দেবী প্রপন্নার্তিহরে প্রসীদ

 

দেবী প্রপন্নার্তিহরে প্রসীদ

অনিতেন্দু মোদক

 

picture curtesy: Saumen Chakrabarty

দেবী প্রপন্নার্তিহরে প্রসীদ প্রসীদ মাতর্জগতোহখিলস্য

প্রসীদ বিশ্বেশ্বরী পাহি বিশ্বম ত্বমীশ্বরী দেবী চরাচরস্য।।শ্রীশ্রীচন্ডী ১১

- হে ভক্তদুঃখহারিনী দেবী, তুমি প্রসন্ন হও হে নিখিল জগজ্জননী, তুমি প্রসন্ন হও হে বিশ্বেশ্বরী, তুমি প্রসন্ন হয়ে বিশ্ব পালন করো হে দেবী, তুমি চরাচর জগতের অধিশ্বরী

চরাচর জগদীশ্বরী দেবী দুর্গার আবাহনের শুভলগ্নটি আজ এসেছে জগতের মা আজ মাটির কোলে ধরা দেবেন বলে মাটির মানুষ হয়ে আমাদের মধ্যে এসেছেন মাটির গন্ধে মাটির সাজে মাটির সাযুজ্যে অনন্ত শক্তি মহামায়াকে তাঁর অপার শক্তিরূপে আমাদের হৃদয়ে ধারণ করতে পারি এমন সামর্থ্য কোথায়! তাই তিনি তাঁর শক্তির সাজ খসিয়ে শুধুহাতে এসেছেন মাটির পৃথিবীতে তিনি যে এই মাটিরই মেয়ে উমা মাটির মেয়ে কল্যাণী মা উমা তাঁর সবকিছু ঐশর্য্য ফেলে বৎসরান্তে ফিরে আসে মাটির কাছে আপন সন্তানের টানেএই আমাদের পরম প্রাপ্তি এই আনন্দেই শারদোৎসব 

ভূবন আলো করা সূর্যের দীপ্তিময় প্রসন্ন মুখ, চাঁদের আলোর মতো স্নিগ্ধ হাসি, শান্ত মৌন তৃপ্ত দুটি চোখে স্নেহের ঘন কাজল আঁকা, গলায় শিউলি ফুলের মালা, হাতে বরাভয়ের শান্তির প্রসাদ যেমন সহজ তাঁর ছবি, তেমনি মধুর তাঁর পূণ্য উপস্থিতি মা অগণিত সন্তানের আশায় ভরা শারদ পূজার তিথিতে তিনি পদার্পণ করেছেন ধরণীতে জগৎ প্রসবিনী মা সাথে মাটির এই পৃথিবীর যোগ রয়েছে নাড়ীতে নিজের শরীর থেকে যাদের তিনি সৃজন করেছেন তাদের ভুলে যাবেন কি করে? তিনি যে গর্ভধারিনী মা সন্তানের প্রতি অপার স্নেহে তিনি আসেন, অগাধ প্রেমে তিনি আসেন, অনন্ত উদারতায় তিনি আসেন মাটির মা মাটির সাজে আসেন মাটির মানুষের বেশে মাটির পৃথিবীতে তাই আয়োজিত হয় উৎসবমাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ উৎসব, মায়ের নামে মিলন উৎসব 

ঋক্বেদের দেবীসূক্তের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি আম্ভৃণী বাক ব্রহ্মশক্তিকে নিজ আত্মারূপে উপলব্ধি করে বলেনঃ-

অহং রাষ্ট্রী সঙ্গমনী বসূনাং চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিয়ানাম্

