হাত বদল : শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

নাটক

হাত বদল

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়



 [পুরুলিয়ার নাচনিদের জীবন অবলম্বনে লেখা মূল ছোটগল্পের নাম ছিল “হস্তান্তর” যার নায়িকার নাম ছিল ‘কমলা’। নাটকে নামদুটি যথাক্রমে ‘হাতবদল’ ও ‘ভাবরী’ করা হয়েছে।]


দৃশ্য-১

 

চরিত্র: ভাবরী, ধনা (ধনঞ্জয়), তবলা ও পাখোয়াজ/মৃদঙ্গ বাদক, হারমোনিয়াম বাদক, বাঁশিবাদক, বেহালা বাদক, বিজলি, মাতলা ডোম, পুরুষ-১, পুরুষ-২, পুরুষ-৩, পুরুষ-৪, পুরুষ-৫, জনতা

[মঞ্চের এক আলোকিত প্রান্তে ঝুমুর নাচের জলসা, ভাবরী গাইছে ও নাচছে। ধনা পাখোয়াজ বাজাতে বাজাতে মাঝে মাঝে নাচের বোল বলছে। উপবিষ্ট জনা পনেরো অর্ধবৃত্তাকারে ঘিরে রয়েছে ভাবরীকে। অন্যদিকে প্রায় অন্ধকার। গাছ তলায় কেউ মুড়ি দিয়ে বসে আছে স্থির।]

ভাবরী: ভূবন সুন্দর গোরা, রমনীর মনচোরা,

নিরখিলু সুরধনী কূলে।

হেরি মধুর মূরতি, করজোড়ে রতিপতি

মুরছিত ধরণীর তলে।।

আজানু বাহু ললিত, যেমতি বীর ললিত,

ভূষণের ভূষণ সব অঙ্গ।

জিনি মদনমোহন, গোরা যুগলনয়ন,

তনু নটে মহাভাবতরঙ্গ।।

কলসী ডুবালাম জলে, দেখি গোরা জলে জ্বলে,

হেলালিলে না ছাড়ে কলসী।

গোরা রূপের কী মাধুরী, কী পুরুষ কিবা নারী,

এ জগতে কে না হয় দাসী।।

পুরুষ-১:         আহা! কী শুনালি রে। এ জগতে কে না হয় দাসী। তা গোরা রূপের দাসী হঁইয়ে ধনার পারা কালার সাথে গাঁটছড়া বাঁধলি যে বড?

ভাবরী (হেসে):    কার সাধ্য হেরি তারে নয়ন ফিরায়?

কটাক্ষে সে রমনী-মন মজায়।।

কিশোর বয়সে বাঁশরি বাজায়

শুনি যমুনা উজান যায়।।

নবীন-নীরদ-সুশোভিত কায়

পীত বসনে কত শোভা পায়

মুখে মৃদু হাসি মোহন চূড়া মাথায়

তাঁরে সমরিয়া রাখাল পাগল প্রায়।।

ধনা:  লাও ইবার জবাব দাও

(সমবেত করতালি, উল্লাসধ্বনিঅন্ধকার প্রান্তে বসে থাকা মানুষটির কাতরোক্তি, গোঙানি)

বিজলিবালা:  জল, জল -।

পুরুষ-২:  কী হে রাখোহরি ছাইড়ে দিবে। জবাবটো দিবে লাই?  (গাইবার প্রস্তুতি নেওয়ার ভঙ্গি)

পুরুষ -৩, ৪, ৫:  হঁ হঁ হঁইন যাক।

পুরুষ-১:          উটো তো তুমারই ডিপার্টমেন্ট বটে দিবাকর। উত্তরটো তুমিই দাও ক্যানে।

সমবেত জনতা:  হঁ হঁ হঁইন যাক।

          (আবহে গান চলতে থাকে, অন্যদিকে বিজলিবালার জলের জন্য অস্ফুট কাতরোক্তি)

পুরুষ-২:                   চরণে ভূলোক     করিছে আলোক

                             পাটলি সুখ চায় রে।

                   তাহাতে নূপুর     বাজিছে মধুর

                             দেখি রতি মুরছায় রে।।

                   দেখ তো সুবল ভাই রে

রূপের তুলনা দিব কার রে?

পদাঙ্গুলে যার      নখর সুন্দর

          কী শোভা হয়েছে তার রে।।

মতি যে বসে তায় রে।।

বিজলিবালা:     টুকদু জল দাও না ক্যানে মাগো বাবারা। (দু-একজন উঁকি দেয়, এগিয়ে যায় না)

পুরুষ-২:         রাম রম্ভা তরু     জিনি যুগ্ম উরু

আছে বসনে ঢাকা তায় রে।।

গমন মন্থর         হেরি কবিবর

দেখি মনে লাজ পায় রে।।

কটি দেশে জিনি   শোভিছে কিঙ্কিনী

                   হেরি কেশরী পালায় রে।।

বিজলিবালা:     বড কষ্ট গো – জল – জল – জল

পুরুষ-২:                   জঘন সুন্দর       অতনুর ঘর

                             উপমা দিবার নাই রে।

                   পয়োধর শোভা    অতি মনোলোভা

                   কুচে দেখি         কমল বালিকা

দেখ জলেতে লুকায় রে।।

[বিজলিবালা হেলে পড়ে। একটা গেলগেল কলরবে উপস্থিত জনতা আসর ছেড়ে গাছতলার দিকে ধাবিত হয়। তখনও বিজলির মুখে অস্ফুটে ‘জল জল’]

পুরুষ-১:         কে গেলেক?

পুরুষ-৫:  বিজলি নাচনি। ভিখ মাঙ্গা বটে।

ভাবরী: হেই গো! ই যে বিজলি মাসি! ইখানকে কী কইরছিল? দাঁড়াও বিজলিমাসি জল লিয়ে আইসছি। (ভাবরী ছুটে গিয়ে নিজের ব্যাগ ঘেঁটে বোতল বার করে আনে। বিজলির দেহ ততক্ষণে নিথর)

পুরুষ-৩:  মাতলা ডোমকে খবর দাও হে। উ এইসে মড়া টেইনে লিয়ে যাক।

ভাবরী: শেষ সময়টো তেষ্টা লিয়ে গেইলেক মানুষটো। তখন থিক্যা জল চাইছে, কেউ টুকদু জল দিতে লাইরলেক?

পুরুষ-৪:  পাপের জীবন, এমনটোই হবার ছিল।

ভাবরী: বিজলিমাসি কত সোন্দর দেইখতে ছিল। কত বড় মাইনষে তার নাচ দেইখে শাড়িতে টাকা লাগায়েন দিত। মরার আগে এক ফোঁটা জলও পেইলেক নাই? আমি তো জল জল শুনেই দৌড় লাগায়েনছি। কিন্তুক রাস্তার লোকে তো আগে থাইকতে শুইনছে। উয়ারা কেউ জলটুকু দিলেক নাই?”

ধনা:  খানকির এমনই গতি হয়। ইবার ডোম আইসবেক, খবর করা হইনছে। আমরা ভাইলে কী কইরব? চল।

ভাবরী: খানকি বইলছ কাকে? উ লাচনি ছিলেক। গুণী শিল্পী, আমার পারা। গরমেন্ট চাদর দিলেক, সাট্টিফিকেট দিলেক, পেরাইজে টাকাও দিলেক, দেখো নাই?”

ধনা:  গুণী শিল্পী – ( ভেংচি কাটল ধনঞ্জয়) চল।

ভাবরী:  মাসির কাছকে কত কিছু শিখছি। শেষ সময়টা টুকদু থাইকতে দাও।

পুরুষ-১:           মাগি আর মরার টাইম পেলেক নাই। শালি জলসার মাঝে –মাতলাকে খবর কইরছিস। উ ব্যাটা সূয্যি ডুবার পর পুরা চুর হঁইয়ে থাকে। কাল সকাল তক মড়া ফেইলে রাখা যাবে না। ইঃ ইখানটো গোবর মাটি দিঁই নিকাতে হবেক।

(জনতার গুঞ্জন। দূর থেকে মড়া ঘিরে ডোমের প্রতীক্ষা। মাতলা এসে বিজলিবালার পায়ে আলগোছে দড়ির ফাঁস দিল। তারপর টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলল শ্মশানের কাছে ভাগাড়ে। বিজলির ছেঁড়া বসন রাস্তায় আটকে আটকে লুটিয়ে চলল। মাথার চুল ধূলো ঝাঁটাল। পুঁটলির চাল ছড়িয়ে পড়ল পথে।)

ভাবরী: আহা! অমন কইরে খরখরে মোরামের রাস্তায় টাইনতে আছে?

ধনা:  ইঃ! কত দরদ? অমন কইরে টাইনতে আছে? ন্যাকা! তুর বিজলিমাসি আর ব্যথা পেছে নকি? শুতে চল। কার ভোরে উঠে গাঁয়ে ফিরতে হবে। মেলা কাজ পইড়ে ঘরকে। তুঁই কাম কাজ ফেইলে ইখানে লাইচ কইরছিস। উখানে টুসুর মা আমাদের বাখাইনে ভূত ভাগাইন দিছে।

পুরুষ-৩:  লাচনির লাশ ভাগাড়ের শিয়াল, কুকুর, শকুন খায়।

 (নিজের ভবিতব্য দেখে যেন শিউরে উঠল ভাবরী)

ধনা:  কী দেইখছিস কী? যা, ডুব দিয়ে শুগে যা। আমি আইসছি। [ভাবরী শাড়ি থেকে টাকাগুলো খুলতে লাগল ধনা] কী লুকাছিস দেখি? শালি চোর কুথাকার।

[ভাবরী ব্লাউজের খাঁজে একশো টাকার একটা নোট লুকিয়ে রেখেছিল। ধনা সেখান থেকে বিশ্রী মুখভঙ্গি করে বার করে নিল। গায়ে হাত দিয়ে তল্লাশি করল আরও গুপ্তধনের সন্ধানে]

আহা! (সুর করে) পয়োধর শোভা অতি মনোলোভা/ কুচে দেখি     কমল বালিকা/ দেখ জলেতে লুকায় রে।।

 

দৃশ্য-২

 

চরিত্র:  অতসী, ভাবরী, বিউটি, ধনা, ভাবরীর ছেলে (কানাই) ও মেয়ে (টুসু)

[ধনার বাড়িবিউটি নিজের ছেঁড় জামা সেলাই করতে করতে গুন-গুন করে গান গাইছে। অতসী ধনা আর ভাবরীকে নিয়ে গজগজ করছে। তার ছেলেমেয়েরা পড়ছে।]

বিউটি: মেরে খাবো মে জো আয়ে, আকে মুঝে ছেড় যায়ে, উসে কহো মেরে সামনে তো আয়ে –

অতসী:  হঁইনছে। ফাটা বাঁশের পারা গলা লিয়ে আর গান গাইতে হবেক নাই। কাম কাজ নাই কুছু? বাসনগুলা কি কলতলে পইড়ে থাইকবেক?

