অণুমিতাদের পরিত্রাণ নেই
পূর্ণপ্রভা ঘোষ
‘হোয়াট ক্যান আই ডু? হাউ ক্যান..হাউ ক্যানডু দিস্?’
ক্রমশ গলার স্বর চড়ছে, পারল না! শেষটায় একেবারে কান্নায় ভেঙে পড়ে। থরথর পছিল অণু। চারপাশে অনেক মানুষ। ঘুরে ঘুরে দেখছিল সবাই।
খুব খানিকটা ভেবলে গেলাম আমরা!
অণুমিতা। সেইযে মিষ্টি মেয়েটা? আমাদের
সকলের আকাঙ্ক্ষার সার্থক
রূপ!
একহারা
চেহারায় উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা। চাপা রঙটার জন্যই ওকে বেশি ভালো লাগত। মসৃণ ঝকঝকে ত্বক। উলোঝুলো ঝুপসি চুলগুলো কাঁধের উপর নেমেই অবাক! শান্ত এবং দৃঢ়মনে এমনভাবেই থাকত অণু।
না চোখেমুখে,
না সাজপোষাকে এক্কেবারে গোছানো ছিল না! তবু এমন অগোছানোতেই ওর
আনন্দময়তার পরিচয় পেতাম। হাসিখুশি মেয়েটা ছুটে বেড়াতো এদিক ওদিক। রোদবৃষ্টি-জল কিছুতে দমার পাত্রী না!
স্কুল জীবনে যেমন,কলেজেও সে
একইরকম। আজও যা, কালও তাই।
ওর নাকি কুড়িবছরের মেয়ে রয়েছে!শুনেই তো আকাশ থেকে ধপাস্!
‘সেকিরে!তুই-ই তিরিশ ছুঁয়েছিস কিনা, তোর কুড়িবছরের মেয়ে?বিয়ে করলি কবে? কিসব যাতা বকছিস?’ রীতিমত
ধমক দিই আমি।
শ্যামলী
ফোড়ন কাটে,
‘ফ্রীতে মেয়ে পেয়েছিস নাকি বরের সঙ্গে?’
ওদিক থেকে কে
যেন বলে ওঠে, ‘শেষে তুইও সেকেন্ডহ্যান্ডে!’
সামনে নানা ধরণের যানবাহনের দৌরাত্মি। জ্যামের জটে থেমে থেমে চলছে গাড়িগুলো। ঘর্ঘর,
ঝড়ঝড়, ঘ্যাঁচঘোচ
নানান আওয়াজে কান পাতা দায়। আমরা মেডিক্যাল কলেজের গেটে। পথচারী
মানুষের হাজার একশ রকমের মন্তব্য শুনছি।
তার কিছুই স্পর্শ করছিল না
অণুকে। কোন ঘোরে রয়েছে যেন।
ভালো করে তাকালাম। বেশ রোগা হয়েছে! তুলতুলে
ভরাট গালগুলো নেই। চোখমুখে ধার বেড়েছে। নাকটা বেশ টিকালো দেখাচ্ছে! দৃষ্টি আনমনা!
পর্যবেক্ষণ পথে চোখে পড়ল ড্রেস। শাড়ি পরেছে?কবে শিখল?
সাধারণ ছাপাশাড়ি যদিও! তবে গুছিয়েই
পরেছে।
স্কুল থেকে কলেজ, সাতটা বছর। কখনও শাড়িতে দেখেছি? উঁহু!
মনে করতে পারলাম না!
স্কুলে আমাদের নাইন থেকেই শাড়ি। সাদা খোলের সবুজ পাড়। রাগে গজগজ করতে করতে হতচ্ছেদ্দায় চারটে বছর পার করেছিলাম। উচ্চমাধ্যমিকের শেষ পরীক্ষা দিয়ে শান্তি। গঙ্গাস্নান করে মুক্তি পেয়েছি!
তারপর কলেজ। পায় কে! যেমন খুশি সাজো। বহু লড়াই করে শালোয়ার কামিজ পরতাম! বড় হয়েছি। পাখা গজিয়েছে। আমাদের
আধা মফস্বল শহরে অন্য ড্রেসের কথা ভাবতেই পারতাম না! আধুনিক পোষাক পরার ইচ্ছে হলেও স্বাধীনতা দিত না বাড়ি থেকে! কিন্তু অণু?
সে ছিল আমাদের সকলের অন্তরের পূর্ণপ্রকাশ। আধুনিকতায় ওস্তাদ। আমাদের পক্ষে যা অসম্ভব!
কলেজের তিনটে বছর জিনস আর
টপে অণু দাপিয়ে বেড়িয়েছিল। চোখ কপালে উঠত সকলেরই। কারণ মফস্বলী চোখে ড্রেসটা এক্কেবারে বখে যাওয়ার। ভদ্রতায় সহজ না!
অণু যেন ইচ্ছে করেই বেপরোয়া হোত।
আর এখন?
গুছিয়ে শাড়ি পরেছে!পাটেপাটে নিপুনতা। বুঝলাম, বেশ অভ্যস্থ। বাহ! নিশ্চয়ই শশুরবাড়ির চাপ! হুম!
কুখ্যাত ডানপিটে মেয়েটা কেজানে কোন অখ্যাত গাঁয়ে পড়েছে!
মন খারাপ হল! কিন্তু বিবাহিত
চিহ্ণগুলো?ছাড় পেয়েছে নাকি?
বিয়ের পরে আমাদের অতসী আর
শ্যামলী কলকাতায়। আমি তো
মেদনীপুরে। পিউ মুম্বাই। কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি।
তারপরেও কলেজস্ট্রীট চত্বরকে
কেন্দ্র করেসংযোগ রেখে চলেছি আমরা। সুযোগ পেলেই একত্র হই।
একটা বছর গেল না, অতসীর বিয়ে গেল ভেঙে। কলেজে পড়ায়, অধ্যাপিকা। গুরুগম্ভীর। পরের পর্যায়ে কড়ক দিদিমণি শ্যামলী এবং আমি। বরের হাতধরে পিউ মুম্বাইতে। শশুরবাড়ি
অবশ্য কলকাতায়।বরের দৌলতে ফ্যাশন কোর্স করে নামী ডিজাইনারের অফিসে চাকরিও পেয়ে গেল। এককথায়
হাইফাই ব্যাপার!
আমরা বলি,
‘ঝক্কাস্-বম্বেবালি’। পিউ কলকাতায় এলে চারিবেদের মহামিলন কে
আটকায়!
পরশু কলকাতা পৌঁছেছে পিউ। তারই প্ল্যান মাফিক উড়ে বেড়ানো সারাদুপুর। জমিয়ে লাঞ্চ সেরেছি। চাকরি প্রাপ্তির কারণে ট্রীট দিয়েছিল। মুম্বাইয়া আদব কায়দার ঝলকে আমরা একেবারে হাঁ-হতবাক!
আনন্দের রেশ নিয়ে হাহা-হিহি করতে করতে পাতালপ্রবেশ। সেন্ট্রালে নামলাম। মেট্রো থেকে বেরিয়ে মেডিক্যালের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম,
তখনই অণুর সঙ্গে দেখা।
কলকাতায় এলে,
কলেজস্ট্রীট থেকে কয়েকটা বই সংগ্রহ করতেই হয়। আমার কর্তার মন
ভেজাতে হবে। প্রবলভাবে বইপোকা তিনি। সারাক্ষণই মুখে বই। পৃথিবীতে
আর যাকিছু থাকুক, সে বিষয়ে হেলদোল নেই। খাওয়া হল
কি হল
না, জামাকাপড়
জুৎসই জুটুক না জুটুক, কিচ্ছুতে
কিছুই যায়-আসে না!
কিন্তু নিয়মিত বইয়ের জোগান না
থাকলে মস্তিষ্কে প্রবল ঝড়। সামলানো
অসম্ভব তখন!
কলকাতা এলেই তাই কলেজস্ট্রীটে দৌড়োই। এইভাবে ছোটখাট লাইব্রেরী করেছি ফেলেছি আমাদের ছোট্ট বাড়িটাকে। বেডরুমটাও বইয়ের দখলদারীতে বেদম নাজেহাল!
এককালে আমারও ভয়ানক নেশা ছিল!ইউনিভার্সিটিতে ঢোকার আগেই বইয়ের দোকানে হাজিরা। দোকানদার দাদারাই বইয়ের খবরাখবর জানাতো সাগ্রহে। বই সংগ্রহ করতাম রাজ্যজয়ের আনন্দে। বরপণ না চাইলেও বইগুলোকে বগলদাবা করে নিয়ে গিয়েছি শশুরবাড়ি। আমার উনার সঙ্গে তো বইপ্রেম থেকেই আলাপ। ভরসা এবং সংসার পাতা। আবার এই সংসারই আমার সুখ-নেশা ঘুচিয়ে দিয়েছে!
পুরোনো অভ্যাস!
ভুলতে পারি না! কলকাতা এলেই কলেজস্ট্রীটে ঢুঁ মারি।
কিন্তু এখানে অণুর দেখা পাব,
ভাবিনি! সেদিন আর কেনা হল না বই!
একরাশ ভাবনায় ভেবলে যে যার বাড়ি ফিরেছিলাম সেদিন!
***
গ্র্যাজুয়েশনের ফাইন্যাল ইয়ারেই হঠাৎ উধাও হয়েছিল অণু! দেখা হল আবার,
হঠাৎই! হয়ত না দেখা হলেই ভালো হত!
এমন পরিণতি দেখার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না! ও ছিল ডাক্তারবাবুর আদরের কন্যা
‘ডল’। ‘ডল’ সত্যিই পুতুল পুতুল। যদিও আদিখ্যেতা পছন্দ করতেন না মা।
কিন্তু বাবার সামনে কিছু বলতেও পারতেন না।
ভুক্তভোগী
মা জানতেন,
ঘরেবাইরে সবদিক সামলাতে হয় মেয়েদেরই। নইলে সাজানো সংসারও নিমেষে ছন্নছাড়া!
আবার বাইরের বিপদেও দিশাহারা হবে!
শেখাতে চাইতেন অনেককিছু। কিন্তু ঠিককথা ঠিকসময়ে কে
আর শুনতে চায়? পুতুলপুতুল মেয়ে হেসে খেলে, নেচে গেয়ে বেড়ায়। দিন এগোয়!
ডাক্তারবাবু
পরোপকারী, সমাজসেবী। সংসারের খুঁটিনাটিতে মাথা ঘামান না। সংসার চলে মা ও
ঠাকুমার তত্বাবধানে।
রমরমিয়ে না
হলেও নির্বিঘ্নে গড়াচ্ছিল
চাকা। বাবার আদরের প্রশ্রয়ে স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়াতো মেয়ে। অথচ সে কে?
‘ডলে’র দুই বেশ মস্তান গোছের! বাবার সমস্ত মনোযোগ ওই দু-আঙুলের
বোনটা পেলে কার না রাগ হয়? বোনকে তাদের
খুব হিংসে। এমনিতেও তারা স্বভাবেও খুব রগচটা!
