ঝড়কে করে সাথী => বুলা বিশ্বাস

 

ঝড়কে করে সাথী

বুলা বিশ্বাস 

 

প্রতিকূলতার ঝড় উঠেছে! একের পর এক দুর্যোগ, ছিদাম আর মণির মাথার উপর দিয়ে বয়ে চলেছে! একে সঠিক কী নামে অভিহিত করা যায়, বলা দুষ্কর। হয়তো বা সুনামী, টর্নেডো কিংবা ফণী অথবা রেমাল!!

 

ছিদামের সাথে মণির প্রেম করে বিয়ে। ছিদাম ঘটি, মণি বাঙাল। ছিদাম জাতে বৈদ্য, মণি শূদ্র। দু'পক্ষের বাড়ি থেকে এই অসম বিয়েটা মেনে নিতে পারেন নি।বাঙালী পরিবারের নিছক আবেগ ছাড়া এর অন্য কোন ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। 

কিন্তু এরাও দমবার পাত্রপাত্রী নয়।  প্রতিকূলতার হাত ধরে তীব্র বেগে এগিয়ে চলেছিলো মানবদ্বয়।

তখন ওরা শক্তি, সাহস, জোশ, প্রাণ খুলে খলখলে হাসি হেসে ডুবতে ডুবতেও বেঁচে গেছে। 

ওদের বিয়ের পরে পরেই, মণির এক ননদাই ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, 'তোমাদের যে সন্তান জন্মাবে, বর্ণসংকর দোষে দুষ্ট হবে।'

ছিদাম, মণি দু'জনের অন্তরেই কথাটা বিঁধেছে। এর অর্থ ওরা জানে। কারণ ওরা গীতা পড়েছে। ভগবদ্গীতার প্রথম অধ্যায়েই শ্লোকের মধ্যে  এই বর্ণসংকরের কথা লেখা আছে। এবং বর্ণসংকর হলে কুলধর্ম ও জাতিধর্ম নষ্ট হয়, এ কথাও লেখা আছে।  

ছিদাম কথাটা শুনে গম্ভীর হয়ে যায়। তার আরও কারণ, সবাই বলে, তিনি নাকি বাকসিদ্ধ পুরুষ, যা বলেন, ফলে যায়। ছিদাম কথাটাতে বড় কষ্ট পেয়েছিলো। ওর মনে হয়েছিল, ওদের সদ্য বিবাহের পর জামাইবাবুর এভাবে ওদের না বললেই পারতেন। 

মণি হা হা করে হেসে কথাটাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়। স্বভাববশতঃ মণি, রাতের বেলা শুয়ে ছিদামকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে গেলে ছিদাম মণিকে সরিয়ে দিতে যায়। ছিদামের ভয় হয়, ওদের তীব্র ভালোবাসার ফল খারাপ হবে না তো! মণিতো অবাক। বলে 'এটা আবার কোন ধরণের ঢং? তুমি কি তপস্যারত কোনো যোগী পুরুষ নাকি গো! নারীদের ছলাকলায় কিছুতেই ভুলবে না! তাছাড়া এই আধুনিকতম যুগে, তুমি এসব মানো?'  

মণির উদ্ধত যৌবন তখন ছিদামের কাছে নিজেকে সঁপে দেবার জন্য উন্মুখ।  ও বলে, 'উহুহু, সেটাতো হবে না। আমি ঊর্বশী, আমি মেনকা, আমি রম্ভা! যেভাবেই হোক, তোমার ধ্যান আমি ভাঙাবোই।' বলেই মণি ছিদামকে জাপ্টে ধরলো। মণির এক একটা চুম্বন ছিদামকে বিদ্যুৎপৃষ্ট করতে লাগলো যেন! ছিদাম নিজেকে ধরে রাখতে পারে নি। ভালোবাসার প্রবল জোয়ারে ওরা হাবুডুবু খেতে থাকে। ছিদাম একবার অবশ্য বলেছিলো, 'কী হচ্ছে মণি, ছাড়ো, ছাড়ো বলছি।'

কিন্তু বিধাতা যেখানে সহায়, তুচ্ছ মনুষ্যজাতির সেখানে কি বা করার আছে! 

