পাঁচ টাকার তহবিল ও কায়মুদ্দিনের গল্প => এস. আজাদ

 

ছোটগল্প

পাঁচ টাকার তহবিল ও কায়মুদ্দিনের গল্প

 

(এক) 

শীতের শেষলগ্ন। কর্কটক্রান্তি রেখার উপর অবস্থিত পূর্ব আমিনপুর গ্রামের আকাশে বাতাসে তখন বসন্তের আগমনী সুর। ক’বছর আগেও কায়মুদ্দিনদের ছোট্ট ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিলে দেখা যেত, খেলার মাঠের ওপারে বড়ো স্কুলটা সেজে উঠছে, নবীন বরণ উৎসবের অপেক্ষায়। প্রতি বছর স্বরস্বতী পুজোর সাথে নতুন (পঞ্চম) শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের বরণ করে নেওয়ার রেওয়াজ অনেক দিনের। যুগের সাথে তাল মেলাতে অক্ষম, হারানো ঐতিহ্য আর রীতির মাঝেও এখনো রেওয়াজ চালু আছে, কিন্তু স্কুলের সাজগোজের সেই বাহার আর নেই।

নবম শ্রেণীর ফার্স্টবয় কায়মুদ্দিন শৈশবের আনন্দময় স্মৃতির চাদর গায়ে জড়িয়ে ঘরের এক কোণে বসে আব্বার ছেঁড়া স্বপ্ন গুলো বুনছে নতুন করে। ঘরের আর এক কোণে কাঁঠাল কাঠের পুরোনো তক্তাপোষে শুয়ে আছে তার আব্বা নজর আলী বিশ্বাস, মাস খানেক আগেও হেঁটে চলে বেড়ানো মানুষটা নড়াচড়া করার ক্ষমতা হারিয়েছে, এখন যাঁতিকলে ধরাপরা ইঁদুরের মতো শুধু চেয়ে থাকে ফ্যালফ্যাল করে, যেন চেনা মানুষ গুলোকে নতুন করে চিনতে চেষ্টা করে। শুধু কায়মুদ্দিন সামনে গেলে দু’চোখের কোনা ভরে ওঠে অক্ষম পিতার অসহায় নিষ্ফল হাহাকারের ঘন অশ্রুজলে। ক’দিন ধরে হাত-পাও আর নাড়তে পারেন না। মাস ছয়েক আগেও যে মানুষটা সাইকেল চালিয়ে সকাল বিকাল মিলিয়ে তিন গাঁয়ে তিনটে টিউশন ব্যাচ সামলাত সেই মানুষ টা প্রায় বিছানার সাথে মিশে গেছে। বুকের মৃদু ওঠা নামা মাঝে মাঝে চোখ খোলা বন্ধ ছাড়া জীবনের আর কোনো চিহ্ন জেগে নেই কঙ্কালের ওপর বেখাপ্পা ভাবে চামড়া জড়ানো শরীরে। তার বাবা নজর আলী বিশ্বাস, যিনি একসময় নিজের মেধা ও নিষ্ঠা দিয়ে গ্রামের অনেক ছাত্রের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলেছিলেন, আজ নিজেই এক নির্মম নিয়তির কাছে পরাজিত নিঃশেষিত। তার শরীরের কোষে কোষে বাসা বাঁধা ক্যান্সার নামক এক অদৃশ্য শত্রু, যা ধীরে ধীরে তার জীবনের স্পন্দন কে সময়ের গুণোত্তর গতিতে কমিয়ে দিচ্ছিল। ঘরের বাইরে তার মা পোষা মুরগি গুলো বেচে কয়েকদিনের খোরাকীর বন্দোবস্ত করতে পাইকারের সাথে দামদরে ব্যস্ত। দরমার ভেতর মুরগি গুলো দিনের আলোর স্পর্শের জন্য ছটফট করছিলো। পুবের জানালার ভাঙ্গা পাল্লায় গোঁজা চোটের ফাঁক গলে কাঁচা সোনার আভা গলে পড়ছিল নজর আলীর মুখের ওপর, কিন্তু আলো কোথায় মৃত্যুর কালো ছায়া ঢাকা কোঠরগত চোখ ও মুখের বাড়তি চামড়া বেঢপ ঝুলে আছে সকালের বাসী বিছানার মতো। 

