প্রবন্ধ
বাংলা নববর্ষের পিতৃত্ব সংকট
বাংলাসহ ভারতের বিভিন্ন অংশে
প্রচলিত পঞ্জিকা অনুযায়ী বর্ষারম্ভ বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটি থেকে। ভারতের অন্যত্র ‘হিন্দু নববর্ষ’ শুরু হয় চৈত্র মাসের প্রথম দিন
থেকে। মাসের গণনা চান্দ্রকলা অনুসারে হলেও, বছরের গণনা করা হয় সূর্যের পরিক্রমা
অনুযায়ী। চান্দ্র ও সৌর গণনার ভারসাম্য বজায় অত্যন্ত উন্নত মানের ক্যালেন্ডার
প্রাচীন কাল থেকেই উত্তর ও দক্ষিণ ভারত, বাংলাসহ উত্তরপূর্ব ভারত, নেপাল ও
পরবর্তীতে বহির্ভারতেও বিভিন্ন এশীয় দেশে প্রচলিত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন প্রাচীন বৈদিক
শাস্ত্রে বছরের যে গণনা পাওয়া যায়, তা আধুনিক আন্তর্জাতিক গ্রেগরিয়ান
ক্যালেন্ডারের সঙ্গে প্রায় পুরোটাই মিলে যায়:[১][২]
সূর্য সিদ্ধান্ত: ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা,
১২ মিনিট, ৩৬.৫৬ সেকেন্ড;
পৌলিকা সিদ্ধান্ত: ৩৫৬ দিন, ৬
ঘণ্টা, ১২ মিনিট, ৩৬ সেকেন্ড;
পরাসর সিদ্ধান্ত: ৩৬৫ দিন, ৬ ঘণ্টা, ১২ মিনিত, ৩১.৫০ সেকেন্ড;
আর্য সিন্দান্ত: ৩৫৬ দিন, ৬ ঘণ্টা,
১২ মিনিট, ৩০.৮৪ সেকেন্ড
লঘু আর্য সিন্ধান্ত: ৩৫৬ দিন, ৬
ঘণ্টা, ১২ মিনিট, ৩০ সেকেন্ড;
সিন্ধান্ত শিরোমণি: ৩৫৬ দিন, ৬
ঘণ্টা, ১২ মিনিট, ৯ সেকেন্ড।
এই শাস্ত্রগুলির বিশেষত
সূর্যসিদ্ধান্তের ভিত্তিতে রচিত ভারতীয় পঞ্জিকাগুলি যাদের দুটি বিভাগ লক্ষ্য করা
যায়:
বিক্রম সম্বাত: ৫৭ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে মহারাজ চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য
নিজের নামে এই প্রণয়ন করে ‘বিক্রমী’ বর্ষপঞ্জী এবং শুরু হয় ‘বিক্রমাব্দ’। এটাই
খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দে উত্তর, পশ্চিম, মধ্য, দক্ষিণ ও পূর্বভারতে প্রচলিত ছিল
তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।[৩]
শক সম্বাত: শকাব্দ দু রকম
– প্রাচীন শকাব্দ ও দ্বিতীয় শকাব্দ। প্রথমটি ঠিক কবে থেকে শুরু তার প্রামাণ্য নথি পাওয়া যায়নি, আনুমানিক
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের গোড়া থেকেই চালু ছিল। দ্বিতীয় বা নতুনতর রূপে
শবাব্দের প্রণীত হয় ৭৮ খ্রিস্টাব্দে[৩] যা মূলত শক রাজত্বের সৌজন্যে দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত হয়।
এছাড়া
অনুরূপ বর্ষপঞ্জীর হদিশ মিলেছে ইন্দোনেশিয়া ও অন্যান্য পূর্ব এশীয় দেশে যেখানে
ভারতীয় সভ্যতার বিস্তার হয়েছিল। যেমন –
দক্ষিণ-পুর্ব
এশিয়ার শকাব্দ: ইন্দোনেশিয়ায় হিন্দু ক্যালেন্ডার
হিসাবে শকাব্দ গৃহীত হয় যেদিন ৭৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে আজি শক জাভায় উপনীত হন[৪][৫]। ইন্দোনেশিয়ার
