দুই গোয়েন্দা বৃদ্ধের কাহিনি
সুব্রত মুখোপাধ্যায়
https://images.app.goo.gl/ |
দুই স্বনামধন্য ব্যক্তি। একজনের নামডাক সারা
পৃথিবীতে; পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশের
ভিন্ন-ভাষার লোকজন তাকে চেনেন
একডাকে। অন্যজন, একান্তই বাংলার, যদিও তাঁর পরিচিতি
বাংলা ছাড়িয়ে দেশের অন্যত্র পৌঁছেছে। দুজনেই বৃদ্ধ হয়েছেন। দুজনেরই পেশা এক, কিন্তু সে পেশা
ছেড়েছেন বহুকাল আগে। বলে রাখা ভাল, পেশাগত কারণেই
বিখ্যাত দুজনেই।
গোয়েন্দাগিরি, আরো পরিষ্কার করে
বলতে গেলে, দুজনেই প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তাঁরা বৃদ্ধ হয়েছেন। গোয়েন্দাগিরি ছেড়েছেন
বহুকাল আগে। ক্ষুরধার বুদ্ধি আর বিশ্লেষণ
যাদের গোয়েন্দাগিরিতে সাফল্য এনে দিয়েছিল, তা আজ অনেকটাই স্থিমিত। তবু, নাম করতেই মনে পড়ে
যায় এদের বিখ্যাত সব কীর্তি কাহিনী।
আসুন, পরিচয় করা যাক, বিশ্ব বিখ্যাত
স্বনামধন্য এই ইংরেজ গোয়েন্দার নাম শার্লক হোমস। আর বাংলাখ্যাত তথা
ভারতীয় গোয়েন্দা হলেন ব্যোমকেশ বক্সী। দুজনেই অশক্ত, বয়সের ভারে ন্যুব্জ। গোয়েন্দাগিরিকে বিদায়
জানিয়েছেন বহুকাল আগে। এতদিন বাদে তাঁরা আছেন কি নেই, তা নিয়ে মনে দোলাচল
ছিল। শার্লক হোমস অবসর জীবনে
ইংল্যান্ডের এক গ্রাম্য খামারবাড়িতে মৌমাছি চাষ করে দিনযাপন করছেন। সে খবর ওয়াটসন জানিয়ে
গিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যোমকেশ বক্সী “বিশুপাল বধ” রহস্যের যবনিকা পতনের আগে
কেমন যেন মিলিয়ে গেলেন। তারপরে তার আর কোন খোঁজ
সন্ধান ছিলনা প্রিয় পাঠকদের কাছে। বহুকাল পর জানা গেল তিনি
বেঁচে আছেন, বৃদ্ধ হয়ে পড়লেও সংসারে
তিনি রয়েছেন। পুত্র ও নাতিদের পরিবারে আজও টিমটিম করে উপস্থিতি তার
অগণিত ভক্ত-পাঠকদের স্বস্তি এনে দিয়েছে।
কেমন আছেন আমাদের খুব পরিচিত, প্রিয় এই দুই
গোয়েন্দাপ্রবর ? পুরনো গল্পগুলো
বারেবারে উল্টেপাল্টে পড়ার সময় মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এখন কী করছেন, কেমন আছেন, কি করে দিন কাটছে দুই বৃদ্ধ গোয়েন্দার ?