ওদিকে দর-দাম শেষ করে পাইকার একটা একটা করে মুরগি দড়মা থেকে বের করে তার ঝাঁকাতে ভরতে থাকে, মুরগিগুলো পাইকারের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টার ব্যর্থ চিৎকার চেঁচামেচিতে কায়মুদ্দিন দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে বলে, — “মা আমার মোরগ ছানাটা …?”

তার মা তখন দড়মার আর এক পাশে অবশিষ্ট মুরগির বাচ্চা গুলোকে খবর দিতে দিতে তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, — “রেখেছি বাপ, তুমি যাও পড়তে বস।”

কায়মুদ্দিন শীত শেষের ম্লান আলোয় দেখত, অসুস্থ আব্বার দেহের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা প্রতিটি শ্বাস যেন এক গভীর দীর্ঘশ্বাস। সে দীর্ঘশ্বাস কেবল বাবার নয়, গোটা পরিবারের—এক ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত জীবনের দীর্ঘশ্বাস। নজর আলীর নশ্বর দেহটা সময়ের সাথে এক অসম যুদ্ধে লিপ্ত, আর কায়মুদ্দিন সেই যুদ্ধের এক নীরব সাক্ষী। সে যুদ্ধ ছিল করুণ, যন্ত্রণাময়—কিন্তু কোনো শব্দ ছিল না। শুধু এক নিরন্তর প্রস্থানের প্রস্তুতি, যা ধীরে ধীরে তাদের পরিবারের সবটুকু আনন্দ, সবটুকু আশা গ্রাস করে নিচ্ছিল। চিকিৎসা বিজ্ঞানের নয় অর্থ বিজ্ঞানের অসহায়তার কাছে তারা বন্দী ও পরাজিত। ভাগ্যের দোহাই দিয়ে চিকিৎসকের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিশ্চিত মৃত্যুর আলিঙ্গনে নিজেকে সমর্পন করা নজর আলী কে দেখতে আসা আত্মীয় পরিজন ও গ্রামবাসীদের খুচরো আলোচনা থেকে কায়মুদ্দিন বুঝেছিলো অনেক টাকা থাকলে তার আব্বা কে হয়ত সুস্থ করে তোলা যেত। 

রোগ যখন নজর আলীকে গ্রাস করল, তখন কেবল মাংসপেশি আর হাড়গুলোই ক্ষয়ে যায়নি, ক্ষয়ে গিয়েছিল তাঁর ভেতরের আত্মসম্মান। টিউশনির সামান্য আয় থেকে যা কিছু সঞ্চয়, সবই গেল চিকিৎসার পেছনে। সামান্য জমিজমা থেকে শুরু করে তার মায়ের স্বর্ণালঙ্কার সব শেষ, স্মৃতি গুলো ছাড়া। স্মৃতি বড়ো বেয়াড়া ছেড়ে যেতে চায় না কোনো মতে, শুধুই আঁকড়ে ধরে, পালাতে গেলে দাঁড়ায় পথ আগলে। কিন্তু তাতে তো আর পেট ভরে না। 

গ্রামের মানুষ তখন নিরব দর্শক। তাদের সহানুভূতি ছিল, কিন্তু সাহায্যের হাত বাড়ানোর মতো সামর্থ্য ছিল না। কায়মুদ্দিন দেখত, কীভাবে তার মা প্রতি রাতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন, কিন্তু সে প্রার্থনা ইথারের তরঙ্গ ভেদ করতে না পেরে প্রতিবিম্বিত হয়ে ফেরত আসত দুঃস্বপ্ন হয়ে।