মণির বাহুবেষ্টনীর প্রবল শক্তির কাছে, পৌরুষত্বের হার হয়। বশ্যতা স্বীকার করে সে। 

এভাবেই কোনো এক শুভক্ষণে, ওদের ভালোবাসার ফসলের দুর্দমণীয় কান্নায় আকাশ বাতাস ধ্বনিত হয়ে উঠেছিলো। শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনিতে পরিবেশ তখন উৎসব মুখর। 

 

পুত্রসন্তানের জন্ম হলো। সব ঠিকঠাক চলছিলো। কিন্তু ওই বাকসিদ্ধা ননদাই যেন পিছনে পড়ে গিয়েছিলেন। বাড়িতে যখন যখনই কোনো দুর্যোগ হয়েছে, দোষের আঙ্গুল ওই বর্ণসংকরের দিকে নিক্ষেপিত হয়েছে। প্রতিবার মণি ছিদাম কে ওই প্রতিকূল ঝড়ের সাথে লড়তে হয়েছে। ওরা মৌনী প্রতিবাদ করেছে। বলেছে, ওরা ভালোবেসেছে যে জাতকে, সেটা হলো মানুষ জাত। আর যে ভালোবাসাকে জন্ম দিয়েছে, সেও পরিপূর্ণ এক মানুষ। তাই তুফানকে কেউ কটুক্তি করলে ওরা সহ্য করবে না। ভয়ংকর প্রলয়কে ওরা অগ্রাহ্য করতে জানে। 

শুরু হলো তুফানকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করার দীর্ঘ পথ যাত্রা। তুফান যখন প্রতিষ্ঠিত, কর্মস্থল সুদূর টেক্সাস, 

ছিদাম আর মণি তখন নিজেদের একটা স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কারণ তখন অফুরন্ত সময়ে ওরা ভাসমান।  একেবারে নিস্তরঙ্গ জীবনে দু'জনেই নিজেদের সৃষ্টিধর্মী, নিজেদের ভালো লাগার বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাশি রাশি আনন্দ ওদের জীবনকে পরতে পরতে নতুন নতুন সাজে সাজাচ্ছে। ওরা খুশিতে মগ্ন।  দুঃসাহসের পাখায় ভর দিয়ে ওরা নিশ্চিন্তে যখন নিজ নিজ কাজের মধ্যে ভেসে চলেছে, হঠাৎ আবার বিপর্যয়! 

কখন যে, লখীন্দরের প্রাণহরণকারী কালনাগিনী, ওদের শান্ত জীবনের কোনো এক ফাঁক ফোকর দিয়ে ঢুকে পড়ে, যাপন করতে শুরু করেছিলো ওরা জানতেই পারে নি। নাগিনী তখন শান্ত শিষ্ট লেজবিশিষ্ট একটি প্রাণীমাত্র! ও যে সবসময় দংশনে ব্যস্ত তা নয়, কারণ প্রায় সব বিষটাইতো ও লখীন্দরের শরীরে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিল। আর যে টুকু অবশিষ্ট ছিলো, ঝোপ বুঝে এক্কেবারে কোপ মারার ভঙ্গীতে পোজ নিয়ে নিয়েছে। যখন যেখানে উদ্যত হলে, শান্তি বিঘ্নিত করা যাবে, ও ওটাই করছিলো। 

ওদের অস্বস্তি হচ্ছিলো, কিন্তু কারণটা বোঝা দায় হয়ে পড়েছিলো। সারা দিনের অবসানে, সূর্যস্নাত মনটাকে যখন মেলে ধরতে চেয়েছে, কে যেন হুল বিঁধিয়ে দিচ্ছিলো। 'জ্বলে গেল, পুড়ে গেল, আর পারছি না!' সজীব ভ্রুণগুলোর মধ্যে সে কি অস্থিরতা! শেষ পর্যন্ত ওরা কি আর জীবন্ত ভূমিষ্ঠ হতে পারবে? মনে ধন্দ জাগে!