সাম্প্রতিককালে দেখা দুটি সিনেমা ও কয়েকটি বই উসকে দিল এদের
বার্ধক্য দশার পরিণতিকে জানতে। সিনেমার একটি বাংলা চলচ্চিত্র, অন্যটি ইংরেজিতে। প্রথমে আসা যাক ইংরেজি বই ও সিনেমাটিরকথায়।
২০০৫ সালে মিচ কালিনের বিখ্যাত উপন্যাস “ এ স্লাইট ট্রিক অফ
দ্য মাইন্ড” প্রকাশিত হয়। উপন্যাসের উপজীব্য ১৯৪৭ সালে
দীর্ঘ অবসরপ্রাপ্ত ৯৩ বছর বয়সী শার্লক হোমসের জীবনযাত্রা। বলাবাহুল্য, বইটি প্রকাশের পরে
হোমস ফ্যানদের মধ্যে একটা সাড়া পড়ে যায়। অনেকে জানতে উৎসাহী
ছিলেন, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বিখ্যাত গোয়েন্দা কেমন আছেন। কিভাবে জীবন কাটাচ্ছেন ? সেসব জিজ্ঞাসার উত্তর
পাওয়া যায় উপন্যাসটির মাধ্যমে। জনপ্রিয় উপন্যাসের উপর
ভিত্তি করে ২০১৫ সালে একটি চলচ্চিত্র তৈরি করা হল। সিনেমাটির নাম, “মিস্টার হোমস”।
সিনেমার শুরুতেই দেখতেপাই, অতিবৃদ্ধ শার্লক হোমস
তার দীর্ঘ অবসরপ্রাপ্ত জীবন কাটাচ্ছেন ইংল্যান্ডের সাসেক্সের এক খামারবাড়িতে। সেখানে তিনি থাকেন বিধবা মিসেস মুনরো এবং তার ছোট ছেলের জারের দেখভালে। ক্ষুরধার বুদ্ধির জন্য
বিখ্যাত শার্লক হোমস মোটেও ভালো নেই। হোমস ভুগছেন ডিমনেশিয়ায়। আস্তে আস্তে সবকিছু ভুলে
যাচ্ছেন তিনি। যে তীক্ষ্ণ মনন, মেধা ও স্মৃতিশক্তির
আধার ছিল তার মস্তিষ্ক, সেটি আর সমানভাবে কাজ করতে
পারেনা। জরা বাসা বেঁধেছে তার
মস্তিষ্কে। আস্তে আস্তে মরচে পড়ছে
ক্ষুরধার বুদ্ধির ধূসর পদার্থে। গোয়েন্দা মনে করার
চেষ্টা করেন তার পুরনো দিনের কথা, পুরনো কেস গুলির কথা, কিন্তু সব সময় তা
পরিষ্কার মনে পড়েনা। আবছাভাবে মনেপড়ে সাফল্যর সাথে
তার ব্যর্থ হওয়া কেসগুলির কথা। যেগুলি তার সঙ্গী ওয়াটসন
সযত্নে বাদ দিয়েছিল তার সাফল্যের ধ্বজা সর্বক্ষণ তুলে ধরার তাগিদে। উপন্যাস ও সিনেমা এগোয় তরতর
করে।
১৮৪৭ সালটা আমাদের কাছে মনে রাখার মতোই। এ দেশ যখন স্বাধীন হচ্ছে সে
সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্যতম বুদ্ধিমান ব্যক্তি শার্লক হোমস ৯৩ বছর বয়সে অবসর
জীবন কাটাচ্ছেন এক গ্রাম্য খামারবাড়িতে মৌমাছি পালন করার মাধ্যমে। কিছুদিন আগে তিনি ঘুরে এসেছেন
হিরোশিমা। সেই হিরোশিমা, যেখানে কয়েক বছর
আগেই প্রথম পরমাণু বোমার আঘাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে জনজাতির এক অংশ। নিজের চোখে দেখেছেন ধ্বংসের
নমুনা। চারদিক ধ্বংসস্তূপের মধ্যে
একাকী বৃদ্ধের হেঁটে যাওয়া যেন সেই মূর্ত প্রতীক চিহ্ন বহন করে যা মনে করিয়ে
দেয় এককালের প্রবাদপ্রতিম গোয়েন্দা আজ স্মৃতির ঘরে, বয়সের ভারে নষ্ট
হয়ে গেছে তার প্রতিভার গুণগুলি।
হোমস তার অবসর জীবনে বিরক্ত একদা সঙ্গী ওয়াটসনের
প্রতি। প্রতিটি গল্পে ওয়াটসন বার বার
উল্লেখ করেছেন হোমসের প্রিয় ধূমপানের কথা। হোমস পরিস্কার করে
জানান, তিনি আদৌ পাইপবিলাসী ছিলেন না, সিগার পছন্দ করতেন। কি আশ্চর্য ! সারা পৃথিবী যাকে
চেনেন, তীক্ষ্ণ নাকের সঙ্গে মুখে ঝোলা পাইপ থেকে নির্গত কুণ্ডলীর
ছবিতে যার পরিচয়, সে কিনা ধূমপান করতেন না। অবিশ্বাস্য !
