বিস্মৃত বিপ্লবী সর্দার অজিত সিং
অর্ণব বন্দ্যোপাধ্যায়
source : https://en.wikipedia.org/wiki/Sardar_Ajit_Singh |
শ্রী সন্তোষ কুমার অধিকারী তাঁর সন্ত্রাসবাদ ও
শহীদ ভগৎ সিং গ্রন্থে বলেছেন
“ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে গুপ্ত বিপ্লবের ধারা এবং সশস্ত্র সংগ্রামের প্রচেষ্টার এক বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। ১৮৭৯/৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রচারিত
বাসুদেব ফাদকের ডায়েরী যেমন এক
অভূতপূর্ব অনুপ্রেরণার সৃষ্টি
করেছিল মুক্তি সন্ধানী ভারতবাসীর মনে,
ঠিক অনুরূপ কিংবা আরোও বেশি আলোড়ন জাগিয়ে ছিল ক্ষুদিরামের ফাঁসি। ইতিমধ্যে
মহারাষ্ট্রে তিলক এবং পরাঞ্জপের রাজনৈতিক রচনা ও বক্তৃতা এবং বাংলায় অরবিন্দ,
ব্রহ্মবান্ধব ও
বিপিনচন্দ্রের পূর্ণস্বাধীনতার দাবি দেশের মানসিকতায় যে বেদনা ও
উৎকণ্ঠার ঢেউ তুলেছিল ,তারই ফলস্বরূপ
দেখা দিয়েছিল যতীন মুখার্জি, রাজবিহারী
বসু ,সাভারকর
ও হরদয়ালের মতো নেতৃত্ব, ভারতের
মাটি থেকে অনধিকার প্রবেশকারী শোষক ও নিপীড়ক ব্রিটিশ
শাসনের মূলকে উন্মুলিত করে ফেলে দিতে যাঁরা জীবনপণ করেছিলেন।”
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা
সংগ্রামের ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে শ্রী অধিকারীর কথার যৌক্তিকতা স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়। ভারতবর্ষের
স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯০৭ সাল নানা দিক থেকে উল্লেখযোগ্য। এই
বছরেই প্রকাশিত হয় শ্রী অরবিন্দ ঘোষের ‘ বন্দে মাতরম্ ’ পত্রিকা, যেখানে
তিনি লিখেছিলেন
“ ব্রিটিশ শাসন মুক্ত পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া ভারতের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা তৃপ্ত হবে না। ” অরবিন্দের
বক্তৃতা ও
রচনা শুধু বাংলায় নয় , সারা ভারতের যুব সমাজের মনে জাতীয়তাবাদের প্রবল প্রেরণা এনে দেয়। ‘ যুগান্তর ’ ও ‘ বন্দে মাতরম্’- এর বিপ্লবাত্মক আদর্শের বাণী উত্তরপ্রদেশ , মহারাষ্ট্র
ও পাঞ্জাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। পাঞ্জাবের
সর্বত্র ইংরেজ বিদ্বেষের মনোভাব নিয়ে গণআন্দোলন যে দানা বেঁধে উঠেছিল তার রিপোর্ট পাওয়া যায় তৎকালীন পাঞ্জাবের গভর্নর ডেনজিল ইবেটসনের রিপোর্ট থেকে।
পাঞ্জাবের সাধারণ মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধিক্ ধিক্ করে জ্বলতে থাকা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অসন্তোষের অগ্নি দাবানলের রূপ নেয় যখন সরকার প্রবর্তিত জল
কর এবং ঔপনিবেশিক করের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান করেন জাতীয় নেতৃবৃন্দ।