বহু প্রাচীন পুস্তক, প্রস্তরলিপি ইত্যাদিতে এর প্রমাণ আছে[৬][৭]। আঙ্কোর বোরেই
শহরে ৫৩৩ শকাব্দ লেখা শিলালিপি পাওয়া গেছে যা ৬১১ খ্রিস্টাব্দের সমসাময়িক।
ভারতের জাতীয় বর্ষপঞ্জী [Indian National Calendar (modern)] বিভিন্ন আঞ্চলিক
ক্যালেন্ডারগুলোর সমন্বয় বিধান করে রচিত। বিক্রমাব্দ অনুযায়ী বছরের শুরু পয়লা
(পহেলা) চৈত্রে আর শকাব্দ অনুযায়ী বৈশাখে, যেটা দক্ষিণ ভারতের মতো বাংলাতেও
সহস্রাধিক বছর ধরে প্রচলিত।
ঋতু বিন্যাসে এক মাসের হেরফের হলেও
ভারত ব্যাপী হিন্দু পালা-পার্বণগুলোর
তিথি কিন্তু ওলট পালট হয়নি। চৈত্রমাসে বাংলার বাসন্তী পুজো বা অন্নপূর্ণা পুজোর
নবমীতেই সমগ্র উত্তর ভারতে উদযাপিত রামনবমী, বাংলার বৈশাখেই পাঞ্জাবের ‘বৈশাখী’, আমাদের বিজয়া দশমীতেই সর্বভারতীয় ‘দশেরা’। তাছাড়া মকর সংক্রান্তি, রথযাত্রা, শ্রীপঞ্চমী থেকে ফাল্গুণী পূর্ণিমায় দোল ও প্রতিপদে হোলি – গণনায় কোনও বিবাদ নেই।
ইদানিং বুদ্ধিজীবীদের একাংশ যতই
বাঙালী সাংস্কৃতিক উৎসব আর হিন্দু ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে বিবাদ লাগাতে সক্রিয় থাকুক, আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য বা স্বাতন্ত্র্য
সত্ত্বেও যে উৎসবগুলির মধ্যে সর্বভারতীয় নাড়ির বন্ধন অটুট, এই সমাপতনগুলোই তার প্রমাণ।
বঙ্গাব্দের ভিত্তি মূলত সূর্য
সিদ্ধান্ত অনুসারে ভারতীয় সৌরবৎসর।
তামিল নববর্ষ ‘পুথণ্ডু’-র সাথে বাংলা নববর্ষ প্রায় প্রতিবারই
সমাপপিত হয়। তাছাড়া আন্তর্জাতিক গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ১৪ অথবা ১৫ এপ্রিল বাংলা
নববর্ষ যা ভারতের মিথিলা, আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুর, উড়িষ্যার নতুন বছর ছাড়াও
বহির্ভারতে নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডের নতুন বছরের সঙ্গেও মিলে যায়। তবে
স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকে বাংলাদেশের ‘পহেলা বৈশাখ’ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ‘পয়লা বৈশাখ’কে আড়ম্বর ও আন্তর্জাতিক প্রচারে
টেক্কা দিয়ে যাচ্ছে।
আকবরী ফসল-ই-সন বনাম শশাঙ্গের বঙ্গাব্দ:
বেশকিছু বছর ধরে এক আনকরা তত্ত্বের
উদ্ভব হয়েছে – বঙ্গাব্দ নাকি মুঘল বাদশা আকবরের
দান। এক দশক আগেও
কেউ ঘুণাক্ষরে জানত না। তাহলে এই চাঞ্চল্যকর ইতিহাসের সূত্র কী? না ২০০৫-এ
প্রকাশিত স্বয়ং অমর্ত্য সেন প্রণীত একটি বই ‘The
Argumentative Indian’। অমর্ত্য অবশ্য এই তত্ত্বের জনক
নন, প্রবক্তাদের মধ্যে মান্যগণতম। বেশ মনোগ্রাহী তথ্যচিত্র দ্বারা
বাঙালীকে ঝিনুকে করে তত্ত্ব গেলানো শুরু হল। ‘বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা যে
আকবর’, ইতিহাসের এই সামান্য তথ্যটি না জানার জন্য বুদ্ধিজীবীদের খোঁটায় আপামর