হোমস বিরক্ত তার তাকে নিয়ে লেখা কাহিনী ও
উপন্যাস গুলি নিয়ে। সেগুলি মোটেই ঠিকঠাকমতো লেখা
হয়নি। রয়েছে বিস্তর ভুলভ্রান্তি। আরও নিখুঁত, আরো গুছিয়ে লেখার
দরকার ছিল সেসব কাহিনী, ঘটনা, বিশেষ করে তার জীবনের
শেষ কিস্তি দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ দাভ গ্রে গ্লাভস” নিয়ে। বাধ্য হয়ে তিনি হাতে তুলে
নিয়েছেন পেন কলম। অশক্ত কাঁপা কাঁপা হাতে শুরু করেছেন
তার গোয়েন্দা জীবনের কাহিনী গুলো সাজিয়ে গুছিয়ে ঠিকমতো লেখার কাজ। কিন্তু বারবার ভুল হয়ে
যাচ্ছে লেখা।
লিখতে গিয়ে খেই থাকছেনা কাহিনীর। তাছাড়া পরিষ্কার করে আর কিছু
মনে পড়ে না। খানিকটা আলো, বাদবাকিটা চলে যায়
স্মৃতির অন্ধকারে। সেখান থেকে সত্যকে তুলে আনার
প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছেন এক বৃদ্ধ গোয়েন্দা। একসময়ের খাপ খোলা
তরবারির মতো ঝকঝকে স্মৃতির মণিকোঠায় পরেছে আস্তরন। আজকাল আর পুরনো কথাই
পরিষ্কার করে মনে পড়ে না। খানিকটা ছবি ভেসে ওঠে, বাদবাকিটা কিরকম যেন
ধূসর বিবর্ণ ধোঁয়াশায় ঢাকা। ঠিক যেরকম শীতকালের
খামারবাড়ির চারদিকটা ঢেকে যায় ঘন কুয়াশার চাদরে, ভালো করে কিছু ঠাহর
করা যায় না। স্মৃতিও তেমনি ছলনা করছে
একসময় স্মৃতিধর এই গোয়েন্দার জীবনে। বারবার লেখার চেষ্টা
বারবার কেটে ফেলা, ফের আবার নতুন করে লেখার
চেষ্টা চলতেই থাকে, চলতেই থাকে বৃদ্ধের জীবনে।
প্রায় ৩০ বছর আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার
পরে ওয়াটসন যখন বিয়ে করে ২২১ বি বেকার স্ট্রিটের বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যান, তারপরে চিরতরে
গোয়েন্দাগিরির ইতি টানেন। লন্ডন শহরের প্রাণকেন্দ্রে
বাড়ি ছেড়ে তিনি চলে আসেন গ্রামের এক খামারবাড়িতে। শেষ জীবন ও মৌমাছি
পালন করে কাটাবার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
তিনি বৃদ্ধ হলেন। আগের সেই প্রাণচঞ্চল
চনমনে তীক্ষ্ণ মেধাবী, তীক্ষ্ণ দৃষ্টির মানুষটির
সাথে নবতিপরের কোন মিল নেই। মুখে হাতে চামড়ায় বলিরেখা
স্পষ্ট। বয়সে থাবায় নিভে গেছে
এককালের জ্বলন্ত আগুনের প্রতিভা। মুখে নেই চিরাচরিত বুনো গোলাপ
কাঠের পাইপ। নেই আত্মরক্ষার সঙ্গী রিভলবার, বন্ধু ওয়াটসন ছেড়ে গেছে বহুকাল। নিঃসঙ্গ হোমস, তিনকুলে কেউ কোথাও
নেই, খবর নেই দাদা মাইক্রপটের, আজও বেঁচে আছে কিনা
তা কেউ জানে না।
অকৃতদার, চিরকালই সাংসারিক জীবন বিষয়ে
অজ্ঞ ; ঠিক যেমনটা সৌরজগৎ