বিউটি:  ওগুলান তো মেইঝে ফেলায়েনছি। অখনই উপুড় কিরে এলম উঠানে। ভাইলে দ্যাখো কেনে।

অতসী: এই ছুঁড়ি! খুব চোপা হঁইনছে লয়? মাজা হঁইন গেছে শুধু এইটুকু বইলতে কী হয়? আমাকে ভাইলে দেইখতে শিখাছিস? তা বাসন মাজার পর আর কুনো কাজ নাই? নিজের কাপড়-কানি নিয়ে বইসলি যে? কোন রাজকুমার এইসে তুকে লিয়ে যাবে রে?

বিউটি:  জামাটো ফেঁইসে গেইনছে, দ্যাখো কেনে। টুকদু সিলাই কইরে লি। তারপর তুমার কাজ কইরে দুব। দোফরে টুকদু হোমটাস কইরতে হবে। যা করানোর আগে থাইকতে করায়েঁ লাও।

অতসী:  হোমটাস কইরতে হবে! বিরাট আমার বিদ্যাধরী এলেক গো। করবি তো মায়ের পারা নাংটামি কইরে রোজগার। সব গতরখাগী কামচোরের দল। আমার ঘাড়ে বইসে খেছে। এই তুরা কী শুনছিস? হুস্কুলের হোমটাস সব শেষ?

টুসু:  এই বিউটি তুর কাজ হইলে এই অংকগুলান কইরে দিবি তো। কুছু বুঝতে লাইরছি।

অতসী:  (ঝাঁজিয়ে) অ্যাই! বিউটি কি মাস্টারনি বটে? উয়াকে জিগ্যেস কইরছিস ক্যানে? নিজে না পাইরলে দাদাকে দ্যাখা।

টুসু:  দাদাকে দ্যাখায়েনছি। উ পারে নাই। বিউটি অংকগুলান কইরলে আমি বাকি হোমটাস শ্যাষ কইরে লুব।

অতসী: উ পারে নাই যখন বিকালে মহাদেবের কাছকে যা। বিউটি মাস্টারনি হইলেক কবে থেইকে? অখন কাজের সময়, একদম উয়াকে আলতু ফালতু সময় লষ্ট করাবি না। এই যে মাস্টারনি কয়লা কি আমার বাপ ভাইংবেক? আর মলাগুঁড়ি জইমে আছে কবে থেইকে। গুল দিবেক কে? তুর মা তো লাইচতে গ্যাছে – ধেই ধেই ধেই ধেই। আমার হঁইনছে যত জ্বালা।

ধনা ভাবরীর কাঁধে বেড় দিয়ে গুনগুন করতে করতে দরজায় শেকলের বাড়ি মারলঅতসী দরজা খুলতেই ভাবরীর কাছ থেকে তফাত হল]

অতসী:  দেইখো। কাচা কাপড়গুলান ছুয়াৎ না যায়। আগে গোবর ছুঁয়ে ডুব দিঁয়ে ঘরকে ঢুইকবে। [ভাবরীকে যেন দেখতেই পেল না]

[ভাবরী উঠোনে ঢুকে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অতসী গামছা রেখে যেতে ধনা স্নানের জন্য আড়াল হল। বিউটির প্রবেশ]

বিউটি: মা তুমাকে চানের জল তুলে দিই?

ভাবরী:  প্যাট টো টিসটিস কইরছে। আগে মাঠ থেইকে ঘুইরে আসি।

বিউটি:  এত বেলা হঁইন গেল। অখন মাঠকে যাবে? লোকে ভাইলবেক নাই? চান কইরবে তো? মামা বের হইলে লুকায়ে লুকায়ে চানের আগে উটোও সেইরে লাও ক্যানে?

ভাবরী: কানা গরুর ভিনু বাথান তুঁই জানিস না? [গলা নামিয়ে] তুঁই বুঝি ইয়াদের কলঘরেই কাম সারিস? যাই মাঠ থেইকে ঘুরেই আসি। অখন ডুব দিয়ে লাভ নাই। মাঠ থেইকে ফিরে আবার ডুব দিতে হবে, কাপড় কাইচতে হবে[স্বগতোক্তি] আর আচার বিচার মাইনলেই বা কী? আমরা তো অছুত বটি। দিনে দশবার ডুব দিলেও যে অছুতকে সেই অছুতই থাইকব।

[বিউটি ঘরের দিকে আর ভাবরী বাইরের দিকে প্রস্থান করলধনার প্রবেশ গামছা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে। ]

ধনা:  কৈ গো জল-টল কুছু হবেক নাই নকি? শালা বাইরে তেইতে পুড়ে ঘরকে ফিরে জুড়াবার উপায় নাই।

[অতসীর প্রবেশ। ধনার হাতে তেল, মুড়ি, কাঁচা লংকা, কাঁচা পেঁয়াজ সহ কাঁসি ধরিয়ে দাওয়ার মেঝেতে বাতাসার বাটি রাখল]

অতসী:  টুকদু সবুর সয় না, লয়? তুমি না বিরালে জলখাবার কি কলঘরে লিয়ে যাব? সকাল থেইকে কি বইসে আছি আর তুমার ঐ নবাব নন্দিনী সব কাইজ করছে? উ এখন ঘরের কাইজ ফেইলে হিন্দী সিনিমার গান গায়। আবার টুসুর মাস্টারনি হবার শখ। যে অংক কানাই তক পারে নাই, তা নাকি কমলির বিটি কইরে দিবেক। হুস্কুলের দিদিমণিগুলানও হঁইনছে বদমাসের ধাড়ি। ভদ্রলোকের ব্যাটাবিটিকে ছেইড়ে নাচনির বিটিকে লিয়ে আদিখ্যেতা, উয়াকে বেশি বেশি নম্বর দিয়ে মাথাটি ঘুরায়েন দিছে।

ধনা:  এই শুরু হইল। ঘরকে ফিরতে না ফিরতে। বিউটিকে কি আমি শখ কইরে হুস্কুলে দাখিল করাইনছিলাম? ঐ মাস্টারনির বাচ্চা আমারই ঘরকে এইসে এমন লেকচার দিলেক, আর কমলিকে এমন হাত কইরলেক যে বাইধ্য হলাম স্কুলে দিতে। পেরাইমারিটো পড়ুক, তারপর দাশুর হাতে তুলে দিব। এই আপদ আর রাইখতে লারি। দাশু সর্দার উয়াকে টেরনিং দিয়ে গড়েপিঠে লিবেক। যাও যাও, কলঘরে মানিব্যাগটো ভুইলে রেইখে আসছি। গিয়ে লিয়ে এইসো

[ভাবরীর প্রবেশ]

অতসী:  ওই যে এলেক মহারানী। বলি মহারানী তিন দিন তো খুব আসর মাতায়ে একেবারে বিশ্ব জয় কইরে ফিরলেন, বলি এই দাসীবাঁদির কথা শুনার কি সময় হবেক? এই ভর দিনমানে মাঠ থেইকে ঘুরে আলি, লজ্জা শরম তুর না থাক আমার তো মাথা কাটা যায়। অতখন সময় লাগে বুঝি হাইগতে? অখন ডুব দিতে গিয়ে দোফর পার করিস না যেন। মেলা কাজ আছে কিন্তুক।

 [ভাবরী ত্রস্ত পায়ে কুয়োর আড়ালে চলে যায়। ধনা মুড়ি চিবোতে থাকে। অতসী রান্নাঘরের দিকে প্রস্থান করেফেরে হাতে চায়ের গ্লাস নিয়ে। মেঝেতে নামায়]

ধনা:  তিন দিন তুমার হাতের চা না খেইয়েঁ তেষ্টা মিটে নাই গো টুসুর মা। বলি কানাই আর টুসুর সাড়া শব্দ নাই যে, বাড়িতে নাই নকি?

অতসী:  সবাই আছে। উয়াদের মাস্টারনি পড়ালিখা দেখাইন দিছে না। খানকির বিটি কিনা মালকিনের ব্যাটাবিটিকে টপকায়ে শিক্ষে দিবে! বলি অ্যাই টুসু, অ্যাই কানাই। বাবা তিনদিন পর বাড়ি ফিরলেক, একবার দেখা করতে মন লাগে না? আর অ্যাই বিউটি। তুঁই কুথায় লুকালি? কয়লা ভাইঙতে কি খাদানে সিঁধালি নকি? যতসব কামচোরের ঝাড়।

[স্নান সেরে ভিজে শাড়িতে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে যায় ভাবরী। টুসু কানাই বাবাকে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখতে দেখতে বেরিয়ে এল। ইতস্তত ভঙ্গি।]

কানাই:  টুকদু খেল কইরে লি বাবা?

