ে নয়, ইতিহাসের গর্ভে; যার স্রোত একদিন ছিল প্রলয়ের মতো, আর আজ উপকূলের নোনা জলে মিশে নিস্তরঙ্গ। ঢেউ নেই, কেবল জলে প্রতিফলিত হচ্ছে পুরনো দিনের দীপ্তি, যা এখন স্মৃতির ফ্রেমে বাঁধা। সেই স্রোত ফিরিয়ে আনা না গেলে, একদিন হয়তো মানচিত্রে বাংলা থাকবে, কিন্তু তার ভেতরে থাকবে না সেই প্রাণশক্তি যা একসময় গোটা ভারতকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল।

এই ক্ষয় রুখতে হলে দরকার সাহসী ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ—

  • শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন, যেখানে মুখস্থ নয়, সৃজনশীলতা হবে মূল চালিকাশক্তি; গবেষণা ও উদ্ভাবন হবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রাণ।
  • বাংলাদেশ–পশ্চিমবঙ্গ–প্রবাসীর যৌথ সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম, যা ভাষা, সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত, প্রযুক্তি—সব ক্ষেত্রেই গড়ে তুলবে এক নতুন ঐক্যের সেতু।
  • নারী নিরাপত্তা ও নেতৃত্বে সমঅংশগ্রহণ, যাতে অর্ধেক জনশক্তি প্রান্তিক না থেকে জাতীয় উন্নয়নের কেন্দ্রে আসতে পারে।
  • দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ভিশন, যা পাঁচ বছরের নির্বাচনী চক্রে সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রজন্মের পর প্রজন্মকে পথ দেখাবে।
  • সাহসী শিল্প ও প্রযুক্তি বিনিয়োগ, যা তরুণদের কর্মসংস্থান ও স্বপ্ন ফিরিয়ে আনবে বাংলার মাটিতে।

নইলে ভবিষ্যতের ইতিহাস হয়তো এক শীতল বাক্যে সীমাবদ্ধ থাকবে—“এখানে একদিন বাংলা ছিল।”

ভাবুন তো, ভারত যখন গগনের চূড়ায় পতাকা গাঁথছে, তার বুকের গভীরে একসময়কার বৌদ্ধিক প্রাণকেন্দ্র বাংলা পরিণত হচ্ছে এক নিস্তরঙ্গ নদীতে—যার জল আছে, কিন্তু ঢেউ নেই; যার ইতিহাস আছে, কিন্তু ভবিষ্যৎ নেই। এই দৃশ্য যেন মনুমেন্টাল, তবু বিষণ্ণ—যেন পুরনো প্রাসাদের ভগ্ন প্রবেশদ্বার, যেখানে ধুলো জমে আছে সোনালি খোদাইয়ের ওপর।

যদি আজও আমরা নীরব থাকি, যদি শিক্ষার অগ্নিশিখা জ্বালাতে না পারি, যদি নারীর হাত থেকে নেতৃত্বের অধিকার কেড়ে রাখি, যদি প্রবাসী ও দেশীয় বাঙালীর মধ্যে সাংস্কৃতিক সেতু না গড়ি—তাহলে বাংলা একদিন ইতিহাসের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকবে এক ভগ্ন মূর্তির মতো। তার চোখে ধুলো, কপালে ফাটল, ঠোঁটে শুকিয়ে যাওয়া এক উচ্চারণ—

“আমি একদিন ভারতকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম।”

সেদিন ভারত হয়তো এখনও শক্তিমান থাকবে—তার রকেট উঠবে মহাকাশে, তার জিডিপি বাড়বে, তার কূটনৈতিক আলোচনায় বিশ্বশক্তিরা করতালি দেবে। কিন্তু তার হৃদয়ের স্পন্দন—বাংলা—থেমে যাবে। আর যে হৃদয় থেমে যায়, সেই দেহ যতই বলবান হোক, তা কেবল সময়ের অপেক্ষায় এক মৃতদেহ।

তবুও, আশার বাতি নিভে যায়নি। নদীর শুকনো চরেও একদিন জল আসে, ভগ্ন প্রাসাদের দেওয়ালে একদিন রোদ পড়ে। যদি আমরা আজ থেকে সেতু গড়া শুরু করি—শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, নেতৃত্বে—তাহলে হয়তো আগামী ভোরে সেই রূপালি আলো আবার বাংলার তীরে এসে ঢেউ তুলবে। ইতিহাস তখন নতুন করে লিখবে—“এখানে শুধু বাংলা ছিল না, এখানে বাংলা ছিল নেতৃত্বের আরেক নাম।

 

উল্লেখ; সূত্র

১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সভ্যতার সংকট

২. সুশোভন সরকার, Modern India (1885–1947)

৩. সুমিত সরকার, From Plassey to Partition and After

৪. সিরাজুল ইসলাম (সম্পা.), History of Bangladesh

৫. বদরুদ্দীন উমর, Political History of Bangladesh

৬. অমর্ত্য সেন, Identity and Violence

৭. নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, An Indian Pilgrim

৮. ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিধবা বিবাহ

Post a Comment

Previous Post Next Post