যখন মৃত্যু এসে নজর আলীর বুকে শেষ আঘাত হানল, তখনও ভোর হয়নি। লোকজনের ব্যস্ততায় জেগে যাওয়া কায়মুদ্দিন দেখেছিল, তার মায়ের আঁচলের তলায় চাপা পড়া এক সুনীল সমুদ্রের মতো কান্না, যা তার হৃদয়ে এক গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল। সে দেখেছিল পূর্বপুরুষের একমাত্র স্মৃতি চিহ্ন পুরনো কাঠের সিন্দুকের ওপর ছড়ানো বইখাতা, প্রতিবেশীদের ফিসফাস, —“ছেলেটা তো ভালোই ছিল... কিন্তু এবার বইয়ের পাট শেষ। আজকাল পড়াশোনার যা খরচ।”

নজর আলীর চলে যাওয়ার এক মাসের মধ্যে সে বুঝতে পারল, তার কৈশোরের দেয়ালে ধরেছে এক চিরস্থায়ী ভাঙন। মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে সে কিছুই বলতে পারেনি, অথচ কতো কথা বলতে চেয়েছে। সে চোখের ভাষা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট, —“তুই স্কুল যাবি, বাপের অধরা স্বপ্ন ধরে আনবি মুঠোভরে।” 

মায়ের সে নির্দেশ মানতে পারেনি চৌদ্দ বছরের বালক কায়মুদ্দিন। তার সামনে কোনো বিকল্পের বিলাসীতা ছিল না, ছিল কেবল বেঁচে থাকার নির্মম বাস্তবতা। তাদের এলাকার অনেক বাচ্চার মতো সেও সস্তা শিশু শ্রমের বাজারে এক দালালের হাত ধরে বেরিয়ে পরে ভিন রাজ্য ছত্তিশগড়ে কাজের খোঁজে, এক নতুন, অচেনা জগতের দিকে। পিঠে পুরোনো জামাকাপড়ের ব্যাগ, ভাঁজে ভাঁজে মায়ের আদর। মাথায় ছিন্নভিন্ন স্বপ্ন আর এক গভীর শূন্যতা। যেন সে এক নাবিক, যে তার চেনা বন্দরের গন্ডী ছেড়ে এক অজানা সমুদ্রের দিকে পাড়ি জমিয়েছিল, যার ভবিষ্যৎ ওই সামুদ্রিক কুয়াশার মতো অস্পষ্ট।

(দুই)

ভোরের আলো তখনো ভালো করে ফোটেনি। জীবনের প্রথম দীর্ঘ ট্রেন যাত্রার বিরক্তি কর অভিজ্ঞতা, একরাশ কাদা-মাটি আর ঘামের তীব্র গন্ধ নাকে নিয়ে কায়মুদ্দিন ছত্তিশগড়ের এক অজানা স্টেশনে নামল। স্টেশনটা খুব বড় নয়, কিন্তু এখানকার সবকিছুই তার কাশিপুরের চেয়ে আলাদা। এখানকার মানুষ ও মানুষের ভাষা তার অচেনা, তাদের চোখের চাহনিতে কোনো পরিচিত ভাব নেই, কোনো আপনজনের স্নেহ নেই। প্রথম মায়ের স্পর্শ ছাড়া একটা গোটা রাত কাটানোর বিষণ্ণতা তখনও তার চোখে মুখে লেপ্টে আছে ভোরের ঘুমের মতো। রাজমিস্ত্রি ফরিদ, যার হাত ধরে সে এখানে এসেছে, ট্রেনে আসতে আসতে তাকে শুনিয়েছে এক গাদা নির্দেশ যেগুলো মেনে না চললে বিপদ হতে পারে। স্টেশনে নেমে চাপা স্বরে তাকে সতর্ক করেছিল, “চুপ করে থাকবি, বাঙালি শুনলে বাঁশ খেতে হবে। নাম বললে তো কথাই নেই। কাহিনী শেষ। নাম জানতে চাইলে চুপ করে থাকবি আমি ম্যানেজ করে নেব।”

