সীমান্ত প্রহরায় লাদাখ ।। ৮ ।। দুরবুক থেকে চুশুল হয়ে সো-মরিরি ও লে প্রত্যাবর্তন

দুরবুক থেকে চুশুল হয়ে সো-মরিরি ও লে প্রত্যাবর্তন

২৯শে জুলাই ২০২২

  



আমাদের প্রধান গাইড অনুপমের পরামর্শ ছিল সরাসরি সোমোরিরি যাওয়ার ভিন্ন একটা রাস্তা ধরার যাতে আরো চারটে ছোট লেক ও একটা পাস দেখা যেত। ড্রাইভার রিগজ়িনও প্যাংগং-এর পথ না ধরে ঐ শর্টকাট ধরেই সোজা সোমোরিরি যাওয়ার পক্ষপাতী। তারপর চুমাথাং-এ গিয়ে আমাদের গ্যারেজ করে সেদিনের দায়িত্ব শেষ করবে। সবার প্রথমে যার সঙ্গে যোগাযোগ করে আমি ভ্রমণসুচি বানাই, আমাদের সেই প্রথম পথপ্রদর্শক অমিতের পরামর্শ অনুযায়ী হানলে মানমন্দির (observatory) অবশ্য দর্শনীয়। ড্রাইভার হানলে যাবে না; কিন্তু আমার জেদে ২৯ তারিখে তাংসের অতিথিনিবাস থেকে বেরিয়ে বাড়তি টাকার বিনিময়ে আবার প্যাংগং দেখিয়ে সোমোরিরির পথ ধরতে রাজি হল।

      অবশ্য লেক পর্যন্ত নামিনি। আমার সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক, রূপবান প্যাংগং দিনের বেলা মেঘলা আকাশেও বুঝিয়ে দিল। যত এগোই মনে হয় এখানটা আরো সুন্দর। কতরকম রং আর কী বিশালত্ব! তাও তো পাঁচটি উপহ্রদের চারটেই তিব্বতে। দৈর্ঘ্যের অর্ধেকটা মতো লাদাখে পড়লেও, মোট আয়তনের ৮০ শতাংশই চীনের দখলে। মাত্র ২০ শতাংশ-এর খানিকটা দেখেই মনে হল, “আবার আসিব ফিরে প্যাংগং সোর তীরে, থেকে যাব একটি কুটিরে।” থাকা খাওয়া জনপ্রতি ৩৫০০ টাকা থেকে শুরু। কয়েকটি টেন্ট নীচে একেবারে হ্রদের ধারেও আছে দেখলাম। আবার এলে থাকা যাবে।

     বেঁকে গেলাম চুশুল উপত্যকার দিকে। প্যাংগং চোখের আড়াল হতে আবার ন্যাড়া মেটে কিছুটা বালুময় ভূমি। মাঝেমাঝে ছোট-ছোট তুষারস্পৃষ্ট শৃঙ্গের শোভা। এই রাস্তা দিয়ে সোজা লাদাখের রাজধানী শহর লে-তেও যাওয়া যায়।

 


রেজ়াংলা যুদ্ধ স্মারক বা শয়তান সিং মেমোরিয়াল

চুশুল উপত্যকায় আপাতত গন্ধব্য রেজ়াংলা যুদ্ধ স্মারক (Rezang La War Memorial) যার আরেক নাম ‘শয়তান সিং মেমোরিয়াল’। রিগজ়িনের মুখে বারবার ‘শয়তান সিং মেমোরিয়াল’ নামটা শুনে মনে হচ্ছিল, আবার আরেকটা ‘বাবা মন্দির’ জাতীয় মিথ আধারিত কিছু বুঝি। মনে হল, দেখলেও হয়, না দেখলেও এমন কিছু নয়। কিন্তু ভুলটা অচিরে ভাঙল।