ধনা:  যাবি? যা।

[ টুসু কানাই যেন মুখিয়ে ছিল। দে ছুট। টুকরো কয়লার ঝুড়ি হাতে ময়লা জামায় বিউটির প্রবেশভাবরীর পুনরায় মঞ্চে শুষ্ক কাপড়ে প্রবেশ। মায়ের দিকে তৃষিত নয়নে তাকায় বিউটি।]

অতসী:  কী রে? মাকে পেথমবার দেইখছিস নকি? যা ঝুড়িটো রেইখে আয়। এসে মা বিটিতে চাট্টি গিলে আমাকে উদ্ধার কর। তারপর সোহাগ কাড়াস। ঢ্যামনামি দেইখলে গাটো জ্বইলে যায়।

[ হাত ধুয়ে বিউটি উঠোনে ছায়া খুঁজে বসে। ভাবরীও বসে তার কাছে। মেয়ের মাথায় হাত দেয়। দুটো কলাই চটা থালায় পান্তা ভাত এনে অতসী দূর থেকে ঠেলে দেয় তাদের দিকে। পান্তার জল ছলকায়। কাঁচালঙ্কা পেঁয়াজ দেয় ছুঁড়ে ছুঁড়ে। মাটিতে পড়ে গেলে কুড়িয়ে পাতে তোলে ভাবরী।]

বিউটি: খাওয়ার পর টুকদু জিরায় লাও মা।

অতসী:  অ্যাই! [হুংকার] ঘরের মালকিন তুই না আমি নকি তুর মা? রাতভর ঢলানি কইরে এসে অখন জিরাবে কিসকে? অ্যাই ভাবরী, খেইতে গিয়ে সূয্যি ডুবাস না যেমন। মুড়ির চাল সিজাতে লাইগবে। দেদার অর্ডার সাপ্লাই দিতে হবেক।

[মা মেয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে খাওয়া শুরু করে]

 

দৃশ্য-৩

[ভাবরীর ঘর]

 

চরিত্র: ধনা, ভাবরী, বিউটি

মা মেয়ে গাইছে।

বিউটি ও ভাবরী:                   হে মা হেমাঙ্গিনী –

তুমি জগতের জননী

মায়ের স্বামী ভোলা মহেশ্বর গো ওগো মা,

মহিমা কে জানে তোর?

তুমি মাগো ত্রিনয়নী –

                             গণেশ কার্ত্তিকের জননী,

                             মায়ের পদতলে মহিষাসুর গো ওগো মা,

                             মহিমা কে জানে তোর?

তুমি মাগো দশভূজা –

ত্রিজগতে করে পূজা

দেখ, অকালে পুজে রঘুবর গো ওগো মা,

মহিমা কে জানে তোর?

অধম পরেশ বলে –

আমায় রেখো মাগো চরণ তলে,

আমায় অন্তিমে দিও ঠহর গো, ওগো মা

মহিমা কে জানে তোর।।

বিউটি: আজ তুমার কাছকে শুই মা? [গলা জড়িয়ে]

ভাবরী: শু না। আজ মনে লয় কেউ ব্যাগড়া দিবেক নাই।

[দরজায় শেকলের আওয়াজ। প্রথমবার আস্তে, ক্রমশ জোরে ও দ্রুতভীত পায়ে ভাবরী দরজা খোলে। ধনা ঢুকে বিছানা থেকে হ্যাঁচকা টানে টুসুকে তোলে]

ধনা:  অ্যাই হারামজাদী, ইখানে কী কইরছিস? যা বিরা। তুর বিছানা কুনটো জানিস না?

ভাবরী: আজ ছাড়ান দাও, দুটি পায়ে পড়ি। আমার শরীল গতিক ভালো লয়। এই দিনগুলাতে অন্তত বিটিটোকে মায়ের কাছকে শুতে দাও।

ধনা: [ভেঙিয়ে] শরীল গতিক ভালো লয়, বিটি মায়ের কাছকে শুবে। শুয়াচ্ছি। অ্যাই শুয়ার! অখনও কী ভাইলছিস। ঘর থিক্যে বিরাতে বইলম না? মুখের কথায় যাবি, নকি পন্‌দে লাথি মেইরে তাড়াব? [বিউটির চুলের মুঠি ধরে দরজার কাছে টেনে নিয়ে যায়]

ভাবরী:  কী কইরছ কী? উয়াকে ছাড়ো। মেইরে ফ্যালাবে নকি মিয়াটোকে? [ধনাকে বাধা দেয়। ধনার ঠেলায় ছিটকে যায়। বিউটিকে বার করে ধনা দরজা দেয়]

ভাবরী: [ডুকরে কেঁদে] প্যাটের ভিতরই মাইরতে চেঁইছিলে, পারো নাই। অখন কি তার শোধ লিছ? ইটো তুমার নিজের বিটি বটে রসিক। টুকদু মায়া দয়া করো –

রসিক: মায়া দয়া? খবরদার! কার না কার পাপকে একদম আমার বলে চালাবি না। সেবার মনে নাই, জলসার পর তুই কার সাথে রাত কাটাইনছিলিস?

ভাবরী: মনে নাই আবার? টাকা লিয়ে আমায় জোর করে সিধু গরাইয়ের ঘরে ঢুকায়েন দিইনছিলে। বিউটি তার আগে থাইকতে আমার প্যাটে। তুমি জাইনতে না?

ধনা:  চোপ শালি! তার আমি কী জানি? কিন্তুক তুই জানিস না, বাপ-মার ভালোবাসাবাসি ছুটু ছিলাদের দেইখতে লাই?

[দরজার বাইরে বিউটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। ভেতর থেকে ভাবরীর চাপা কান্না ভেসে আসে]

 

 

দৃশ্য-৪

[ধনার বাড়ি]

 

চরিত্র: ভাবরী/ভাবরী, ধনা, অতসী, দিদিমণি, বিউটি

[টুসু, কানাইয়ের প্রবেশ। কানাই উৎফুল্ল। বাকি দুজনের মুখ ব্যাজার। পেছন পেছন বিউটির ভয়ে ভয়ে অপরাধীর মতো প্রবেশ। তিনজনের কাঁধেই ঝোলা ব্যাগ। অতসী ঢুকতে তিনজনেই সিঁটিয়ে গেল]

অতসী: কী রে, কী হইল? সবার মুখগুলান শুকনা ক্যানে? পাস দিছিস তো? [বাচ্চাদের নীরবতা] কী রে! জবাব দিস না ক্যানে? পাস না ফেল সিটোও কি জানিস না? কী রে কানাই? পাস কইরছিস না ফেল মাইরছিস?

কানাই: আমি পাস কইরেছি মা। টুসু ফেল। আমি ইবার টুসুকে ল্যালাব।

অতসী: থাম। ল্যালাব। কী রে টুসু ফেল মাইরলি ক্যানে? [টুসু মাথা নীচু করে নিরুত্তর। বিউটি ততোধিক কুঁকড়ে আছে] আর তুঁই? [বিউটির প্রতি] [বিউটি আরও গুটিয়ে গেল]অ্যাই! মুখে জিভ নাই? রা কাড়িস না ক্যানে?

কানাই: বিউটিও পাস দিছে। অনেক ভালো রেজাল্ট বটে। শুধু টুসু ফেল।

অতসী: বাবাহ্! কী বিচার দিদিমণিদের বলিহারি। ভদ্দরলোকের বিটিকে ফেল করালেক, আর ছুটুলোকের একটা দু টাকার নাচনির বিটিকে পাস? তা বিউটিরানী, ইবার থেইক্যে কি তুমায় মাথায় তুলে রাইখতে হবে? হারামজাদী! আমারই খাবি আমারই পড়বি, আর আমারই ছিলাকে গুণতুক কইরে ফেল করাবি? [বিউটির কাঁধ থেকে ব্যাগ নিয়ে মাটিতে আছাড় মেরে ফেলে দিল অতসীপ্রথমে হাত দিয়ে, পরে হাতের কাছে একটা ঝাঁটা দিয়ে মারতে শুরু করল]তুর মা বাড়ি ফিরুক। তারও হছে।

[দিদিমণির প্রবেশ। অতসী খেয়াল না করে কয়েক ঘা বসানোর পর সচকিত হয়বিউটির উচ্চকিত কান্না]

দিদিমণি: কী হচ্ছে কী? মারছেন কেন? [থতমত খেয়ে যায় অতসী] ভালো ভাবে পাস করেছে। এবার হাইস্কুলে ভর্তি করাতে হবে। ফেল তো করেছে টুসুরানী। কেন এরা কিছু বলেনি? কানাই পাস করলেও নাক ঘষে কোনওমতে। রেজাল্ট ভালো না। যে সবচেয়ে ভালো ফল করল তাকেই পেটাচ্ছেন?

অতসী: [ইতস্তত করে] না মানে আমার বুইঝতে ভুল হঁইনছেউয়ারা কী বইলতে আমি কী শুনছি।

দিদিমণি: আর ফেল করলেই বা মারবেন কেন? মারলে কি পাস নতুন ক্লাসে উঠে যাবে না পড়াশুনোয় মনোযোগী হবে? বরং ভয়ে আরও খারাপ ফল হতে পারে। ভাগ্যিস আমি আজ স্টুডেন্টদের সাথে সাথেই বেরিয়ে পড়েছি। না হলে – ওইটুকু এক রত্তি মেয়েকে কেউ এভাবে মারে? বিউটির মা কোথায়?

অতসী:  উ বাইরে চইরতে গেছে। উ কি বাড়ি থাকবার বিটিছিলা? কী দরকার আমাকে বইলতে পারেন।

দিদিমণি: দরকারটা ওর মায়ের সাথে। তাকেই বলব।

অতসী: আমি উয়ার মামি বটি। মায়েরই পারা। উয়ারা আমারই বাড়ি থাকে খায় পরে। আমাকে বলা যাবেক নাই?

দিদিমণি: মায়ের পারা – সে তো দেখতেই পাচ্ছি। আমি অপেক্ষা করছি। না হলে বলুন বিউটির মাকে কোথায় পাওয়া যাবে?

অতসী: আমি জানি না, উ মাগি কুথায় চইরতে গেছে। আপনি বাইরের লোক যেমন তেমনই থাকুন, আমার ঘরের ভিতর দখলদারি কইরবেন না।

দিদিমণি: অন্যায়ের প্রতিবাদ করাটা দখলদারি নয়। একটা বাচ্চা মেয়েকে যেভাবে মারছিলেন তাতে আর যাই হোক মায়ের মতো মনে হচ্ছিল না। আমি এসে না পৌঁছলে অঘটন কিছু একটা ঘটে যেতেই পারত। ওর মাকে কোথায় পাব যদি বলেন তো ভালো, নয়তো এখানেই অপেক্ষা করছি।

অতসী:  আপনার কামকাজ না থাইকতে পারে, কিন্তুক আমার আছে। উ কখন ফিরবেক কোনও ঠিক নাই। পাড়া বেড়াতে গেলে কি হুঁশ থাকে?

[ভাবরীর প্রবেশ। মুখ ক্লান্ত ও থমথমে। দিদিমণিকে দেখে]

ভাবরী:  ও মা! পরণাম দিদিমণি। আপনি কতখন আইসছেন?