কায়মুদ্দিন কথা দিয়েছিল, সে চুপ থাকবে। কিন্তু তার নীরবতা তাকে রক্ষা করতে পারল না। গায়ের রঙ, মুখের গড়ন, কথা বলার সময় ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা বাংলার টান, সবকিছুই যেন চিৎকার করে জানান দিচ্ছে তার পরিচয়। এখানে সে বহিরাগত। তার চতুর্দিকে মানুষের ভীড়, থিকথিকে ভিড়ের মাঝেও সে একা। দিনগুলো বড়ো একঘেয়ে, রাত্রি তার থেকেও বেশি। চারিদিকে অদ্ভুত এক রুক্ষতা, যেন চৈত্র দুপুরে ঝলসে যাচ্ছে জীবন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলত হাড়ভাঙ্গা খাটুনি। শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়লেও হার না মান পণ এক অসম্ভব জেদ তার মুখের কাঠামোয় এঁকে চলেছে নিয়তি। তার লড়াই শুধু নিয়তির সাথে নয়, সময়ের সাথেও। সে সময় কে হারাতে চায়, কিন্তু কিভাবে? জানে না।  শুধু জানে একদিন শেষ লড়াইয়ে তারা জিতবে। কানে বাজত মায়ের কান্না, আব্বার শেষ ছবি আর ইতিহাস স্যারের সেই কথা, ‘সভ্যতার ইতিহাস লড়াইয়ের ইতিহাস, প্রতিটা লড়াইয়ে শেষ হাসি হেসেছে শ্রমজীবী জনগণ’।

একদিন দুপুরে, প্রচণ্ড গরমে কাজ করতে করতে তার গলা শুকিয়ে কাঠ। সে যখন কল থেকে অঞ্জলি ভরে জল পান করছিল, তখন দুজন অবাঙ্গালী মজুর এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “ যা ভাগ।” সে উঠে দাঁড়িয়ে কলের কাছে যেতে  এক লাথি দিয়ে ছিটকে ফেলে দিল মাটিতে। রেগে গিয়ে সে তখন ছোট্ট দুটো হাতে মুঠো ভরে বালি ছড়িয়ে দিল তাদের চোখ লক্ষ্য করে, একজন দুহাতে চোখ ঢেকে — ‘মেরে আঁখে’ ‘মেরে আঁখে’ বলতে বলতে বসে পরে। অন্যজন পালানোর আগেই তাকে ধরে ফেলে, ততক্ষনে তাদের আরো কয়েক জন সঙ্গী সাথী এসে জুটেছে। ‘কামবখত কমিনা’ ‘পরদেশী’ ‘বাংলাদেশী, ‘মেরে দেশ কো লুটনে চলা আয়ে… মার সালে কো’ শব্দবন্ধের সাথে শুরু হয় এক বর্বরোচিত আঘাত। কিল চড় লাথি ঘুষি।  

