কোনও একটি প্রথম শ্রেণীর দৈনিকের
ভেতরের পাতার খবর, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের তরফ থেকে নাকি বলা হয়েছে তাদের কাছে সেই খবর
ছিল। তাই নিয়ে এক বিশিষ্ট সাংবাদিক ও বর্তমানে ইউটিউবার, আমার খুবই শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি
প্রচণ্ড উত্তেজিত, পশ্চিমবঙ্গের এডিজি সাউথবেঙ্গলের নাম করে প্রশ্ন তুলেছেন, আপনারা
যখন জানতেন ব্যবস্থা নেননি কেন? আর যদি নাকের ডগায় জঙ্গিডেরার কথা না জেনে থাকেন. নিজেদের
অপদার্থতা স্বীকার করুন। মানে ভাবতে পারছেন আপনাদের নিরাপত্তা কোথায়? এই মুর্শিদাবাদে
আলকায়দার কাছে ট্রেইনিং নেওয়া জঙ্গি ডেরা বেঁধেছে? আর আমাদের রাজ্য পুলিশ কিছু টের
পায়নি? হতে পারে? এডিজি সাহেব আপনি মাঝেমাঝেই মিডিয়ার সামনে খুব গুছিয়ে কথা বলেন?
আপনি হয় স্বীকার করুন আপনারা ঘুমোচ্ছিলেন, you are incompetent, inefficient,
your intelligence failed. আর তা যদি না হয়ে থাকে আপনারা জেনেও কেন ব্যবস্থা নেননি,
জবাবটা দিন। ভিডিওটি আধঘণ্টার ছিল যার নির্যাস আমি বিগত এক মিনিটে শোনালাম। যেন জবাবদিহি
বা ব্যর্থতাস্বীকার করলেই সমস্যার প্রাথমিক সমাধান হয়ে যাবে। অন্তত আমরা তাতেই সন্তুষ্ট।
তাই তো। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের
নাকের ডগায় টেররিস্ট ডেরা বাঁধা তো এই প্রথম। ২০১৪-র ২রা অক্টোবর বর্ধমানের খাগড়াগড়
বিস্ফোরণ হয়েছিল বুড়িমার ধানিপটকা ফেটে। জানুয়ারি ২০২০-তে নৈহাটির মাশরুমাকৃতি ধোঁয়া
তোলা বিস্ফোরণ, যেমনটা পরমাণু বোমার বেলা হয়, মহাভারতের ব্রহ্মাস্ত্রের বর্ণনায় আছে,
সেটাও হয়েছিল অসাবধানে তুবড়ি ফেটে। আর ২০২৩-এ পরপর ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ ২৪-পরগণার
বাসন্তী, মার্চে মুর্শিদাবাদের মাঠপাড়া, এপ্রিলে ইসলামপুর, মে-মাসে দক্ষিণ ২৪ পরগণার
মহেশতলার ভূপতিনগর, এগরা, জুনে নদীয়ার মহেশনগর, বীরভূম নলহাটির লস্করপুর, মুর্শিদাবাদের
জঙ্গিপুর, আগস্টে বারাসাত – এইসব বিস্ফোরণগুলো তো ঐ দোদোমা, মানে বাজি কারখানায় দুর্ঘটনা
বা বড়োজোর এলেবেলে ক্রুডবোমা ফাটা বলেই নথিভুক্ত। বিরোধীরা মিছিমিছিই পশ্চিমবঙ্গের
বোমা-শিল্প নিয়ে কটাক্ষ করে এসেছে। প্রসঙ্গত ইম্প্রোভাইজ়ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস মানে
কিন্তু শুধু প্রথাসিদ্ধ ডিনামাইট বা আরডিএক্স নয়, যেকোনও যন্ত্র বা পদার্থকে বিস্ফোরক
হিসাবে ব্যবহার করা।
যাইহোক, পুলিশের না-জানা বা
জেনেও না-জানা নিয়ে নতুন করে তোলপাড় হচ্ছে। অথচ সেই ২০১৪ সালেই NIA তদন্তভার নিয়ে খাগড়াগড়ে
পৌঁছোনোর আগেই সব বোমা ফাটিয়ে নষ্ট করা নিয়ে বিস্তর হৈহল্লা হয়েছিল। মানে প্রমাণ
লোপাট শুধু ২৪-এর আরজিকর সিনড্রোম নয়, ১৪-র খাগড়াগড় ছিল পথিকৃত। তারও আগে কত বাজি-কাণ্ড
ধামাচাপা পড়েছিল, কে জানে? তবু আজকের আনকোরা দাবি, আমাদের পুলিশ হয় অজ্ঞতার জন্য স্বীকারোক্তি
কিংবা জেনেশুনেও নিষ্কৃয়তার জন্য জবাবদিহি দেবে।
এই বোমাশিল্পের ভোটের বাজারে দারুণ রমরমা সেই বাম কিংবা তারও আগে কংগ্রেস আমল থেকেই। ভোটে বোমা ফেললে হয় রাজনৈতিক সংঘর্ষ আর গোয়েন্দা সংস্থা ভিনদেশের যোগাযোগ আবিষ্কার করলে তখন সন্ত্রাসবাদ। রাজনৈতিক রঙের একটা মস্ত সুবিধা, হিংস্র থেকে হিংস্র সাম্প্রদায়িক কর্মকান্ডকেও দিব্যি রাজনীতির আড়ালে মহিমান্বিত কিংবা লঘু করা যায়।
একসময় যেমন ধানতলা ডাকাতি-ধর্ষণ-খুন
কাণ্ড ছিল শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের গল্প, যেখানে কোরবান আলি মণ্ডল, টুকু সর্দার,
চিমু সর্দার, লোধাই সর্দাররা ছিল দলের বিক্ষুব্ধ সদস্য। সইদুল ইসলাম ও সুবল বাগচি ছাড়া
১৫ জনকে বেকসুর খালাস করা হয়, তাদের নাম আমরা জানি না। বানতলার বীভৎস ধর্ষণ হত্যাকাণ্ডের