তাং মা দেবা ব্যদধুঃ পুরুত্রা ভূরিস্থাত্রাং ভূর্যাবেশয়ন্তীম্।।

ময়া সো অন্নমত্তি যো বিপশ্যতি যঃ প্রাণিতি ঈং শৃণোত্যুক্তম্

অমন্তবো মাং উপক্ষিয়ন্তি শ্রুধি শ্রুত শ্রদ্ধিবং তে বদামি।।

অহমেব স্বয়মিদং বদামি জুষ্টং দেবেভিরুত মানুষেভিঃ

যং কাময়ে তং তমুগ্রং কৃণোমি তং ব্রহ্মাণং তমৃষিং তং সুমেধাং।।ঋক্বেদ ১০১০১২৫-

- আমিই জগদীশ্বরী ধনদাত্রী পরব্রহ্ম স্বাত্মারূপে প্রত্যক্ষকারিনী যজ্ঞার্হগনের মধ্যে আমিই শ্রেষ্ঠা আমি বহুভাবে অবস্থিতা সর্বভূতে জীবরূপে প্রবিষ্ঠা সকলে আমাকেই বিবিধভাবে আরাধনা করে আমারই শক্তিতে সকলে আহার দর্শন করে, শ্বাসপ্রশ্বাসাদি নির্বাহ করে শ্রবন করে যারা আমাকে অন্তর্যামিরূপে জানে না তারা জন্মমরণাদি সংসারচক্রে আবর্তিত হয় এবং মোক্ষপদ প্রাপ্ত হয় না দেব মনুষ্য দ্বারা সেবিত আমি স্বয়ং এই ব্রহ্মাত্মক উপদেশ দিতেছি আমি যাকে রক্ষা করতে ইচ্ছা করি সেই সেই পুরুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ করি, তাকে ব্রহ্মা করি, তাকে অতীন্দ্রিয়দর্শী ঋষি করি, তাকেই পরম প্রজ্ঞাবান করি 

আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ব্রহ্মতত্ব প্রদায়িনী আমি ব্রহ্মস্বরূপিনী আমিই জগৎকারন আমার থেকেই প্রকৃতিপুরুষাত্মক জগৎ উৎপন্ন আমি শুন্য অশুন্য আনন্দ নিরানন্দ বিজ্ঞান অবিজ্ঞান আমিই ব্রহ্ম আমিই অব্রহ্ম -

সাহব্রবীদহং ব্রহ্মস্বরূপিনী মত্তঃ প্রকৃতিপুরুষাত্মকং জগৎ শুণ্যাঞ্চাশুণ্যাঞ্চ

অহমানন্দানানন্দাঃ বিজ্ঞানাবিজ্ঞানে অহম ব্রহ্মাব্রহ্মনীদেব্যুপনিষৎ  

অর্থ্যাৎ পরমাপ্রকৃতি নিজেই বলেন যে তিনি ব্রহ্ম এক অভিন্ন যিনি পরমব্রহ্ম ওঁকারস্বরূপ তিনিই শক্তিরূপে ব্রহ্মস্বরূপিনী আদ্যাশক্তি মহামায়া দেবীভাগবতেও দেবী মহামায়া বলেন, আমি ব্রহ্ম এক উভয়ের মধ্যে কোন ভেদ নেই যিনি ব্রহ্ম তিনিই আমি আমি যা তিনিও তাই ব্রহ্ম শক্তির ভেদজ্ঞান ভ্রমকল্পিত আবাস্তব

সদৈকত্বং ভেদোহস্তি সর্বদৈব মমাস্য

যোহসৌ সাহম অহং যা সৌ ভেদোহস্তি মতিবিভ্রমাৎ।।দেবীভাগবত

অমিততেজা নিত্যশক্তি পরমাপ্রকৃতি আত্মপরিচয়ে আরো বলেন, - জগতে আমিই এক এবং অদ্বিতীয় -

একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরাশ্রীশ্রীচন্ডী ১০

সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম মহাশক্তি একই অঙ্গের দুটি রূপমাত্র সচ্চিদানন্দময় নির্গুন ব্রহ্মের যেমন গুনভেদে তিনটি রূপপ্রকাশ পাইঃ- সৎরূপে ব্রহ্মা, চিৎরূপে বিষ্ণু এবং আনন্দরূপে সদাশিব মহেশ্বর তেমনই সচ্চিদানন্দময়ী নির্গুনা মহাদেবীরও গুনভেদে তিনটি রূপপ্রকাশ পাইঃ- সৎরূপে ব্রহ্মানী মহাসরস্বতী, চিৎরূপে বৈষ্ণবী মহালক্ষ্মী এবং আনন্দরূপে মহেশ্বরী মহাকল্যাণী -

মহাসরস্বতী চিতে মহালক্ষ্মী সদাত্মকে

মহাকল্যানন্দরূপে তত্বজ্ঞানসুসিদ্ধয়ে।।দেবীভাগবত  

ফলতঃ সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম সচ্চিদানন্দময়ী শক্তি যেমন অভিন্ন, তেমনই তাঁদের গুনভেদে ত্রিবিধ রূপপ্রকাশ মূলতঃ এক অভেদ

কঠোপনিষদে ব্রহ্মের সর্বশক্তিমত্তার পরিচয় দিতে গিয়ে মৃত্যুদেবতা যম শিষ্য নচিকেতাকে বলেছেন,-