দিদিমণি: এই তো একটু আগে। তোমার খবর পরে নিচ্ছি, তার আগে তোমার মেয়ের খবর জান কি?

ভাবরী:  খারাপ কুছু? [উদ্বিগ্ন হয়ে]

দিদিমণি: খারাপ কিছু হলে সেটা বাড়িতে হচ্ছে। স্কুলের খবর ভালো। বিউটি ভালো ভাবে পাস করেছে। যদিও ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ডের মধ্যে কিছু হয়নি, নাম্বারও দারুণ কিছু নয়, কিন্তু এত বাধা বিঘ্নের মধ্যে পড়াশুনো চালিয়ে ষাট শতাংশ নাম্বার পাওয়াটা মুখের কথা নয়। চাইল্ড লেবার মানে শিশু শ্রম বিরোধী কাজ করে এমন একটা এনজিও থেকে কিছু স্কলারশিপ, ইয়ে কী বলে যেন, হ্যাঁ জলপানি দেয় যাতে গরিব বাচ্চাদের, বিশেষ করে বাচ্চা মেয়েরা যাতে পড়াশুনো ছেড়ে ছোটবেলা থেকে কাজে না নেমে পড়ে। তার জন্য একটু ভদ্রস্থ রেজাল্ট হওয়া দরকার। এই স্কলারশিপটার জন্য স্কুল থেকে আমি মানে আমরাই সুপারিশ করেছিলাম বিউটির নাম। তবে শর্ত একটাই, ও যেন পড়াশুনোটা চালিয়ে যায়, ছেড়ে দিলে এক পয়সাও পাবে না। এবার আমাদের স্কুলের পাট শেষ। ক্লাস ফাইভে অনীলাদেবীতে ভর্তি করাও। কবে থেকে ফর্ম দেবে খোঁজ খবর নাও। চলি। বিউটি, চলি। ভালো করে মন দিয়ে পড়াশুনো চালিয়ে যাও। [প্রস্থান]

ভাবরী:  যাক, ঠাকুর মুখ তুলে চেইনছে। [কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম]

অতসী: ঠাকুর মুখ তুলে চেইনছে? [ভেংচে] আর আমার টুসুটোকে যে গুণতুক কইরে ফেল করালি তুরা মা বিটি, তার হিসাব কে দিবে? দেখাছি মজা। আসুক টুসুর বাপ ঘরকে। অনীলাদেবীতে ভর্তি করাছি উয়াকে। কী দেখছিস কী? এত তাড়াতাড়ি ফিরলি যে? মুকুন্দ ঘোষের চাল ছাওয়া এর মইধ্যে হইন গেল? কত টাকা পালি?

ভাবরী:  [ইতস্তত করে] টাকা পাই নাই। ঠিকাদার আমাকে কাজ দেয় নাই।

অতসী: কাজ দেয় নাই? তাহলে এত দেরি হইল যে? কুথায় ছিলি এতক্ষণ? গতরখাকি, কাজে ফাঁকি দিতে পাইরলে আর কুছু চাস না, না? জবাব দে। শুনেছিলম ডাইরেক্ট কাজ করাবেক, অইটুকু তো কাজ। হঠাৎ ঠিকাদারকে কনটাক্ট দিল যে? কুন ঠিকাদার?

[ভাবরী কাচুমাচু মুখে নিরুত্তর থাকেধনার প্রবেশ। অগ্নিশর্মা মুখচোখ]

ধনা:  জবাব দে মাগি। কুন ঠিকাদার? [ভাবরী আরও গুটিয়ে যায়] জবাব দিবে কী কইরে? জবাব থাইকলে তো দিবে। উ কি মুকুন্দ ঘোষের ঘরকে গিইনছিল নকি? কুথায় গিইনছিলি বল।

অতসী:  তাই তো বলি, এত জলদি ঘরকে ফিরল কী কইরে? হুস্কুলে গিইনছিলি। দিদিমণিকে শিখাপড়া কইরে ঘরকে তুয়েই আনছিস লয়?

ভাবরী:  বিশ্বাস করো। আমি হুস্কুলের কথা কুছু জানি না। দিদিমণিকে ইখানেই দেইখলম।

ধনা:  দিদিমণি মানে, অই আইবুড়া নন্দিতা মাস্টারনি? ঘরকে আইসছিল কিসকে?

অতসী:  বিরাট সুখবর লিয়ে গো। তুমার মিয়া ফেল মেইরে কেলাস থিরিতেই রইন গেল, আর ভাবরীর বিটি পাস দিয়ে একেবারে জলপানির হকদার হইনছে সেই খবরটো দিতে।

ধনা:  তাই? আর কানাই?

কানাই: আমিও পাস কইরেছি বাবা। ইবার অম্বিকাচরণে অ্যাডমিট হব।

ধনা:  লিশ্চই হবি। কিন্তু দাঁড়া, আগে বিউটির জইন্য উরমা হাটে অনীলাদেবী তক দৌড় করার হুকুম হইনছে, সিটো আগে পালন করি। [দালানের চাল/খুঁটি থেকে একটা লিকলিকে বেত বার করে] ইয়াদের মা বিটি দুয়েরই খুব বাড় হইনছে টুকচান ঝরাতে হবেক নাই?

ভাবরী:  বিউটি কী দোষ কইরল? তুমাদের সংসারের সব কাজকাম কইরে তুমাদের ছিলাদের ফাই ফরমাস খেইটে সামান্য পড়া লিখা করে পাস দিছে। কানাই আর টুসুর ব্যাগটোও উকে বইতে হয়। টুঁ শব্দ করে না। তারপরেও কেন জ্বালা তুমাদের? অখন তো জলপানি পাবেক। সব উ দিদিমণিই ব্যবস্থা কইরে দিবেক। তার জইন্য বৌদিদি উয়াকে ঝাঁটা পিটা কইরলেক। অখন তুমিও –

ধনা: আর তুঁই কী কইরেছিস সিটো বল একবার। মুকুন্দর গোয়াল ছাইবার নাম কইরে কুথায় গিইনছিলি? [ভাবরী ভয়ে সিঁটিয়ে যায়] বিডিও অফিস যাস নাই? একশ দিনের কাজ চাইতে? কী যাস নাই? তা দিলেক উয়ারা? নাংটি মাগি! সেই যে রেশনের লেইগে বিপিএল কার্ড করায়েন দিলম। সিটোই কাল হইনছে। ভাবছে উড়তে শিখে গেইনছে।

অতসী: আর উয়ার জিদ রেইখে বিউটিকে হুস্কুলে দাখিল করাওনি? দেখো তার ফল। হবেক নাই ক্যানে? বারোভাতারি নিজের মিয়াকে উঠাবার লগে কতজনের সাথে শুইনছে তার হিসাব রাখো নকি তুমি? মা বিটির ডানা গজায়েনছে গো ডানা। টুকদু ছাঁইটতে হবেক

ধনা: [ভাবরীকে বেত দিয়ে মারতে মারতে] খুব শখ না? আমি তুকে পুষছি নাই? ফের বেচাল দেইখলে জ্যান্ত কুত্তা দিয়ে খাওয়াব। মরা তক অপেক্ষা কইরব না। আর বিউটিকে দাশু সর্দারের হাতে বিকে দুব। মায়ের পারা কাপড় তুলে রোজগার কইরবে।

[ভাবরীকে প্রায় সংজ্ঞাহীন করে ক্লান্ত হয়ে ছেড়ে দেয়। বিউটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদে। ]

অতসী: অবেলায় ছুয়াৎ কইরলে। কলঘরে কাচা কাপড় দিছি। কাপড় ছেইড়ে ঘরকে ঢুইকবে।

[বিউটি ভয়ে ভয়ে এগিয়ে জল ছিটিয়ে মায়ের শুশ্রূষা করে]

 

 

দৃশ্য-৫

[রাতে ভাবরীর ঘরে ধনা]

চরিত্র: ভাবরী, ধনা, বিউটি

[ভাবরী বিউটির সাহায্যে কোনওমতে টেনে হিঁচড়ে ঘরে এসে মেঝেতে শুয়ে পড়ে]

বিউটি:  রেইতে কুছু খাও নাই মা। টুকদু জল দিই। [জল গড়িয়ে দেয়]

ভাবরী:  আর প্যাটে কুছু ঢুইকবেক নাই। তুঁই কিন্তুক অতসী মামির থেকে মেইঙ্গে কুছু খাঁইয়ে লিস। রাত উপাসি থাকিস না মা।

বিউটি:  আচ্ছা মা, তুমাকে সবাই নাংটি বলে ক্যানে? নাচনি আর নাংটি কি একঅই কথা?

ভাবরী:  সবাই বলে? আঃ! [দুর্বল গলায়]

বিউটি:  হুস্কুলেও নন্দিতা দিদিমণি আর মণ্ডল সার বাদে বাকি মাস্টাররা বলে। পড়া না পাইরলে মাস্টার মারে, সাজা দেয়। বুইঝতে চাইলে বুঝায় না। বলে তুঁই কী কইরবি পড়ালিখা শিখে?

ভাবরী: তারপরেও তুই ভালো ভাবে পাস দিছিস বিউটি? আমি তুকে পড়াবই। ইভাবে মার খেইতে দুব না।

[মাকে জড়িয়ে ধরে বিউটি। আচমকা ধনা ঘরে ঢোকে। বিউটি মাকে জড়িয়ে ধরে]

ধনা:  তুঁই ইখান থেইকে বিরাবি নকি মায়ের পারা মার খাবার শখ জাইগছে।

[ধনা বিউটির দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাতে বিউটি ভয়ে পালিয়ে যায়। দরজা দিয়ে দেয় ধনা]

ধনা:  খুব বেদনা কইরছে? [উত্তর দিল না ভাবরী] আমার কি তুর গায়ে হাত তুইলতে মন চায় রে? তুই আমার সোহাগী চাঁদ বটিসদিকে দিকে তুর কত নামডাক ছড়াইনছে। ইয়াতে তুঁই খুশি লোস? বিডিও অফিস কিসকে গেঁইছিলি। পালি কুছু? উয়ারা অপমান কইরে তাড়ায়েন দিলেক না? বলে নাই, তুঁই নাচনি বটিস ধনা সর্দারের, ইখানে ক্যানে? যা ঢলানি কইরে রোজগার করগে যা। ইটো গেরামের গরিব বউ বিটিদের জইন্য? তুকে ভালাবুরা বইললে আমাকেও বাজে ইটো বুঝিস না? তুকে কি আমি খারাপ রেইখেছি? তুর বিটিও পড়ালিখা শিখছে আমার ছিলাগুলার সাথে[ভাবরীকে টেনে বিছানায় তোলে ধনা।]

ভাবরী:  আমার বিটি তুমার বিটি লয়? আঃ! বাইজছে। ও মাগো!