সম্বন্ধে তার অজ্ঞানতা অবাক করেছিল প্রথম সাক্ষাৎকারে সঙ্গী ওয়াটসনের। সংসার জীবন কুটিলতা জটিলতা
কোনটাই স্পর্শ করেনি চিরকুমার হোমসকে এবং সেটাই হয়তো তার জীবনের ব্যর্থতার কারণ
হিসাবে দেখা দিয়েছিল। এ কাহিনীর বিচারে দেখা যায়
তার শেষ যে ঘটনা বা কেসটি গোয়েন্দা হিসাবে হাতে আসে তাতে টমাস কেলমট নামে এক
ব্যক্তি হোমসের কাছে পরামর্শ নিতে আসেন তার বদলে যাওয়া স্ত্রীর আচরণ বিষয়ে। সাংসারিক জীবনে অজ্ঞ হোমস
বুঝতে পারেননি নারী মনের গোপন কথা। টমাস কেলমটের নিঃসঙ্গ স্ত্রী অ্যান চেয়েছিল সম-নিঃসঙ্গ হোমসের সঙ্গী হতে। কিন্তু সবিনয় সে
আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেন হোমস।
হোমসের কোন কাহিনীতে তার প্রতি কোন যুবতীর
প্রনয়ের কোন ঘটনা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। কিন্তু “ এ স্লাইট ট্রিক অফ
দ্য মাইন্ড” উপন্যাসে লেখক মিচ কালিন দেখিয়েছেন তার
সর্বশেষ কেসের মক্কেলের স্ত্রী হোমসের প্রতি অনুরক্ত। হোমসের মতই সে
নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন অনুভব করেছিল তার চলার জীবনে। অসমবয়সী অ্যান
চেয়েছিল তার সঙ্গী হতে। নারী হৃদয়ের কথা বুঝতে
পারেননি হোমস। বোঝার ক্ষমতাও ছিল না। ফিরিয়ে দিয়েছিলেন অ্যানকে
যে পরমুহূর্তে অবসাদের ডুবে বেছে নেয় চলন্ত রেল গাড়ির সামনে ঝাঁপ দিয়ে
আত্মহত্যা। এ ঘটনায় কেস না বোঝারব্যর্থতায়ডেকে
নিয়ে এসেছে এই করুণ পরিণতি। হোমসের ব্যর্থতা তাকে টেনে
নিয়ে যায় গভীর হতাশায়। ওয়াটসনের চেষ্টাতেও সে হতাশা
কাটিয়ে উঠতে পারেননি না-হারা গোয়েন্দা।
শার্লক হোমস চিরকাল সাফল্যের জয়গান গেয়ে যাওয়া
ওয়াটসনের কলমে কখনো ধরা দেয়নি হোমসের ব্যর্থতা, হেরে যাওয়া এবং বোকা
বনে যাওয়ার কোন কাহিনী। চিরকাল তার সফলতা উঠে এসেছে
গল্প-উপন্যাসে। কিন্তু নিজের ব্যর্থতাকে ঢাকা
রাখতে চান না। নিজের হাতেই শুরু করেন লেখা
তার জীবনের ব্যর্থতার ইতিহাস ও সে সংক্রান্ত কেসগুলি। কিন্তু বয়স ও স্মৃতি
তাকে আর সঙ্গ দেয় না। সেখানেও চূড়ান্ত ব্যর্থ হোমস। ঠিকঠাক মনে আসেনা ঘটনাগুলি, নাম-পরিচয় সময় সব
যেন তালগোল পাকিয়ে বারবার ভ্রান্তি ছড়ায় গোয়েন্দার। যে মগজাস্ত্র একসময়
সারা পৃথিবীতে সাড়া ফেলেছিল তা আজ নিস্তেজ।
শেষ সময়, বৃদ্ধ বয়সে এসে হোমস অনুভব
করেন তার নিঃসঙ্গ জীবনের কথা। সংসার ধর্ম তো করলেন না, তাই শেষ বয়সে নেই
কোনো বিশ্বস্ত সঙ্গী। জানলেন না অপত্য স্নেহ কাকে