বাঙালী সেই তত্ত্বই
মগজস্থ ও পত্রপত্রিকায় কাগজস্থ করতে শুরু করল। বাঙালী এমনিতে পেটরোগা হলেও মোগলাই
খানা ভালোবাসে।
তাই গদগদ চিত্তে ‘মোগলাই বাংলা নববর্ষ’-এর কাঁঠালের আমসত্বকেই পরিপাক করতে
সচেষ্ট হল।
আমি নিজেও
বাদ যাইনি, যদিও লেখার মধ্যে ইতি গজ কেতায়
আসল ইতিহাসটাও আলগা করে জুড়ে আকবর বাদশার সঙ্গে বঙ্গাব্দের ভাব-ভালোবাসার দেখিয়ে
ঠেকজোড়া দিয়েছিলাম।
কিন্তু দেখলাম, আকবরপন্থীদের
গণনা বেশ ভজকট। খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে আকবর নাকি ‘তারিখ-ই-ইলাহী’ নামে একটি সৌর বর্ষপঞ্জী চালু
করেন। কিন্তু তার ভিত্তিবর্ষ ছিল ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ, আকবরের শাসনকালের প্রথম বছর।
অর্থাৎ তারিখ-ই-ইলাহী শুরুই হয় তার ২৯তম বর্ষ থেকে। ওদিকে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ ছিল
৯৬৩ হিজরি। ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দকে নাকি ৯৬৩ বঙ্গাব্দ ধরে, ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গাব্দও
চালু করেন আকবর, যার নামকরণ হয় ‘ফসল-ই-সন’ যার অর্থ ‘ভালো ফসলের বছর’। অর্থাৎ ‘ফসল-ই-সন’ বা বঙ্গাব্দ শুরু হয় তার ৯৬৩ +
২৯ = ৯৯১তম বর্ষ থেকে। চান্দ্রবর্ষ হওয়ায়, হিজরি ততদিনে আবার এক বছর এগিয়ে গেছে।
১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দ ছিল ৯৯২ হিজরি। সুতরাং এই বছর থেকে যুক্ত হল ২৯তম তারিখ-ই-ইলাহী
ও ৯৯১তম বঙ্গাব্দ। কিছু বোঝা গেল?
ব্যাপারটা বোঝার জন্য নানা সূত্র
ঘেঁটে আমি একটা যোগসূত্র মানে ঐ বঙ্গাব্দের সঙ্গে হিজরির ভাবভালোবাসার ফর্মুলা আবিষ্কারের
চেষ্টা করি। মুঘলরা ইসলামিক চান্দ্র মাস অনুযায়ী খাজনা আদায় করত যার সাথে ঋতু ও
মৌসুমি বর্ষণের কোনও সম্পর্ক নেই। ফলে কৃষকদের অসময়ে খাজনা দিতে নাভিশ্বাস উঠে যেত। তাই আকবর চলতি ক্যালেন্ডারের
উন্নতি ঘটানোর আদেশ দেন অর্থমন্ত্রী তোডরমলকে। তোডরমলের সাহায্যে গৌড়রাজ শশাঙ্ক
প্রণীত বাংলা ক্যালেন্ডারেই কিছু রদ বদল করে সৌর ও চান্দ্র গণনার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে
তাতে মুঘল বাদশা জালালুদ্দিন মহম্মদ আকবর ‘ফসল-ই-সন’ নামে মোগলাই শিলমোহর লাগিয়ে দেন। সেই
সময় বাংলা নববর্ষ চালু হয়েছিল ১০ বা ১১ই মার্চ ১৫৮৪ সাল থেকে, যদিও ভিত্তি তারিখ
ছিল ৫ নভেম্বর ১৫৫৬ খ্রীস্টাব্দ বা ৯৬৩ হিজরি সাল, যেদিন আকবর পাণিপথের দ্বিতীয়
যুদ্ধে হিমুকে পরাস্ত করে দিল্লীর তখ্ত নিশ্চিত করেছিলেন। এবার বোঝা গেল? আমি কিন্তু নিজেই বুঝিনি। বোঝার
জন্য যত অনুসন্ধান করি, ততই অভিনবতর ব্যাখ্যার জেরে আরও গুলিয়ে যায়।
এবার আসি সহজ পাটীগণিতে। ২০২০ খ্রিস্টাব্দের প্রথমার্ধ