ধনা:  কুথায় বাজে দেখি।

ভাবরী:  সারা শরীল চিড়বিড়াইচ্ছে। আজ রেইতে খেমা দাও। মারার সময় খেয়াল থাকে না। আমি তো অছুৎ বটি। মইরলে আগুনটুক পাব নাই অবেলায় আমার গায়ে হাত তুইললেও কাপড় ছাড়তে লাগে, আর অখন?

ধনা:  আয় তুর গায়ে হাত বুলায়েন দিই। বোরোলিন লাগায়েন দুবো? টুসুর মাকে বইলব কাল চূন-হলুদ কইরে দিতে। বেদনা কুথায়?

ভাবরী:  আর সোহাগ কাড়াতে হবেক নাই। সারা দিন তুমার সংসারের লেইগে জিউকে জামিন দিয়ে খাটি। সন্‌ঝায় মার খাই। রেইতে ঘুমাতে তো দিবে

ধনা:  ঘুম পাড়াতেই তো আসছি রে। [কাছে টানার চেষ্টা]

ভাবরী:  আঃ! বাইজছে। আমার বানধা গানগুলান পর্যন্ত তুমি নিজের নামে চালাও। আমি যে নাচনিকে সেই নাচনিই থেইকে যাই। সংসারের সব কাজ কইরে যদি নিজের বিটি লেইগে বাড়তি খেইটে দুটো বাড়তি রোজগার করি তুমাদের বাজে ক্যানে? আমাকে মাইরছ মেইরে লাও। কিন্তু কথা দাও বিউটিকে দাশুর হাতে তুলে দিবে না। কথা দাও উয়াকে হাই হুস্কুলে অ্যাডমিট করাবেআঃ.. বডো বেদনা গো, আজ ছাড়ো।

ধনা:    [বিলি কাটার ভঙ্গিতে মাথার চুলে আঙুল ডুবিয়ে খামচে ধরে হ্যাঁচকা টান দিল ধনা] শালি ভালো কথার বিটিছিলা লয়

[ধনার বল প্রয়োগযন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল ভাবরী। নেপথ্যে বিউটির কান্না]

 

 

দৃশ্য-৬

[ধনার বাড়ি]

 

চরিত্র: ভাবরী/ভাবরী, মঙ্গলা, ধনা, অতসী, বিউটি

[ভাবরী উনুন ধারে বসে ঢুলছে। সামনে মস্ত মাটির মালসায় মুড়ির চাল। অতসীর প্রবেশ]

অতসী:  এই মাগী, চার বেলা গিলে উনানধারে বসে ঘুমাচ্ছিস? ভাগ্যে চুলাটো নিভে গেইনছে, নইলে সব চাল লষ্ট হইত

ভাবরী:  [ধড়মড় করে উঠে বসে ভাবরী] ই বাবারি! দোফোর গড়ায়েন গেছে। রেতে ঘুম হছে নাই, চোখে ঢুল এইসে গিইনছিল। কুছু হবেক নাই। চালটো ঠিকঠাক সিজাইনছে। দালানে তুলে রাখি? [বড়ো মাটির মালসা উনুন থেকে নামায় ভাবরী]

অতসী: কুছু হবেক নাই –সব জেইনে বইসে আছে। যা আর মড়া আগুলতে হবেক নাইরেইখে দে? আর শুন, আজ যদি টুসুর বাপ রেইতে তুর ঘরকে গেইছে তো সকালে তুর একদিন কি আমার একদিন। কদিন আগে লাইচতে গিয়ে অত ফুর্তি মেইরে এলি, তারপরেও নাংটা মাগীর রস যায় না

ভাবরী:  আমি কি তাকে ডাকি? উয়ার যখন ইচ্ছা আমাকে মারে, আর যখন ইচ্ছা ঘুম ভাঙায়। আমার শরীল-গতিক ভাল লয়। তুমার সোয়ামীকে তুমি সামাল দাও

অতসী:  আমি কী কইরব তুর কাছে শিখব নকি? শোন, আমি টুকচান বিরাচ্ছি, মান্তুদের ঘরে আজ সত্য নারায়ণ পূজা বটে। সইনঝা হবে ফিরতে। [প্রস্থান বাইরের দিকে]

[ভাবরী মালসা তুলে দাওয়ার কোণে রাখে। টুকটাক কাজ করতে করতে গুনগুন গান গায়।] [মঙ্গলার প্রবেশ]

মঙ্গলা:  ভাবরী বাড়ি আছিস?

ভাবরী:  কে? ও মা! মঙ্গলা যে গোকতদিন পর। তা কী মনে কইরে?

মঙ্গলা:  মনে কইরে লয় রে, চোখে পইড়ে। রাস্তায় আইসতে আইসতে দেইখলম অতসী বৌদি মান্তুদের বাড়ি ঢুইছে। উয়াদের বাড়িতে সত্যনারায়ণ আজ। আমাদের তো কেউ ডাইকবেক নাই। তাই ভাইবলাম অখন তো উয়ারা কত্তা-গিন্নি কেউ ঘরকে নাই, ইখান দিয়ে যেছি যখন, তুর সঙ্গে দুটো কথা করে যাই। ছিলাগুলান কুথায়? উয়ারাও কেউ নাই নকি, সঙ্গে গেইনছে?

ভাবরী:  টুসু আর কানাই হুস্কুল থেইকে ফিরে খেইলতে গেইনছে। উয়ারাও মান্তুদের বাড়ি যাবেক হয়ত। বিউটি ঘরকেই আছে। আয় বোস।

মঙ্গলা:  বিউটি হুস্কুল যেছে না? উকে আর পড়াবি নাই? বিটি শুনছি পেরাইমারি পাস দিলেক ভালো রেজাল্ট হইনছে। [দাওয়ায় বসে]

ভাবরী:  ক্যানে পড়াব নাই? আর আমার মেইয়ে ফোর পাস দিছে না, টুসুর মায়ের কী জ্বলন কী জ্বলন! টুসু ফেল মেইরেছে লয়? তাই লিয়ে কত অশান্তি। তবে উয়ার বাপকে হাতে-পায়ে ধইরে বড় হুস্কুলে ভর্তি করাইতে রাজি করাইনছি। উ বইলেছে বিউটিকে নিজে ভর্তি করাবেক

মঙ্গলা:  করাবেক মানে? অখনও অ্যাডমিট হয় নাই? কেলাস ফাইভের নতুন কেলাস তো কবে শুরু হঁইন গেইনছে

ভাবরী:  সিটো তো ইখানে অম্বিকায়। উরমার অনীলাদেবীর অ্যাডমিটে তো অখনও মাস খানেক দেরি আছে বইললেক ধনা সর্দার

মঙ্গলা:  তবে তাখেই শুধাগে যা। আমি বসন্ত মল্লিকের লেগে ঐ হুস্কুলের পাঁচিলে ঘুঁটে দিঁইয়ে আসি হপ্তায় তিন দিন। যা দেখছি নিজের চোখে, তাই বইললাম। আমার কথা বিশ্বাস না যায় শুধা কেনে দিদিমণিদের

ভাবরী:  উ যে বইলেক। পেথমটায় রাজি হছিল নাই। টুসুর মা রেজাল্ট দেইখে বিউটিকে ঝাঁটা পিটা কইরেছে। আমায় তো মেইরে – সে যা ছেইড়ে দে। কিন্তুক আমি অনেক কাঁদাকাটা করায় অনেক হাতেপায়ে ধরে মিনতি করায় ধনা রসিক বইলেক যে বিউটিকে উরমায় দাখিল করাবেক। তুঁই ঠিকঅই জানিস কেলাস শুরু হইন গেছে? কবে থাকতে?

মঙ্গলা:  মাস কাবার হইতে চলল। ধনা তুকে মিছা বইলছে। পেরাইমারিতে ভর্তির সময় নিজের নাম দিঁইছিল উ, যে হাইস্-কুলের বেলা দিবেক? তুর নামে বিউটি হুস্কুলে দাখিল হয় নাই? ইবারও ধনার ভরসা না কইরে নিজে গেলি নাই কেনে?

[ভাবরী ধপ করে দাওয়ায় বসে পড়ে মাথায় হাত দিয়ে]

ভাবরী:  অখন কী কইরব? এত বড় ধোঁকা কইরলেক ধনাটো? অখন আর ভর্তি করা যাবেক?

মঙ্গলা:  তার আমি কী জানি, কথা কইরে দ্যাখ। না বাবা। আমি অখন যাই। উয়ারা কেউ এইসে পইড়লে ভাইববেক আমি লাগান-ভাজান কইরতে আসছি।

[মঙ্গলার প্রস্থান। ভাবরী বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকে ওভাবেবিউটি এসে মায়ের কাছে বসে।]

বিউটি:  মঙ্গলা মাসি কী বইলে গেলেক মা? কেলাস ফাইভের কেলাস শুরু হইন গেছে? কতদিন হইল? মামা কী বইলেছে?

[ ভাবরী নিরুত্তর থাকেধনার প্রবেশ। ভাবরী ঝাঁপিয়ে পড়ে]

ভাবরী:  বিউটিকে কবে অ্যাডমিট করাবে?

ধনা:    মানে? তার তো দেরি আছে। বইলেছি তো উটো ইবার আমার ভাবনা। তুঁই ইটো জানতে কাজ কাম ফেইলে বইসে আছিস?

ভাবরী:  কেলাস ফাইভের কেলাস পেরায় এক মাস আগে থাইকতে শুরু হঁইন গেছে। উয়াদের ভর্তি লিবার সময় শেষ। গরীবের বিটি বইলে একটো জলপানির ব্যবস্থা হইনছিল। সিটো আর পাবেক নাই বিউটি। নিজের বিটির সাথে এমন বেইমানি  কইরতে পাইরলে?

