সম্পর্ক
পরীক্ষা
শেষ হতেই এই বাড়িতে ফিরলাম। বাক্স বিছানা সাথে নিয়েই। বি. এসসি. অনার্সের রেজাল্ট আউট
হতে মাস দুই দেরি। পরবর্তী স্তরের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছের শীর্ণধারাটা পারিপার্শ্বিক
সমস্যার মরুস্থলিতে পথ হারানোটাই স্বাভাবিক। নিজেকে এখন ভীষণ একা ভাবতেই বেশ স্বস্তি।
এই বাড়ির একটা কামরায় একান্তই অনাত্মীয়ের মতোই অবস্থান। পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে
নেহাৎ অশ্রদ্ধা ছাড়া আমার কিছুই বাড়তি পাওনা নেই। যদিও তাঁদের বেশির ভাগই এ রাজ্যের
বাইরে কিংবা প্রবাসে। এই পরিবারে পরজীবী অবস্থান। এই পরান্নভোজী জীবনের উপর প্রবল ঘৃণা
আমার। যে ভাবেই হোক একটা চাকরি আমার প্রয়োজন। তার বাইরে অন্য বিকল্পে সায় নেই।
রেলশহর
খড়গপুরের ইন্দায় এই বিশাল অট্টালিকাতে একটা দিনও আমার পক্ষে বেশ অসহনীয়। বাড়িটার মানুষদের
থেকে দূরে থাকতেই ভীষণ ইচ্ছা। কিন্তু আপাতত উপায় নেই। এই বাড়িটার প্রতি আমার ক্ষুদ্র
ভগ্নাংশ মাপেও মমত্ববোধ নেই। আমি এখানে একান্তই অবাঞ্ছিত। এই বাড়ির পুরানো কাজের লোক
শুভামাসি। শুভামাসির কোলে পিঠেই অতিবাহিত আমার রুগ্ন, রুক্ষ শৈশব।
একান্তই
অনাদৃত, উপেক্ষিত আমার শৈশব। সেক্ষেত্রে মাসির সামান্য দোষ খোঁজাও অন্যায়। তা একান্তই
সহজবোধ্য। কারণ, আমাকে আদর-যত্ন করার মতো সময় কাজের চাপের স্তূপে সহজেই চাপা পড়ে যেতো।
সেই সময়কে খুঁজে বের করার সাধ্যটাও মাসির ছিলোনা। তবুও এই বাড়িতে আমার কাছে মাতৃস্নেহের
একমাত্র বিকল্প আধার শুভামাসি।
আমার
গর্ভধারিনীও ছিলেন এই বাড়ির বিশ্বস্ত কাজের লোক। তিনি আমায় পৃথিবীর আলো দেখালেন। আমার
সাথে তাঁর নাভিরজ্জু ছিন্ন হওয়ার আগেই এই সংসারের মায়ারজ্জু ছিন্ন করলেন। তেমন কথাই
বারবার শোনা শুভামাসির মুখে। আমার বাবার নামটা মাধ্যমিক অ্যাডমিট কার্ড, সার্টিফিকেট
ইত্যাদিতে উজ্জ্বলভাবেই উপস্থিত। তবে শুরুতেই Late সংযুক্ত। তাই পিতা কিংবা মাতার মুখমণ্ডল
দেখার সৌভাগ্য এই অধমের কোন কালেই ছিলোনা। তাঁদের নাম শুধু পরিচয় হিসাবেই আমার অন্তরে
বেঁচে। তখন আমি হোস্টেলে। শুভামাসি যে মারা গেলেন, সেই খবরটাও আমাকে এই বাড়ি থেকে পাঠানো
হয়নি। শুভামাসির মৃত্যু সংবাদ আমাকে জানানোটা জরুরি কিনা, সেটা ভাবার লোকও এই বাড়িতে
সম্ভবত আর তেমন কেউ নেই। এই বাড়ির মালিক শ্রীযুক্ত অম্লানকান্তি সিংহরায় আমার পড়াশোনার
যাবতীয় ব্যয়ভার বহনে অঙ্গীকার বদ্ধ। তাঁকে মেসোমশাই বলি। তিনি কোন উপায়ে আমার সম্পর্কিত