মণি ভীষণ ভালো লেখে। ওর ভাবনাসম্ভূত লেখাগুলো যখন পূর্ণতা প্রাপ্তির দিকে কোনোটা এগিয়েছে, কোনোটা পূর্ণতার পথে, উপসংহারটাকে সাজাতে সংহত সংযত মন, মণি কেমন অস্থির হয়ে পড়লো। 

ওর ভাসুরঠাকুর, শৈবাল সেনের হঠাৎই মনে হয়েছে, তাঁদের পৈতৃক বাড়িটা বোধ হয় ভোগদখল হয়ে যাচ্ছে। ছিদাম আর ওর বৌ নিশ্চয়ই সব দখলে নিয়ে নিচ্ছে। প্রায় দেড়শো বছরের বাড়িটা প্রায় জরাজীর্ণ অবস্থা। একান্নবর্তী পরিবারের  অনেকেই গত হয়েছেন, অনেকেই অন্যত্র বাড়ি করে চলে গেছেন। তাঁদের ঘরগুলো এখনও সব বহাল আছে। অত বড় পোড়ো বাড়িটাতে ওই দু'টি প্রাণী আর দু'জন কাজের লোক ছাড়া আর কেউ থাকে না। যাঁরা বাইরে থাকেন, তাঁরা অবশ্য মাঝেমধ্যে এসে তাঁদের নিজ নিজ ঘরটির দেখভাল করে চলে যান। এতদিন ছিদামের দাদাও ওই একই কাজ করতেন। ছিদামের ঘরে দু'টি অন্ন মুখে দিয়ে, তবে বাড়ির পথে পা বাড়াতেন। কিন্তু ইদানীং তাঁর মনের অবস্থার বেশ পরিবর্তন হয়েছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাঁর মনে হয়েছে, শেষ পর্যন্ত ছিদামই বোধ হয়, ওদের অংশটা উদরস্থ করবে। গত রবিবার ছিদাম আর,মণি যখন ওদের এক বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণে গিয়েছিল, কাজের লোকেরা ওদের সাথেই ছিলো, শৈবাল হঠাৎ কোন সময়ে বাড়িতে এসে, একতলার বাথরুম আর ঘরগুলোতে  তালা দিয়ে চলে গেছেন। সিসিটিভি চেক করে ছিদাম এই আশাতীত ঘটনা দেখে থ' হয়ে গিয়েছিল। ছিদামের ঘর দোতলায়। আনডিভাইডেড সম্পত্তি। ছিদামের মনে হয়েছে, এভাবে এধরণের কাজ করা যে ক্রিমিনাল অফেন্স, আশি বছরের শৈবালের নিশ্চয়ই জানা আছে। তবুও তিনি যে এটা কেন করলেন, ছিদাম বা মণি, কেউই বুঝতে পারে না। কিন্তু আগাম কোনো ঝড় যে দ্রুত গতিতে আসতে চলেছে, তার আভাস পায়।

ছিদাম দাদা শৈবালকে ফোন করে জানতে চায়, তিনি কেন এধরণের কাজ করেছেন, তিনি জানান, 'বাড়িটা কি তোদের একার? আমরা কি সব বানের জলে ভেসে এসেছি? যা করেছি ঠিক করেছি। এবার থেকে যখন যা মনে হবে করে আসবো। তোরা কিচ্ছুটি করতে পারবি না।'

মণি ছিদামের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে যখন ভাসুরঠাকুরের সাথে কথা বলতে যায়, শৈবাল মণিকে সরাসরি আক্রমণ করেন। বলেন, 'বেবুশ্যে মেয়েছেলের সাথে আমি কোনো কথা বলি না। এই যে কথায় কথায়, সবাই তোমার লেখার প্রেমে পড়ে যাচ্ছে, ফেসবুক জুড়ে তোমার গুনগানে মুখর, তার বেশিরভাগ কমেন্টদাতাই তো সব পুরুষ! এর অর্থ কি আমাদের অজানা! তারপর এই যে, এতো এতো অ্যাওয়ার্ডস পাচ্ছো, আমরা কি এর গোপন তথ্যটির কোনো খোঁজ রাখিনা? রাবিশ সব লেখা!  লেখা জুড়ে একস্ট্রা ম্যারিটাল অথবা উগ্র যৌনতায় পরিপূর্ণ, ছিঃ! কী ভেবেছোটা কি, তোমার লেখার বিষয় লোকে খাবে? স্ক্রিপ্ট বানিয়ে সেগুলো মঞ্চস্থ হবে! আর তারপর তুমি বসে বসে বাহবা কুড়োবে, তাই না?'

উগ্র, ঝাঁঝালো গলায় ফোনের অপর প্রান্ত থেকে মণি শুনতে পায় ওর বড় জা চিৎকার করছে, দেখো গিয়ে বাড়িটাকে কি শেষমেষ রংমহল করবে। থিয়েটার ঘর তৈরি করে শেষ পর্যন্ত পতিতাপল্লী না করে ছাড়বে না দেখছি। শৈবাল বলেন, 'লেখার বিষয় এতো নোংরা কেন? পুরুষদের মন টানার...'