যদি ১৪২৬ বঙ্গাব্দ হয়, তাহলে বঙ্গাব্দের প্রথম বছর ২০২০ – ১৪২৬ অর্থাৎ ৫৯৪
খ্রিস্টাব্দ হওয়ার কথা।
ষষ্ঠ শতকের শেষ দশকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের
সামন্তরাজা শশাঙ্ক নিজেকে গৌড়বঙ্গের স্বাধীন সার্বভৌম শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। স্বাধীন নৃপতি হিসেবে
নিজের শাসনকালের সূচনাকে স্মরণীয় করে রাখতে সূর্যসিদ্ধান্তভিত্তিক বাংলার নিজস্ব বর্ষপঞ্জী
তথা বঙ্গাব্দের সূচনা করেন। এই ব্যাপারে সুনীলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বঙ্গাব্দের
উৎস কথা’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন, “সৌর বিজ্ঞান ভিত্তিক গাণিতিক হিসাবে ৫৯৪
খ্রিষ্টাব্দের ১২ এপ্রিল, সোমবার, সূর্যোদয় কালই বঙ্গাব্দের আদি বিন্দু।”
ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী শশাঙ্কের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল সে বছরই। অতএব সহজ পাটীগণিত ও প্রামাণ্য
ইতিহাস মেলালে গৌড় রাজ শশাঙ্ককেই বঙ্গাব্দের জনক বলে অনায়াসে সনাক্ত করা যায়।
এখন নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদের অত
মাথা খাটিয়ে বানানো তত্ত্ব কি শুধু দুর্বোধ্য বলেই ফেলে দেব? ঐতিহাসিক সূত্রগুলো কী বলছে?
প্রথমত: ‘আইন-ই-আকবরী’-তে
৩০ পাতা জুড়ে বিশ্বের ও ভারতের বিভিন্ন বর্ষপঞ্জীর কালানুক্রমিক বিবরণ শেষে হয়েছে
তারিখ-ই-ইলাহী দিয়ে; কিন্তু ‘ফসল-ই-সন’ বা ‘বাংলা সন’-এর কোনও উল্লেখ
নেই। আকবর সত্যিই ‘বাংলা সন’ প্রবর্তন করে থাকলে আইন-ই-আকবরীতে তার উল্লেখ থাকত না?
দ্বিতীয়ত:
‘আইন-ই-আকবরী’-তেই স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে আকবর হিজরি সন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না বলেই
‘তারিখ-ই-ইলাহী’র সূচনা করেন। একই সঙ্গে তিনি
যদি সত্যিই ফসল-ই-সন বা বঙ্গাব্দেরও সূচনা করতেন, তাহলে তার ভিত্তিবর্ষ নিজের
প্রবর্তিত তারিখ-ই-ইলাহী-র বদলে
অপছন্দের হিজরি সনের সাথে মেলাতে গেলেন কেন?
তৃতীয়ত: আকবরের
শাসনকালে মোগল সাম্রাজ্যে বাংলা, ইলাহাবাদ, অযোধ্যা, আগ্রা, পাটনা, মূলতান, কাবুল
ইত্যাদি মোট বারোটি সুবা ছিল। তাহলে শুধুমাত্র বাংলার জন্য পৃথক বর্ষপঞ্জী তৈরি
করতে গেলেন কেন?
চতুর্থত: বাংলাকে তখন
কার্যত শাসন করছেন প্রতাপাদিত্য, কেদার রায়ের মত প্রবল পরাক্রান্ত বারভুঁইঞারা।
মুঘগলদের সঙ্গে তাঁদের লাগাতার বিরোধ। মুঘল অধিকৃত বাংলার রাজধানী রাজমহল বঙ্গীয়
রাজনীতির ভরকেন্দ্র যশোহর বা শ্রীপুর থেকে অনেকটাই দূরে। মুঘলদের দৃষ্টিকোণে
বাংলায় তখন জঙ্গলরাজ চলছে। প্রতাপাদিত্য তো বারবার নিজের নামে মুদ্রা পর্যন্ত চালু
করেছিলেন। যেখান থেকে খাজনা আদায়ের নিশ্চয়তাই নেই, সেই বাংলার জন্য আগ্রার বাদশা
এত ঝক্কি কেন নেবেন,?