ধনা:    কে বইলেক ইসব?

ভাবরী:  যেই বলুক, কথাগুলান সত্যি কিনা বলো।

ধনা:    যা কইরেছি বেশ কইরেছি। জলপানির টাকায় সব হইত? খরচ যুগাবেক কে?

ভাবরী:  রোজগার তো আমি করি। নিজের মিয়ার জইন্য এটুকু করার অধিকার নাই আমার? আমি বলে ডবল খাইটছি, আর তুমি –

[ধনা ভাবরীর চুলের মুঠি ধরে নেড়ে নেড়ে]

ধনা:    রোজগার, অধিকার? আবার আমার মুখে মুখে তক্ক করিস? আবার উত্তম-মধ্যম খাওয়ার শখ হইনছে মাগির। নাইলে যে থালে খায়, সেই থালে ছ্যাঁদা করে? সেদিনের দাওয়াইটো ভুলে গেইলি? [ছুঁড়ে দেয় উঠোনে। অতসীর প্রবেশ। তার পায়ের কাছে পড়ে যায় ভাবরী। বিউটি ছুটে এসে ধনার হাত ধরে]

অতসী:  আবার কী হইল? আবার মাইরছ কেনে? কী কইরলেক?

ধনা:    কী কইরলেক? আমার কাছে জবাবদিহি চায় সব কাজকাম ফেইলে ক্যানে বিউটিকে উরমা ইসকুলে দিই নাই।

বিউটি: মামা মাকে ছেইড়ে দাও। আমি আর পড়ালিখা কইরব না। হেই মামা গো, তুমার দুটি পায়ে পড়ি। মাকে ছেইড়ে দাও।

[ধনা বিউটিকেও ঠেলে সরিয়ে দিল]

অতসী:  [স্বগতোক্তি] মর কসবি[খানিকক্ষণ তারিয়ে তারিয়ে মজা দেখার পর] মেইরে ফেলাবে নকি? ঘরের কাজগুলান কইরবে কে? ওগো, ইবার ছাড়ান দাও। আমি কথা দিছি, আর হুস্কুলের নাম কইরবে না। ভাবরীকে ছাড়ো। বিউটিকেও নাচ-গানের তালিম দাও

ভাবরী: [ঝাঁঝিয়ে] কখনও না। উয়ার পড়ার খরচ তো আমি বাড়তি খেইটে যুগায়েনছি, যুগাবও। তুমাদের গায়ে লাগে কেনে?

অতসী:  এই হারামজাদি। আমি তুকে বাঁচাতে চাইছি, তুঁই আমার উপর কথা বলিস? টুসুর বাপ তোকে মেইরে ফেইললে বিটিটোর কী হবে ভেইবে দেখছিস?”

ভাবরী:  উটো তো তুমরা ভেইবে রেইখেছ? নাচনি কইরবে। দাশুর হাতে তুলে দিবে

বিউটি:  আমি পড়ালিখা কইরব না, মায়ের পারা নাচনি হব। মাকে ছেইড়ে দাও মামা। [কান্না]

[ধনা থামলে মাকে জল দিয়ে পরিস্কার করল। দশ বছরের বালিকার মাকে ঘর পযর্ন্ত নিয়ে যেতে জোর পায় না। অবাক হয়ে দেখল, অতসীমামি মাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মুখে জল দিচ্ছে]

অতসী: বিউটি, আজ রেতে মায়ের পাশে শুস। সেবা করিস

 

 

দৃশ্য-৭

[ধনার বাড়ি]

 

চরিত্র: ভাবরী, অতসী, ধনা, বিউট, সনাতন

[ভাবরী উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে। গায়ে ব্যথা নিয়ে]

অতসী: উঠান ঝাঁটানো হইলে চা মুড়িটো খেঁইয়ে আমায় উদ্ধার করিস। একদিন মার খেইলে তিন দিন কাজ থেইকে ছুটি। ভালোই।

ধনা:    সব সময় উয়াকে এমন করো ক্যানে বল তো? সনাতন রসিককে চিনছ? অনেক বড বড জায়গায় কানেকসান। উ ইবার সরকারি জলসায় ঝুমুর দিবেক। কমলির কথা বইলছিল। ভাবছি আমার তো যাওয়ার উপায় নাই। কমলির নামডাক হইনছে। উয়াকে সনাতনের সঙ্গে পাঠায়েন দি?

অতসী: তাই দাও। উকে দেইখলে আমাকে বমি পায়। ....কত টাকা দিবেক জাইনছ?

ধনা:    ভালোই দিবেক। সরকারি পোরগেরাম বটে।

ভাবরী: [থেমে] কিন্তুক বিউটি অখনও নতুন হুস্কুলে দাখিল হয় নাই। বড়দিমণির হাতে পায়ে ধইরে যেমন কইরে হোক উয়াকে অ্যাডমিটটো করায়েঁ লিই আগে। তারপর যেখানকে যেইতে বইলবে যাব।

অতসী:  ই তো আচ্ছা জ্বালাইলেক, অ্যাডমিট অ্যাডমিট কইরে! পরশুর দাওয়াইটো ভুলে গেঁইছিস? অখনও সোজা হঁইয়ে ডাঁড়াতে লাইরছিস। তুকে ঘুরে আইসতে পারমিসন দিছি জলসা থেইকে, তুঁই যা না।

ভাবরী:  [অতসীর পায়ের কাছে মাটিতে পড়ে বলল] বৌদিদি গো, তুমার ফাই-ফরমাস খেইটে, তুমার ছিলামিয়ার বইপত্তর বয়ে মিয়াটো আমার পেরাইমারি পাস দিছে। উয়াকে ছাড়ান দাওতুমারই মরদের কইন্যা। তুমারও বিটির পারা। আমাকে মাইরছ, মেইরে লাও। কিন্তু উয়াকে আর পাঁকে নামাও না। আমি তো তুমাদের সংসার টাইনছি। যতদিন গতর চইলবে ততদিন জিউকে জামিন দিয়ে কইরব। আমি পাপী বটি। আমাকে শাস্তি দাও। আমার বিউটিকে টুকদু লিখাপড়া শিখতে দাও। উয়ার খরচ আমি জুগাব আমি তুমাকে মুকুন্দ ঘোষের চেয়েও বড় বাড়ি কইরে দুবো।

অতসী:  কী? তুই আমাদের সংসার টাইনছিস? যা না, বিরা আমার বাড়ি থিক্যা। দেইখব কোন ভাতারে তুকে লেয়। আমার সোয়ামী আসরা না দিলে, নাচগান না শিখালে তুকে কে পুঁইছত? পঞ্চমীর কথা শুনিস নাই? মদন রসিকের সনে বেইমানি কইরে কার না কার সাথে পালাতে গেঁই সোনাগাছি চালান হইন গেইনছিল। অখন তো কেউ বলে বোম্বাই কেউ বলে দুবাই চালান গেছে।

ভাবরী:  আমি উ কথা বলি নাই। আমি তুমাদের দাসী-বাঁদী হঁইয়ে থাইকব। আমার বিটিটোকে শুধু হাই হুস্কুলে অ্যাডমিট হইতে দাও

অতসী:  এ যে বইসতে পেইলে শুতে চায় গোহাইসকুলে অ্যাডমিট? ধনঞ্জয় সর্দারের বিটি ফেল মাইরবে, আর নাচনির বিটি উয়াকে টপকায়েঁ বড় হুস্কুলে যাবে?

[ধনা ইশারায় অতসীকে চুপ করতে বলে]

ধনা:  ক্যানে যাবেক নাই? যদি লিখাপড়ায় মাথা থাকে, খরচাপানি পায়, তবে ক্যানে পইড়বেক নাই? বিউটি আমাদের মুখ উজ্জ্বল কইরবেক লয়? আমি নিজে উরমা যেইয়ে উয়াকে অনীলাদেবীতে দাখিল করাব। উটো আমার ভাবনা। তুই ঘুরে আয় সনাতনের সাথে। সরকারি আসর, তুকেও বিজলি মাসির পারা সাট্টিফিকেট দিবেক, টাকা দিবেক। উ টাকায় আমি হাত দুব না। উটো তুই তুর বিউটির জইন্য তুলে রাখিস। আজ শরীল ঠিক আছে? 

[ভাবরী অবাক, অতসী অস্থিরধনা অতসীকে আবার চুপ হতে ইশারা করে]

ভাবরী:  টুকদু। পুরা লয়

ধনা:  থালে দু দিন আরাম কর। বাবু ঘরামিকে না বলে দিছি। রবীন গোপের গোয়াল ছাইবার কাজ ছিল।

[দরজায় শেকল/কড়া নাড়ার শব্দ। অতসী দরজা খুলতে সনাতনের প্রবেশ]

ধনা:   অই দ্যাখো। নাম লিতে না লিতেই হাজির। অনেক দিন বাঁইচবে হে সনাতন। এই তুমার কথাই হছিল। 

সনাতন:        তাই বুঝি? তা কী বইলেক তুমার ভাবরী সুন্দরী? যাবে? ইটো কিন্তু মস্ত মঞ্চ বটে।

ধনা:   আমি তো সিটোই বুঝাছি।

ভাবরী:  কবে যাওয়া? তাইলে বিঊটিকেও নিয়ে যেইতে মন কইরছে। উ যাবেক আমার সাথে?

ধনা:  বিউটি গিয়্যা কী কইরবি? তুঁই তো উয়াকে নাচনি বানাইতে চাস না

ভাবরী: উ তো সবার কাছে শুনে উয়ার মা নাংটি বটে, একবার শিল্পী মাকে দেখুক কেনে

ধনা:  তাহলে উরমা বালিকা বিদ্যালয়ে দাখিল হবেক কে? তুঁই চাস না? আমি বড়দির সাথে কথা কইরেছি। দু-এক দিনের ভিতরই আবার ফরম দিবেক। উয়ার জলপানিটো যাতে বন্ধ না হইন যায় সিটোও দেইখবেক।

ভাবরী:  সত্যি বইলছ? [ধরা গলায়] কবে ভর্তি? আমিও সাথে যাই। তারপর লিশ্চিন্ত হঁইয়ে জলসায় যাব।

ধনা:  জলসা কি তুর জইন্য থেইমে থাইকবে? উটো তো, সনাতন কবে যেন, কাল বাদে পরশুদিন রওনা।

ভাবরী:  তবে কি ঘুরে এইসে ভর্তি করাব? তাইলে তো তুমিও সাথে যেইতে পারো।

ধনা:  আমি সাথে গেইলে বিউটিকে ভর্তি করাবেক কে? যাওয়া আসা মিলে চার-পাঁচ দিনের মামলা বটেযদি তার মইধ্যে ভর্তি লেয়?

সনাতন:          হঁ, হঁ। আর লাইচ দেখার দিন কি ফুরায়েন যেছে? হুস্কুলটো বেশি জরুরি বটে। আর কিন্তুক সময় নাই, ভাবরীরানী তুমি তল্পি তল্পা বানধো। পরশু ভোরেই রওনা দিব।

ধনা:  যা তুঁই নিজের ঘরে যাগোছগাছ কইরে লে। বেশি কইরে জামা কাপড় লিস। ইখানে অখন থাইকতে হবেক নাই।

[ভাবরীর প্রস্থান]

ধনা:   [ভেতরঘরে অতসীর প্রতি] হঁ গো, সনাতন রসিককে চা খাওয়াবে নাই? ভিতর ঘরে চল সনাতন। [চাপা গলায়] তুমিও ভিতরে এইসো, শলা আছে।

         

 

দৃশ্য-৮

[জলসা]

 

চরিত্র: ভাবরী, সনাতন, বাজনদার-৪ জন, জনতা, মাতব্বর ইত্যাদি

ভাবরী:  বৃন্দাবনে ফুটি গেলা নানা জাতি ফুল গো

মধু লোভে উড়ে ভ্রমরা আকূল গো।

          কমল চম্পক বক মাধবি টগর গো

          ফুটি গেলা কত পলাশ পারুল গো।

          ফুলে ফুলে ভরল ধদকি পলাশ গো

গন্ধে মন মতোয়ালা যমুনার কূল গো।

কী করিব রাসের নিশি, রসে সমতুল গো

তরুমূলে বসে দীনা সে বাউল গো।।

[হৈ হল্লা]

[দৃশ্যান্তর : সনাতনের বাড়িঅগোছালো ঘরে বাদ্যযন্ত্র ছড়িয়ে]

[সনাতন ও ভাবরীর প্রবেশ]

সনাতন:  এসো হে ভাবরী সুন্দরী। এই অধমের কুটিরে আইজ তোমার পেথম পায়ের ধূলা পইড়ল। বইস বইস।

ভাবরী:  [ইতস্তত করে কোথায় বসবে] উ কথা বুইলে আর লজ্জা দিও না দাদা। আমাদের আবার পায়ের ধূলা, আমাদের তো ছায়া মাড়ানো পাপ গো। যতক্ষণ মজলিসে আছি, ততক্ষণ সোহাগ চাঁদ। তারপর ঘরকে ফিরেই ঘুঁটে কুড়ুনিরেতের বেলা কদর, দিনমানে অছুত বটি।

সনাতন: সবাই কি সব জিনিসে কদর কইরতে শিখে? ধনা কি আর জাত রসিক বটে? উয়ার বাপ তো জন খাইটত। উ আমাদের দলে ভিড়ে টুকদু ঢোল খঞ্জনি শিখে বিরাট সমঝদার হইনছে। তারপর কপাল ভাল, তুমাকে পেঁই গেলেক। তারপর ধরাকে সরা জ্ঞান করে। টুকদু চা করি। ঘরে খাবার কী আছে দেইখতে হবে। কুনো বিটিছিলা নাই তো, আমাকেই সব কইরতে হয়।

ভাবরী: ব্যস্ত হবার দরকার নাই সনাতন দাদা। বাড়িতে বিটিছিলা থাইকলে নাচনির কী যাতনা হয়, তা আমাদের চেয়ে বেশি কে জানে? তা চা খেইয়েঁই আমাকে জুরিডি পৌঁহুছানোর ব্যবস্থা করো। বিটিটোর জন্য বড মন কেমন কইরছে। উয়াকে ধনা সর্দার হুস্কুলে ভর্তি করালেক কিনা বড চিন্তা হছে।

সনাতন: [কুটিল হেসে] উয়ার চিন্তা ইবার থেইকে ধনার উপরই ছেইড়ে দাও। তুমি অখন ইখানে মন দাও। আমাকে দাদা ডাকো ক্যানে সুন্দরী। আমার কিন্তু নিজঝনঝাট সংসার বেটে। বিয়া শাদি করি নাই। গেলবার পোরগামের পর পোস্তবালা মইরে গেল। একা থাকি। এই ঝুমুর গানই আমার সাথী বটে, ইটোই সাধনা। শুধু একটো যোইগ্য সাধন সঙ্গিনী দরকার। তুমি পাইরবে না এই ঘরটোকে সাজায়ে গুজায়ে লিতে?

ভাবরী:  কী আনখাই কথা বইলছ দাদা? আমার মিয়াটোর কী হইল জাইনতে লাইরছি। উ উখানে ঐ শয়তানগুলার জিম্মায়, আর আমি ইখানে ঘর সাজাব? আমায় জুরিডি লিয়ে চলো, আমার ঘরকে।

সনাতন: অখন থেইকে ইটোই তুর ঘরবাড়ি বটে। ধনা সর্দারের কাইছ থেইকে লগদ বারো হাজারে কিনছি তুকে। আমার ঘরে বৌ না থাক, দুটো পালোয়ান শাকরেদ আছে। পালানোর কথা ভুলেও ভাবিস না।

ভাবরী:  মানে? উ আমাকে বেইচে দিইনছে? আর বিউটি?

সনাতন: বিউটির কথা জানি না। আমি যাকে কিনে আনছি সে আমার ব্যাস।

ভাবরী:  আমাকে না জানায়ে বেইচে দিইনছে? এমন হয় নকি? তুমি সত্যি বইলছ না। আমায় নিজের ঘর দেখাবে বইলে ফুইসলে নিয়ে এইসে ইখানে জবরদস্তি করার লেইগে উল্টা সিধা কথা বানাছ। আমাকে অখনই জুরিডি নিয়ে চল। না হলে কিন্তুক চেঁচাব।

সনাতন: বানায়ে বইলে আমার লাভ? আমি যদি ধনার সম্পত্তি লিয়ে নিজের কাছকে কয়েদ রাখি উ আমায় ছেইড়ে দিবে? নগদ টাকা পেইনছে, তাথেই তো তুকে দিলেক।

ভাবরী: [কান্না] ঘরের সব কাম কাজ আমি আর বিউটি করি। ঐ মাগী একটো গতরখাকি বটে। অখন কি আমার বিউটিকে সারাদিন খাটায়ে মাইরবে? নকি উয়াকেও দাশুর হাতে তুলে দিছে? আমাকে তাইলে মিছা বইললেক যে বিউটিকে হুস্কুলে দিবে? হেই সনাতন দাদা, তুমার পায়ে পড়ি আমাকে একবার উখানকে লিয়ে চল।

সনাতন: আইজ বড থকে গেইনছি। কাল পরশু দেখি, তুর ভুল ভাঙাতে পারি কি না। কিন্তু ম্যালা ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ কইরলে কিন্তুক কুথাও লিয়ে যাব নাই।

ভাবরী: আমাকে যদি ইখানে থাইকে হয়, বিউটিও ইখানে থাইকবে, আমার চখের সামনে। উখানে চখের আড়ালে ঐ জানওয়ারগুলার সঙ্গে থাইকতে দুব নাই। বিউটি রে – উকেও নির্ঘাৎ দাশুর হাতে দিছে গো। অনেকদিন ধইরে আমাকে শাসাচ্ছিল। ভাইবলম যতই হোক, বাপ বটে, পাইরবেক নাই। উয়ারা সব পারে গো, সব পারে  [কান্না]

 

 

দৃশ্য-৯

[ধনার বাড়িদুপুর বেলা]

চরিত্র: ধনা, ভাবরী, বিউটি, অতসী, সনাতন

[সনাতন শেকল ধরে নাড়ে। দরজা খোলে না। বারবার দরজায় কড়া ও শেকল নেড়ে যায়।]

সনাতন: ধনা আছ নকি? বলি ও ধনা... [দরজায় আলতো চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল। সনাতন ও ভাবরী ভেতরে উঠোনে এসে দাঁড়াল। কিন্তু হাঁকডাকেও কোনও সাড়া শব্দ নেই। ঘরে নিঝুম ভাব]

সনাতন:  বলি কুথাকে গেইলে গো সব? সাড়া লাই ক্যানে? লিজের ঘরের মাল আমার উপর খালাস কইরে সব হাওয়া, নকি? বলি অ্যাই ব্যাটা ধনা। দুয়ার খুলে সব কুথাকে গেলি? অতসী বৌদিও নাই নকি?

ভাবরী: বৌদিদি গো, কুথায় তুমরা?

