গ্রন্থালোচনা : উৎসব (শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়) : অর্কপ্রভ সান্যাল

 

উৎসব (গল্প সংকলন) ।। শ্রীপর্ণা বন্দোপাধ্যায় ।। প্রকাশক : পত্রপাঠ প্রকাশনী ।। মুদ্রিত মূল্য : ২৩৫.০০

আলোচক : অর্কপ্রভ সান্যাল

প্রাপ্তিস্থান : পত্রপাঠ বিপণি ।। ব্লক: ২, স্টল: ২৭, সূর্য সেন স্ট্রিট, কলেজ স্কয়ার, কলকাতা – ৭০০০০১২

অনলাইন স্টোর : https://patrapath.com/product/utsab/ ; হোয়াটস্যাপ : 7043099768

 


এই নিয়ে পরপর কয়েকটি বই পড়লাম শ্রীপর্ণা বন্দোপাধ্যায়ের। প্রবাসে বিশেষ করে যেখানে জীবনের ঝুঁকি প্রতি মুহূর্তে, সেখানে দেশের মাটির এই গন্ধটা নিজেকে ভুলিয়ে রাখার অন্যতম অবলম্বন। প্রবাস বলতে ভারতের পশ্চিম সীমান্তে ভিনরাজ্য, দেশের মাটি বলতে পশ্চিমবঙ্গ, আর জীবনের ঝুঁকি বলতে কী, সেটা নাই বা বললাম। আসানসোলে ইংরেজি মাধ্যমে পড়লেও ও পরে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো হলেও বাংলা সাহিত্যের রুচি খুব ছোট থেকেই তৈরি হয়েছে পারিবারিক কারণে। দেশ, আনন্দমেলা, শুকতারা নিয়মিত আসত। পুজোর আগে শারদীয়ায় ঘর ভরে যেত। ইদানিং বাজার চলতি বইগুলো দু একটা বাদে অধিকাংশ আমাকে বাংলা বই বিমুখ করে তুলেছিল। এই সময় হঠাৎই হাতে পেলাম শ্রীপর্ণা বন্দোপাধ্যায়ের "আগাছা", "অণু-কল্প" ও "বাঘের মাসি"-র মতো বইগুলো। লেখিকা স্মরণ করতে না পারলেও বইগুলো তাঁর হাত থেকেই অটোগ্রাফ সমেত সংগ্রহ করেছিলাম বছর চারেক আগে। নিজের বই নিজেই তুলে দিতে চাইছেন দেখে কথা রেখেই নিয়েছিলাম সেগুলো। পয়সা নষ্ট ভেবে পাতা ওল্টাতে গিয়ে দেখি পরতে পরতে বিস্ময়। মুগ্ধতায় ছাড়তে পারছি না। পরে Amazon থেকে কিনি "ছুটি" বইটি। ছুটিও অসামান্য যদিও "আগাছা" উচ্চতায় আরও অতুলনীয়। স্বয়ং সাহিত্যিক তপন বন্দোপাধ্যায় নিজের ভূমিকায় উচ্ছ্বসিত মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। লেখিকার প্রতি কৌতুহল ও আস্থা দুটোই বাড়তে থাকে। গতবছর কলকাতা বইমেলা থেকে অন্য কিছু বইয়ের সঙ্গে নিই "ইচ্ছামণি" উপন্যাস। আর এবার নিলাম "দাগমোচন ও অন্ধকার আলো" (উপন্যাস) এবং "উৎসব" (ছোটগল্প)। উপন্যাসগুলিও যথেষ্ট ভালো হলেও এখনো পর্যন্ত শ্রীপর্ণা দেবীর ছোটগল্পগুলোই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার কথা। "উৎসব" যথারীতি ব্যতিক্রম নয়। জানি না, বইটির বাজার কেমন। আলোচনা তো দেখিনি। তাই নিজের পাঠ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছি। group admin post approve করলে পাঁচজনের কাছে পৌঁছানো যাবে।

 

"ওঁ গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরি সরস্বতি ..."