পঞ্চমত: পাঞ্জাব
থেকে দাক্ষিণাত্য, গুজরাত থেকে অসম, মণিপুর থেকে দাক্ষিণাত্য, মায়ানমার, থাইল্যান্ড,
কম্বোডিয়া হয়ে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যেখানেই ভারতীয় সংস্কৃতি পৌঁছেছে, সব
জায়গাতেই বর্ষ শুরু পয়লা বৈশাখে। বাদশা কি নিজের সাম্রাজ্য বহির্ভূত ঐ সুবিস্তীর্ণ
অঞ্চলেও নিজের ফসল-ই-সন চালু করতে পেরেছিলেন? খুব
কষ্ট কল্পিত ভাবনা নয় কি?
ষষ্ঠত: বঙ্গাব্দের উল্লেখ কিছু
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনেও আছে? নিতীশ
সেনগুপ্তর ‘The Land of
two Rivers’ বইয়ে
উল্লেখ রয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার
ডিহারগ্রাম ও সোনাতপন গ্রামের হাজার বছরেরও প্রাচীন টেরাকোটার শিব মন্দিরের গায়ে
বঙ্গাব্দের কথা খোদিত রয়েছে।
আকবরের তখন
জন্মও হয়নি।
তবে আকবর তারিখ-ই-ইলাহী প্রণয়ন করেছিলেন এটা
ঐতিহাসিক সত্য। ‘আইন-ই-আকবরী’ই তার সাক্ষী। কারণ হিসাবে আকবরের আমলের সরকারি দলিলে
বলা আছে, হিন্দুস্থানের বিস্তীর্ণ
অঞ্চলের বর্ষপঞ্জীগুলোর মধ্যে পুরোপুরি সামঞ্জস্য ছিল না। সেই ব্যবধান ঘোচাতেই
নতুন বর্ষপঞ্জী ‘তারিখ-ই-ইলাহী’র সূচনা হয়। তবে অনেকে
ঐতিহাসিকের মতে ১৫৮২ সালে পোপ অষ্টম গ্রেগরী পূর্বতন জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের
সংস্কার সাধন করে নতুন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করে ইউরোপে বেশ খ্যাতি অর্জন
করেন দেখে নিরক্ষর আকবরেরও ইতিহাসে প্রসিদ্ধিলাভের বাসনা জন্মেছিল। তাই শাসনকালের
তিন দশকের মাথায় গিয়ে হঠাৎ এই সন-তারিখ
সংস্কারের তাগিদ জেগে ওঠে। ফলে মধ্য এশিয়ার সমরকন্দের গুরগানি গণনাপদ্ধতিকে ভিত্তি
করেই আকবরের জ্যোতির্বিদ ফতুল্লাহ শিরাজী তারিখ-ই-ইলাহী বর্ষপঞ্জী তৈরি করেন। সুতরাং
ধরা যেতে পারে, হিজরি গণনার অসুবিধা, প্রচলিত আঞ্চলিক বর্ষপঞ্জিগুলির অমিল ও
খ্যাতির বাসনা – এইসবের মিশ্র
ফলশ্রুতিই হল তারিখ-ই-ইলাহি।
আকবরী বঙ্গাব্দ তত্ত্বের জন্ম:
এখন বঙ্গাব্দের আকবরীয় তত্ত্বটি অমর্ত্য সেন পেলেন কীভাবে? এর উৎস ১৯৬০-এর দশকের পাকিস্তান। ভাষা
আন্দোলনে সাফল্যের জেরে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব-পাকিস্তানের
সরকারী ভাষা হিসাবে বাংলা তখন স্বীকৃত। মূলত হিন্দু বাঙালীর রক্ত পিচ্ছিল পথ বেয়েই সেই প্রাপ্তি। ১৯৬৪-তেও তেমনই
এক নারকীয় গণহত্যায় হাজার হাজার বাঙালী হিন্দুর লাশে ছেয়ে গেছে ঢাকা থেকে
নারায়ণগঞ্জ, লুঠপাট হচ্ছে হিন্দুদের
সম্পত্তি।
ঢাকেশ্বরী কটন মিলের মালিক পর্যন্ত পথের ভিখারী। বাঙালী
হিন্দুকে ধনেপ্রাণে উদ্বাস্তু করার পর এবার সাংস্কৃতিকভাবে ছিন্নমূল করার পালা।
কোনও ঐতিহাসিক গবেষণা ছাড়াই ১৯৬৬ সালে ঢাকার বাংলা একাডেমিতে ডঃ মুহাম্মদ
শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ‘পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি’ তার ৪ নং সুপারিশে সিদ্ধান্ত নিল
আকবরই বঙ্গাব্দের প্রবর্তক। এই কমিটির নেতৃত্বে প্রচলিত বাংলা পঞ্জিকায় মাসের
দিনসংখ্যা পাল্টে ও টুকটাক খানিক রদবদল করে তৈরি হল বর্তমান বাংলাদেশের জাতীয়
ক্যালেন্ডার। গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান দেখে নয়, এমনিই ১৪ই এপ্রিল দিনটিকে এই নতুন
বাংলা বর্ষপঞ্জী ‘পহেলা বৈশাখ’ হিসাবে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। কিন্তু পূর্ববঙ্গ পূর্ব-পাকিস্তান
থাকা কালীন এই ক্যালেন্ডার লাগু করার সুযোগ ছিল না।
প্রায় দু’দশক পরে স্বাধীন
বাংলাদেশে ১৯৮৮-তে মহম্মদ এরশাদের প্রধানমন্ত্রীত্বে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষিত
হওয়ার ঠিক পরের বছরই চালু হল এই নতুন জাতীয় ক্যালেন্ডার। ১৪ই এপ্রিলকে বাংলা নববর্ষ হিসাবে
ধরে ছুটির দিন
ঘোষিত হয়।
বাঙালীয়ানা
বজায় রাখতে নববর্ষের দিন পেঁচা ও বাঘের মুখোশ সহকারে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র প্রথা
চালু হল।
এখন পার্বত্য চট্টগ্রামে ঐ সময়ই ত্রিপুরীদের
‘বৈশুক’, মার্মাদের ‘সংগ্রাই’ ও চাকমাদের ‘বিজু’। এগুলোর সম্মিলিত রূপ ‘বৈশাবী’
পালিত হয় চৈত্রের শেষ দিন অর্থাৎ ১৩ই বা ১৪ই এপ্রিল। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটা
ছুটির দিন। সনাতন জ্যোতির্গণনার এই আঞ্চলিক অবশেষগুলোর এখনও ইসলামীকরণ হয়নি, তবে অমর্ত্য সেন বা তাঁর যোগ্য
উত্তরসূরীরা চেষ্টা শুরু করতেই পারেন।
এখনও ভারতে হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী পয়লা
বৈশাখের দিনটি কখনও ১৫ই কখনও ১৪ই এপ্রিলে পড়ে এবং সেভাবেই উদ্যাপিত হয়।
গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে লিপ ইয়ারে ফাল্গুন মাসে বাড়তি একদিন
যোগ করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাডেমির একটি নির্দেশিকাও আছে।
ইসলামের বাঙালিয়ানা
আত্মসাৎ:
দেশভাগের সময় সমগ্র বাংলাকে
পাকিস্তান গ্রাস করতে না পারায় আজকের বাংলাদেশও আসলে খণ্ডিত বাংলা। তবে অখণ্ড তথা
বৃহত্তর বাংলা’র স্বপ্ন এখনও অটুট, যা পূরণের জন্য শুধু পশ্চিমবঙ্গের জমি নয়, দখল করতে হবে সমগ্র বাঙালী
জাতিসত্তাও।
বাংলা ভাষার
আরবীকরণ, আকবরকে বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা
বানানো, খন্ডিত পূর্ববঙ্গের ‘বাংলাদেশ’
নামকরণ, ‘হাজার বছরের বাঙালী’ তত্ত্ব প্রচার, নতুন বাংলা ক্যালেন্ডার প্রণয়ন – এ সবই বাঙালী জাতিসত্তাকে
হাইজ্যাক করার একেকটি মাইলফলক কৌশল।
এই কৌশলগত সাফল্যের জোরেই আজ
পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীও
বিশ্বাস করছে বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা আকবর।
তবে পাকিস্তান আমলে তাড়াহুড়ো করে আকবরকে বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা বানানোর সময়
বোধহয় মুসলমান বঙ্গবাসী ভাবেনি শেষ পর্যন্ত পূর্ব-পাকিস্তান ভেঙে আত্মপ্রকাশ করবে