বলে, পেলেন না কোন ভালোবাসার স্পর্শ। চিরকাল দৌড়ে গেলেন শুধু অপরাধ
আর অপরাধীর পিছনে। সে কারণেই হয়তো তার দেখভাল
কারী মিসেস মুনরোর ছোট ছেলে রজারের সাথে জমে ওঠে সখ্যতা। রজারের বাবা নেই, পিতৃস্নেহ থেকে সে
বঞ্চিত। আবার সংসার ধর্ম যে করলেন না, কিন্তু শেষ বয়সে এসে
নাতির সমান রজারকে পেয়ে তার হৃদয়ে হয়তো বা বাৎসল্য প্রেম জেগে উঠেছে।
কাজের লোক, নিতান্তই কাজের লোকের ছেলে
হলেও রজারকে আঁকড়ে বৃদ্ধ গোয়েন্দা যেন নতুন করে বাঁচতে চায়। বুড়ো বয়সে
ছেলেবেলার ফিরে যাওয়ার যে প্রবণতা থাকে তাতে পুরোদস্তুর মদত পেয়েছিল রজারের। দুই অসম বয়সী মেতে উঠেছিল
নিঃসঙ্গ জীবনের কষ্ট দূর করার লক্ষ্যে, পরস্পর আরো কাছাকাছি আসার
মাধ্যমে। লেখক মিচ কালিন দেখিয়েছেন, সে আমাদের পরিচিত সেই
শার্লক হোমস নন, সিগারেট মাদকের নেশা নেই, এমনকি বেহালা বাজনাটা
ছেড়ে এসেছেন বহুকাল। বলতে গেলে গোয়েন্দা জীবনের
খোলস থেকে বেরিয়ে এ এক অন্য পুরুষ, সামনে ভবিষ্যৎ আছে কিন্তু
অতীতের আর কোনো পরিচয় রাখতে চান না বৃদ্ধ।
মৌমাছি চাষ, অবসর সময়ে এদিক ওদিক ইতিউতি
ঘুরে বেড়ানো, সেইসঙ্গে বয়স জনিত অসুখ
বিসুখে কাবু হয়ে বিশ্ব বিখ্যাত গোয়েন্দার করুণ পরিণতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সিনেমার কথা বলতে গেলে মি. হোমস সিনেমায় বিল
কনডোনের নির্দেশনায় অসাধারণ অভিনয় করেছেন নাম ভূমিকায় ইয়ান ম্যাক কেলেন। হোমসের ভূমিকায় অনবদ্য তাঁর
অভিনয় আমাদের কাছে মনে রাখার মত।
অপরদিকে ব্যোমকেশের পরিণতি দেখি, কোন উপন্যাসে নয়, ২০১৮ সালে প্রকাশিত
এক বাংলা চলচ্চিত্রে। “বিদায় ব্যোমকেশ” সিনেমায় পরিচালক দেবালয়
ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন প্রখ্যাত গোয়েন্দা সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সীর
বৃদ্ধ বয়সের কথা। ব্যোমকেশ কে নিয়ে হাতে
রয়েছে দুটি বই। একটি পূর্ণেন্দু পত্রীর লেখা, “জুনিয়ার ব্যোমকেশ জিন্দাবাদ”। ১৯৮৮ সালে আজকাল পূজা
সংখ্যায় প্রকাশিত উপন্যাস পরে বই হিসাবে প্রকাশ পায়।
সেখানে ব্যোমকেশের সঙ্গী অজিত জানায়, ১৯৭০ সালে ব্যোমকেশ
মারা যায়। ব্যোমকেশ মারা যাওয়ার পর
সত্যবতী অসুস্থ, একেবারে বিছানায় শয্যাশায়ী। ব্যোমকেশের ছেলে অভিষেক এখন
নতুন গোয়েন্দা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। অভিষেক বেশি পরিচিত
তার ডাকনাম জাম্বো হিসাবে। কিন্তু ব্যোমকেশ উপস্থিতি নেই