মেসোমশাই কিনা তাও অদ্যাবধি অজ্ঞাত। শুভামাসিই আমাকে ছোটবেলায় শিখিয়েছিলেন মেসোমশাই
সম্বোধন করতে। তিনি দু-তিন জনের এরূপ দায় অতীতেও বহন করেছিলেন। সেই তথ্যও আমার বহুবার
শ্রুত। তবে অতীতের সাহায্য প্রাপ্তরা কেউ এই বাড়ির বাসিন্দা ছিলেন না। সেই বিচারে আমি
‘ব্যতিক্রমী’, এটা সহজবোধ্য।
তখনও
মেসোমশাই এই সংসারের কর্তা। তবে পরবর্তী প্রজন্মের উপর পিতৃত্বের এবং কর্তৃত্বের দাপট
দেখানোর সুযোগ তাঁর ছিলোনা। নাতি-নাতনিদের আদর করার সুযোগ থেকেও তিনি স্বাভাবিক ভাবেই
বঞ্চিত। তখন কিছু বিশ্বস্ত কাজের লোক তাঁর প্রায় সর্বক্ষনের সঙ্গী। সকালে ঘন্টা দুই
দোকানের কাজ সামলেই ফিরে আসতেন। পাইকারি ব্যবসা। চুরি-চামারির সম্ভাবনা কম। ফোনের মাধ্যমেই
আমদানি রপ্তানির কথাবার্তা চলতো। তাই তিনি বাড়িতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। এই বিরাট অট্টালিকায়
পরিচারক, পরিচারিকাদের সান্নিধ্যেই কাটতো।
এই
বাড়ির ‘বাজার সরকার’ জীবনকাকা। বেশ পুরানো চাকরি তাঁর। ইদানিং বাজার করার বাইরে দোকানেও
ডিউটি করতেন। হন্তদন্ত হয়ে এলেন আমার কামরার বাইরে। সেখান থেকেই হাঁক দিলেন, “অ, অঞ্জনবাবু,
আপনাগো ফোন আইছে। তাড়াতাড়ি আইসেন। ফোনটা ধরাই আসে। তাড়াতাড়ি গিয়া কতা শুরু করেন।” আমিও
অনুরূপ দ্রুততায় গিয়ে দেখলাম, রিসিভারটা টেবিলে পাশফিরে শুয়ে। সেটিকে কান এবং মুখের
সম্পর্কিত করেই বললাম, “হ্যালো।”
বিপরীত
প্রান্তে পিয়ালির অতি পরিচিত কন্ঠ। বলল, “বলো কেমন আছো? এম. এসসি. করার ব্যাপারে কি
সিদ্ধান্ত নিলে?”
আমি
কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা গ্রহণে বাধ্য। তাৎক্ষনিক উত্তর তৈরির সামর্থ্যের অভাবে। আমার
কণ্ঠে বিমর্ষতা স্বাভাবিক নিয়মে উপচে পড়ছিলো। জানালাম, “পিয়ালি, প্লিজ কিছু মনে নিওনা।
আমার এম. এসসি. পড়তে আদৌ ইচ্ছা নেই। একটা চলনসই চাকরি জোগাড় করাই একান্ত জরুরি। শিক্ষাগত
যোগ্যতা বৃদ্ধিটা নিতান্তই বিলাসিতা। একজন পরান্নভোজীর পক্ষে তা একান্তই বেমানান।”
“চাকরি
না করেও যদি উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাও, তাকেও অগ্রাহ্য করবে?”
“তাছাড়া
উপায় কি বলো?”
“উপায়
অনেক আছে। ফোনের খরচ বাড়াতে চাইছি না। বিকেলে আই. আই. টি. গেটের সামনে এসো। তোমার সাথে
সামনাসামনি কথা বলতে চাই। কি আসবে তো?”
“বলছো
যখন যাবো। কাজের কাজ কিছু হবে, এমন আশা মোটেই করবে না পিয়ালি।“
“বিকেলে
এসো। তখন আশা নিরাশার ভাবনা ভাববো। এখন রাখছি। ঠিক পাঁচটায় আসবে.........”