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ! বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আবহে মুঘল বাদশা আকবর যেন
পাকিস্তানীদেরই নিকটাত্মীয়।
তাই বিগত দু’ দশকে বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা
হিসাবে কখনও ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ’ আলাউদ্দিন হুসেন শাহ কখনও বা মুর্শিদ কুলি খাঁর
নাম উঠে আসছে। ‘সুবে বাংলা’র স্বপ্নদর্শীরা যতদিন না তাদের মনমতো বঙ্গাব্দের জনক
খুঁজে পাচ্ছে, এমন অনেকে খাঁ-ই আসবেন যাবেন; আর প্রকৃত বাঙালীর ভূগোলের মতো
ইতিহাস ভাষা সংস্কৃতিও বেহাত হতে থাকবে।
অবাক লাগে, বাঙালীর ইতিহাস
বেদখলে পশ্চিমবঙ্গের তৎপরতাও কম নয়। পূর্ববঙ্গের অনুসরণে পয়লা বৈশাখের পরিবর্তে ‘পহেলা
বৈশাখ’ লেখা ও প্যাঁচার মুখোশ তথা প্রতীকের ব্যবহার সম্প্রতি (২০২০ থেকে) বিভিন্ন
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এমনকি চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নাচগানের অনুসঙ্গ
হিসাবেও ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখন পয়লা-কে পহেলা বলায় (প্রথম>পহেলা>পয়লা)
কিংবা মালক্ষ্মীর বাহন নিয়ে সমস্যা নেই, কিন্তু এর উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিগ্ধ হওয়ার যথেষ্ট
অবকাশ আছে।
তথ্যসুত্র:
১. https://en.wikipedia.org/wiki/Hindu_calendar
২. Ebenezer Burgess (1989).
P Ganguly, P Sengupta (ed.). Sûrya-Siddhânta: A Text-book of
Hindu Astronomy. Motilal Banarsidass (Reprint), Original: Yale
University Press, American Oriental Society. pp. 26–27. ISBN 978-81-208-0612-2.
৩. Richard Salomon (1998). Indian
Epigraphy: A Guide to the Study of Inscriptions in Sanskrit, Prakrit, and the
other Indo-Aryan Languages. Oxford University Press. pp. 181–183. ISBN 978-0-19-535666-3.
৪. Duncan Graham (2004). The
People Next Door: Understanding Indonesia. University of
Western Australia Press. pp. 16–17. ISBN 978-1-920694-09-8.
৫. J. Gordon Melton
(2011). Religious Celebrations: An Encyclopedia of Holidays, Festivals,
Solemn Observances, and Spiritual Commemorations.
ABC-CLIO. pp. 652–653. ISBN 978-1-59884-205-0.
৬. M. C. Ricklefs;
P. Voorhoeve; Annabel Teh Gallop (2014). Indonesian Manuscripts in Great Britain: A Catalogue of Manuscripts
in Indonesian Languages in British Public Collections.
Yayasan Pustaka Obor Indonesia. pp. 49, 69–73, 81. ISBN 978-979-461-883-7.
৭. J. G. De Casparis
(1978). Indonesian Chronology. BRILL Academic. pp. 15–24. ISBN 90-04-05752-8.
রচিত: ০২.০৪.২০
অনেক বিস্তারিতো তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। উপকৃত হলাম।
ReplyDelete