ছোট্ট কায়মুদ্দিনের মাথায় তখনো ঢোকেনি তাদের কথার মর্মার্থ। সে শুধু চেয়েছিল আরেকটু জল পান করতে। সে ভাবছিল সেতো পরদেশী নয়। এটা কি নিছক কোন গালাগালি নাকি অন্য কিছু। ঠিক ভাবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ওপর শুরু হয় সমবেত বর্বরোচিত আক্রমণ। কাকে মারছি কেন মারছি না জেনেই কিল, চড়, লাথি, ঘুষি। কায়মুদ্দিন বুঝতে পারছিল, এটি নিছক মার নয়। এই আঘাতের পেছনে ছিল এক গভীর ঘৃণা, এক তীব্র অপমান, যা তার অস্তিত্বের ওপর এক চরম আঘাত। জ্ঞান হারানোর আগে তাদের কাটা-ছেঁড়া কথোপকথন আর চোখের ভাষায় সে বেশ বুঝতে পেরেছিল, কেবল বাঙালি বলে তাকে এই অপমান, অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে। লঘু পাপে গুরু দন্ড। আশেপাশে অনেকেই দাঁড়িয়ে দেখছিল, কেউ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। যাত্রা দলের মৃত সেপাইয়ের মতো সবাই ছিল নীরব দর্শক যারা দৃশ্য শুরুর আগেই নিজ পায়ে হেঁটে গিয়ে স্টেজের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে থাকে জ্যান্ত কুশীলব কিন্তু জড়বৎ। চেঁচামেচির আওয়াজে তার সাথে থাকা বাঙালী শ্রমিকরা ভয়ে লুকিয়ে গিয়েছিল আগেই। তার ক্লান্ত অভুক্ত ছোট্ট শরীর মায়া মমতা হীন বিজাতীয় ঘৃণা বেশিক্ষণ সইতে না পেরে জ্ঞান হারালে রণে ভঙ্গ দিয়ে সবাই নিজের নিজের কাজে চলে গেলে, সঙ্গের লোকের তাকে তুলে নিয়ে স্থানীয় এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। আঘাত ততোটা মারাত্বক না হলেও এক ভয়ংকর ট্রমা চেপে বসেছিল তার মাথায়। 

রাতের পর রাত ঘুম ছিল তার চোখে নিষিদ্ধ। বয়সের তুলনায় একটু বেশিরকম পারিপার্শ্বিকতাকে চিনতে শেখা ছেলেটা, অসময়ে পিতৃবিয়োগ যাকে এক ধাক্কায় বড়ো করে দিয়ে ছিল, সেই ছেলেটা একা একা বিছানায় শুয়ে মাকে মনে করে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল, সে ভাবছিল, তার কী ভুল ছিল? কেন তাকে এত অপমান সহ্য করতে হলো? সেই রাতেই সে বুঝল—সব কষ্ট সহ্য করা যায়, কিন্তু অপমান নয়। অপমান মানুষের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়, তার আত্মাকে গুঁড়িয়ে দেয়। তার ভেতরে কোথাও একটা চাপা কান্না ফেটে যাচ্ছিল, যা সে কাউকে দেখাতে পারছিল না। ‘এই অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে কিভাবে নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে বাঁচবে?’ সেই রাতেই  সে সিদ্ধান্ত নিল এখানে আর এক মুহূর্ত নয় ভোরের আলো ফুটলেই সে বেরিয়ে পড়বে, সে ফিরে যাবে। সে তার গ্রামে, মায়ের কাছে, নিজের চেনা পরিবেশে ফিরে যাবে। যেখানে মায়ের ভাষায় কথা বলার অপরাধে মার খেতে হবেনা।

(তিন)