কুশীলবদের সবার নাম দুষ্কৃতী, কারণ অভিযুক্তদের নামগুলোই সামনে আসেনি। তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী
প্রশান্ত সুর তাদের পক্ষ নিয়ে বলেছিলেন, স্থানীয় লোকেরা নাকি শিশুপাচারকারী ভেবে মহিলা
আধিকারিকদের আক্রমণ করে। তাই তারা অনিতা দেওয়ানকে ধর্ষণ করে শরীরে ধাতব টর্চ ঢুকিয়ে
অথবা গাড়িচালককে তেতাল্লিশবার কুপিয়ে পুরুষাঙ্গ পিষে দিতেই পারে। নিন্দুকদের প্রতিবেদন
অনুযায়ী ডাঃ অনিতা দেওয়ান ইউনেসকোর অনুদানে চলা স্বাস্থ্য প্রকল্পের টাকা স্থানীয় গ্রামপঞ্চায়েত
দ্বারা নয়ছয়ের খতিয়ান রাখছিলেন বলেই স্থানীয়দের বিরাগভাজন হন। পার্টিকুলারলি তাঁকেই
টার্গেট করা হয়েছিল। মানে স্বাস্থ্যদুর্নীতি ও তার জেরে মহিলাদের টার্গেট করাটাও পশ্চিমবঙ্গের
পুরোনো অসুখ। তুৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায় “it happens” – হয়েই থাকে। অর্থাৎ ধর্ষণ-খুনকে টোখাটো ঘটনা, এমনটা হতেই পারে, বলা-- সেটারও ঐতিহ্য বহুদিনের। বাচ্চা চুরির
প্রসঙ্গে আবার মনে পড়ল, বিজনসেতুতে আনন্দমার্গী সন্ন্যাসী সন্ন্যাসিনীদের আগুনে পুড়িয়ে
যে মারা হয়েছিল সেটাও বাচ্চাচুরির গুজব রটিয়ে। কেলেঙ্কারি! ট্র্যাকে ফিরি।
যাইহোক, সেসব সন্ত্রাসবাদ ছিল
না, অন্তত ইসলামিক সন্ত্রাস তো নয়ই। কারণ সেগুলো
ঘটেছিল রাজনৈতিক আদর্শের খাতিরে। ২০০৩-এ ধানতলা কাণ্ডের সময় এ রাজ্যের বিরোধী নেত্রী
খুব সক্রিয় ছিলেন বলে তবু চারজন দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল, ১৯৯০-এর বানতলা পুরোটাই হাশ্শ্শ্ড্-আপ;
এমনকি নির্যাতিতাদের ডাক্তারি পরীক্ষা করেছিলেন যিনি, সেই ডাক্তার চন্দন সেনও খুন হয়ে
যান। সেটাও শোনা যায় জাল ওষুধ নিয়ে গোলমালের জেরে যদিও প্রমাণিত কিছুই হয়নি। এক ঢিলে
দুই পাখি মারা আর কী। এগুলোতে মানুষ সন্ত্রস্ত হতে পারে কিন্তু সন্ত্রাসবাদ ছিল না,
বিশেষত সাম্প্রদায়িক হিংসা তো একেবারেই নয়, যদিও বলি হয়েছে একতরফা সংখ্যাগুরুরাই। আর
শিকারিদের সাম্প্রদায়িক পরিচয় যাই হয়ে থাক।
তাই হয়তো ২০২৪-এ বাংলাদেশে
হাসিনা সরকারের পতন ও নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসার পর বাংলাদেশি নাগরিকদের ভুয়ো
ভারতীয় পরিচয়পত্র বাগানো কি মাদ্রাসা খোলার খবরে আমরা বিস্মিত। কারণ এর আগে বাংলাদেশ
থেকে জঙ্গি কেন এমনি অনুপ্রবেশও ঘটেনি, তাদের ভোটার কার্ড রেশন কার্ডও করে দেওয়া হয়নি।
৪ঠা আগস্ট ২০০৪ পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন বিরোধীনেত্রী লোকসভার স্পিকারের মুখে এমনি-এমনিই
কাগজ ছুঁড়ে মেরেছিলেন। বলেননি, সিপিএম অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে তাদের ভোটার বানাচ্ছে। বাংলাদেশ
প্রকাশ্য রণহুংকার দেওয়ার পর ১০-১২ বছরের পুরোনো চক্রগুলো সবে শুরু হল মনে হচ্ছে।
অথচ সেই বাম আমল থেকেই শুনে
আসছি, পশ্চিমবঙ্গ সন্ত্রাসবাদীদের স্বর্গরাজ্য; কিন্তু এখানে তারা কোনও অঘটন ঘটাবে
না যেহেতু পশ্চিমবঙ্গ হল তাদের নিরাপদ আশ্রয়, আত্মগোপনের ডেরা। West Bengal is the
safe heaven of terrorists, its their launchpad, and they are not like to cause
any destruction here since its their shelter. সবটাই বোধহয় আমার একার হ্যালুসিনেশন।
দৃষ্টিভ্রম শ্রতিভ্রম। কারণ চ্যানেলগুলো এখনও প্রশ্ন করছে, ‘তাহলে কি পশ্চিমবঙ্গ জঙ্গিদের
ডেরা নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠছে?’ ‘তাহলে কি পুলিশ সব জেনেও নিষ্কৃয়?’ ‘তাহলে কি পুলিশমন্ত্রী
রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে ব্যর্থ? মানে এখনও সন্দেহ আছে, তবে সেটাও সদিচ্ছা নিয়ে
নয়, দক্ষতা নিয়ে।
সুতরাং পুলিশ কর্তামশাই আপনি
নিজেদের অপদার্থতা স্বীকার করলে কিংবা নিষ্কৃয়তার কৈফিয়ত দিলেই আমরা সন্তুষ্ট। কারণ