 

এভাবেই আরম্ভ হয়েছে গ্রন্থটির প্রথম তথা নামগল্প উৎসব। মন্ত্রটি শ্রাদ্ধের। কেন্দ্রীয় চরিত্র মালার নানা আধিব্যধিতে অথর্ব ও প্রায় অন্ধ হয়ে যাওয়া খিটখিটে বাবার সঙ্গে ও তাঁকে কেন্দ্র করে মায়ের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া দিয়ে গল্পের সূত্রপাত। অত্যন্ত বাস্তব কিন্তু সরস ও গতিশীল এই কলহ, যদিও তার নেপথ্যে করুণ সুরটি চিনে নিতে অসুবিধা হয় না। ধীরে ধীরে বৃদ্ধ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মেয়ের বাড়িতে মেয়ের বিরক্তিভরা কর্তব্য, স্ত্রীর নিরলস সেবা ও জামাইয়ের যথাসাধ্য চেষ্টার শেষ মুহূর্তের সম্বল করে। মেয়ে সব কর্তব্য করেও মা বাবা আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখরা ঝগরুটে যার জন্য নাকি সবার সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। অথচ সারাজীবন ভাইবোনেদের জন্য আত্মত্যাগ করেও দুই স্বামী স্ত্রী তাদের অবহেলা ও দোষারোপের শিকার। একটা অত্যন্ত জটিল কিন্তু ততোধিক বাস্তব পরিস্থিতিকে ছোটগল্পের অংশবিশেষে তুলে ধরার অবিশ্বাস্য যে কাজটি করেছেন শ্রীপর্ণা অতি দক্ষতার সঙ্গে, সেই ছবি অনেক নামজাদা লেখক উপন্যাসের মাধ্যমেও তুলে ধরতে ব্যর্থ হন। কিন্তু এ তো গল্পের প্রথমাংশ। এরপর শুরু হল মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বাড়িতে 'অতিথি' সমাগম ও তাদের মধ্যেকার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার উপস্থাপনা, যার মধ্যে সুতীব্র সাটায়ারে নগ্ন করে দেন আমাদের সমাজের এঁটে রাখা মানবতার মুখোশ। বিশেষ করে উচ্চবিত্ত ছোটবোনের সঙ্গে টানাপোড়েনের পর্বটি যেখানে মা যেকোনও প্রশ্নেই ছোট মেয়ের পক্ষ অবলম্বন করেন। সেটা ঠিক না ভুল, তা পাঠকের বিচারের ওপর ছেড়ে লেখিকা নিজেও সরাসরি কিছু বলেননি, আমিও বলছি না। গল্পটি এখানে শেষ হলে সেটা আর পাঁচজন বাজারি লেখকের গল্প হত, শ্রীপর্ণার সিগনেচার থাকত না। তাই এমন চেনাজানা পরিস্থিতিতেই গল্পটির শেষে থাকে সমাজের আচারনীতির গালে সপাটে থাপ্পড়। যেহেতু বইটি সবে ২০২৩ বইমেলায় বাজারে এসেছে, তাই সেই থাপ্পড় বা ক্লাইম্যাক্সটা এখানে ভাঙলাম না। রসজ্ঞ পাঠক নিজেরাই আবিষ্কার করুন।

খুব সম্ভব নবকল্লোল বা সাপ্তাহিক বর্তমানে পড়েছিলাম গল্পটি। বেশ বড় গল্প, দেশ পত্রিকার জন্য উপযুক্ত ছিল। তবে সেখানে প্রকাশিত নয় বলেই মনে হয়। উনি নিজের অন্যান্য বইয়ের মতো পত্রিকার নাম ও প্রকাশ কাল কেন উল্লেখ করেননি জানি না। কেন জানি পড়ে মনে হল গল্পটা ওনার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। তাই হয়ে থাকলে নিজেদের এমনকি নিজেকেও নগ্ন করে তিরস্কারের সৎসাহস লেখিকার আছে। বইটির ভূমিকায় অবশ্য "বাবাকে উপসর্গ করা কতটা যন্ত্রণার" বলে সেই ইঙ্গিত দিয়েওছেন। অবশ্য যে গল্পই পড়ুন মনে হবে সব লেখিকা চাক্ষুষ করেছেন, নাহলে এমন অন্তরঙ্গ ডিটেইলিং অসম্ভব।

চলে আসি পরের গল্পগুলোতে। প্রথমটা পড়লে পরেরটা যে প্রত্যাশা জাগায়, অধিকাংশ লেখক তার সঙ্গে সুবিচার করতে পারেন না। বইটির পরিচয়ে প্রচ্ছদের ব্লার্বে লেখা আছে "একটি সংকলনের সবকটি গল্প ভালো হতে পারে না সেই ধারণা ভেঙে যাবে"। জানি না কথাটা কার লেখা, তবে একটুও অতিকথন নয়। যথার্থই একের পর এক বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়।

দ্বিতীয় গল্প "ঘূর্ণাবর্ত"র পটভূমি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। একটি প্রেমের গল্প যার পরিণতি...। থাক বলছি না। বইয়ে দেওয়া পরিচিতি থেকে জানা যায় শ্রীপর্ণা দেবী নিজে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছেন। তাই গোলাপবাগ তারাবাগের ছবি নিপুণ ভাবে তুলে ধরবেন, এতে আর আশ্চর্য কী? কিন্তু আশ্চর্য আছে গল্পের বুনন ও বিস্তারে এবং অবশ্যই পরিণতিতে। গল্পের সময়কাল নিজের সময়কার নয়, পরবর্তী প্রজন্মের বলে পাঠক নিজেদের চারপাশকে বেশ রিলেট করতে পারবেন। রাজনীতির একটা বড় ভূমিকা আছে যদিও তার প্রতি কটাক্ষ খুব সূক্ষ্ম। রাজনৈতিক কারণে বর্তমান প্রজন্মের দিকভ্রষ্ট হওয়ার ইঙ্গিত থাকলেও স্থূলভাবে সরাসরি তার নিন্দা নেই। যেটা আছে তা বুকে দোলা লাগানো রোমান্স, বুকে মোচড় দেওয়া বাঁক ও সবশেষে বুকে ধাক্কা মারা চমক। "... আজাদিটাই আসল?" প্রশ্নে প্রেমিক ও তার রাজনীতি দুটোরই মুখোশ ফালাফালা হয়ে যায়। ও হেনরি গল্পে চমকের জন্য, মোপাসাঁ বাস্তবসম্মত ডিটেইলিং-এর জন্য পৃথিবী বিখ্যাত, কারণ পৃথিবী শ্রীপর্ণা বন্দোপাধ্যায়ের গল্প পড়েনি। পৃথিবী কেন, বাংলার পাঠকই বা কজন পড়েছেন কিছু অতিপ্রচারিত অতিআলোকিত মধ্যমমানের লেখার ভিড়ে? শ্রীপর্ণার ভাষার মহিমা উদ্ধৃত না করলে বোঝানো যাবে না যেটা তপন বন্দোপাধ্যায় নিজের লেখা আগাছার ভূমিকায় করেছিলেন। কিন্তু সেটা করতে হলে কোনটা ছেড়ে কোনটা তুলে ধরি ভেবে পাচ্ছি না। তাই এই স্বল্প পরিসরে উদ্ধৃতি দিলাম না। এই গল্পটিরও শেষটা বললাম না একই কারণে। বইটি নবজাতক।

অল্পবয়সী প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্ক নিয়ে আরেকটি গল্প "বিজয়া" আছে বইটির শেষের দিকে। মার্জিত ভাষা ও বর্ণনায় এখনকার খুল্লামখুল্লা যুগের ছেলেমেয়েদের উদ্দাম প্রেমকে ধরা অত্যন্ত মুশকিল। কিন্তু সেই মুশকিল শ্রীপর্ণার কলম সহজেই আসান করে দিয়েছে। প্রেমিকের আচরণেও অস্বস্তি নিয়েই সায় দিয়ে চলা মেয়েটি শেষ পর্যন্ত যে স্বার্থপরতার সম্মুখীন হল, সেটাও গল্পের একটা সার্থক শেষ হতে পারত। কিন্তু গল্পটা যে শ্রীপর্ণার। তাই এরপরেও অবাঞ্ছিত দিক থেকে আসা স্নেহ ভালোবাসার স্পর্শমাখা একটি মাত্র ছোট্ট সংলাপ নায়িকা কুঁড়ির মতো আমাদেরও এলোমেলো করে দেয়।

যেহেতু প্রধান চরিত্রগুলো প্রায় সমবয়সী, এবং দুটোতেই প্রেমের সম্পর্কে এক রকম অন্তঃসারশূন্যতা ধরা পড়ে, তাই 'ঘূর্ণাবর্ত'র পরেই 'বিজয়া'র কথা পাড়তে হল। নতুবা দুটির পরিবেশ প্রেক্ষিত পরিণতি সবই আলাদা। বিজয়া গল্পটি শ্রীপর্ণা বন্দোপাধ্যায়ের নামে নেটে সার্চ দিলেই পাওয়া যাবে, কারণ এটা 'উনিশ কুড়ি' অনলাইন পত্রিকায় বেরিয়েছিল। বইয়ে উল্লেখ করতে ভুলে গেছেন।

'সভাঘরে' গল্পটি একজন নারী সাহিত্যককে যে সাংসারিক পিছুটান নিয়ে কাজ করতে হয়, তার বাস্তবচিত চিত্রায়ণ। যারা সাহিত্য সভায় যান, তারা নিজেদের দর্পণের সামনে দেখবেন।

'বিনিময়' হল শ্রীকৃষ্ণের জন্ম বৃত্তান্তের পৌরাণিক প্রেক্ষাপটে লেখা গল্প। তবে যে শিশুর জন্ম ঘিরে গল্পের বিস্তার, সে কৃষ্ণ নয়, তার জীবন রক্ষাকারিণী মহামায়া বা যোগমায়া। অতুলনীয় মানানসই ভাষা। দুর্যোগের রাতে যশোদার সন্তান প্রসবের ও নন্দ গোপের অসহায় অবস্থার অনুপুঙ্খ বর্ণনা নারী গল্পকার বলেই এমন নিবিড়ভাবে দিতে পেরেছেন। সঙ্গে আছে নন্দের দ্বিতীয় পত্নী রোহিণীর সারোগেট মাতৃত্বের অজানা কাহিনী যা থেকে বলরামের জন্ম। যশোদার নিজের সন্তানকে যে কৃষ্ণের প্রাণ বাঁচাতে ঘাতকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল, তা সবার জানা। কিন্তু নন্দ কেন কী পরিস্থিতিতে নিজের কন্যার সঙ্গে অনাত্মীয় পুত্রকে বিনিময় করলেন, সেই কল্পিত টানাপোড়েন তুলে ধরেছেন শ্রীপর্ণা, যা থেকে উঠে আসে পিতৃতন্ত্রের প্রতি সূক্ষ্ম প্রশ্ন।

'শ্রীক্ষেত্রে' গল্পটা আনন্দবাজার রবিবাসরীয়তে পড়েছিলাম। তখন একটু জাম্পকাট লেগেছিল। বই পড়ে প্রতিটি মুহূর্ত টানটান উত্তেজনার সঙ্গে শেষে দারুণ স্বস্তি অনুভব করলাম। আর ডিটেইলিং। উনি কি পুরীর রাস্তাঘাটও চষে ফেলেছেন?

'বিপক্ষ' গল্পটি ক্রিকেট আশ্রিত। প্রথমেই লেখিকার টেকনিক্যাল নলেজ ও তার উপস্থাপনার মুন্সিয়ানার প্রশংসা করতে হয়। ভাগ্য বিড়ম্বিত এক ক্রিকেটার কীভাবে বারবার ষড়যন্ত্র ও ভাগ্য বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে, তার বাস্তবচিত গল্প। খেলা কেন্দ্রিক হলেও জীবনের অন্যান্য আবশ্যিক দিক যেমন পড়াশুনো, জীবিকা নির্বাহের লড়াই ইত্যাদির টানাপোড়েনও আছে। ক্রিকেট নির্ভর আরেকটি গল্প 'ক্লাবহাউসের টিকিট' এক অবসরপ্রাপ্ত আম্পায়ারের জীবন নিয়ে। ক্রিকেটীয় জ্ঞান ও ডিটেইলিং-এ অনবদ্য হলেও এই গল্পটি 'বিপক্ষ'এর তুলনায় একটু পিছিয়ে।

আমি যেহেতু শ্রীপর্ণা বন্দোপাধ্যায়ের এই নিয়ে ছোটগল্প অণুগল্প মিলিয়ে চতুর্থ গল্পের বই পড়ছি, তাই তাঁর ক্রীড়াকেন্দ্রিক গল্পগুলো নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা করতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু পরিসর কম। শুধু বলি, পড়তে পড়তে মতি নন্দীর তুলনা মনে আসছিল যদিও শ্রীপর্ণার লেখা একেবারেই স্বতন্ত্র।

পরপর 'পুজোর বোনাস' 'বেতন' দুটোতেই বাড়ির কাজের মেয়ে বা মহিলার পুজো কাটানোর কথা আছে। পুজোর বোনাস অনন্য তার ন্যারেশন ও পরিণতিতে, আর 'বেতন' তো অন্য মাত্রার গল্প।করোনা কালের সমাজ ও তার দ্বারা প্রভাবিত অন্তজ মানুষের কাহিনী। তবে এর শেষে যেভাবে রহস্যাবৃত নাড়া দিয়েছেন, তার বিন্দুমাত্র আভাস গল্পের কোথাও পাওয়া যায়নি, শেষে শুধু স্তম্ভিত হতে হয়।

'ঘোষণা' একটি ঐতিহাসিক রাজকাহিনী। কাশ্মীরের পটভূমি। মূল চরিত্র চরিত্র কাল্পনিক হলেও গল্পের শেষে তথ্যসূত্র নির্দেশ আছে যা থেকে বোঝা যায় রীতিমত পড়াশুনো করে লিখেছেন। এর বিষয়ে বলতে গেলে এখানে স্থান সংকুলান হবে না। একটা উপন্যাস লিখতে পারতেন অনায়াসে, বরং এত বিশাল পটকথা ছোটগল্পে ধরাই কষ্টকর। সেই কঠিন কাজটিও রসোত্তীর্ণ। দুর্দান্ত নাটকীয় চমক দিয়ে শেষ। এক কথায় অনবদ্য ও সিনেমার পক্ষে আদর্শ। অবশ্য সংকলনের সবকটি গল্প নিয়েই সিনেমা নাটক হতে পারে।

'উৎসব' নামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে পরপর গল্পগুলো সাজানোর মধ্যেও একটা চিন্তা ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। 'ফেরা' গল্পটি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের আসল রহস্য ফাঁস করে দিয়েছে প্রচলিত আহা উহুকে উড়িয়ে দিয়ে।

ব্যবচ্ছেদ একটি ব্যর্থ প্রেমের সিম্বলিক আখ্যান। ভাষা দিয়ে যে এমন কারুকাজ সম্ভব, ব্যবচ্ছেদ না পড়লে জানা যেত না। "সেই সন্ন্যাসিনী ছিল অনেক বেশি উর্বরা যার সঙ্গে এক বাউল ঘর বাঁধতে চেয়েছিল"। যে আর্তি যে আর্তনাদ কাব্যিক গদ্যে তুলে ধরেছেন, তা নিজের ব্যক্তিগত হওয়া স্বাভাবিক। অনুমান সত্যি কিনা জানি না, তবে অধিকাংশই চিরকালীন উদ্ধৃতি করে রাখা যায়।

শেষ গল্প 'হোলি'তেও নিজের লেখার যাদুময় স্পর্শ ও চমক অব্যাহত। বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের একাকীত্ব নিয়ে অনেক গল্প আছে। কিন্তু "হোলি"-র মতো এমন মর্মভেদী আরেকটাও পড়িনি। গল্পটা এয়ারলাইনস ও আমেরিকার সময় নিয়ে রিসার্চ করে লেখা বুঝতে পারা যায়।

প্রতিটি গল্পই একরকম হতবাক করে দেয়। তবে বইটির প্রচ্ছদ থেকে সেই বার্তা সঠিক পাওয়া যায় না, যদিও বেশ উজ্জ্বল দৃষ্টিনন্দন কালার কম্বিনেশন। বইটা পড়লে প্রচ্ছদের তাৎপর্য নিয়ে ভাবনা জাগতে পারে, কিন্তু প্রচ্ছদ দেখলে বিষয়বস্তুর প্রতি কৌতুহল জাগবে কিনা প্রশ্ন। তবে পাতার মান, ছাপা, বাঁধাই সবই অতি উন্নত মানের।

আর একটা প্রশ্ন আবার রাখছি: শ্রীপর্ণা বন্দোপাধ্যায়ের অন্যান্য গল্প ও অণুগল্পের বইয়ে যেমন দেখেছি প্রতিটি গল্পের শেষে প্রকাশের স্থান-কাল উল্লেখ থাকে এই বইটিতে কেন নেই? কয়েকটি গল্প আনন্দবাজার, নবকল্লোল ইত্যাদি বাণিজ্যিক পত্রিকাতেও পড়েছি বলে আবছা মনে আছে। বাকি গল্পগুল্পো কি তাহলে অপ্রকাশিত ছিল? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে বাংলা সাহিত্যের জগতে চরম দুর্দিন। গোষ্ঠীবাজির দৌলতে আমরা পত্র পত্রিকার মারফত অখাদ্য গেলানো চলছে, আর এমন সমৃদ্ধ গল্পগুলোর স্থান হয় না!

 

বিঃ দ্রঃ গল্পগুলি সবকটিই প্রকাশিত কোনও না কোনও পত্রপত্রিকায়। পরবর্তী মূদ্রণে উল্লিখিত হবে। নীচে প্রকাশ স্থান ও কাল দেওয়া হল:

Post a Comment

Previous Post Next Post