     আমরা জানি কাশ্মীর অশান্ত বলে সেখানে সেনা তৎপরতা বেশি। কিন্তু সেখানে ডাল লেক, শিকারা, বাজার ও প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যে ভরা জনজীবন সম্পৃক্ত এলাকায় থাকার ফলে সেখানে সেনার সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাৎ বিশেষ হয়নি। কার্গিল দ্রাস এইসব যুদ্ধক্ষেত্রগুলোও কাশ্মীর ভ্রমণের সময় কনডাক্টেড ট্যুরের সূচিতে ছিল না। আর আমাদেরও তাগিদ ছিল না, কারণ অমৃতসর স্টেশন পড়ে গিয়ে আমার মায়ের পা ভেঙে যাওয়ায় আলাদা গাড়িতে কোনওমতে দিনগুলো পার করেছিলাম। স্থানীয় বাসিন্দাদের হাবভাব ‘যুদ্ধং দেহী’  ধরণের হলেও স্থানে স্থানে এত ওয়ার মেমোরিয়াল দেখিনি। কিন্তু লাদাখের আগাগোড়াই সেনাকর্মীরাই ‘ফ্রেন্ড-ফিলসফার কাম গাইড’।

    এই সরু মরূসদৃশ উপত্যকারও প্রধান দর্শনীয় রেজ়াংলা ওয়ার মেমোরিয়াল’ (Rezang La War Memorial)। ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধের ইতিহাস বিধৃত এই যুদ্ধ স্মারকেরই আরেক নাম ‘শয়তান সিং মেমোরিয়াল’। রেজ়াংলা হল চুশুল শহর থেকে একটু দূরে ভারতের লাদাখ ও চীন শাসিত পয়াংগং সো-র হ্রদ সমতটের (Spanggur Lake basin) মাঝে ভারত-চীন প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় (Line of Actual Control) অবস্থিত একটি পর্বত পাস। । চুশুলের উচ্চতা ৪৩৩৭ মিটার, যার উত্তরে সুনীল হ্রদ, পূর্ব ও পশ্চিমে পর্বতশ্রেণী, আর দক্ষিণে উপত্যকা যেখানে ভারতীয় বায়ুসেনা ঘাঁটিও আছে। পূর্বদিকে প্যাংগং হ্রদের সমতটে যাওয়ার সংযোগও আছে।  আমরা সম্ভবত সেদিক দিয়েই এসেছি।

       
এসব তথ্য অবশ্য পরে বসানো। তখন যেখানে নামলাম, সেই ঝকঝকে নিঃসঙ্গ সৌধটিকে ধূধূ বন্ধুর শূন্যতায় যেন মরীচিকার মতো লাগল। টিপিকাল আর্মি আতিথেয়তা। তবে অন্যান্য সংগ্রহশালা বা স্মারকের মতো কোনও টিকিট নেই। অফিসার ও জওয়ানরা এমনিই সব ঘুরিয়ে দেখাল ও বোঝাল। এমনকি প্রেক্ষাগৃহে যে চলচ্চিত্র তখন প্রদর্শিত হতে চলছিল, সেখানেও বিনা পয়সায় বসিয়ে দেওয়া হল উপস্থিত সমস্ত পর্যটকদের।

     যুদ্ধের পরিচিত উপকরণ, মডেল ইত্যাদি দেখে তার বিবরণ শোনার তেমন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু শোনার পর আনুভূতি বদলে গেল। ১৯৬২-র ১৮ নভেম্বর চৈনিক সেনা কুমায়ুন রেজিমেন্টের ১৩ নং ব্যাটেলিয়ানের ওপর অপ্রস্তুত অবস্থায় অতর্কিত আক্রমণ করে। তারা অনেক উন্নত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ও সংখ্যায়ও অনেক বেশি। মেজর শয়তান সি-এর নেতৃত্বে অবিশ্বাস্য বীরত্ব ও রণকুশলতার পরিচয় দিয়ে ভারতীয় সৈন্যরা চীনা সৈনিকদের হঠিয়ে তো দেয়, কিন্তু মেজর শয়তান সিং সমেত ১১৪ জন ভারতীয় সৈন্যকে মৃত্যুবরণও করতে হয়। তাঁদের স্মৃতিতে পরে নির্মিত হয়েছে রেজ়াংলার  ‘শয়তান সিং ওয়ার মেমোরিয়াল’।