২০১১-র পর থেকে আমরাও অনেককিছু দেখেও না দেখাটা অভ্যাস করে ফেলেছি। ২০১৭ থেকে রোহিঙ্গা
শরণার্থীর ঢল নামে, তাদের অনেকের সঙ্গে পাক জঙ্গি সংগঠনের ঘনিষ্ঠতার খবরও ফাঁস হতে
থাকে। ২০১৭-তেই 'সাউথ এশিয়া টেররিজম'
পোর্টালের পরিচালক অজয় সাহানি ভারতে অনুপ্রবিষ্ট
রোহিঙ্গা শরণার্থী সম্পর্কে বলেছিলেন, তারা কেউকেউ মৌলবাদী ইসলামিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত
হয়ে ভারতে উদ্বেগের কারণ ঘটতে পারে যদিও সাহানি
তখনই ভারতের তরফে কোনও পদক্ষেপের প্রয়োজন অনুভব করেননি, বরং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির সুপারিশ
করেছিলেন। আর রবীন্দ্র-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক
সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক অনিন্দ্যজ্যোতি মজুমদার তো রোহিঙ্গা নিয়ে ভারত সরকারের উদ্বেগ প্রকাশকে
পুরোপুরি রাজনৈতিক অভিসন্ধিপ্রসূত অপযুক্তি বলে উড়িয়ে দেন। ভারত রাখতে চায় না বলেই
রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ফালতু ওজর তুলছে। সাম্প্রদায়িক সেণ্টিমেন্টে উস্কানি দিচ্ছে।
সন্দেশখালিতে শাহজাহান শেখের
পিঠে খাওয়া আর তার সলতনাতে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার মৌরুসিপাট্টার খবর জেনেও আমরা আজকে
বাংলাদেশ-পাকিস্তান-জঙ্গি যোগাযোগের ব্যাপারটা নতুন করে জানছি; বিস্মিত হচ্ছি জেনে
একজন রাজমিস্ত্রি কি শালওয়ালাও টেররিস্ট হতে পারে? আর বাংলাদেশের যোগ, যেখানে কবি-সাহিত্যিকরা
সাংস্কৃতিক টুরিজম করতে যান? ধুস! অথচ খাগড়াগড় কাণ্ডের জন্য ২০১৯-এই কলকাতা হাইকোর্টে ৪ জন বাংলাদেশিসহ ১৯
জনের সাজাও ঘোষিত হয়েছিল।
ভারত সরকার আবার ভীষণ তৎপর ও সজাগ। সীমান্ত দিয়ে একটা মাছিও গলতে দিচ্ছে না তো জঙ্গি। হিন্দু-বৌদ্ধ শরণার্থীদের কথা ভাবার দরকার নেই। বিএসএফ বর্ডারে বাংলাদেশি দেখলেই একেবারে ঢিচকাঁউ। কখনও রাবার বুলেট ছুঁড়ে একজনকে তিস্তায় ফেলে দিচ্ছে তো কখনও তিন-তিনজনকে ভাগীরথীতে ভাসিয়ে দিচ্ছে… ইত্যাদি। আপনারা শুনতে পাবেন এমন অনেক আশাবাদী গপ্প। যা হবে স্পষ্ট হবে, কিংবা কোনও কথা চেপে রাখতে দেব না। অথচ এসব খবর সামনাসামনি আসার পর পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতারা কিঞ্চিত লাফালাফি করায় ও মিডিয়ারও ঘুম ভাঙার পরেও বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে ভারতের মাটিতে জামাই আদরে ডেকে এনে খেলানো হচ্ছিল, যেটা সবে বন্ধ হয়েছে। চিন্তা নেই, ভারত অস্ত্রেলিয়া সফর সেরে ফিরলেই ওদের আবার ডেকে আনা হবে। ঠিক যেমন বাংলাদেশ সরকারকে মৃদু বকি-বকি দেওয়ার পাশাপাশি ভারত থেকে বাংলাদেশে রপ্তানী অব্যাহত। ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক, বস্ত্র পোড়ানো এসবের মাঝেই খেপেখেপে ১৮০ টন পেঁয়াজ, ২৪ হাজার ৬৯০ টন চাল, আলু, পেঁয়াজ, সয়াবিন তেল, কোটি কোটি ডিম ইত্যাদি পাঠানো হয়েছে। গত আড়াই-তিন বছর ধরে ক্রিকেট খেলা হোক কি যেকোনও ক্ষেত্রে, সামাজিক মাধ্যমে বাংলাদেশিদের ভারতের বিরুদ্ধে বিষ ও বিষ্ঠা ছড়ানো দেখেও বাংলাদেশের ভারতবিদ্বেষ যখন এতদিনে শনাক্ত করতে পারেনি ভারত সরকার, তখন এখনও করবে না। কারণ মহম্মদ ইউনূস সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন, কিন্তু ইচ্ছাকৃত নির্যাতন তো করাচ্ছেন না বা মদত দিচ্ছেন না। ঠিক যেমন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যপুলিশের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু অপরাধী বা সন্ত্রাসী ধরায় ব্যর্থ হচ্ছে। কালীঘাট বা চোদ্দতলার সদিচ্ছার অভাব নেই, কিন্তু পেরে উঠছেন না। তাই বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রী সাফ জানিয়েছেন, হিন্দুদের ওপর যতই অত্যাচার করা করুক মৌলবাদী বাংলাদেশ, সেখানকার জনগণের অসুবিধা হতে দেবে না ভারত, যাতে তারা খেয়েদেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে হিন্দুসহ সংখ্যালঘু নির্যাতনে হীনবল না হয়ে পড়ে।
সময়টা কোন সন্ধিক্ষণ ভাবুন
তো। বাংলাদেশের মতো পুঁচকে দেশ ভারতের দয়ায় যার স্বাধীনতা সে চোখ রাঙাচ্ছে? এই ইউনুস
মিয়াই যত নষ্টের গোড়া। তিনি এসেই সংখ্যালঘু নির্যাতন শুরু করেছেন। ওহো! উনি তো কিছু
করছেন না, ওনার ইনটেশন নিয়ে এখনও একটু সন্দেহ জাগছে মাত্র, কনফার্ম না। শুধু সন্দেহ,
যে উনি বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। মানে চাইছেন নিরাপত্তা দিতে
হিন্দুদের বৌদ্ধদের চাইছেন মঠ মণ্ডপ রক্ষা করতে কায়মনবাক্যে কিন্তু কিন্তু পারছেন
না, ব্যর্থ হয়েছেন। ঠিক যেমন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুলিশের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ নেই,
কিন্তু অপরাধীদের ধরা হোক বা জঙ্গিদের, ব্যর্থ হচ্ছে। চোদ্দতলা না থাক। এক লক্ষ জঙ্গি
ধর্ষকের আত্মা এক দেহে ধরা পড়লে অমন একজন উচ্চাঙ্গের ব্যর্থ তৈরি হতে পারে।
তা ইউনুস মিয়াই প্রথম হিন্দুদের
ওপর হামলা রুখতে একটু আধটু ব্যর্থ হচ্ছেন, শেখ হাসিনার আমলে কি বাংলাদেশে একই বৃন্তে
দূটি কুসুম ফুটে থাকত? তাহলে এনআরসি সিএএ মানে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন
২০১৯ এগুলো কোন অশ্বডিম্ব প্রসবের জন্য আনা হয়েছিল? হাসিনার জমানায় সোনার বাংলায় কি
হিন্দু বৌদ্ধরা সুখে থাকত? তাহলে ২০২১-এ দুর্গাপুজোর মণ্ডপে হনুমানের কোলে কোরান রাখার
গুজবকে উপলক্ষ্য করে যা হয়েছিল সেটা কি বিএনপি কিংবা জামাতের শাসনকাল ছিল? আওয়ামীলীগ
তো ধোয়া তুলসীপাতা, থুড়ি, তুলসী নাপাক, ধোয়া ইয়াবাপাতা। মানে এক ইয়াবাখোর নেশাড়ুই
তো সব গোলমাল পাকিয়েছিল বলে হাসিনার পুলিশ আবিষ্কার করে।
যাইহোক, সারা বাংলাদেশ জুড়ে
২০২১-এ যা হয়েছিল, তা নেহাতই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। করেছিল কিছু মৌলবাদী, অন্যান্য বাংলাদেশী
মুমিনরা সবাই সুশীল এবং বাংলাদেশ সরকারের কোনও দোষ ছিল না। তাই তো আমাদের ৫৬ ইঞ্চি
সে দেশে হিন্দুরা দীপাবলীতে আলো না জ্বালালেও বাংলাদেশের সংখ্যাগুরুর জন্য দীওয়ালীর
উপহার উপঢৌকন পাঠাতে ভোলেননি। লম্বা সেই তালিকা। আমার খান পঁচিশ অ্যাম্বুল্যান্সের
কথা মনে আছে, সঙ্গে ছিল আরও অনেক অনেক কিছু। ফোকটে। ভালো কাজের পুরস্কার যে। অথচ হাসিনা
খামোখা ঘাবড়ে গিয়ে ভারতকে শাসিয়েছিলেন, বাংলাদেশের ক্রিয়ার কোনও প্রতিক্রিয়া ভারতীয়
মুসলিমদের ওপর হলে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর তার প্রভাব আছড়ে পড়বে।
সত্যিই দায়িত্বশীল রাষ্ট্রনেত্রী।
তাঁর বাবা যেমন হিন্দু ভোটে বারবার নির্বাচন জিতে হিন্দুদের গণহত্যা করিয়ে নিতেন,
কখনও মুক্তিযুদ্ধের নামে, কখনও মৌলবাদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে, সেকুলারিজম কথাটি বাংলাদেশের
সংবিধানে প্রবেশ করিয়ে নিজে উদার সেকুলার সেজে যাতে ধোঁকা খেয়ে বাংলাদেশের সারোগেট
মাদার ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৬-এ ভারতীয় সংবিধানেও সেকুলার কথাটির অনুপ্রবেশ ঘটান। অবিকল
ঠিক সেই মুজিবের পদাঙ্কই অনুসরণ করে চলছে তাঁর মেয়ে। হিন্দুদের জোরে ক্ষমতায় চড়ে
ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেই হিন্দুদের ওপর অত্যাচার রুখতে ইচ্ছাকৃত ব্যর্থ হয়েছেন
তাঁর দীর্ঘ প্রধানমন্ত্রিত্বে। আমাদের স্মৃতি বড়ো দুর্বল ও বাছাইপন্থী। আমরা ২০২৪-এর মেটিয়াবুরজ, বেলডাঙা ভুলে গেলাম, আর ২০২১-এর দুর্গাপুজো মনে রেখে দেব? এত নীচ মন নাকি আমাদের? বরং
২০১৫-র আখলাখ হত্যা মনে রাখা মানসিক প্রসারতা, ঠিক যেমন ৯২’-এর গোধরা হিন্দু গণহত্যাকাণ্ড
ভুলে গুজরাট দাঙ্গার বিরুদ্ধে পথে নামাটা। আমরা রাখব জঙ্গির খোঁজ, তাও আবার প্রাণের
বাংলাদেশের?