মণি চিৎকার করে ওঠে। বলে, 'কী বলছেন কি আপনি? খবরদার বলছি, সীমারেখা ছাড়িয়ে কোনো কথা বলবেন না। আপনি আমাকে মানসিক ভাবে ধর্ষণ করছেন। আমি থানায় যাচ্ছি। আপনার নামে আমি এফ আই আর করবোই করবো।' ফোন স্পিকার অন এ ছিলো ছিদাম সব শুনেছে। 

ফোনটা রেখে মণি হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকে। ছিদাম নিজেই নিজের চুলের মুঠি ধরে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে। আজ পর্যন্ত ওরা কোনোদিন কারও ক্ষতি করে নি। তবুও জীবন গড়ার শুরুর কাল থেকে প্বল ঝড়ের তাণ্ডবে ওরা আছাড় পাছাড় খেয়ে চলেছে। 

দু'জনে দু'জনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। বলে, 'আমাদের সব শেষ, কেউ আমাদের একপাও এগোতে দেবে না।' ছিদাম ভাবতে থাকে, আর নিজের মনে বিড়বিড় করতে থাকে, কাজের লোকেদের নীচের ঘরগুলো, বাথরুম সব বন্ধ করে দিলে, ওরাতো আর কাজ করবে না। এতোদিনকার পুরোনো মানুষগুলোকে আশ্রয়চ্যুত করলে, ওরা কোথায় যাবে? আর এত বড় বাড়ির দেখভালই বা কে করবে? আমাদের দু'জনেরই তো বয়েস হয়েছে। হে ভগবান, আবার কেন আমাদের এই দুর্দশা দিলে? জন্ম থেকেই কি আমরা অভাগা? আমরা কী পাপ করেছি যে, ক্রমাগত এতো শাস্তি একের পর এক দিয়ে যাচ্ছো!'

মণি সবে একটা সৃষ্টির সমাপ্তি ঘোষণা করে আরেকটির জন্ম দিতে গিয়েছে। এ কী বিড়ম্বনা! এলোপাথারি ঝড় ওর ভাবনাগুলোকে উড়িয়ে, পুড়িয়ে তছনছ করে দিলো। মণি পাগলের মত ওর উঠোন জুড়ানো ছেঁড়া ভাবনাগুলোকে একটা একটা করে জড়ো করছে ঠিকই, ততক্ষণে ওর অশ্রুবৃষ্টিতে খানিক ধুয়ে মুছে গেছে। আর ওদিকে ছিদাম, ওর শেষ বয়সে সমাজের কাজে নিয়ৌজিত উৎসর্গিত প্রাণে কুঠার হানলো, ওর দাদা, শৈবাল।  

ছিদাম, প্রাণ ভরে অসহায়ের পাশে দাঁড়াবার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলো।  অমানুষিক পরিশ্রমে ছুটে গেছে অনাথের পাশে, ট্রামে ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছিলো যে বিধবা অসমর্থ মা, তাঁর বাঁচার অধিকারকে সম্মান জানাতে এগিয়ে গিয়ে তাঁর হাতটা ধরেছে ছিদাম। 'এই শোনো, এই নাও কাগজের চিরকুট। এতে আমার ঠিকানা আছে। প্রতিমাসে তোমার বাঁচার রসদটুকু নিয়ে যেও মা।' ছুটে গেছে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত সতীর কাছে। যেভাবে ও বাঁচতে পারে, ছিদামের সাহায্যের হাত ওর দিকে এগিয়ে গেছে। পুরুলিয়ার আদিবাসী বাচ্চাগুলো, বসনে, শিক্ষায় উলঙ্গ। ছিদামদের ওখানে একটা সংস্থা আছে। পরিচালক ছিদামের সেখানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আছে। অর্থের অভাবে কেউ পড়তে পারছে না, কেউ পরীক্ষার ফি জমা দিতে পারছে না, ওষুধের ব্যয়ভার বহন করতে পারছে না, কিংবা পাড়ার অবলা প্রাণীদের প্রতিনিয়ত খাবার, ওষুধ দেবার দায়িত্ব, ছিদামইতো নিজের  কাঁধে স্বেচ্ছায় তুলে নিয়েছে। নির্মল আনন্দে ওরা দু'টিতে কাজ করে আর প্রাণখোলা হাসিতে ফেটে পড়ে। তুফান বাবা মা'কে টাকা পাঠায়। 'তোমরা কাজ করো। যা লাগবে আমি দেবো।' 

ছিদাম সেদিনও বলছিলো, জানো মণি, এখনও কত কাজ পড়ে আছে। জীবনটা বড় ছোট গো। একটা অনাথ আশ্রম আর একটা পথ পশুদের জন্য যে হাসপাতাল গড়বো বলেছিলাম, দু'টো জমিরই সামনের মাসে রেজিস্ট্রেশন হবে। 

ছিদাম ডুকরে কেঁদে ওঠে। এই বেসামাল বিপদের সাথে লড়বে না কাজ করবে! 

মণি ওর মাথাটা নিজের কোলের মধ্যে রেখে, মাথার চুল এলোমেলো করে ছিদামের প্রিয় গানের কলি গেয়ে ওঠে,

'মাঝির লাগি আছি জাগি, সকল রাত্রিবেলা/ ঢেউগুলো যে আমায় নিয়ে করে কেবল খেলা।/ ঝড়কে আমি করবো মিতে, ডরব না তার ভ্রুকুটিতে-----/ দাও ছেড়ে দাও, ওগো, আমি তুফান পেলে বাঁচি/ আমি ডুবতে রাজি আছি......'

অশান্ত, ক্লান্ত ছিদাম খানিক ঘুমিয়ে পড়ে। 

মণি ওর মাথার বালিশটা ঠিক করে দিয়ে, গায়ের চাদরটা টেনে দেয়। 

রাত হয়েছে। পাশের ঘরে গিয়ে দেখে পুতুলদি ঘুমোচ্ছে। রামুদাদা ঠাকুরঘরে বিছানা করে মশারি টাঙিয়ে নাসিকা গর্জন করে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। 

বৈষয়িক ব্যাপারে মণির একদম মন নেই।ও ব্যালকনিতে পায়চারি করছে, আর ভাবছে, আর ওরা এ বাড়িতে থাকবে না। একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনে চলে যাবে। কারণ এই অশান্তি আর সহ্য হয় না যে। 

মোবাইলের আলোটা জ্বলে উঠল। ভাইব্রেটে ও ফোনটা রেখেছে, কারণ ফোনের গাঁকগাঁক আওয়াজে, অন্যের ডিস্টার্ব হতে পারে। রুম্নি, ওর বড় প্রিয় এবং খুব ঘনিষ্ঠ, ওর জেঠতুতো ছোট জা ওকে ফোন করেছে। 

মণিও ভাবছিলো, রুম্নিকে একটু ফোন করলে, এই ঝড়ের কিছু বার্তা ও পেলেও পেতে পারে। যাই হোক রুম্নিই ফোন করেছে। একেই বলে টেলিপ্যাথি। ফোন তুলতেই রুম্নি ওকে বলে, 'অনেক রাত হয়ে গেছে, এখনও ঘুমাস নি?'

'না রে, গুম আসছে না। মনটা বড় অশান্ত রে। তোর ফুলদা' বড় ভেঙে পড়েছে।'

রুম্নি বলে, 'এখানেইতো ঘটনার ক্লাইমেক্স শুরু। শোন মন, তোর ভাসুর আর আমাদের দু'জন মিলে আলোচনা করছিলো, এই পুরোনো ধ্যারধ্যারে বাড়িটা বিক্রি করা হবে। যা টাকা পাওয়া যাবে, চার ভাইয়ের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা হবে। যদিও আমি বলেছি, আমার মত নেই। এরকম বাড়ি এখন হেরিটেজ। এটাকে কেউ বিক্রি করে? ওরা বললো, ধ্যুর, আমরা ওখানে থাকি না। ওসব অর্থহীন আবেগ নিয়ে বেঁচে থেকে কী লাভ? যাই হোক তোদের কাছেও প্রস্তাবটা যাবে। তোর তুফানটাতো বেশ ভালো চাকরি করছে। যদি পারিস, বাড়িটা কিনে নিস, মন। তোরা কিনলে, আমরাও তো যেতে পারবো। ওই বাড়িটা ঘিরে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে বলতো! আমি জানি, আমার সাথে তোর আবেগ বেশ মেলে। তাই তোকে কথাটা জানালাম। রাখছি রে। চিন্তা করিস না।  শুভ রাত্রি,' বলে রুম্নি ফোনটা ছেড়ে দেয়। 

খুশিতে উত্তেজনায় মণির শরীর কাঁপতে থাকে। কারণ, এতো টাকা ওদের কাছেতো নেই। একমাত্র তুফান যদি ফেভার করে..., ভাবতে ভাবতে ও তুফানকে ফোন করে ফেলে। 

তুফানের ওখানে বেলা দু'টো পঁয়ত্রিশ। তার মানে মায়ের ওখানে রাত একটা বেজে গেছে। ও ফোনটা তুলেই বলে, 'মা এখনও ঘুমাওনি? Anything wrong?'

মণি বলে, 'পাগল ছেলে আমার! আমার ঘুম আসছিলো না বলে, তোকে একটু ফোন করলাম। ভালো আছিসতো সোনা। কী করছিলি?'

'এই সবে মিটিং সেরে লাঞ্চ করলাম। এবারে স্নানে যাবো। সকাল আটটা থেকে ব্যাক টু ব্যাক মিটিং চলছে। জানো না মা, কাজের কী প্রেসার গো। যাক আমি ভালো আছি। তোমরা, মানে বাবা ভালো আছেন তো?'

মণি খুব শান্ত ভাবে বলে, 'হ্যাঁ রে, আমরা ভালো আছি। কিন্তু বাবু, যে তুফানে আমরা বেসামাল হয়ে পড়ছি, সেটাকে সামলাবার জন্য, আমার তুফানটাকে যে বড় দরকার।'

তুফান হা হা করে হাসে। 'এটা আবার কোনো কথা হলো নাকি? বান্দা সবসময় হাজির। বলো কী করতে হবে। আর নিশ্চয়ই জেঠু আবার কোনো ঝামেলা করছে।'

মণিতো আকাশ থেকে পড়ে। বলে, 'মানে, তুই কী বলছিস? জেঠুর কথা জানলি কী করে?'

'হু হু, সব জানতে হয়!'

কিছুক্ষন চুপ করে বলে, 'না গো মা, এমনি মজা করছিলাম। বলো আমাকে কী করতে হবে।'

'জানিনা বাবু, আমাদের এই বাড়িটা বড়োরা সবাই মিলে বিক্রি করে দিতে চাইছে। আমার খুব ইচ্ছে, এত বড় বাড়ি এত ষুন্দর সব আসবাব পত্র, কোলকাতার বুকে এর ঐতিহ্যই আলাদা। যদি তুই পারিস, এটা কিনে নে বাবু।'

তুফান বলে, 'আমি নয় মা। তুমি আর বাবা এই বাড়ি কিনবে। ফাইনান্সার আমি। তোমাদের বাড়ি, আমাদের সকলের বাড়ি। আমাদের ঐতিহ্যকে পরের হাতে তুলে দেবার আগে একবার হলেও ভাববো, মা। কোনো চিন্তা করো না। জেঠুদের সাথে কথা বলে, আমাকে জানিও। জেঠুদের বোলো,  আর বাড়িটার নাম যা আছে, তা বদলিয়ে দিয়ো না মা। 'কৃষ্ণাভিলা'। ঠাম্মিকে হারিয়ে ফেললে, আর কি কিছুই থাকে!জেঠুদের বোলো, এই বাড়ি আমাদের সকলের ছিলো, আছে এবং থাকবে। আমরা সবাই মিলে থাকবো। রাখছি মা।

একি! চুপ করে আছো যে! আবার ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদছো? 

চোখের জলটা মূছে একবার বলো, তোমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের অবস্থা কীরকম? টাকা পয়সা আছে তো? কিছুইতো জানাও না। বাবাকে নিয়ে চিন্তা করি না। পেনসনহোল্ডার, ঠিক আছে। আর তুমিতো আবার স্বাধীনচেতা নারী। কারও কাছে হাত পাতবে না। ঠিক আছে, তোমার লাস্ট ডিজিট 1426 এ ফেলে দিচ্ছি। ভালো থেকো তোমরা। always I love you. রাখছি মা।' 

'Love you babu, ভালো থাকিস। দিনটা ভালো কাটুক।'

এক বুক অক্সিজেন সংগ্রহ করে, মণি ছিদামের পাশে এসে শুয়ে পড়ে।  নিশ্চিন্তের একটা ঘুম আসতে ওর বেশি সময় লাগে না।

Post a Comment

Previous Post Next Post