      শুধু শয়তানের কুমায়ুন বাহিনী নয়, গোর্খা রেজিমেন্টের সেনারাও সাহায্যে এসে অসম সাহসে লড়েছিল। অবিস্মরণীয় অবদান ছিল উৎক্ষেপণ বিভাগের (Artillery Division) সৈন্যদেরও, যাঁদের স্মরণে আরেকটি মেরোরিয়াল আছে অনতিদূরে রেজ়াংলা ও চুশুল গ্রামের মাঝামাঝি এক জায়গায়। আমরা সেখানে আর যাইনি।

      বক্তাদের মুখে ও ছায়াছবিতে বেশ কয়েকটা শিখর বা টপের নাম শুনলাম। কখনও পাহাড় চূড়ায় কখনওবা পাদদেশে সেই তুমুল যুদ্ধের বিবরণ এখন বিশেষ কিছুই মনে নেই, দেওয়ার পরিসরও নেই। কিন্তু দেখতে দেখতে ও শুনতে শুনতে গলা কনকন করছিল, কণ্ঠস্বর বুজে আসছিল, কেমন যেন অপরাধবোধও হচ্ছিল। অনুরূপ আবেগে আক্রান্ত হয়েছিলাম ‘হল অফ ফেম’-এও।

      “আর্মি জয়েন করলো বেটী।” সিয়াচেনের সেই সুবেদারের কথা কি আমার মেয়ে শুনবে নাকি চাইলেই পাওয়া যাবে? আর আমার বাংলা সাহিত্য জগতের সতীর্থ ও সম্পাদকরা জানতে পারলে তো নির্ঘাৎ আমাকে আরও একঘরে করে একেবারে নির্বাসন দেবে। যে উচ্চতায় শ্বাস নেওয়া ভার, যে শৈত্যে সামান্য ঠোকাতেই যন্ত্রণায় নীল হয়ে যেতে হয়, সেখানে বেয়োনেটের খোঁচা কিংবা পাথরে আছড়েও মারতে ও মরতে হয়েছিল। সিয়াচেনের সেই সৈনিকের কথাও মনে পড়ল, “জংগ তো তব হোতা যব উপর সে অর্ডার আতা হ্যায়।”

       এসব জায়গা দেখার অনুমতি সহজলভ্য নয়। জানি না, ট্রাভেল এজেন্ট লাদাখের ইনার লাইন পারমিট করাতে কত নেবে। আমাদের পারমিটের পাশাপাশি শুভঙ্করের বিভাগীয় আইডেন্টিটি কার্ডও কাজে লেগেছে। সুবিশাল এই রাজ্য যে আসলে একটি রণক্ষেত্র, কে জানত? দুটি দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমা থাকায় সেখানে সেনার উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। সবকিছুই বেশ সুশৃঙ্খল, সুছন্দিত। পশ্চিমবঙ্গে সম্ভবত আন্তর্জাতিক সীমার দৈর্ঘ্য আরও বেশি, কিন্তু ঘোষিত রণক্ষেত্র নয়।  

 

সোমোরিরি 

এবার গন্তব্য সোমোরিরি। অমিত ও অনুপমের মতে সোমোরিরি নাকি আয়তনে ক্ষুদ্রতর হলেও প্যাংগং-এর চেয়েও সুন্দরতর। এই পথেও রাস্তার পাশ দিয়ে ছুটন্ত উচ্ছ্বল অগভীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নাম-না-জানা নাদী-নালা-ঝোরা আর মিনিয়েচার বৃক্ষের মিষ্টি নিসর্গ। কিন্তু এমন রাস্তাতেও যানজট। মাহে নামে এক জায়গায় চেকপোস্ট থেকে রাস্তা দুই ভাগ হয়ে গেছে। বাঁ দিকেরটা সোমোরিরি যাবে। বাঁক নিয়ে একটা দোকানে চাওমিন ও চা খেয়ে এবং কিছু চিপস্ কেক ইত্যাদি সঙ্গে নিয়ে আবার ছোটা। সেখানে একটি বাঙালী পরিবারের সঙ্গে আলাপ হল যারা লেকের ধারেই রিসর্টে থাকবে।