তবে ১৯০৭ সালের আগেই পাঞ্জাবে বিপ্লব আন্দোলনের বীজ বপন করেছিলেন যিনি, তিনি হলেন শহীদ-ই-আজম সর্দার ভগৎ সিংয়ের কাকা সর্দার অজিত সিং। তাঁর বড় ভাই কিষান সিং , ছোট ভাই শরণ সিং,সুফী অম্বা প্রসাদ, এবং ঘসিতা রাম-প্রমূখের সহযোগিতায় অজিত সিং যে
‘ভারতমাতা সংঘের’
প্রতিষ্ঠা করেন তা সেসময়ের পাঞ্জাবে জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রসঙ্গত
উল্লেখযোগ্য, এই সময় বাংলা থেকে বিপ্লবী মহানায়ক শ্রী যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (নিরালম্ব স্বামী)-ও এই সময় পাঞ্জাবে ছিলেন এবং অজিত সিংহ ও
তাঁর অনুগামীদের উপর তাঁর প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়।
১৮৮১ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি জলন্ধর
জেলার খটকার-কালন গ্রামে সর্দার অজিত সিং-এর জন্ম হয়। তার পিতা অর্জন সিং
-এর জীবিকা চাষাবাদ হলেও তিনি ছিলেন পন্ডিত ব্যক্তি। আর্য সমাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে তিনি সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করা ও
জনহিতৈষী কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এরপর জলন্ধর থেকে লায়ালপুরে সপরিবার চলে এসে তিনি বঙ্গাগ্রামে স্থায়ীভাবে
বসবাস শুরু করেন।
১৯০৬ সাল নাগাদ বাংলা থেকে প্রকাশিত ‘যুগান্তর’- সহ অন্যান্য প্রচার পত্রিকাও গুপ্তভাবে লাহোরে পৌঁছচ্ছিল। স্যার ডেনজিল ইবেটসনের নোটে বলা হয়েছে যে, “চেনাব ক্যানাল
কলোনি ও
বারিদোয়াবের গ্রামগুলিতে ক্যানেল
করকে উপলক্ষ করে প্রবল অসন্তোষ ও বিক্ষোভ এবং ইংরেজ বিদ্বেষ মাথা নাড়া দিয়েছে। এই বিক্ষোভকে চরম আন্দোলনের রূপ দেওয়ার জন্য চেষ্টা চলছে।”
প্রকাশ্য আন্দোলনে সেদিন সর্দার অজিত সিং এবং কিষাণ সিংয়ের পাশে যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন,
তিনি পাঞ্জাবের সর্বজনমান্য নেতা লালা লাজপত রায়। এর ফলে সর্দার অজিত সিং এবং লালা লাজপত রায়কে গ্রেপ্তার করা হয় ও অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়।
ইংলিশম্যান পত্রিকার বিরুদ্ধে লালাজীর অভিযোগক্রমে মানহানির যে
মামলা হয়
,সেই সূত্রে বিচারপতি ফ্লেচার তার রায়ে এই অবস্থার বিশ্লেষণ করতে ২৭-শে মার্চ অনুষ্ঠিত এক বিক্ষোভসভার উল্লেখ
করে বলেন-
“..... বাদী ( লালা লাজপত রায়)
এই সভায় প্রস্তাবিত বিলের বিরুদ্ধে বলবার জন্য আমন্ত্রিত হন এবং তাঁর ভাষণ দান করেন। এই
সভায় অজিত সিং-ও বক্তৃতা
দেন। বাদী বলেছেন, অজিত সিং তাঁর বক্তৃতায় কড়া কড়া শব্দ ব্যবহার করেছেন গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে। কিন্তু
তিনি মনে করেন না যে, ওইসব ভাষা আইনতঃ আপত্তিজনক।”
রাওয়ালপিন্ডি এবং লাহোরেই ব্রিটিশ বিরোধী এই আন্দোলনের ধারা প্রবল হয়ে উঠেছিল। ৬ই- জুন কমন্স সভায় বিবৃতি দিতে গিয়ে লর্ড মোরেল বলে-“ ১-লা মার্চ থেকে ১-লা মে এই