বাড়ি থেকে বেরোনোর তিন সপ্তাহের মাথায়, এক কালবৈশাখী সন্ধ্যায় দুদিনের ভয়ংকর ট্রেন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সারা গয়ে মেখে কায়মুদ্দিন যখন গ্রামে ফিরল, তার পরনের ছেঁড়া জামাকাপড়ে লেগে ছিল ছত্তিশগড়ের রুক্ষ ধুলো আর অপমানের ছাপ। সে যখন তার ভাঙা ঘরের দাওয়ায় এসে দাঁড়াল, তার মা ছুটে এলো। মায়ের চোখে ভয় মিশ্রিত জিজ্ঞাসা, নিদারুণ অসহায়তা। তবুও তিন সপ্তাহ ধরে দু’চোখের পাতা এক করতে না পারা মা যেন অমাবস্যার সন্ধায় হাতে চাঁদ পেল। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে সদ্য বিধবা মায়ের দু’চোখে উপছে পরেছিল শেষ চৈত্রে শ্রাবনের প্লাবন। তিনি জানতেন, কায়মুদ্দিনের ফেরার অর্থ তাদের অস্তিত্বের ওপর নতুন এক সংকট। কিন্তু সন্তানের এই ধ্বস্ত রূপ দেখে তিনি স্থির পারলেন না। মনে মনে স্থির করলেন খাই না খাই এই টুকু ছেলেকে কোথাও পাঠাবো না। তাড়াতাড়ি ছেলেকে হাতমুখ ধুইয়ে ঘরে যা ছিল খেতে দিলো। এই কয় দিনের কথা মনে পড়তে কায়মুদ্দিনের ভেতর থেকে দলা পাকানো কান্নার মোচড় দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়, সে না খেয়ে নাড়াচাড়া করছে দেখে তাকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে মা বলে, — “খা, বাপ। কখন কি খেয়েছিস ঠিক নাই। এখন খেয়ে নে, পরে দেখব কী করা যায়।” কায়মুদ্দিন মায়ের বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। সাত দিনের জমানো কান্না যেন শেষ হতেই চায় না। 

সেই ‘কী করা যায়’—এর কোনো উত্তর ছিল না তাদের কাছে। কায়মুদ্দিনের বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তাদের জীবন এক অন্ধকার সুড়ঙ্গের মতো হয়ে গিয়েছিল, যার শেষ দেখা যাচ্ছিল না। কায়মুদ্দিনের এই ফিরে আসা যেন সেই সুড়ঙ্গের দেয়ালকে আরও শক্ত ও গভীর আঁধারে ঢেকে দিল।

সেদিন, রাতে মায়ের বুকের ভিতর সিঁটকে ঘুমোতে ঘুমোতে তাঁর প্রবল জ্বর এলো, কাঁপুনি দেয়া সেই জ্বরের ঘোরে ভুল বকতে বকতে সে শুধু বলছিলো ‘আমাকে মেরোনা, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি মায়ের কাছে যাবো।’  তার বাড়ি ফেরার খবর শুনে স্কুলের শিক্ষক সমরেশবাবু এলেন তাদের বাড়ি, কায়মুদ্দিন তখন তার মোরগ ছানাকে খুদ খাওয়াচ্ছিল। স্যারকে দেখে জড়োসড়ো হয়ে একপাশে দাঁড়ালো যেন বিচারকের সামনে নিষ্পাপ অভিযুক্ত, হাজারো গোয়েবলসীয় চিৎকার চেঁচামেচির ভিড়ে তার ক্ষীণ স্বর চাপা পরে যাচ্ছিলো, বিচারকের কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছিল না। স্কুলের ত্রাস ছাত্র দরদী সমরেশের চোখে একরাশ হতাশা, তিনি জানতেন, কায়মুদ্দিনের মতো মেধাবী ছাত্রের পড়াশোনা ছেড়ে যাওয়া সমাজের জন্য এক বড় ক্ষতি। তিনি কায়মুদ্দিন কে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “কাল থেকে স্কুলে আয়, তোর বন্ধুরা—সুমন, জয়ন্ত, রোহিত, সাগর —আর আমরা ক’জন মিলে একটা তহবিল গড়েছি ‘পাঁচ টাকার তহবিল’। তোর পড়াশোনা বন্ধ হবে না। তুই যে স্কুলের গর্ব। আমি নিশ্চিত জানি একবছর পর মাধ্যমিকে তোর রেজাল্ট স্কুলের পরিচিতি অনেক দূর বাড়িয়ে দেবে।” তার মাকে প্রয়োজনীয় কথা বলে কিছু টাকা হাতে দিয়ে স্যার চলে যায়।