বলেআমাদেরআলোচ্যবিষয় নয় বইটি। এরপর মনে পড়ছে যেউপন্যাসেরকথা, তা হল সুজয় ঘোষের
লেখা “ব্যোমকেশ খুন” নামে উপন্যাস।
এই উপন্যাসে আশ্চর্য মিল পাওয়া যায়” এ স্লাইট ট্রিক অফ দ্য মাইন্ড” সঙ্গে। একসময় রহস্যের সমাধান করতে
একের পর এক ব্যর্থ হতে থাকে ব্যোমকেশ। চিরকাল সাফল্যের
স্বাদে অভ্যস্ত ব্যোমকেশ তার কর্মজীবনের ধারাবাহিক ব্যর্থতা মেনে নিতে পারেনা। সত্যসন্ধানীকে ঘিরেধরে প্রবল
হতাশা, সেই থেকেই স্ত্রীর প্রতি দিনের পর দিন তার আচরণ
হয়ে ওঠে রুক্ষ। ধারাবাহিক হতাশা গ্রাস করতে
থাকে ব্যোমকেশকে, অসুস্থ হয়ে পড়ে। একসময় হঠাৎ মারা যায়
ব্যোমকেশ। সত্যবতী কিন্তু এই মৃত্যুকে
স্বাভাবিক বলে মানতে চায়নি। সে নিজেই শুরু করে তার
স্বামীর পথে চলে ব্যোমকেশের মৃত্যু রহস্য সমাধান। এক বৃদ্ধ ব্যক্তি
নিজেকে ব্যোমকেশের সঙ্গী অজিত বলে পরিচয় দিয়ে, লেখকের কাছে বর্ণনা
করেন ব্যোমকেশের কাহিনী। সে কাহিনীর সত্যাসত্য নিয়ে
সন্দেহ থেকেই যায়। কিন্তু “বিদায় ব্যোমকেশ”-এ যখন আমার দেখি দিব্যি
রয়েছেন বৃদ্ধ ব্যোমকেশ, তখন প্রিয় পাঠক হিসাবে মনে
স্বস্তি আসে। যতই হোক, ব্যোমকেশ আমাদের বহুদিনের পরিচিত আপনজন।
ব্যোমকেশ বক্সীর ওপর অনেকগুলি সিনেমা তৈরি হয়েছে। সে হিসাবে এটি একটু হলেও
খানিকটা অন্যমাত্রার। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের
কোন গল্প বা উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত নয়, বরং সত্যান্বেষী পেশা ছেড়ে
দেয়ার পর সংসার জীবনে, নিজের সংসারে কিভাবে দরকার
হয়ে পরলো সত্যান্বেষীর ভূমিকাকে, সেটাই সিনেমার উপজীব্য।
সত্যান্বেষী বয়স ৮০ পেরিয়েছে। মাথায় টাক, শরীরে বার্ধক্য। ১৯৭০ সালের অসমাপ্ত বিশুপাল
বধের পরে তার আর কোনো সন্ধান ছিল না। হঠাৎ দেখা গেল সংসারে রয়েছেন
ব্যোমকেশ, তবে নিজের পেশা ছেড়েছেন
বহুকাল।
পেশা ছাড়লেও ছাড়তেপারেননিবহুকালেরনেশাকে। সিগারেটের নেশা এখনো সমান ভাবে
চালিয়ে যাচ্ছেন বৃদ্ধ গোয়েন্দা। তার সংসার ছোট নেই, পুত্র এবং নাতি নিয়ে
সে সংসারে রয়েছেন গোয়েন্দা প্রবর। আজকের সত্যান্বেষী একজন
দুর্বল বৃদ্ধ কিন্তু মস্তিষ্কের তীক্ষ্ণতার ধারে এখনো মরচে পড়েনি। বহু পরিবর্তন এসেছে তার জীবনে। স্ত্রী সত্যবতী মারা গেছেন, চির বিদায় নিয়েছেন
বিশ্বস্ত বন্ধু ও সঙ্গী অজিত। শেষ বয়সে বইপড়া, বাগান করা ও ক্লে মডেলিংয়ে এই
সময় কাটছে সত্যান্বেষীর । এখানে খানিকটা হলেও মিল
পাওয়া যায় বৃদ্ধ হোমসের সঙ্গে ব্যোমকেশের । দুজনেরই শেষ বয়সের সঙ্গী