দু মাসের মধ্যে পাঞ্জাবে বিক্ষোভকারীরা মোট ২৮ টি
সভার অনুষ্ঠান করেছে। এর মধ্যে পাঁচটি কৃষক সম্প্রদায়ের স্বার্থে এবং ২৩টি রাজনৈতিক কারণে অনুষ্ঠিত।”
১৯০৭ সালের ১৬-ই এপ্রিল লাহোরে দাঙ্গা লাগার কারণে গ্রেপ্তার করা হয়
’ভারতমাতা সঙ্ঘের’
সম্পাদক নন্দকিশোরকে। পলাতক হন
সর্দার অজিত সিং-এর বড় ভাই সর্দার কিষাণ সিং। অবশেষে
ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট ফিলিপসকে
প্রহার করার অভিযোগে ১৩-ই সেপ্টেম্বর নেপাল থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে লাহোরে আনা হয় । ডিসেম্বর
মাসে ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ ব্রেশারের কোর্টে বিচারে কিষাণ সিং-কে দু'বছরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। সরকারের
মতে ঐ
বছরেরই ২রা-মে তারিখে রাওয়ালপিন্ডিতে উত্তেজিত জনতা এক প্রচণ্ড গোলমালের
সৃষ্টি করে তার মূল ছিলেন দুই ভাই কিষেণ সিং এবং অজিত সিং। ভাইসরয়
তার নোটে লিখেছিলেন তিনি দৃঢ় নিশ্চিত যে, এই আন্দোলনের মস্তিষ্ক হচ্ছেন লালা লাজপত রায় এবং তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধি হলেন অজিত সিং।
পুলিশ অফিসার মিঃ ফেন্টন তার চিঠিতে লেখেন:
“আমি শুনেছি অজিত সিং নামের এক অধ্যাপক জমিদারদের
এক বিরাট সমাবেশে বলেছে যে, তারা যেন বর্ধিত হারে ট্যাক্স না দেয় এবং এই ট্যাক্স আদায়ের
চেষ্টাকে প্রতিহত করে। জিজ্ঞাস্য
এই যে, অজিত সিংকে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪৩ ধারায় অভিযুক্ত করার মতো যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ আছে কিনা।”
অজিত সিং - এর বিরুদ্ধে পাঞ্জাব গভর্নমেন্টের অভিযোগ ক্রমেই বাড়তে থাকে। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি প্রায় সমগ্র পাঞ্জাব জুড়ে শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত সাধারণ মানুষের মধ্যে ইংরেজ বিদ্বেষের ইন্ধন ছড়িয়ে বেড়াতে লাগলেন। অথচ তাঁকে আইনের আওতায় আনার মতো যথেষ্ট প্রমাণ সংগ্রহ করা গেল না। শেষ পর্যন্ত গভর্নর
, অজিত সিং এবং লালা লাজপত রায় এই দুই নেতাকে ১৮১৮ সালের কুখ্যাত তিন নম্বর রেগুলেশনে গ্রেপ্তারের সিদ্ধান্ত নেয়। যার কারণ হিসেবে ৮-ই মে পার্লামেন্টে ভারত সচিব মিঃ মোরলে জানায়: “পাঞ্জাবের বর্তমান বিপজ্জনক পরিস্থিতির কারণে গভর্নর আন্দোলনকারীদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুজন নেতাকে গ্রেপ্তার করে অন্য কোন প্রদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য ভাইসরয়ের অনুমতি চেয়েছেন। ভারত সরকারও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। ”
৯-ই মে
লাহোরে লালা লাজপত রায় কে