সনাতন:  লাও ক্যানে। মায়ের মন কাঁইদছে। বিটিকেও সঙ্গে রাইখতে চায়। আমার দয়ার প্রাণ। আমি রাইখতে রাজি আছি। কিন্তু একটা বাড়তি জীবকে রাখা, এমনিতেই খরচ পোষাবেক নাই; তার উপর উয়ারা যদি দর হেঁকে বসে তো হঁইন গেল। বিউটির জইন্য্ দাম দিতে লাইরব। [ভাবরীর দিকে তাকিয়ে] যদি মাগনা পাই তো সঙ্গে লিয়ে যেইতে রাজি আছি। কিন্তু দাম হাঁইলে যেমন আসছি, তেমনই ফিরতে হবে। কথাটো মাথায় থাকে যেন।

[ঘরে ঢুকতে চোখে পড়ল ভাবরীর ফেলে যাওয়া ঘর ভেতর থেকে বন্ধ। একটা চাপা গোঙানির শব্দ যেন ভেসে আসছে। একটু চোখ ফেরাতে নজরে এল দালানের সিঁড়িতে একটু অন্ধকারে অতসী মাথায় হাত দিয়ে বসে।]

ভাবরী:  বিউটি! আমার বিউটি কুথায় বৌদিদি? দাশুর কাছে দিছ উয়াকে? বল, কুথায় উ। বিকে দিছ আমার পারা? [অতসী নিরুত্তর]

সনাতন:  ধনাকে ডাকো বৌদি। উয়ার ভাবরী সুন্দরীর আমার কথায় বিশ্বাস হছে নাই। তাই ইখানকে লিয়ে এলাম। লাও চক্ষু কর্ণের বিবাদভঞ্জন কইরে লাও। ভাবরীকে নগদ বারো হাজার টাকায় কিনছি কিনা তুমিই বলো বৌদি। তুমি তো ছিলে, সবঅই জানা তুমার।

[বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে বিউটির চিৎকার শোনা যায়। সঙ্গে ধনার তর্জন।]

অতসী:  রাক্ষুসি, লিজে নাংটামি কইরতে গেলি যদি বিটিটোকে সঙ্গে লিতে লাইরলি। [অতসী বন্ধ ঘরের দিকে ইঙ্গিত করে ডুকরে ওঠে। ভেতরে ধস্তাধস্তি চিৎকারে সব বোঝা যায়।]

ভাবরী: [চিৎকার করে] আমার বিউটির সঙ্গে কী কইরছ রসিক? উটো তুমারও বিটি বটে! তুমি উর বাপ বটো...এত বড় অধম্ম্ ধম্মে সইবে না! আমাকে যা খুশি করো, ছিঁড়ে ফেলাও, কিন্তুক আমার মিয়াটোকে ছাড়ান দাও। ওগো, আমি তুমার পায়ে পড়ি।

[ভাবরী দরজায় আঘাত করতে করতে বসে পড়ে।]

অতসী: ইবার কি লিজের টুসুকে নিয়েও ঘরে দোর দিবে? জল্লাদ কুথাকার! বিউটি তুর অইকখম মামিটোকে ক্ষমা কইরে দিস মা। ভাবরী আমাকে মাফ কর বুইনটি। অনেক পাপ করছি। তুর বিটিকে লিয়ে যা, পাইরলে আমারটোকেও বাঁচা।... কিন্তু তুঁই যাবি কুথাকে হতভাগী? সব রাস্তা তো আমরাই বইন্ধ কইরে রাখছি...”

[পাশে অতসীও বসে কান্নায় ভেঙে পড়ে। মঞ্চের আলো নিভে ক্ষীণ লালাভ হয়ে আসে।]

 

-----সমাপ্ত-----

 

ঘোষণা: © নিজেরই ছোটগল্প ‘হস্তান্তর’ অবলম্বনেL

নাট্যরূপ দান: ০৫.০২.২০১৮ (বিশেষ অনুরোধে)

 

12.07.21


সংক্ষিপ্তসার


জলসায় নাচ গান হচ্ছে। গানে গানে চলছে সওয়াল জবাব। ভাবরী নাচনির রসিক ধনঞ্জয় বা ধনা পাখোয়াজ/মৃদঙ্গ নিয়ে সঙ্গতে। কাছাকাছি ‘জল জল’ বলে কাতরোক্তি শোনা গেল। একদা নাচনি বৃদ্ধা বিজলীবালা মৃত্যুমুখে জল চাইছিল। কেউ দেয়নি। ভাবরী ছুটে জল নিয়ে আসার আগেই বিজলী নিথর। ডোমককে খবর দেওয়া হল পায়ে দড়ি বেঁধে ভাগাড়ে ফেলে দেওয়ার জন্য যেখানে চিল শকুনে মৃতদেহ ছিঁড়ে খাবে। বিজলীর গোঙানি বা মৃত্যুতে কারও ভাবান্তর নেই, কারণ ওর পাপের জীবন। কমলা নিজের ভবিষ্যৎ প্রত্যক্ষ করে ডুকরে ওঠে। ধনা বিজলীকে ‘খানকি’ বলায় ও ফুঁসে ওঠে বলে বিজলী মাসি ওর মতোই গুণী শিল্পী। নাচার সময় দর্শকদের কাছে পাওয়া ভাবরীর টাকা ছিনিয়ে নেয় ধনা ভাবরীকেই ‘চোর’ বলে। মড়া ছুঁয়েছে বলে তাকে স্নান করে ঘরে ধনার জন্য অপেক্ষা করার আদেশ দেয়।

ধনার বৌ অতসীর কাছে ভাবরী অস্পৃশ্য। স্নানঘরে কি কুয়োতলায় যাতায়াতেও বিধিনিষেধ আছে। সে ভাবরীর দুর্ঘটনাক্রমে (সচরাচর সন্তান হতে দেওয়া হয় না) হওয়া কন্যা বিউটির প্রতিও নির্দয়। জলসা সেরে বাড়ি ফিরে বিশ্রাম তো দূর, ভাবরীকে প্রকৃতির ডাকে মাঠ থেকে ঘুরে আসারও সময় দিতে চায় না অতসী। মেয়ের সঙ্গে দুটো কথা বলার পরিবর্তে গালাগাল সহকারে নিযুক্ত হতে হয় কঠিন কাজে। নাচনির সঙ্গে সময় কাটানো ধনাকে কাপড় ছেড়ে স্নান করে শুদ্ধ হতে হয়।

রাতে কোনও অবসরে বিউটি মায়ের বিছানায় বসে মায়ের সঙ্গে গান গাইলে ধনা ঢুকে মেয়েকে তাড়িয়ে দোর দেয়। বিউটি তার নিজের সন্তান জেনেও স্বীকার করে না, যদিও ভাবরীকে নিরস্ত করতে বিদ্রূপ করে, বাবা-মার প্রেমের দৃশ্য ছোটদের দেখতে নেই। বিউটি ভেতরে কী হচ্ছে অনুমান করে অসহায়ভাবে কাঁদে।

ভাবরীকে নাচের জলসা ছাড়াও মুড়ি ভেজে, অন্যের বাড়িতে কঠিন পরিশ্রম করে উপার্জন করতে হয় রসিক ধনার পরিবারের জন্যই। নিজের উপার্জনে তার অধিকার নেই। ভাবরীর পিড়াপিড়িতে বিউটিকে ধনা ও অতসী ছেলেমেয়েরা যে স্কুলে পড়ার সেখানে ভর্তি করা হয়েছে ঠিকই, তবে বিউটি খাটাখাটনি সামলে পড়াশুনোয় ততটা সময় দিতে পারে না। তবু স্কুলের বাৎসরিক পরীক্ষায় অতসীর ছেলেমেয়েদের তুলনায় অনেক ভালো ফল করার অপরাধে অতসী মামির হাতে নির্দয়ভাবে মার খায়। স্কুলের এক দিদিমণি এসে পড়ায় তখনকার মতো মার থামে। কিন্তু ভাবরী গ্রামের একজনের ঘর ছেয়ে ধনার পরিবারের জন্য টাকা আনার বদলে লুকিয়ে সরকারি একশো দিনের প্রকল্পে কাজ খুঁজতে গিয়েছিল জানতে পেরে ধনা তাকে নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে নিস্তেজ করে দেয়। অথচ রাতের চাহিদাটাও ভাবরীর আহত শরীর থেকেই মেটাতে হয়।

রসিক ও তার স্ত্রীর কথাবার্তা থেকে ভাবরীর আশঙ্কা, তারা বিউটিকে অন্য কোনও রসিকের কাছে বিক্রি করে নাচনি জীবনের দিকে ঠেলে দেবে। কিন্তু বিউটি প্রাইমারি স্কুল পাস করে দিদিমণির চেষ্টায় একটি এনজিও-র কাছে বৃত্তির হকদার। বিউটিকে তাই হাইস্কুলে ভর্তি করাতে মরিয়া তার মা। বিউটির পড়াশুনোয় ধনা ও অতসীর মত নেই। কিন্তু ভাবরীর অনুনয়-বিনয়ে মারধোর করলেও ধনা রাজি হয়। ধনার ছেলে নতুন স্কুলে গেলেও বিউটির মেয়েদের হাইস্কুলে অ্যাডমিশন শুরু হতে নাকি দেরি আছে। ভারবী আশায় আশায় থাকে আর হাড়ভাঙা খাটে। একদিন তার এক নাচনি বান্ধবীর কাছে শোনে, মেয়েদের উচ্চবিদ্যালয়ে অনেক আগেই ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। যে বৃত্তি পেত বিউটি, সেটা সময়মতো ভর্তি না হওয়ায় ফস্কাবে। বুঝতে পারে ধনারা মেয়েটাকে আর পড়তেই দেবে না। সে ক্ষোভে ফেটে পড়ে বলে, সে রোজকার রসিকের সংসার টানলেও নিজের মেয়ের জন্য কিছু করতে পারবে না কেন। যুক্তি দ্বারা যে সত্য খণ্ডানো যায় না, প্রহার দ্বারা তাকে দমানো যায়। মেরে অচৈতন্য করে দেয় ভাবরীকে ধনা। অতসী যদিও উস্কেছিল, কিন্তু মারের প্রাবল্য দেখে শেষে উদ্ধারে নামে; কাজ ও উপার্জনের লোক হারালে লোকসান।

তিন-চারদিন পরে ভাবরী উঠে দাঁড়ালে ধনা খুব নরম গলায় তাকে সরকারি জলসায় অংশগ্রণের জন্য সনাতন রসিকের সঙ্গে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। ধনা সঙ্গে যেতে পারবে না, কারণ স্কুলে কথা বলে রেখেছে, বিউটিকে ভর্তি করাবে নিজের পরিচয় দিয়ে। ভাবরী আনন্দে আত্মহারা হয়ে রাজি হয়। জলসা থেকে ফেরার পথে ভাবরী দেখে তাকে সনাতন ধনার বাড়িতে নয়, নিয়ে যায় তার নিজের বাড়িতে। ভাবরী নাকি এবার থেকে সনাতনের নাচনি। তাহলে বিউটি? তাকে কি ধনারা বেচে দিয়েছে অন্য রসিকের কাছে?

না। ধনা বেচেছে ভাবরীকে সনাতনের কাছে, আর নিজে ভোগ করছে বিউটিকে, মানে তার নিজেরই ঔরসজাত কন্যাকে! সনাতনের হাতেপায়ে ধরে ছুটে আসে ভাবরী। তাকে দেখে হাহাকার ও সহমর্মিতায় ডুকরে ওঠে অতসীও। 

 

 

Post a Comment

Previous Post Next Post