এমন খবর তো আগে শুনিনি, অন্তত
মনে তো রাখেনি। বাই দ্য ওয়ে, শেখ হাসিনা খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডের পরেও ভারতের
national intelligence agency তদন্তভার নিয়ে বাংলাদেশ যোগসূত্র আবিষ্কার করামাত্র ভারতকে
বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গকে ভর্ৎসনা করেছিলেন, বাংলাদেশের জঙ্গিরা এই দেশ বিশেষত এই রাজ্যে
আশ্রয় পাচ্ছে বলে। কী কাণ্ড বলুন তো! পড়শি দেশের প্রধানমন্ত্রী জানতেন তাঁদের সন্ত্রাসী
ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নতুন নতুন প্রোডাকশন ডিস্ট্রিবিউশন ইউনিট
খুলছে, কিন্তু আমরা এতদিনেও কিছু জানতাম না। তাই আব্বাস আলি, মিনারুল শেখ, নুর আলম,
সাদ ওরফে সাব শেখরা ধরা পড়ার খবর গোগ্রাসে সংবাদ গিলতে টিভি ও ইউটিউব চ্যানেলকে টিআরপি
দিচ্ছি, ভিউ দিচ্ছি। মাদ্রাসা, ভুয়ো ভারতীয় পরিচয়পত্র তৈরির র্যাকেট ইত্যাদির খবরে
বিস্মিত হয়ে পরক্ষণেই কবিসম্মেলনে ডুবে যাচ্ছি।
আসলে হাসিনা বিবি নিজে ভারতপন্থী
সেকুলার সেজে মৌলবাদের যে আগুনে নিজের রুটি সেঁকেছিলেন আর হিন্দুদের phased
annihilation, ক্রম-নির্মূলীকরণ ঘটতে দিচ্ছিলেন, সেটাই দাউদাউ করে জ্বলে উঠতে নিজের
হাতেও ছ্যাঁকা খেয়েছেন। তখন যথারীতি এই ভারতবর্ষের কথাই মনে পড়েছে আশ্রয় নেওয়ার
জন্য। হাসিনার বাবাও পাক-আমলে বারবার হিন্দু ভোটে নির্বাচন জিততেন, আর সেই আক্রোশে
পাকবাহিনী ও রাজাকাররা হিন্দু-গণহত্যা চালাত। প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও হিন্দুমৃত্যু ঘটেছে
তিলেতিলে যখন পাকিস্তান সরকারের বিলম্বিত ত্রাণকার্য আরও বিলম্বিত হয়ে আওয়ামি লীগের
হরতালের ফলে। ভাষা-আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম — পুরো পরিক্রমাটাই
ছিল মুসলিম বাংলাভাষী ও বাংলাবাসীদের স্বার্থে সনাতন বাঙালিদের রক্তে পিচ্ছিল। অথচ
সেকুলারিজ়ম কথাটি বাংলাদেশের সংবিধানে ঢুকিয়ে মুজিব নিজে এমন উদার সেকুলার সাজেন,
যে বাংলাদেশের সারোগেট মাদার ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৬-এ ভারতীয় সংবিধানেও সেকুলার কথাটির
অনুপ্রবেশ ঘটান। সেই ইতিহাস গভীরে অধ্যধন করলে অনুধাবন করা যাবে, পিতার পদাঙ্কই অনুসরণ
করে চলছেন কন্যা। বাপ মুক্তিযুদ্ধ ভাঙিয়ে প্রধানমন্ত্রী, নিজেরও তারই ধারাবাহিকতায়
ক্ষমতায়ন। তাই মুক্তিযুদ্ধের সেন্টিমেন্ট অবশ্যই তাঁর আছে, কিন্তু সেই সেন্টিমেন্টে
হিন্দু বাঙালির জন্য কোনও জায়গা নেই। হিন্দু বাঙালিকে দরকার শুধু অবিভাজিত ভোটের জন্য।
এই দ্বিচারিতায় আজ ব্যালান্স হারিয়েছে।
২০১৬ সালে ঢাকা ট্রিবিউন ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ ডঃ বারাকাতকে উদ্ধৃত করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল,
আগামী ৩০ বছরে বাংলাদেশ হিন্দুশূন্য হয়ে যাবে। সেই প্রক্রিয়াতেই হিন্দু জনসংখ্যা এত
কমে গেছে যে হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নিজেই বিপদে পড়ে গেছে। যে ডালে বসে আছে, সেই ডালেই
কুঠার চালালে যা হয়। চেয়ারের চারটি পায়ার একটি একেবারে ভেঙে ক্ষয়ে গেলে সেই চেয়ারে
বসা যাবে? ঠেকজোড়া দিয়ে কিছুদিন চালানো গিয়েছিল। এখন গদি উল্টে গেছে। তাই চেতনা হয়েছে।
যে নেতিবাচক শক্তি বাংলাদেশকে হিন্দুশূন্য করতে ব্রতী, সেই নেতিবাচক শক্তিই আজ গৃহযুদ্ধ
ডেকে এনেছে। কিন্তু আমরা তো ইতিহাস মনে রাখি না, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া তো দূর।
আর বাঙালির উভয় সংকট। ভারতের