এবং ৩-রা জুন ফিরোজপুরে অজিত সিংকে গ্রেপ্তার করে বার্মার মান্দালয় জেলে পাঠানো হয়। এই দুই নেতার গ্রেফতারির পর সমগ্র পাঞ্জাব জুড়ে প্রবল বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অমৃতবাজারের
১০-ই এবং ১১-ই মে-এর রিপোর্ট অনুযায়ী বিক্ষোভ দমন করতে লাহোরের রাস্তায় সৈন্য নামাতে হয়েছিল।
প্রচন্ড আলোড়ন ওঠে পার্লামেন্টেও। বিরোধীরা
১৮১৮ সালের ৩ নম্বর রেগুলেশন
প্রয়োগের যৌক্তিকতাকে চ্যালেঞ্জ
করেন। শেষ পর্যন্ত প্রবল চাপের মুখে সরকার ১৭-ই নভেম্বর
দু'জনকেই মুক্তি দেয়। মান্দালয়
জেল থেকে দু'জনকে মুক্ত করে পাঞ্জাবে ফিরিয়ে আনা হয়। অজিত সিংকে এরপরে সরকারের পক্ষ থেকে বহু প্রলোভন ও বহু ভীতি প্রদর্শন করা হয় । কিন্তু
অজিত সিং একদিকে যেমন হেলায় সমস্ত প্রলোভন দূরে সরিয়েছেন, তেমন অন্যদিকে
বহু নির্যাতনও সহ্য করেছেন মুখ বুজে। পাঞ্জাবে
ফিরে এসেই তিনি আবার সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। ১৩-০৭-১৯০৯ তারিখে অমৃতবাজারে প্রকাশিত
খবর অনুযায়ী তিনি চার হাজার লোকের এক সমাবেশে
‘রাইজ অ্যান্ড ফল অফ্ নেশনস্’ এই পর্যায়ে বক্তৃতা দেন। এই সময় তাঁর একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় যার নাম
‘মহিব্বনি ওয়াতন’
বা ‘দেশপ্রেমিকের
ইতিহাস’। লাহোরের
জেলাশাসক অজিত সিংকে ডেকে সাবধান করার চেষ্টা করলে তিনি বলেন “আমি যা ঠিক মনে করি, তা করবোই ; কপালে যাই জুটুক না, তার জন্য ভ্রুক্ষেপ করি না।”
অজিত সিং ব্রিটিশ শাসকের চোখে ছিলেন এক
দুর্ধর্ষ নায়ক। লাহোরের ডি.এ.বি কলেজের ছাত্র অজিত সিং প্রথম জীবনে ছিলেন শিক্ষক। তিনি ছিলেন নির্ভীক ও স্পষ্টবক্তা। তাঁকে দমিয়ে রাখার ক্ষমতা সরকারের ছিল না। তিনি সভা-সমিতিতে
বক্তৃতা করে লোক ক্ষেপিয়ে দিতেন, তাঁর বক্তৃতায় উত্তেজিত জনতা লাহোর ও
রাওয়ালপিন্ডিতে দাঙ্গা বাঁধিয়েছে বলে সরকারি নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। পাঞ্জাবের
কৃষকদের ওপর থেকে অবিচার ও
শোষণ দূর করার জন্য দুই ভাই কিষাণ সিং এবং অজিত সিং গ্রামে গ্রামে ঘুরে অশিক্ষিত কৃষকদের সঙ্গবদ্ধ করে তুলেছিলেন। অজিত সিং পাঞ্জাব সরকারের কাছে ভীতিজনক হয়ে উঠেছিলেন। ১৯০৯ সালে পুলিশি অত্যাচার এড়াতে তিনি এরপর প্রথমে পারস্য এবং তারপর জার্মানি হয়ে ব্রাজিল চলে যান।
এরপর স্বাধীনতার পূর্বমুহূর্তে তৎকালীন কংগ্রেস নেতাদের চেষ্টায় তিনি দেশে ফেরেন। ১৯৪৭ সালের ১৫- ই আগস্ট পাঞ্জাবের এই মহান বিপ্লবীনেতা তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর
আগে তাঁর শেষ কথা ছিল:
“ভগবানকে ধন্যবাদ। আমাদের সাধনা সফল হয়েছে।”
তথ্যসুত্র :
১) সন্ত্রাসবাদ ও শহীদ ভগৎ সিং - শ্রী সন্তোষ কুমার অধিকারী।
২) The Wire 15 August 2018
৩) https://www.jatland.com/home/Sardar_Ajit_Singh