কায়মুদ্দিনের প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। সে ভেবেছিল, এটা কেবলই করুণা। কিন্তু কয়েকদিন পর যখন স্যার আবার এলেন, তখন বুঝল—এটা শুধু দান নয়, দয়া নয়, ভালোবাসা। শ্রেণিকক্ষের সম্পর্ক, যা কেবল বই আর সিলেবাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তা এক মানবিক বন্ধনে পরিণত হয়েছে। সমরেশবাবুর কথায়, সেই  ‘পাঁচ টাকার তহবিল’ কায়মুদ্দিনের মনে এক নতুন আশার আলো জ্বলে উঠল। সে বুঝতে পারল, তার চারপাশে এখনও এমন কিছু মানুষ আছে, যারা তাকে শুধুমাত্র একজন পিতৃহীন দরিদ্র ছাত্র হিসেবে নয়, বরং একজন মানুষ হিসেবেও মূল্য দেয়।

(চার)

তিন মাস বিরতির পর, কায়মুদ্দিন আবার স্কুলের দিকে পা বাড়াল। তার হাতে সেই পুরোনো, ছেঁড়া ব্যাগটি। যেটা শুধু একটি ব্যাগ নয়, নিজের ফেলে আসা শৈশবকে সে আবার নতুন করে খুঁজে নিচ্ছিল। স্কুলগেট দিয়ে সে যখন নীরবে প্রবেশ করছিল, তখন তার ভেতরে এক মিশ্র অনুভূতি। লজ্জা, ভয়, আর এক অজানা সংকোচ। নিজের স্কুলেই নিজেকে কেমন যেন পর পর মনে হয়, তার এই মনে হওয়া বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। পেছন থেকে ভেসে আসা একটি কণ্ঠস্বর যা তার ভাবনাকে থামিয়ে দেয়, “দেখ, জিৎ দাদা এসেছে!"। শব্দটা ছিল ‘জিৎ দাদা’। কায়মুদ্দিনের স্কুলের ডাক নাম, সবরকমের পরীক্ষা থেকে প্রতিযোগিতায় জিততে জিততে তার নাম হয়ে গেছে ‘জিৎ দাদা’। দীর্ঘ তিন মাস পর কেউ তাকে এই নামে ডাকল। সেই ছোট্ট, সাধারণ শব্দটি কায়মুদ্দিনের কানে বাজল এক নতুন সুরের মতো। এই ডাকটি কেবল একটি সম্বোধন নয়, এটি যেন তার হারানো পরিচয়, কয়েকটা শব্দ মুহূর্তে তার সম্মান ফিরিয়ে দিল, ভুলিয়ে দিল সব অপমানের গ্লানি। তার চোখে জল এসে গেল। সে বুঝতে পারল, সে একা নয়—তার সঙ্গে আছে সকলের স্নেহ ভালোবাসার নিবিড় ছায়া।

প্রধান শিক্ষক নারায়ণবাবু এগিয়ে এসে তাকে ক্লাসে নিয়ে গেলেন। তাঁর চোখে ছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি। তিনি হয়তো জানতেন, কায়মুদ্দিনের ফিরে আসাটা কতটা জরুরি ছিল। সেদিনই দুপুরে পঞ্চায়েত প্রধান স্কুলের সভাপতি এলেন, তিনিও তার ফিরে আসাকে সাধুবাদ জানালেন। তিনি বললেন, “আমরা ওর জন্য পঞ্চায়েত স্তরে একটা বিশেষ ছাত্রবৃত্তির ব্যবস্থা করব, আর প্রশাসনিক স্তরে কথা বলে দেখি, পরিবারের জন্য কোনো বিশেষ ব্যবস্থা করতে পারি কিনা।” কায়মুদ্দিন সেদিন আর মাথা নিচু করেনি। তার চোখে তখন কোনো লজ্জা ছিল না, ছিল এক নতুন ধরনের সাহস। সে সবার দিকে তাকিয়েছিল, কৃতজ্ঞতা, লজ্জা আর সাহসের এক মিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে। যদিও সে জানে তার আব্বা ছিলেন একজন আদর্শবাদী মানুষ তিনি  প্রধানের দলের কাজকর্মের প্রকাশ্যে সমালোচনা করতেন। তিনি থাকলে এই সাহায্য হয়তো নিতেন না, নেওয়ার প্রয়োজন হতো না। তারও প্রয়োজন হয় নি।