বর্তমান গুজরাট-শাসিত কেন্দ্রসরকার হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে যে মাথায় তুলে রেখেছে, তার
কারণ শুধু জিওপলিটিক্স নয়, হাসিনাবিবিকে বাঙালি নির্মূলীকরণের পুরস্কার দেওয়াও। ভূরাজনীতির
কথা যখন উঠলই, তখন ভারতের উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলিকে অক্ষত রাখতে, বঙ্গোপসাগরকে ভারতের
জন্য নিরাপদ রাখতে, একদিকে চীন অন্যদিকে আমেরিকার চট্টগ্রাম সেন্টমার্টিনের দখল নিয়ে
যে ক্ষমতার লড়াই, তার থেকে ভারত ভূখণ্ডকে বাঁচিয়ে রাখতে, ত্রিপুরাসহ উত্তরপূর্বকে
বঙ্গোপসাগরে সংযুক্ত করতে একদিকে যেমন হিন্দু-বৌদ্ধ অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে
ভারতীয় টেরিটোরির মধ্যে শামিল করা একান্ত প্রয়োজন, তেমনি শিলিগুড়ির চিকেন নেককে
রক্ষা করার জন্য দরকার বাংলাদেশের রংপুর ডিভিশনকে পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গীভূত করা। নাহলে
আমেরিকা-চীনের দ্বৈরথে বাংলাদেশের মাটি আরেকটা সিরিয়া হয়ে উঠলে, মানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
বদান্যতায় ইসলামিক মৌলবাদের সৌজন্যে যেটা হওয়ার পথে বাংলাদেশ, বস্তুত আইসিসের ঝাণ্ডা
উড়তেও দেখা গেছে ঢাকার রাজপথে, তেমনটা কার্যকর হলে শুধু লাগোয়া রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ
নয়, সারা ভারতই বিপদে পড়বে।
বদ্ধপাগল-শাসিত সেই বদ্ধভূমিতে
আমেরিকার অস্ত্র কারবার ফুলেফেঁপে উঠবে, এক চুলও ক্ষতি হবে না; চীনেরও কিছু হারাবার
নেই, বড়জোর আমেরিকার দাপটে বঙ্গোপসাগরে তাদের কাঙ্ক্ষিত ওপেনিং পেতে ও ব্যবসা চালাতে
খানিক বেগ পেতে হবে। কিন্তু ঘর পুড়বে ভারতেরই। গজ্জুভাইরা যদি ভাবেন, শুধু কালী বা
দুর্গা নাম জপা বাঙালির সর্বনাশ, তাহলে কিন্তু ভুল করছেন। একমাত্র জাতিবিদ্বেষের কারণে
পশ্চিমবঙ্গে চলা জামাতি-হরকতি অরাজকতাকে টিকিয়ে রাখা ও মদত দেওয়া যে সমগ্র ভারতের
জন্যই বিপজ্জনক হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের মাটি ব্যবহার করে অনুপ্রবেশ ও অনুপ্রবিষ্ট জঙ্গীদের
ভারতে নাশকতার উদ্দেশ্যে ছড়িয়ে পরাই তার প্রমাণ।
কলকাতার মহানাগরিক কিন্তু চেতাবনী
দিয়েই চলেছেন। সেই কবে গার্ডেনরিচ মেটিয়াবুর্জ়কে "মিনি পাকিস্তান" বলে
পরিচয় করিয়াছিলেন, ২০২৪-এ এসে তো সরাসরি কখনও অমুসলিমদের দুর্ভাগা বলে দাওয়াত-এ-ইসলাম
দিচ্ছেন তো কখনও মুসলিমদের "মেজরিটি সে ভী মেজরিটি" করার প্রকল্প ঘোষণা করে
পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে ভবিষ্যতে উর্দু বলতে হবে বলে ভবিষ্যৎবাণী করছেন। বাংলা, বাঙালি,
‘জয়বাংলা’ কপচানোর নেপথ্যে ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদের চেহারাটা আর গোপন রাখার প্রয়োজনটাও
অনুভব করছেন না তাঁরা। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, সারা ভারতেই
তাদের লক্ষ্যমাত্রা সেটাও কিন্তু স্পষ্ট করেছেন বঙ্গসন্তান। এমনকি সেই সংখ্যাধিক্য
লাভ করার রুটম্যাপটাও গোপন রাখার চেষ্টা নেই। তাই নির্দ্বিধায় কেউ ধর্মান্তরণের আহ্বান
জানান তো কেউ ভাগীরথীর জলে হিন্দুদের কেটে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা সদর্পে প্রকাশ্য সমাবেশে
বলেন। যদি ৫৬ ইঞ্চিরা মনে করেন এর দ্বারা শুধু জয়শ্রীরাম ধ্বনিতে অদীক্ষিত বাঙালির
বিপদ, হনুমানের লেজ পুড়িয়ে লঙ্কাদহন করার মতো কোনও কার্যসিদ্ধি হবে, তাহলে ভুল করছেন,
এটা সমগ্র ভারতবর্ষের জন্যই অশনিসংকেত।
জয় শ্রীরাম বলতে মনে পড়ল,
ঐ একটি সাফল্যই গেরুয়াদল বা সঙ্ঘপরিবার অর্জন করেছে। বাঙালিকে দিয়ে জয় শ্রীরাম বলানো।
গোটা আন্দামানে দেখছি সেখানকার বাঙালিরা কালী-দুর্গা-সরস্বতী সব ভুলে গেছে প্রায়,
এই রামের জয়ধ্বনির সঙ্গেই বাঙালিত্বকে আইডেন্টিফাই বা রিলেট করছে, বাংলার বদলে হিন্দী
বলছে, আর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বলে সেটা বিনাপ্রশ্নে করানোও গেছে। আবার বাংলাদেশের সংখ্যালঘু
লুপ্তপ্রায় হিন্দুরাও রামের জয়ধ্বনি দিয়ে, দুর্গামণ্ডপে হনুমান পুজো করে, মানে যা
নিয়ে ২০২১-এ লঙ্কাকাণ্ড বেধেছিল আর কী, সেইসব করে বাঁচতে চাইছে। বাপের জন্মে শুনিনি,
দুর্গাপুজোয় হনুমান মূর্তি থাকে। কিন্তু রামচন্দ্রের প্রতিনিধি কোল পেতে বসেছিল। তারা
ভুলে যাচ্ছে, মৃতদেহের শ্মশানযাত্রার সময় হিন্দীওয়ালারা "রামনাম সত্য হ্যায়"
বলে, ওটা বাঁচার মন্ত্র নয়। সুতরাং হিন্দু বাঙালি যারা হিন্দুদের মধ্যে প্রগতিশীল
জাতি, তাদের "রামনাম সত্য" করার লক্ষ্যে সঙ্ঘ ও তার রাজনৈতিক দলটি সফল হতে
পারে, কিন্তু হিন্দুত্বের মুখ উজ্জ্বল করা থেকে ভারতকে স্বাধীন করা -- সবেতেই যে জাতিটা
সবচেয়ে বেশি রক্ত দিয়েছে, আত্মত্যাগ করেছে, তাকে নিশ্চিহ্ন করা মানে সমগ্র ভারত রাষ্ট্র
ও বৃহত্তর ভারতীয় জাতিসত্তার পক্ষেই আত্মঘাতী হবে। তাই ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্যে
প্রাণ দেওয়া চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের মহানায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রতিলতা
ওয়াদ্দেদারের জণ্মভূমিকে অবিলম্বে সসম্মানে ভারতে নিয়ে আসুন ও বাঙালিকে বাঙালির মতো
করে বাঁচতে দিন, তাতেই সবার মঙ্গল। গুজরাটি বেনেদেরও, দিল্লির হিন্দিওয়ালাদেও।
সদিচ্ছা
থাকলে অনেককিছু করা যায়, আর না থাকলে আরুশি হোক বা তিলোত্তমা, বিচার পায় না। রাশিয়া
ইউক্রেন করেছে কার অনুমতি নিয়ে? ইসরাইল গাজা দিয়ে শুরু করে ইরাণ সিরিয়ায় ব্যাপক
ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে। মানা করলেও কি শুনছে? না শুনলেও কে কী করতে পেরেছে? একমাত্র ভারত
চোখের সামনে মানুষ মরতে, ধর্ষিতা হতে দেখেও সেই রাষ্ট্রে চাল পাঠাচ্ছে, সাহায্য পাঠাচ্ছে।
দেশবাসীর চাপে কিছুদিন বাণিজ্য বন্ধ রেখেই আবার শুরু করছে। ১৯৭১-এ ইন্দিরার ভারত যথেষ্ট
নড়বড়ে ছিল এবং একদিকে আমেরিকা অন্যদিকে চীনের প্রবল বিরোধিতার মুখে দাঁড়িয়েছিল।
তবু সদিচ্ছার জন্য ইন্দিরা অত বড়ো ঝুঁকি নিয়েছিলেন। সহায় ছিল কেবল রাশিয়া। তারপর
যা সব ভুল করেছিলেন, তার খেসারত তো দিচ্ছিই। কিন্তু ছাপ্পান্ন ইঞ্চি প্রগতিশীল বাঙালীকে
ধ্বংস করার জন্যই এই ইচ্ছাকৃত নিশ্চেষ্ট সংযম অবলম্বন করে আছে।
মাতৃউপাসক বাঙালী হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া সঙ্ঘের একটা অন্যতম এজেন্ডা। কেন্দ্রের শাসকদল ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের শাসকদল, দুই পক্ষই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্য পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার খোলাখুলি মুসলিম পক্ষপাতী রাজনীতি করছে, বিজেপি হিন্দু হিতের কথা বলে। কিন্তু তৃণমূল তার মুসলিম নীতিতে অনেক সৎ ও আন্তরিক। রাজনীতিটা করছেই ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে। সেখানে কোনও ফাঁকি নেই। কিন্তু হিন্দুদের নিয়ে বিজেপি শুধু রাজনীতিই করছে, হিন্দু হিতে কিছুই করছে না। রামমন্দির করে গোবলয়ে জনপ্রিয়তা নিশ্চিত করা গেছে। কিন্তু রামের ভক্তদের জীবন রক্ষার জন্য কী করছে? একেকটা জিগির তুলে হিন্দুদের মধ্যে বিপন্নতা ও ভীতি জাগিয়ে তুলে ভোট পাওয়াটাই দলটির একমাত্র লক্ষ্য। তারপর তাদের বিপন্নতার সমাধান করতে আর উদ্যোগ নেয় না, বা নেওয়ার ভান করে ছেড়ে দেয়। ভাবে সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে যদি সব মানুষ জীবিকা কর্মসংস্থান মূল্যবৃদ্ধি মাত্রাতিরিক্ত প্রাইভেটাইজেশন এসব নিয়ে ভাবতে শুরু করে।