রাগহিংসাতে জ্ঞানহারা হয়ে তক্কেতক্কে থাকত দাদারা। মা বাবাও বোঝেননি! জমাট বাঁধা ক্রোধহিংসা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে কী ভয়ানক রূপ নেবে।
***
অণুমিতার
সঙ্গে দেখা হয়েছিল দু’হাজার সতেরোতে। কেটে গেছে পাঁচবছর। না! ওর সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি আর আমাদের। অনেকভাবে চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা কিম্বা যোগাযোগের নম্বর কিছুই সংগ্রহ করতে পারিনি সেদিন। এই ক’বছরে আমরা চারজন বারকয়েক একসাথে হয়েছি। জমিয়ে আড্ডা দেওয়ার চেষ্টা করেছি প্রাণপণে! কিন্তু বারেবারেই
যেন তাল কেটে যায়! কথায় কথায় ছোটবেলার স্মৃতির ঝাঁপি খুলতে গেলেই এসে পড়ে অণুর কথা। হরিহর আত্মা ছিলাম পাঁচজন। সবাই মজা করে
‘পাঁচমাথার মোড়’
বলত।
সানন্দেই
উপভোগ করতাম দুর্নামটা। সত্যিই তো। সারাক্ষণই আমাদের পাঁচমাথা একসাথে। পাঁচমাথা যেমন সর্বদা ভীড়ে গমগম,
দুষ্টুমির জঞ্জালও জমত তেমনই! স্কুল পেরিয়ে কলেজ। উন্নত পরিভাষায় সেই দুর্নামের খ্যাতি জুটল! ‘পঞ্চরত্ন’। খেলাধুলায়,
সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে কিম্বা
পড়াশোনায় বিশেষ তালিকায় থাকতাম আমরা। সেইসময়ে
হঠাৎ হারিয়ে গেল অণু!
ওর বাড়িতে গিয়েও কোনোভাবে খোঁজ পেলাম না। কয়েকদিনের
মধ্যেই ওর
মা মারা গেলেন। ডাক্তারবাবুও স্ট্রোক
হয়ে শয্যাশায়ী। এতদিন ছুটে দাপিয়ে দশজনকে ভরসা জোগানোর মানুষটি নিজেই তখন পেশেন্ট হয়ে অসহায় অবস্থায় বিছানায় বন্দী। অণুর দাদারা দু’চক্ষে দেখতে পারত না আমাদেরকে। খোঁজ নিতে গেলেই খামোকা অপমান জুটত। অণুর ব্যাপারে একটুকরো খবর পেতাম না কোনোভাবেই! একসময় প্রবল বিতৃষ্ণায় খোঁজ নেওয়াটা বন্ধ করে দিলাম। মিষ্টিমেয়ে ‘ডল’ অর্থাৎ
অণু হারিয়ে গিয়ে ‘পঞ্চরত্ন’ থেকে আমাদেরকে তখন
‘চতুর্বেদ’ বানিয়েছে।
তারপর জীবনযুদ্ধে হিমসিম খেতে খেতে এগোচ্ছিলাম,
হঠাৎই অণুর সঙ্গে দেখা। এড়িয়েই যাচ্ছিল
আমাদের। প্রচন্ডভাবে
অস্থিরতায় ছটপট করছিল। ভয়ও পাচ্ছিল খুব! কাকে ভয়?কেন ভয়? অনুমান
করতে পারছিলাম না সেইমুহূর্তে!
অবশ্য জানতাম নিখোঁজের আগে থেকেই ওর
দাদাদের প্রচন্ড দৌরাত্মি! সাংঘাতিক কুখ্যাতি এলাকায়। নামী ডাক্তারের ছেলে হয়েও অসভ্যতার লাগাম ছিল না! মস্তানি আচার-আচরণে এড়িয়েই চলত সকলে, আমরাও।
হয়ত ওর
দাদাদের প্রতি বিতৃষ্ণায় অণুর প্রতি ভালোবাসাও মলিন হয়ে গিয়েছিল। তবুও ভুলতে পেরেছি কই? প্রতি মুহূর্তেই মনে পড়ত। সেইসব সোনালী স্মৃতি ভুলি কীভাবে?
কত পরিকল্পনা!
দাঁতে দাঁত চেপে প্রস্তুতি নেওয়া আর জয়লাভ।
সবার আগে অণু দাঁড়িয়ে। আমরা পেছনে তার অনুচর।
সেদিন দেখা হওয়ার সময় সেই কথাগুলোই মনে করিয়ে দিয়েছিলাম। বললাম, ‘ঠিক আছে তোর কথা বলতে না
চাস, বলিস না! যেমন আগে ছিলিস তেমন কিছু কর। যাতে তোর সঙ্গে থাকতে পারি। বছরে একবার অন্তত জমায়েত হই কোথাও।’
পিউ জিজ্ঞেস করেছিল,
‘সেই যে
এনজিও করতিস?
আছে এখন?
আমাদেরকেও নে। অন্তত তোর সূত্রে ভালো কিছু কাজ করি।’
কেঁদে উঠল অণু! আর্তস্বরে বলে উঠেছিল, ‘কীভাবে সম্ভব?’
ওকে ওইভাবে সাংঘাতিক ভয় পেতে দেখে থমকে গিয়েছিলাম সবাই! থরথর কেঁপে ওঠা আর
ঝরঝর কান্নার পরে কিছুই বলতে পারিনি সেদিন।
ভুলতে কষ্ট হলেও অণু আমাদের বলেছিল,
ভুলে যেতে। পেরেছি
কোথায়! আমাদের
সকলের প্রাণভোমরা ছিল সে! ডাক্তারবাবুর
আদরের ‘ডল’! হাসিখুশি এনার্জী ভরা আনোন্দোজ্জ্বল মিষ্টি মেয়েটা! সকলের প্রিয়, সকল শুভময়তার কান্ডারী মেয়েটিকে ভোলা সম্ভব?
***
দু’হাজার কুড়ি। দারুণ উচ্ছ্বাসে ভেসে ফ্রেব্রুয়ারীর শুরুতে সবাই শান্তিনিকেতন গিয়েছিলাম। পিউও এসেছিল। তবে একা। অফিসের
কাজে ওর
হাজব্যন্ড তখন বিদেশে। অতসী,
শ্যামলী, পিউ ও আমি,
চতুর্বেদী হুল্লোড়ে লাগামছাড়া আনন্দে মেতেছি।
কলকাতাতে পিউ থাকবে আরও মাস দু’য়েক।
আবার বসন্ত উৎসবে এসে জুটব। পরিকল্পনা পাক্কা করে শান্তিনিকেতন ছেড়েছিলাম। আর তারপরে তো
মাসটা ফুরোনোর আগেই করোনাতঙ্ক এবং লকডাউন।
একদিন, তিনদিন, চোদ্দদিন, একুশদিন, ক্রমশ এঁটে বসছে লকডাউনের বেড়ি। আটকে পড়ল পিউ। ওর হাজব্যান্ড তখনও আমেরিকাতে। আমরা বাকিরা যে যার জায়গায়। না
ছুটি! না স্বস্তি! না স্বাভাবিক কাজকর্ম!
কীযে ভয়ঙ্কর অবস্থা! স্বাভাবিক কাজকর্ম ফেলে সবাই গৃহবন্দী। কেউই জানি না ভবিষ্যৎ কি!
ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হচ্ছিলাম। পেপার বন্ধ। টিভিতে একই বস্তাপচা প্যানপ্যানানি!তর্কযুদ্ধ! নয় কাদা ছোঁড়াছুড়ির নাটক!
বিরক্তিকর বকোয়াস। বোধহয় পাগল হয়ে যাব। ফোনেও কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করত না।
একই আতঙ্ক!
গুজব! সস্তার
চাটুকারিতা। অনলাইন ক্লাসের
চক্করে মাথা বনবন!
সেদিন সকাল থেকেই মনটা চঞ্চল!
শ্যামলী ফোনে জানালো, ওদের আবাসন পুরোপুরি ব্লকড। বিদেশ প্রত্যাগত কোন নবাবপুত্তুর নাকি করোনা ছড়িয়েছেন! পিউর ফোনে প্রবল কান্না! ওর হাজব্যান্ড
বিদেশে আটকে,
সাংঘাতিক অবস্থা।
টুং! হোয়াটস্যাপে
অতসীর মেসেজ!
চমকে উঠলাম!
পেপারকাটিংয়ের ছবি সহ মেসেজ।
ত্রাণের লাইনে নতমুখী দাঁড়িয়ে! মুখে মাস্ক থাকলেও চিনতে অসুবিধে হচ্ছে না। ‘দুর্বার মহিলা সমিতি’র দেওয়া ত্রাণ গ্রহণ করছে অসহায় নিষিদ্ধপল্লীর অভুক্তরা!
সাধারণ মানের এই ছাপা শাড়ি বারবার দেখছি পরণে! সত্যিই অণু!
***
ডাক্তারবাবু অর্থাৎ অণুর বাবা সমাজসেবী। কিন্তু এই
সমাজসেবা করতে গিয়েই চরম বিপদে পড়েছিলেন। অসহায় এক মহিলাকে রক্ষা করতে গিয়েই ফেঁসে গিয়েছিলেন এলাকার প্রভাবশালী এক নেতার চক্রান্তে।
কুড়ি আগের ঘটনা!
ওই নেতা গোছের বদমাইশটি দলবল জুটিয়ে এক অল্পবয়সীকে মেয়েকে
ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে আমোদ উল্লাস করত মাঝেসাঝে। মেয়েটির
বিধবা মা
ছাড়া আর
কেউ ছিল না! এই মেয়েটাকেই
উল্টোপাল্টা দুর্নাম দিয়ে ঝেড়ে ফেলার পরিকল্পনা ছিল। সম্ভব হয়নি যথাসময়ে ডাক্তারবাবুর হস্তক্ষেপে।মেয়েটি ডাক্তারবাবুর
পায়ে এসে কেঁদে পড়ে। সে সন্তানসম্ভবা। ডাক্তারবাবুর
আন্তরিক পরিচর্যায় ক’দিন পরেই সুস্থভাবে একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেয় মেয়েটি। শুরুতে অবশ্য নেতাটি মেরে ফেলতে চেয়েছিল মেয়েটিকে। কিন্তু এক অসহায় বিধবার আর্তিতে তার সন্তান প্রসব করিয়ে
নিজের মেয়ের মতো মানুষ করেছেন অণুর ডাক্তার বাবা। ঐ মহিলার খবর জানা যায় না। আমরা অবশ্য
তখন এতসব বিস্তারিত কিছুই জানতাম না।
সদ্যোজাত মেয়ে অণুর ডাকনাম ডাক্তারবাবুই রেখেছিলেন ‘ডল’। বড়দাদার সঙ্গে অণুর বয়সের তফাৎ প্রায় আঠারো বছরের। ছোটদাদার থেকেও চোদ্দ বছরের ছোট। অণুর জন্মের পরেই ডাক্তারবাবুর নামযশ, অর্থ, প্রতিপত্তি
সবই বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেইকারণে
ছোট্ট ‘ডলে’র উপর সকলের স্নেহ উপচে পড়ত। পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যই খুব খুশি। ততোধিক আক্রোশ
বাড়ছিল দুই ভাইয়ের! তাদের গুরু ওই বদমাইশ নেতা যে পরিকল্পনা মাফিক ভোগ
করা মেয়েদের নিষিদ্ধপল্লীতে বেচে দিত। এদিকে ডাক্তারের নাম
জড়াতে আগল।
এনজিওতে কাজের সূত্রে অণু জানতে পেরেছিল হারানো
মেয়েরা কোথায় যায়। কিন্তু সেই নেতা কিম্বা নিজের দাদাদের বিরুদ্ধে একটুকরো প্রমাণও জোগাড় করে উঠতে পারেনি। এদিকে
মায়ের মৃত্যু,
বাবার স্ট্রোক। দাদা ও নেতার জোট একদিন সেখানেই
পৌঁছে দিল
অণুকে
যেখানে ঠাঁই হয়েছিল তার জন্মদাত্রী ময়ের!
সম্পাদকীয়
টীকা: বানান, যতি কিছুটা এবং গল্পের শেষাংশ
অনেকটা সম্পাদিত।