       সো-মরিরির পথে রাস্তার ধারে কিছু দূরে কয়েকটা ছো থেকে মাঝারি জলাশয় চোখে পড়ল। তিনটের সামনে মিনিট কয়েক করে দাঁড়ালাম। রিগজ়িন যে নামগুলো বলেছিল তখন কোথায় নোট করে রেখেছিলাম, মনে নেই। বড়ো পুকুর কিংবা দীঘির আকার বিশিষ্ট জলাশয়গুলোর নাম থাকতে পারে, ভাবিওনি। পরে নিজের তোলা ছবি ও গুগুল মানচিত্র দেখে মিলিয়ে নিয়েছি -- মিরপাল সো (Mirpal Tso) বা মিটপাল সো’, ইয়েইয়ে সো (Yeae Tso)কিয়াগার সো (Kyagar Tso)। লেখার সময় আমার সূত্ররা আরও দুটো পাওয়া গেল – ওরডং সো (Ordong Tso) ও ইয়াশু সো (Yashu Tso), কিন্তু এগুলো ঠিক স্মরণ করতে পারছি না; হয়তো পুকুরতুল্য লেগেছিল বলে।

     
        সো-মরিরির উচ্চতা অনেকটা বলে আমাদের প্রাথমিক গাইড অমিত ও প্রধান গাইড অনুপম বলে দিয়েছিল, হ্রদের ধারে খানিকক্ষণ কাটিয়ে নেমে এসে লে-র পথে যেন চুমাথাং-এ থাকি। সেখানকার হোটেল রিসর্টগুলোতে উষ্ণ প্রস্রবণে স্নান ও স্পা করে পথক্লান্তি দূর করার ব্যবস্থা আছে। খুব ভালো। আমাদের বুকিং না থাকলেও পেয়ে যাব আশাকরি। আকাশে বিকেলের আলো আছে যদিও মাঝামাঝে একটু মেঘের আভাস।
 সো-মরিরির উচ্চতা অনেকটা বলে আমাদের প্রাথমিক গাইড অমিত ও প্রধান গাইড অনুপম বলে দিয়েছিল, হ্রদের ধারে খানিকক্ষণ কাটিয়ে নেমে এসে লে-র পথে যেন চুমাথাং-এ থাকি। সেখানকার হোটেল রিসর্টগুলোতে উষ্ণ প্রস্রবণে স্নান ও স্পা করে পথক্লান্তি দূর করার ব্যবস্থা আছে। খুব ভালো। আমাদের বুকিং না থাকলেও পেয়ে যাব আশাকরি। আকাশে বিকেলের আলো আছে যদিও মাঝামাঝে একটু মেঘের আভাস।

      ফেরার পথে একটু এগিয়েই গাড়ি ঝাঁকুনি দিয়ে ক্যাঁচ্‌-ফটাস্‌! রথের চাকায় ফুটো হয়ে গেছে। রিগজ়িন বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনে বোলা কিঁউ উস দিন? দেখিয়ে ওহী হুয়া!” বিশ বছর গাড়ি চালাচ্ছে, প্রথমবার টায়ার পাংচার হল।

       যাব্বাবা! ২৬ জুলাই ভয়ানক এবড়োখেবড়ো খোঁচাখোঁচা পাথুরে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় স্টেপনি আছে কিনা খোঁজ করেছিলাম শুধু, আর চাকা ফাটল ২৯ তারিখে। তাহলে আমার বলার দোষ কোথায়? কিন্তু হাসিখুশি মানুষটার অভিব্যক্তি বদলে গেছে, মৃত প্রাণীর হাড়খানাই বা নিলাম কেন?

     শুভঙ্করও হাত লাগাল। গাড়ি সচল হতে হতে সন্ধে ঘনিয়ে এল। রিগজ়িন মুখে হাসি ফুটিয়েই আমাকে হাতজোড় করল, “ম্যাডাম, আপ অউর কুছ মত বোলিয়ে।”

     পরে অনুপমের কাছে জেনেছি, রিগজ়িন-এর ঐ ক’দিনেই কেন জানি ধারণা হয়েছিল, আমি খুব রাগী ও বাকসিদ্ধা। হাড় দেখে হয়তো তান্ত্রিক-টান্ত্রিকও ভেবে বসেছে। অথচ ভ্রমণসূচি তৈরি, সেই পরিকল্পনা রূপায়নে কিছু তাৎক্ষণিক সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং গাড়ি ও পথ সংক্রান্ত সম্ভাব্য বিপদের কথা ভেবে সতর্ক বার্তা দেওয়া ছাড়া আমি সারাক্ষণ, আমার মেয়ের ভাষায়, পঞ্চাশোর্ধ্ব টিন এজারদের মতো আনন্দোচ্ছ্বাসে ডগমগই ছিলাম। কপাল!

চুমাথাং:

যাইহোক, ফিরে এসে লে-র পথে চুমাথাংএ রাত্রিবাস ও hot spring spa করানোর বাসনায় থেমে দেখি একটাও খোলা নেই। দালাই লামা লেতে বিশেষ পুজো ও যজ্ঞ করতে এসেছেন বলে সবকটি হোটেল মালিক পসারে তালা ঝুলিয়ে পুজো দেখতে চলে গেছে। সবকটি বলতে গোটা ৫-৬ চোখে পড়ল। খোলা ছিল ডিফেন্সের একটা মেস। কিন্তু সেখানে পরিচিত কারও ব্যবস্থাপনা নেই। সুংতরাং রাত, ক্লান্তি, অসুস্থতা, মহিলা নিয়ে ঝুঁকি – কোনও কিছুই আমল পেল না। প্রায়ান্ধকারে বন্ধ হোটেলগুলোর চেহারা দেখে তেমন ভক্তিও হচ্ছিল না। কিন্তু রাতে আশ্রয় দরকার। অগত্যা সন্ধে আটটায় লে অভিমুখে ছোটা। রাস্তায় আলোকিত সেনা কলোনি চোখে পড়লেও শুভঙ্কর থামতে রাজি হল না।

      ড্রাইভার কিছুদূর গিয়ে একটা দুঃস্থ দোকানে হোম-স্টে বলে রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছিল ১০০০ টাকা দরে। জায়গার নাম হিমা। রিগজ়িনের বন্ধুর দোকান বোঝা গেল। ও তো গিয়েই বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর সঙ্গে খোশমেজাজে গল্প জুড়ে দিল। কিন্তু মোমবাতি জ্বালিয়ে বাথরুম যেতে হবে দেখে আমার কান্না পেয়ে গেল। ম্যাগি ও চা খাওয়া হল। ভাগ্যিস সেখানে ঘরের বদলে লে-তে ফেরার সদুপদেশ মিলল। সেই ঘুপচি ঘরের মালিক রিগজ়িন-এর ক্লান্তির অজুহাত সহাস্যে উড়িয়ে দিয়ে ওর টানা ৪৮ ঘণ্টা ট্রাক চালানোর অসীম ক্ষমতার কথা ফাঁস করে দিল।

      আমাদের দু’জনের পোস্ট পেইড ফোনেও টাওয়ার নেই। ওদের ফোন থেকেই শুভঙ্কর লে-তে ওর ডিপার্টমেন্টের ডিএডি মেসের শৈলেনকে ফোন করল। আমাদের লে ফেরার কথা ছিল ৩০ জুলাই। কিন্তু টায়ার পাংচার, রাত্রিবাসের হোটেল না পাওয়া ইত্যাদি দুর্যোগের কারণে একদিন আগেই ফিরতে হচ্ছে। শৈলেন আমাদের লে বিমানবন্দরেও নিতে গিয়েছিল, কিন্তু ফিরে যায় যেহেতু আরসিসি-র ড্রাইভার তার আগেই আমাদের পাকড়াও করে তাদের মেসের গেস্টহাউসে নিয়ে যাবে বলে গাড়িতে বসিয়ে ফেলেছিল। শৈলেন জানাল, ওদের মেসে আমাদের বুক করা ঘর তৈরিই আছে।

      এটা অবশ্য শুভঙ্করের দূরদর্শিতার ফল। শুভানুধ্যায়ীদের আতিশয়াগ্রহে লে-তে দুই জায়গায় বুকিং হয়ে গিয়েছিল। আরসিসি-র অতিথি নিবাসে থাকলেও ডিএডি-র ঘরখানা শুভঙ্কর বাতিল করা হয়নি; ভাড়া সামান্যই বলে আপৎকালীন প্রত্যাবর্তনের কথা ভেবে সাত দিন ধরে বায়না করাই ছিল। অবশ্য রিগজ়িনের বন্ধুর কাছেও কৃতজ্ঞ। সে উপার্জনের সুযোগ ত্যাগ করে ওকে ঠেলা না লাগালে কপালে দুর্ভোগ ছিল।

       বিশেষজ্ঞদের মতে প্যাংগং থেকে সো-মরিরির রাস্তাটা লাদাখের অন্যতম সুন্দর যাত্রাপথ। তার কিছুটা আমরা অবশ্যই দেখেছি, কিন্তু এই কাহিনী লেখার সময় মনে হচ্ছে, অক্সিজেন সিলিন্ডার যখন সঙ্গে ছিলই, তখন চুমাথাং-এর পরিবর্তে সো-মরিরিতেই রাত্রিবাসের পরিকল্পনা করলে ভালো হত, তাহলে লেকের সৌন্দর্য তো দেখা যেতই, হয়তো হানলে গ্রাম হয়েও ঘুরে আসা যেত। হানলে মানমন্দির (observatory) দেখার ইচ্ছা প্রবল হলেও মাত্র ৮ দিনের ভ্রমণসূচিতে শামিল করা যায়নি। ড্রাইভারও রাজি হল না।

       কিন্তু হানলে হয়ে এলেও চুশুল উপত্যকা হয়েই কিছুদূর আসতে হত, আর সম্ভবত মাহে থেকেই সোমোরিরির পথ ধরতে হত। গুগুল মানচিত্র অনুযায়ী প্যংগং থেকে হানলে লাগে ৭ ঘণ্টা ৪২ মিনিট, হানলে থেকে সোমোরিরি ৪ ঘণ্টা ৫ মিনিট। আর প্যাংগং থেকে সরাসরি সো-মরিরি আসতে সাধারণভাবে লাগার কথা ৮ ঘণ্টা ৪২ মিনিট, যে সময়টা মাহের কাছে রাস্তায় যানজটের কারণে অনেক বেশি লেগেছে। সেক্ষেত্রে দেখছি কিয়াগার সো ছাড়া বাকি দুটো হ্রদ দেখা যেত না। একটু ঘুরপথে এলে হানলে থেকে সোমোরিরি এলে পথে পড়ত জোড়া হ্রদ কায়োন সো ১ বা রায়ুল সো (Kyon Tso 1 or Ryul Tso) এবং কায়োন সো ২ বা চিলিং সো (Kyon Tso 2 or Chiling Tso)। কিন্তু সত্যি বলতে প্যাংগং দেখার পর এইসব দীঘি-পুকুরগুলো আর চোখে লাগছিল না। হয়তো সো-মোরিরি ঠিকমতো দেখলে মনেও ধরত। কিন্তু চুমাথাং-এ রাত্রিবাস বলেই গাড়ির চালক হ্রদটির নির্জন কিনারা থেকে ফিরিয়ে আনল, শেষ বিকেলে যা দেখে মন একেবারে ভরল না।

       সময়ের অভাব সব আকাঙ্ক্ষা পূরণ হতে দেয় না। অভিজ্ঞতাও নেই। উপরন্তু সতর্কতা ছিল, সো-মরিরির যা উচ্চতা ও শৈত্য, তাতে সেখানে রাত্রিবাস নিরাপদ নয়।

       যাইহোক, রিগঝ়ং-এর দোস্তরূপী দুশমনের দোকানে পিত্তিরক্ষা করে আমরা মা-মেয়ে তো মাঝের সীটে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। চালকের পাশে বসা পরিবারের জাগ্রত সদস্য তথা অভিভাবক পরে জানালেন, গাড়ির স্পীডোমিটার প্রায়ই ১০০ পেরিয়ে যাচ্ছিল বলে সতর্ক করতে হচ্ছিল। অতঃপর ২৯ তারিখ রাত এগারোটায় লে এসে যেন বাড়ি ফেরার স্বস্তি।


পূর্ববর্তী পর্ব : ৭।। গন্তব্য প্যাংগং                                                    পরবর্তী সংখ্যা : ৯।। লে সার্কিট-২ (ক)


Post a Comment

Previous Post Next Post