পিয়ালি
আমার চেয়ে বছর খানেকে ছোট। তার কলেজ প্রেসিডেন্সি। কোলকাতাতে মেসে থেকেই পড়াশোনা। তার
অনার্স ইংরাজিতে। আমার বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির, ফিজিক্সে অনার্স। হোস্টেলের
আবাসিক। দু’জনারই গ্র্যাজুয়েসনের বছর এবং বিশ্ববিদ্যালয় একই। খড়গপুর হাওড়া যাতায়াতের
পথেই পরিচয়। উভয়ের ভালোলাগার উষ্ণতাটা পারস্পরিক অনুভবে। সেখানে ভালোবাসার রঙ লেগেছিলো
কিনা, তা আমার একান্তই অজ্ঞাত।
আপাতত
একই শহরের বাসিন্দা আমরা। আমার আশ্রয় দাতার অট্টালিকা ইন্দাতে। পিয়ালিদের বাড়ি সুভাষপল্লী।
সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী কন্যা সে। আমার এম. এসসি. পড়া বা শিক্ষাগত যোগ্যতা
বৃদ্ধি বিষয়ে আমার তুলনায় তারই আগ্রহের মাত্রা অনেক বেশি। সেটা তার ফোনবার্তায় প্রকাশিত।
আমার
বিচারে ধূলোওড়া ম্যাড়ম্যাড়ে বিষন্ন বিকেল। সেই অপরাহ্ণে আমার হাজিরা আই আই টি গেটের
অদূরে। সময় চারটে পঞ্চান্ন। আমার সস্তা দামের অ্যাংলো-সুইস ঘড়ির ডায়াল জানালো। ঠিক
পাঁচটা এক মিনিটেই হাজির পিয়ালি। আমায় ইশারায় ডাকলো, গাছের ছায়া্মাখা বেঞ্চিতে বসতে।
গিয়ে বসলাম তার পাশে। সামান্য ইঞ্চি দশেকের ব্যবধান দু’জনার।
পিয়ালিই নীরবতা ভাঙলো।
বললো, “জানো অঞ্জনদা, আমি একটা চাকরি পেয়েছি।”
“রেজাল্ট
আউট হোলনা, তার আগেই চাকরি পেলে কি করে?”
“চাকরিটা
স্টেটসম্যান কাগজে। পরীক্ষার ক’দিন পরেই এক বন্ধুর সাথে চৌরঙ্গি স্কোয়ারের অফিসে গিয়েছিলাম।
সেখানেই কথায় কথায় বেরিয়ে পড়ে আমি ইংলিশে অনার্স করেছি। এই পরীক্ষা মিটেছে। এডিটোরিয়াল
সেকশনের একজন আমায় প্রশ্নকরেন, “আমি বাঙলা বাক্য বললে, শুনেই ইংরেজি ট্রান্সলেশন করতে
পারবেন?”
“কি
উত্তর দিলে?”
“বললাম,
বলুন চেষ্টা করে দেখি। পারি কিনা। ভদ্রলোক কয়েকটা বাক্য বললেন। আমিও তর্জমা করলাম।
তাঁর মুখ দেখেই বুঝলাম, তিনি খুশি। আমাকে জানালেন, গতকালের স্টেটসম্যানের অ্যাড দিচ্ছি
আপনাকে। সেই অনুসারে একটা অ্যাপলিকেশন রিসিভং সেকশনে জমাকরে যান। তাই করলাম। দিন কুড়ি
পরেই ইন্টারভিউয়ের চিঠি হাজির বাড়িতে। কন্ডিশনাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়েছি। আগামিকালই
জয়েন করবো। তোমার সাথে আপাতত দেখা হওয়ার সুযোগ নেই। বাড়ির নম্বরে কল করলে কথা বলবে
আশাকরি।”
“নিশ্চয়
বলবো। কিন্তু আমাকে আজকে ডাকার উদ্দেশ্যটা কি?”
“সেটাই
তো বলবো এবার। শোন অঞ্জনদা, আমি কোলকাতায় তোমার থাকার জায়গা ঠিক করছি। এম. এসসি. তোমায়
পড়তেই হবে।”
“আমি
নতুনভাবে পরজীবী হতে চাইছি না। রেজাল্ট বেরোলেই তোমার মতোই একটা চাকরি জোগাড় করে নেবো।
আমি এম. এসসি. পড়বো না। কিছুতেই না।’
“মাথাগরম
করবে না। কোনভাবেই চাকরির চেষ্টা করবেনা। পড়তে তোমায় হবেই। দায় নেবো আমি।“
“না,
আমি মানতে পারছিনা। আমি চল্ছি। পরে কথা বলবো। আসছি....”
আমার
তখন মাথাগরম। আমি আর দাঁড়াইনি। ফিরে এলাম ইন্দার বাড়িতে। পরে বিজয় পেলো পিয়ালিই। নিত্যদিনের
ফোনালাপেই অনড় আমিকে নড়ালো। কোলকাতায় বাসা ঠিক করলো। ভর্তি হলাম এম. এসসি.তে। তার মা-বাবার
সম্মতিতে আমায় আইনি বিয়েতে বাধ্য করলো। ইন্দার বাড়ি ছাড়লাম, মেসোমশাইকে না জানিয়ে।
স্থায়িভাবে চলে গেলাম কোলকাতা। মেসোমশাইকে চিঠিতে সব জানালাম। তিনিও আমাকে কোন উত্তর
দেননি।
সময়
গড়িয়ে চললো তার আপন নিয়মে। এম. এসসি.র পর রিসার্চ। তারপর কল্যানী ইউনিভার্সিটিতে যোগদিলাম
লেকচারার হিসাবে। এবার পিয়ালীর পালা। সে চাকরি ছেড়ে, বি. এড. করলো। সেও চাকরি পেলো
কল্যানী বি.সি. মেমোরিয়াল গভঃ স্কুলের সহশিক্ষিকা পদে। সরকারি চাকরির বদলির ঝক্কি মিটিয়ে
আবার ফিরলো কল্যাণী। সেখান থেকেই গত বছর অবসরিত। কোলকাতায় থাকতেই পুত্র অনিন্দ্যর জন্ম।
সে এখন পোস্ট-ডক্টরেট করার জন্য এম. আই. টি.তে।
কল্যানীর
ভাড়া বাড়িতে পুরানো খোপে পায়রার মতোই গায়ে গা ঠেকিয়ে অবসরিত বুড়োবুড়ি। ইন্দা ছাড়ার
পরে বার পাঁচেক গিয়েছিলাম সুভাষপল্লীতে। পিয়ালীর প্রয়োজনে কিংবা পারিবারিক অনুষ্ঠানে।
কয়েকটা রাতও কাটিয়েছিলাম খড়গপুরে। ইন্দার বাড়ির কথা মনে এলেও যাইনি। প্রবল ঘৃণাবোধ
বাড়িটার প্রতি। না, বাড়িটার প্রতি নয়। সেই বাড়ির কিছু মানুষের প্রতি। বাড়ি তো কংক্রিটমোড়া
আশ্রয়। বেশিরভাগ বৃদ্ধ-বৃদ্ধার অতীত চারণার বাসনা জাগে একটা সময়ে। আমারও ঘটলো তাই।
যাবো কি যাবোনা, এমন দ্বিধাও ছিলো। দ্বিধা থাকার কারণে পিয়ালীকে না জানিয়েই বেরোলাম।
কিছু মানুষের প্রতি অশ্রদ্ধা মনের পকেটেই রইলো। পিয়ালীকে গোপন করেই গেলাম ইন্দার বাড়িতে।
বাড়িতে
প্রবেশের আগেই মনটা উদভ্রান্ত। দীর্ঘ চার দশকের ব্যবধান। দাঁড়ালাম মূল ফটকের সামনে।
প্রাচীরের পলেস্তরায় কালের ছোবল। পলেস্তরার ফাঁকে ছোটবড়ো পাদপকূলের মূলরাজির উদ্ধত
অনুপ্রবেশ। সেই বেদনায় বিব্রত, প্রায় বিধ্বস্ত প্রাচীর। ভেঙে পড়েনি। মূল অট্টালিকারও
বেজায় শ্রীহীন অবস্থা। মূল ফটকের পাল্লা হাটকরে খোলা। কোন দারোয়ান নেই। আগেতো এমন ছিলোনা।
বাইরে থেকেই অনুমান করলাম বাড়িতে বর্তমান বাসিন্দার সংখ্যা আগের তুলনায় বেশি। বারান্দার
ধারে শুকোতে দেওয়া পোশাকেই তা প্রমাণিত।
উঠানের
সামনের অংশ পেরিয়ে পৌঁছালাম বারান্দায়। এক অপরিচিতার প্রশ্ন, “কাকে চাই কাকু?”
“অম্লানবাবুদের
কেউ আছেন এখানে?”
“উনিতো
আগেই মারা গেছেন। তাঁর ছেলে, বৌমারা কি একটা কারণে আর আসেন না, শুনেছি। তাঁদের অংশেই
ভাড়াটেরা। আপনি বরং
সোজা নিচের তলার পূর্ব দিকের কামরায় যান। ওখানে কামাক্ষাবাবু আছেন। তিনিই বাড়িটার কেয়ার-টেকার।
তিনি হয়তো আপনাকে উত্তর দিতে পারবেন।”
গেলাম
কামাক্ষাবাবুর কাছে। রোগা ঢ্যাঙা ভদ্রলোক। আমার তুলনায় বয়স কম। মাথায় কেশের স্বল্পতা।
গোলাকার মুখমণ্ডলে তীক্ষ্ণনাসা, পুরু ঠোঁট। গাত্রবর্ন তামাটে। চোখে মোটা লেন্সের চশমা।
পরনে ধুতি গেরুয়া রঙের হাফহাতা পাঞ্জাবি। দৃষ্টিতে বুদ্ধির ছাপ। আমিই পরিচয় জানালাম,
“আপনিই সম্ভবত কামাক্ষাবাবু? আমি এককালে এই বাড়ির বাসিন্দা ছিলাম। শৈশব থেকে যৌবনের
প্রথম পর্যন্ত এই বাড়ির সাথে আমার সম্পর্ক। আমি অঞ্জন সিংহরায়।”
“কি
নাম বললেন! অঞ্জন সিংহরায়?”
“হ্যাঁ,
সন্দেহ কিসের?”
‘আপনাকেই
খুঁজতে যাওয়ার কথা আমার। যাক পরিশ্রমটা বাঁচলো। আমি সুভাষপল্লীতে আপনার শ্বশুরবাড়িতে
কয়েকবার খোঁজ করেছিলাম। তাঁরা কল্যানীর একটা ঠিকানা দিয়েছিলেন। আমি ফোন নম্বর চেয়েছিলাম।
তাঁরা দিতে অস্বীকার করেছিলেন। তাঁরা আমার মতো অপরিচিতকে নম্বর দেননি। আপনার খোঁজে
কল্যানীই যাবো, এমনটাই ঠিক করেছিলাম। যাক আপনি নিজেই হাজির। আমার ভাগ্যটা ভালো বলতে
পারেন…’
‘কেন?
আমাকে খোঁজার কি দরকার?’
‘আছে
মশাই দরকার। আমিতো যখের ধনের মতোই আপনার সম্পত্তি আগলে......’
‘এখানে
আমার সম্পত্তি? কিসের.........?’
‘যদি
আপনিই সব জানবেন, তাহলে আমি কি বলবো? শুনুন, অম্লানবাবুর উইল অনুসারে আপনি দ্বিতলের
অর্ধাংশের মালিক।’ তাঁর কথা শুনে আমিতো বেজায় অবাক। আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই তিনি
টেবিলের ড্রয়ার থেকে দুগোছা চাবি নিলেন। বিস্ময়ে আমার প্রশ্ন, “আমি? অর্ধাংশের মালিক?
কি বলছেন আপনি?”
‘বিশ্বাস
হচ্ছেনা? এই আপনার ঘরগুলোর চাবি। আপনি যে ঘরটায় থাকতেন, সেই ঘরেই অম্লানবাবুর আলমারিটা।
তার দেরাজেই উইলটা। এই নিন আলমারির চাবিগুলো।’
আমি
চাবি হাতে নিলাম না। দোতলায় কামাক্ষাবাবুর সাথেই উঠলাম। আমার বিস্ময়ের নিষ্পত্তি এবং
প্রশ্নের উত্তরের আশায়। আমার অতীতের আস্তানার চাবি তিনিই খুললেন। খুলে দিলেন জানালাগুলো।
জমাট ভ্যাপসা গন্ধটা তখনও নাকে। কামাক্ষাবাবু ‘আসছি’ বলেই বিদায় নিলেন। খুললাম ধূলোমাখা
সেগুন কাঠের আলমারি। টান দিলাম দেরাজের নবটায়। উপরেই উইলটা, সহজেই বোঝা গেল। সেটি বের
করলাম। রোলকরা উইলটা লাল ফিতের বাঁধন মুক্ত। সেই রোলের মধ্য থেকেই একটা খড়খড়ে তুলোট