বাগান, একজন মৌমাছি চাষ তো অন্যজন বাড়ির ছাদ ও
সংক্ষিপ্ত বাগানের চর্চার দিনযাপন। ব্যোমকেশের একমাত্র পুত্র
অভিমন্যু বক্সী নিরুদ্দেশ। কলকাতা পুলিশের ডিসিপদমর্যাদারঅফিসারএকরহস্যজনকখুনেরপরথেকেনিখোঁজ। কেন খুন কিভাবে খুন এবং
বাবাকে খুঁজে পাওয়ার তাগিদে ঠাকুরদার পেশায় নামল নাতি সাত্যকি।
নিখোঁজ অভিমন্যু একদিন ফিরে আসে রক্তাক্ত ছোরা
হাতে থানায়। রহস্য সমাধানে ফের একবার
সত্যান্বেষীর চশমা পড়েন বৃদ্ধ ব্যোমকেশ। এবার নিজের ছেলেকে
রক্ষা করার তাগিদে। সে কাজে হাত লাগায় নাতি
সাত্যকি। তার বাবার নিখোঁজ রহস্য
সমাধানে। বৃদ্ধ সত্যান্বেষীকে প্রায়ই
শুনতে হয় কঠোর সমালোচনা, দেশ-বিদেশের কঠিন অপরাধ
রহস্যের উদ্ঘাটন করলেও নিজের ছেলেকে খুঁজে পেতে ব্যর্থ গোয়েন্দা। সংসারে থেকেও হোমসের মত
নিঃসঙ্গ ব্যোমকেশ। মাঝেমাঝে অবচেতন মনের স্বপ্নে
দেখা দেয় সত্যবতী। তার সাথে খুনসুটি করার ফাকে
আবার প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে গোয়েন্দার মন। কিন্তু বাস্তব জীবন দেখা যায়
অসহায় বৃদ্ধর ছেলেকে খুঁজে পাওয়ার আকুল প্রচেষ্টা। সিনেমা হিসেবে হয়তো
খুব একটা উচ্চমার্গের নয়, কিন্তু বৃদ্ধ গোয়েন্দার শেষ
কটা দিন যাপনের এক বিরল চিত্র তুলে ধরা হয়েছে সিনেমাটির মাধ্যমে। বন্ধু অজিতের সাথে ২৩ বছর বয়সে দেখা হওয়ার পর আর বিচ্ছেদ হয়নি। মাঝে মাঝে আসে স্বপ্নের ঘোরে। প্রিয়জনরা একে একে পৃথিবী
ছেড়ে চলে যাচ্ছে। রয়েছে শুধু পিছনে ফেলে আসা
স্মৃতির পাহাড়। মস্তিষ্কের কোষে জমছে সময়ের
পলেস্তারা। ঢাকা পড়ে যায় বহু পুরনো
দিনগুলির ছবি। নেমে আসে অন্ধকার।
দুই গোয়েন্দার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির মধ্যে পার্থক্য থাকলেও
একসময় সেই মস্তিস্ক তাদের কাছেই হয়ে ওঠে পীড়াদায়ক বার্ধক্যের বোঝা। ভালো নেই তারা দুজনে। নৈব্যক্তিক হয়েও বেঁচে আছেন এইটুকু মাত্র
সত্য, আর বাদবাকি পুরোটাই কষ্টের, অন্তত প্রিয় পাঠকদের
কাছে। তবু বেঁচে থাক তারা আরও
শতবর্য । নবীণ পাঠক, দর্শক আসুক প্রিয় দুই গোয়েন্দার
সাথে পরিচিত হতে।
তথ্যসূত্র:
1. এ স্লাইট ট্রিক অফ
দ্য মাইন্ড--মিচ কালিন
2. জুনিয়ার ব্যোমকেশ
জিন্দাবাদ-- পূর্ণেন্দু পত্রী
3. ব্যোমকেশ খুন--সুজয় ঘোষ
4. মিস্টার হোমস—বিল কনডোন (সিনেমা)
5. “বিদায় ব্যোমকেশ--পরিচালক দেবালয়
ভট্টাচার্য (সিনেমা)
ছবি—ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত