সীমান্ত প্রহরায় লাদাখ ।। ৯ ।। লে সার্কিট-২ (ক)

লে সার্কিট-২ (ক)

৩০শে জুলাই ২০২২

 


আমি ছাড়া বাকি দুজনও তো আর কিছু দেখার পরিবর্তে শুতে ইচ্ছুক। কিন্তু স্বস্তিতে জিরোতে দেবার মানুষ আমি? ৩০ জুলাই সারা লাদাখ ভ্রমণের সারথীকে টাকা মেটানোর পালা। তাকে সময়ের আগেই ছুটি দিচ্ছি। তাই বাড়তি দু হাজার টাকার বিনিময়ে তাকে বিকেল ৩টে পর্যন্ত কাছাকাছি কয়েকটা স্পট যেমন সিন্ধুঘাট, শে প্যালেস, থিকসে মনেস্ট্রি, জোহরাওয়ার ফোর্ট ও বাজার বা মল এলাকা ঘোরাতে নিমরাজি করালাম। তবে হেমিস গুম্ফা যাবে না। এগুলোর কয়েকটা এই দিন চুমাথাং থেকে ফেরার পথে দেখানোর কথা ছিল। ড্রাইভারও যে রক্ত-মাংসের মানুষ, রোবট নয়, তারও যে শরীর-অশরীর ক্লান্তি আছে, বেড়ানোর ঝোঁকে পর্যটকরা প্রায়ই ভুলে যায়। আমিও গিয়েছিলাম; এখন লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে। 

 

সিন্ধুঘাট:

.

এদিন সকালে মূল গন্তব্য থিকসে। পথে গাড়ি থামল একটা সুন্দর চত্ত্বর ঘেরা স্থানে। বহতা সিন্ধুনদের দুই ধার বাঁধিয়ে স্নানের ব্যবস্থা। বাঁধানো উঠোনে সামান্য সজ্জা। বিরাট কিছু নয়, কিন্তু খোলামেলা মনুষ্যরচিত ঘাটখানা বেশ ভালো লাগছিল। জুলাই মাসে যেহেতু ঠাণ্ডার নামগন্ধ নেই, অনেকেই স্নান করছিল। বহতা জলে পা ডুবিয়ে ছবি তুলিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল। বুড়োটে দুই সঙ্গীর তাড়ায় ও কাছাকাছি অন্যান্য দর্শনীয়গুলো যাওয়ার তাগাদায় মনোরম পরিবেশে বেশিক্ষণ কাটানো গেল না; ক্যাফেটেরিয়াতে বসাও গেল না। সফটি খেয়ে বাহনে উঠে পড়তে হল।  


শে প্যালেস:

একটু এগিয়ে এবার গাড়ি থামল একটি কাদা-পাথরময় ধূসররঙা প্রাকার ও পাথুরে সিঁড়ির সামনে। এরা এত বিবর্ণ অট্টালিকা বানায় কেন কে জানে? তাও সিঁড়ি-পাহাড় ভেঙে উঠছিলাম। ওপরে পৌঁছে দেখি মূল প্রসাদটি বন্ধ। কারণ সেই দালাইলামা যজ্ঞ। ভাগ্যিস বন্ধ। তবে ৬০ টাকার টিকিট কেটে সেখানকার মন্দিরখানা দেখা গেল। ভারী অদ্ভূত ব্যাপার! যজ্ঞতে মন্দিরের পুরোহিতরা না গিয়ে প্রাসাদের কর্মীরা গেছে? সে যাক গে, সাতদিন ধরে এত বর্ণচ্ছটা দেখার পর মাটি কাদাময় ধূসর প্রাসাদে প্রবেশ করতে না পেরে তেমন হতাশ লাগল না। লে প্রাসাদে গিয়ে তো ঘুমিয়েই পড়েছিলাম।

চড়া রোদে গায়ে শীতবস্ত্র রাখতে কষ্ট হচ্ছিল। নামার সময় দেখলাম কয়েকজন লাদাখি বৃদ্ধা তারই মধ্যে কয়েক প্রস্থ জ্যাকেট-টুপি চাপিয়ে সিঁড়ি ভাঙছেন।


 .

থিকসে মনেস্ট্রি:.


সকালে প্রথমে গেলাম থিকসে মনেস্ট্রি। এই ধূসর সাম্রাজ্যে ভারি ঝলমলে রঙিন এই মঠ। হলুদ-মেরুন-সাদা-কালোর বর্ণবিন্যাস ঘটনাচক্রে আমাদের তিনজনের সেদিনকার পোশাকের সঙ্গেও দারুণ খোলতাই লাগছিল। ৫০ টাকা করে টিকিট।

        আমাদের বাংলার মাতারা আর বৌদ্ধ তারাদেবী – অনুরূপ নন, কিন্তু একজনের আধারেই অন্যজনের অবতারণা। অনেক গবেষকের মতে বৌদ্ধ তারাই বাংলায় কালীর রূপভেদ মাতারা রূপে প্রবর্তিতা। কে কার পূর্ববর্তী সেই আলোচনায় যাচ্ছি না। কিন্তু রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতাবাদ যতই ভুল বোঝাক, একই ধর্মীয় সংস্কৃতির আধারে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের অবিচ্ছেদ্য নাড়ির সম্পর্ক লৌকিক বিশ্বাসে ঠিকই ধরা পড়ে। এই আত্মীয়তার কারণেই মন্দ-ভালো যেমনই হোক, হিন্দু তন্ত্রই রূপ বদলে অনায়াসে ঘাঁটি গেড়েছে বজ্রযান বৌদ্ধধর্মে, স্পিটুক মঠই হিন্দু পরিভাষায় কালীমাতা মন্দির।

        কতগুলো সিঁড়ি ভাঙলাম গুনিনি। তবে পরপর বুদ্ধ মন্দির, মহাকাল মন্দির ও তারা মন্দির দেখে মনে মুগ্ধতার সঙ্গে প্রশান্তিও জাগে। মোটামুটি সবকটি মঠেই দেখলাম মোট তিনজন আরাধ্য – ‘শাক্যমুণি’ বা ‘তথাগত’ বা ‘বুদ্ধ’ হলেন প্রধান, তাঁর সঙ্গে অধিষ্ঠিতা কোনও দেবী – হয় ‘তারা’ নয় ‘কালী’ অথবা দু’জনেই এবং ‘মহাকাল’ যা শিবের অরেক নাম। স্থানে-স্থানে অজস্র সাদা ও কদাচিত হলুদ উত্তরীয়র মতো কাপড় বাঁধা কিংবা ঝোলানো, ভক্তরা হয় মানত করে অথবা মানত পূর্তিতে দান করেছে সম্ভবত। সেগুলোও অন্দরসজ্জাকে যেন আরও খোলতাই করেছে। কাপড়ের এই আস্তরণকে Temple Upholstery বলব কিনা ভাবছি।

        মঠের তারামন্দিরকে তো মন্দিরের পরিবর্তে মূর্তি-ভাস্কর্যের সংগ্রহশালা মনে হল। অন্যগুলোও সৌন্দর্য, পরিচ্ছন্নতা ও চাকচিক্যে হতবাক করার মতো। বাস্তবিকই মানুষের বাক্য সেখানেই কমই ছিল। পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণ ছাড়া হৈচৈ নেই, পাণ্ডার উৎপাত নেই, ভক্তদের ডালা দেওয়া কিংবা পুষ্পাঞ্জলি নিবেদনের হুড়োহুড়ি নেই, মেঝেতে পদদলিত ফুল-বেলপাতা-নৈবেদ্যও নেই। সুদৃশ্য পাত্রে জল হল এখানকার অন্যতম নৈবেদ্য। মজা লাগল বিগ্রহের সামনে ফুল, ফল, জলের পাশাপাশি চকোলেট, বিস্কুট, প্যাকড্ ফলের রস ইত্যাদি নানাবিধ আধুনিক খাদ্য-পানীয়ও নিবেদিত দেখে। হয়তো লামারা পছন্দ করেন। কিন্তু প্রসাদ বলতে শুধু নকুলদানা। 

        দানপাত্র বা বাক্সে সবাই টাকাই দিচ্ছে। আমিও দিলাম তারা মন্দিরে। অনুপম বলেছিল কালীমাতা বা তারাদেবীর মন্দির থেকে কোনও দ্রব্য আশীর্বাদস্বরূপ নিয়ে আসতে। পুজো দিলে প্রসাদ আনতাম। কিন্তু এখান থেকে কী নিয়ে যাব? স্পিটুকে মাথায় আসেনি, কিন্তু থিকসেতে বায়না পেয়ে বসল। আমার ইচ্ছা ব্যক্ত হতে একজন লামা একটা সাদা উত্তরীয় খুলে আমার গলায় পরিয়ে দিল।

        মোটামুটি স্বর্গলাভের হাসি মুখে ঝুলিয়ে নীচে নেমে এলাম। হলুদ কামিজ, সাদা লেগিংসের সঙ্গে সাদা উত্তরীয়টা দারুণ মানাল।

,

 র‍্যাঞ্চো স্কুল:

‘থ্রি ইডিয়েটস্‌ খ্যাত’ Three Idiots Wall ও স্কুলটিও আমাদের সূচিতে ছিল, কিন্তু বন্ধ থাকায় দেখতে হয়নি।             

 অন্যতম দর্শনীয় হেমিস মঠ যেতে রিগজ়িন রাজি হল না। আসল কারণটা দূরত্ব, যদিও ওর যুক্তি ছিল, দালাই লামার আগমন ও যজ্ঞের কারণে সব মঠ ও মন্দিরই নাকি বন্ধ থাকবে। চেমদে মনেস্ট্রির কথা তো কানেই নিল না। আমি সূচিপত্র বের করলেই ও অন্যদিকে তাকায়। কী আর করি? ক্লান্তও লাগছিল। যাতায়াতের পথে বহুআলোচিত যজ্ঞস্থলটাও চোখে পড়ল; তবে জনসমাগম দেখেই পেরিয়ে গেলাম, নামা হল না।

        আসলে শুভঙ্করের লাদাখ-বিশেষজ্ঞ সহকর্মীবৃন্দ ও একটি পর্যটন সংস্থার ইটিরানারি মিলিয়ে দেখেছি লে সার্কিটে আরও কয়েকটি দ্রষ্টব্য আছে। হাতে ৩ দিন রাখলে মোটামুটি সবকটা ছোঁয়া যায়। লে প্রাসাদে গিয়ে আবার ঐ রাজবংশের স্থানান্তরিত নতুনতর ও বৃহত্তর আরেকটি প্রাসাদ ‘স্তোক গুম্ফা’র সন্ধান পাই। কিন্তু বাস্তবে একই দিনে অত ছোটাছুটি করতে শরীর, সময়, বাড়ির মানুষ, গাড়ির চালক – কেউই অনুমতি দিতে চাইল না। অমিত অনুপমরা বাইক চালিয়ে লাদাখ চষে বেড়ানো ছেলে। ওদের সঙ্গে আমাদের মতো নিড়বিড়ে মা-মেয়ে তো কোন ছার, ওদের সংসারী স্যরেরও কি তুলনা চলে?

        ডিএডি গেস্টহাউসে ফিরে রিগজ়িন-কে মোট ৪৮০০০ টাকা মিটিয়ে দিলাম। ওর সঙ্গে ৪৫,০০০ টাকায় চুক্তি হয়েছিল। সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া তো এমনিই ছিল। দ্বিতীয়বার প্যাংগং-এর রাস্তা ধরা ও কথা রেখে উদ্বৃত্ত সময় আমাদের খানিকটা ঘোরানোর জন্য মোট ৩০০০ টাকা বাড়তি দিলাম। ও বেশ হৃষ্ট হয়ে আমাদের পুনরায় লাদাখ আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে এবং পুনরায় ঘোরানোর প্রতিশ্রতি দিয়ে চলে গেল।









Post a Comment

Previous Post Next Post