কাগজের মতো মোটা ধূসর কাগজ মেঝেয় পড়লো। তুলে দেখলাম, একটা জন্মকুণ্ডলী। সেখানে গ্রহাদির
অবস্থান সমেত ছক। তার নিচেই জাতক পরিচিতি। জাতকের নাম আয়ুষ্মান অঞ্জন সিংহরায়, পিতা
লক্ষ্মীকান্ত সিংহরায়। পিতার নামটা কাটা ডটপেনের লাল কালিতে। তার নিচেই লাল কালিতে
লেখা শ্রী অম্লানবিকাশ সিংহরায়। এই কাটা এবং লাল কালিতে লেখাটি একান্তই পরবর্তী কালের।
রাশি, গণ, রাশ্যাশ্রয়ী নাম ইত্যাদি কোন কিছুতেই কাটাকুটি নেই। উইলটা পড়লাম। সেখানেও
উল্লেখিত, পিতা অম্লানবিকাশ সিংহরায়।
জন্মকুণ্ডলীতে
নামের কাটাকুটিতেই স্পষ্ট লক্ষীকান্ত সিংহরায় নামক কোনও ব্যক্তির সাথে আমার মায়ের বৈবাহিক
সম্পর্ক হয়তো ছিলো। অথবা এই জন্ম কুণ্ডলী যিনি তৈরি করিয়ে ছিলেন তিনি নিজের ছদ্মনাম
হিসাবে লক্ষীকান্ত সিংহরায় নামটি ব্যবহার করেছিলেন। এই জন্মকুণ্ডলী তাঁর জিম্মাতেই
ছিলো। শেষ বয়সে আমাকে পুত্র হিসাবে স্বীকার করার কারণেই তিনি জন্মকুণ্ডলীতে কেটে স্বনাম
ব্যবহার করেছিলেন। প্রশ্নটা পেয়ে বসলো, লক্ষ্মীকান্ত এবং অম্লান বিকাশ কি আলাদা ব্যক্তি?
নাকি অভিন্ন?
সেই
সেগুনকাঠের আলমারির অন্যান্য তাকের ফাইলগুলোকে নামালাম আমার পড়ার টেবিলে। একটার পর
একটা ফাইলের প্রতিটা কাগজ দেখতে রইলাম। একটা ফাইলে পেলাম আরও তিন জাতক এবং এক জাতিকার
জন্মকুণ্ডলী। সেই তিন জাতক এবং জাতিকার পিতার নাম শ্রী অম্লানবিকাশ সিংহরায়। অনেক অন্বেষণের
পর অন্য একটি ফাইলে মিললো একটি প্রবৃদ্ধ তুলোট কাগজের রোল। সেটি একটি সুদীর্ঘ কোষ্ঠি।
সেটির প্রথমেই উল্লেখিত জাতকের পরিচয় এবং জন্মতারিখ, জন্মলগ্ন, রাশি, জন্মস্থান ইত্যাদি।
সেখানেই
পেলাম জাতকের নাম অম্লানবিকাশ সিংহরায়। রাশ্যাশ্রয়ী নাম লক্ষ্মীকান্ত সিংহরায়। সন্দেহের
অবকাশ থেকে খানিক মুক্তি। বুঝলাম অম্লানবিকাশ এবং লক্ষ্মীকান্ত অভিন্ন। এখনও দোলাচল,
উক্ত ব্যক্তির সাথে আমার মায়ের প্রকৃত সম্পর্ক কি ছিল? রক্ষিতা নাকি বিবাহিতা স্ত্রী?
কোনটা সত্যি? তা আমাকে জানতেই হবে। তবুও সংশয়ের দোলাচলে। আমি কি সত্যিই এই বাড়িটার
কেউ ছিলাম? জন্মকুণ্ডলী, উত্তরাধিকার পেয়েও আমি দ্বিধাগ্রস্থ। আমি কি কোনও গোপন প্রেমের
ফসল? নাকি কোন ধনাঢ্য ব্যক্তির জবরদস্তি নারীদেহ সম্ভোগের ফল? কোন্টা সত্যি, তা আমাকে
জানানোর মতো কেউই এখন ইহ জগতে নেই।
বেজায়
অবসন্ন লাগছিলো। চাবি লাগিয়ে কামাক্ষাবাবুর কাছে চাবির গোছা দিতে গেলাম। তিনি নিতে
অস্বীকার করলেন। সম্পত্তি, জন্মকুণ্ডলী, পিতৃপরিচয় আর জন্মদাত্রীর সঙ্গে তার ধোঁয়াশা
মাখা সম্পর্ক নিয়ে অন্ধকারে বসে রইলাম।
[দেহ ছাড়াও শেষ অনুচ্ছেদ অনুমতিক্রমে সম্পাদিত]