জীবন কখনও কখনও সব কিছু কেড়ে নেয়, শুধু একটি জিনিস ছাড়া—প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা প্রবল ইচ্ছা শক্তির জোরে অনেক কিছুই করা সম্ভব। কায়মুদ্দিনের কাছে সেই ইচ্ছাই ছিল তার জীবনের মূল ভিত্তি। সে স্কুলে ফিরেছিল, শুধু একজন ছাত্র হিসেবে নয়। সে ফিরেছিল এক ইচ্ছা শক্তির প্রতীক হয়ে, কথায় বলে, ‘অন্ধকার যদি গ্রাস করে, তার মধ্যেই আলো খুঁজে নিতে হয়। আলোর সন্ধানে এগিয়ে যেতে গেলে, ছায়ার অস্তিত্ব মেনে নিতে হয়।’ তার এই ফিরে আসা যেন এক খণ্ড খণ্ড জীবনের কোলাজ, যেখানে প্রতিটি কষ্টের দাগ, প্রতিটি অপমান, আর প্রতিটি সাহায্যের হাত মিলেমিশে এক নতুন জীবনের গল্প তৈরি করেছিল।

গল্পটা এভাবে শেষ হলে খুব ভালো হতো, আমরা সবাই স্বস্তির শ্বাস নিতাম। কিন্তু কায়মুদ্দিনের জীবনে তা হয় নি। সমাজের দুই একটা ভালো কাজের পুরস্কার দিয়ে আশু আঁধার সাময়িক ভাবে ঢেকে দেওয়া গেলেও স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রশ্ন করতে শিখতে হবে, যেটা কায়মুদ্দিন করে ছিল সে জানতে চেয়েছিল কেন পানি খেতে পাবে না? সে পড়েছিল বিবর্তনের ইতিহাস, পড়েছিল বিরুদ্ধ পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া বানর গুলোই মানুষ হয়েছে, উত্তরের দিকে পালিয়ে যাওয়া গুলো নয়। 

সে ময়ের কোলে ফিরে এসেছিল ঠিকই, কিন্তু নিজের পায়ে নয়, প্লাস্টিকে মোড়া অর্ধ দগ্ধ পচা গলা লাশ, যাকে সঠিক ভাবে সনাক্ত করা যায় নি। প্রতক্ষদর্শীদের বয়ানের ভিত্তিতে কায়মুদ্দিন বলে দাফন করা হয়েছে। রাজনৈতিক দল গুলো প্রতিযোগিতায় নেমেছে কে কতটা বেশি মানবিক অন্যের থেকে, গণতন্ত্রের লাশের ওপর কার অধিকার কতটা বেশি। সংবাদপত্র, নিউজ চ্যানেল, সমাজ মাধ্যমে যে যার যার মতো করে গল্প তৈরি করে বেচেছে। কায়মুদ্দিনের মা আনোয়ার বিবি আনোরা ক্ষেপি হয়ে গেছে। কায়মুদ্দিনের মোরগটা মরে একটা গাছ হয়েছে। আমরা আছি যে যার মতো লক্ষণ রেখা অতিক্রম না করে। কায়মুদ্দিনের স্কুল পূর্ব অমিনপুর হাই স্কুল সত্য সত্যই ‘পাঁচ টাকার তহবিল’ চালু করেছে যাতে আর কোনো কায়মুদ্দিন কে হারাতে না হয়। 

Post a Comment

Previous Post Next Post