ভয়াদস্যাগ্নিস্তপতি ভয়াত্তপতি সূর্যঃ

ভয়াদিন্দ্রশ্চ বায়ুশ্চ মৃত্যুর্ধাবতি পঞ্চমঃ।।কঠোপনিষদ

- যাঁর ভয়ে অগ্নি তাপ দেয়, সূর্য কিরণ ছড়ায়, ইন্দ্র বায়ু মৃত্যু নিজ নিজ কাজ করে, সেই অপরিমেয় শক্তিমান পরমাত্মাকে ব্রহ্ম বলি যদিও ব্রহ্মের ভয়াল মূর্তির রূপকল্প দেখানোর কোনও প্রচেষ্টাই এই কথায় নেই, তবু কথা স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে যে জগতের বিধ্বংসী শক্তি বলে যাঁদের পরিচয় সেই মহাশক্তিধর দেবগণও পরমব্রহ্মকে তাঁদের প্রভু বলে স্বীকার করে এতে করে শুধু পরমব্রহ্মের শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন দেওয়ার প্রচেষ্টা করা হয়েছে মহাকাব্যিক আঙ্গিকে ঠিক এই একই শ্রেষ্ঠত্বের ব্যঞ্জনা পাই পরমাশক্তির স্বপক্ষে ভূবনেশ্বরী সংহিতায়ঃ-

যদ্ভয়াদ বাতি বাতোহয়ং সূর্যো ভীত্যা গচ্ছতি

ইন্দ্রাগ্নিমৃত্যুবস্তদবৎ সা দেবী চন্ডিকা স্মৃতা।।ভূবনেশ্বরী সংহিতা

- যাঁর ভয়ে বায়ু বয়, সূর্য উদয়াস্ত গমন করে, ইন্দ্র অগ্নি মৃত্যু নিজ নিজ কাজ করে, সেই দেবী চন্ডিকা নামে অভিহিতাচন্ডিকাকথাটি ব্রহ্মশক্তি অর্থেই ব্যবহৃত যা ব্রহ্ম শক্তির অভিন্নতাকে প্রতিষ্টিত করে এমনও বলা হয়েছে যেখানে পরমেশ্বর বিলীন হন সেই ব্রহ্মমায়াশক্তিই চন্ডিকার স্বরূপ -

ব্রহ্মমায়াত্মিকা রাত্রিঃ পরমেশলয়াত্মিকাদেবীপুরাণ 

এই মহামায়া যিনি আনন্দময় বিজ্ঞানময় ব্রহ্মস্বরূপ নিরাকার, তিনিই আবার ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরাদি দেবগণের সৃষ্টিকারিনী শক্তি 

তস্যা এব ব্রহ্মা অজীজনৎ বিষ্ণুরজীজনৎ রুদ্রোহজীজনৎ

  ... সর্বমজীজনৎ সর্বং শাক্তমজীজনৎবহ্বৃচোপনিষদ 

- তাঁর (মহাদেবী) থেকে ব্রহ্মার সৃষ্টি হল বিষ্ণুও জাত হলেন এবং রুদ্রও জাত হলেন ... ক্রমে সকল সংসার জাত হল সকল শক্তি তাঁর থেকে জাত হল প্রায় এই একই কথার অনুরনন শুনি যখন স্বয়ং ব্রহ্মা দেবীর উদ্দেশ্যে বলেন,-

অর্দ্ধমাত্রা স্থিতা নিত্যা যানুচর্যা বিশেষতঃ

ত্বমেব সা ত্বং সাবিত্রী ত্বং দেবজননী পরা 

ত্বয়ৈব ধার্যতে সর্বং ত্বয়ৈতৎ সৃজ্যতে জগৎ

ত্বয়ৈতৎ পাল্যতে দেবী ত্বমৎস্যন্তে সর্বদা।।শ্রীশ্রীচন্ডী ৭৪-৭৫

- আপনি অমৃতরূপা -- ত্রিবিধ মাত্রা রূপে অবস্থিত প্রাণস্বরূপ ওঁকার যা অনুচর্যা নির্গুনা তা- আপনি আপনি গায়ত্রীরূপা দেবজননী আপনি এই জগৎ ধারণ করে আছেন এই জগৎ সৃষ্টি তথা পালনও করেন আপনি এবং প্রলয়কালে আপনিই এর সংহার করেন 

অয়মাত্মা ব্রহ্মেতি বা অহং ব্রহ্মাস্মীতি বা ব্রহ্মৈবাহমস্মীতি বাবহ্বৃচোপনিষদ

অথবা তিনি যখন এভাবে নিজের পরিচয় দেন তখন আর বুঝতে সংশয় থাকে না, নিরাকার পরমব্রহ্মই শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করেন পরমাপ্রকৃতি জগজ্জননীর বেশে তাই পরমব্রহ্ম পরমাপ্রকৃতি আদতে এক অভিন্ন শুধু অরূপের পালাবদল রূপের আদলে যতক্ষণ তিনি নিরাকার অবাঙ্মানসোগোচর ততক্ষণ তিনি ব্রহ্মরূপে বিরাজমান আবার তিনিই যখন সাকার অপরোক্ষানুভূতিগ্রাহ্য তিনি শক্তিরূপে আবির্ভূত ভগবান রামকৃষ্ণের কথায়যিনি ব্রহ্ম, তিনিই কালী’- 