যদি সত্যিই হিন্দুর জন্য দরদ থাকত, তাহলে বাংলাদেশের এই বেয়াদপি ও হিংস্রতা সহ্য করত না। কিন্তু জবাব দেওয়ার পরিবর্তে তাদের চরম অসভ্য ভারতবিদ্বেষের মধ্যেই লক্ষ লক্ষ টন চাল, আলু, পেঁয়াজ, সয়াবিন তেল, গম, আটা, কোটি কোটি ডিম পাঠাত না। জবাব হয়তো দেবে, তবে বাঙালী হিন্দুরা বিলুপ্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে। কিন্তু হিংস্র বাঙালীবিদ্বেষ চরিতার্থ করতে গিয়ে সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতেই অশান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছে। এই আন্তরিক বাঙালীবিদ্বেষের কারণেই পশ্চিমবঙ্গের সরকারকে সরানোর রাজনৈতিক চেষ্টাই করছে না, যেখানে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করে নির্বাচন করানোর প্রয়োজন ছিল অনেক আগেই। পশ্চিমবঙ্গের শাসকরা হিন্দুবিদ্বেষী আর কেন্দ্রের শাসকরা হিন্দু বাঙালীবিদ্বেষী। সুতরাং হিন্দু বাঙালীর যা হওয়ার তাই হচ্ছে। আরাকান বাহিনী, পাকিস্তানে অশান্তি, পাক-আফগান যুদ্ধ, বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ গোলমাল-- এসব কোনোকিছু দিয়েই এই সীমাহীন জাতিবিদ্বেষকে ঢাকা যায় না। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে সমস্যাকীর্ণ রাজ্যটার জন্য কাজ করতে হবে, কিন্তু রাজ্য সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিলে সিন্ডিকেট, গরুপাচার, মেডিক্যাল যাবতীয় দুর্নীতি থেকে কালো উপার্জনের ভাগ কাজ না করেই ভোগ করা যাচ্ছে। নতুবা রাজনৈতিক ফায়দা কিন্তু রাজ্যকে জয় করতে পারলেই হত, দেশের নিরাপত্তাও বাংলাদেশকে শায়েস্তা করলেই নিশ্চিত হয়। কিন্তু নিরোর বেহালা বাজিয়ে মোদী-শাহরা বাঙালী জাতিটার সর্বনাশ দেখছে।
অন্ধ ভক্তরা এখন ১৮০ ডিগ্রি
ঘুরে ভুলভাল যুক্তি খাড়া করছে। যে কাজ করার পক্ষে ন্যারেটিভ নামাত, এখন সেই কাজ না
করার পক্ষে সাফাই দিচ্ছে। আর হিন্দু পরিবারে জন্মেও যাদের হিন্দু শব্দটাতেই এলার্জি,
তারা বিশ্বের হিংস্রতম বর্বরতম মতবাদে সাম্যবাদ খুঁজে পান। ভারত সরকার বিশেষত গেরুয়া
দলের প্রতি এমনিতে যথেষ্ট বিদ্বেষপ্রবণ হলেও এখন বেশ সরকারের পাশে দাঁড়ানোর অবস্থান
নিয়ে ফেলেছে। কারণ তাদের মনের মতো কাজই হচ্ছে – হিন্দু সাফাই। তাই পররাষ্ট্র নীতির
বাধ্যবাধকতার বুঝিয়ে রাষ্ট্রের পক্ষ অবলম্বন। কেন বলা মুশকিল কিন্তু ভারতের
কমিউনিস্ট পার্টির জন্মলগ্ন থেকে প্রতিটি কার্যকলাপ ভারতের সংখ্যাগুরু জনগণের বিপক্ষে।
বাম কংগ্রেস তৃণ এমনকী বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারও যে যার মতো করে বাঙালী হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন
করে দিতে চাইছে। কিন্তু ওরাও কি রক্ষা পাবে? পশ্চিমবঙ্গকে জঙ্গিডেরা হতে দিলে, বাংলাদেশকে
অসভ্যতা করতে দিলে, আর এভাবেই চললে আমরা দশ বছরে বিলুপ্ত হব, কিন্তু গজ্জু মেড়ো মরাঠীরাও
পঁচিশ বছরের বেশি টিকবে না। অমিত শাহ হয়তো দেখে যাবেন না, কিন্তু জয় শাহকে একদিন সন্তানের
ভবিষ্যৎ ভেবে দুশ্চিন্তা করতে হবে।
শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়