যথা নটো রঙ্গগতো নানারূপো ভবত্যসৌ

একরূপা স্বভা্বোহপি লোকরঞ্জন হেতবে।।

তথৈষা দেবকার্যার্থমরূপাপি স্বলীলয়া

করোতি বহুরূপাণি নির্গুণা সগুণানি ।।দেবী ভাগবত ৫৮-৫৯

- অভিনেতা এক ব্যাক্তি হলেও লোকরঞ্জনের জন্য বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চে বিভিন্ন বেশে তিনি যেমন আবির্ভূত হন, সেইরকম দেবী নির্গুণা হয়েও দেবকার্যে বা নিজ লীলা প্রকাশের কারনে সগুণরূপেও আত্মপ্রকাশ করেন এই অভিন্নতাই তাঁকে সৃষ্টির মধ্যে রেখেও এর বন্ধনের বাইরে রেখেছে শান্তনবীটীকাতেও উদ্ধৃত আছে, -

জগতো নাহমন্যা স্যাং স্যাৎ মদন্যৎ জগৎ

জগতো মম চাপ্যৈক্যাৎ ব্যক্তিরন্যা ততোহস্তি কা।।

অহং জগতী চৈকা জগতী মন্ময়ী মতা

দুগ্ধবৎ দধি চাপ্যেকং দধি দুগ্ধময়ং মতম।।শান্তনবীটীকা

- আমি জগৎ থেকে পৃথক নই এবং জগৎও আমার থেকে পৃথক নয় আমি জগৎ শক্তিতঃ অভেদ বলে আমার অতিরিক্ত দ্বিতীয় কেউ জগতে নেই যেমন দধি দুগ্ধময় এবং আদতে এক দুগ্ধই দধিরূপে দৃষ্ট, তেমন এক অদ্বিতীয় আমিই জগন্ময়ী এবং জগৎও আমাতেই সমাহিত প্রকৃতপক্ষে শক্তি স্বরূপের নিত্যত্ব চিরকালীন

শক্তি ব্রহ্মের এই অভেদত্বই মৌলিক এর কোন বিকল্প নেই

সেয়ং শক্তির্মহামায়া সচ্চিদানন্দরূপিনী

রূপং বিভর্ত্যরূপা ভজানুগ্রহ হেতবে।।দেবীভাগবত

- সেই সচ্চিদানন্দরূপিনী মহামায়া পরাশক্তি অরূপা হয়েও ভক্তগনকে অনুগ্রহ করার জন্য বিভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ করেন সৎ চিৎ আনন্দময় এক শক্তির রূপভেদে গুনভেদে বিবিধরূপে আত্মপ্রকাশ পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ যেমন বলেছেন, -

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত

অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম।।

পরিত্রাণায় সাধুনাম বিনাশায় দুষ্কৃতাম

ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।গীতা -

- যখনই ধর্মে গ্লানির গ্রহণ লাগে, আর অধর্মের বৃদ্ধি হয় তখনই আমি মায়াকে আধার করে নিজেকে সৃজন করি এবং সাধুর রক্ষার্থে দুষ্কৃতের বিনাশের লক্ষ্যে যুগে যুগে আবির্ভূত হই এই একই আশ্বাসবানীর অভিন্ন সুরে প্রতিধ্বনি শুনি দেবী মহামায়ার কন্ঠে

ইত্থং যদা যদা বাধা দানবোত্থা ভবিষ্যতি

তদা তদাবতীর্যাহং করিষ্যাম্যরিসংক্ষয়ম।।শ্রীশ্রীচন্ডী ১১৫৫

- যখনই দানবের উৎপীড়ন ধর্মকর্তব্যে বাধা সৃষ্টি করে তখনই আমি অবতীর্না হয়ে অসুরশক্তির বিনাশ করি ফলে ভগবত-প্রতিজ্ঞা ভগবতী-প্রতিজ্ঞার এই একত্ব প্রকৃতপ্রস্তাবে পরমপুরুষ পরমাপ্রকৃতির একত্বকেই সূচিত তথা প্রমানিত করে ভক্ত সাধককবি রাম্প্রসাদ যেমন তাঁর গানে বলেছেন,-



কালী ব্রহ্ম জেনে মর্ম ধর্মাধর্ম সব ছেড়েছি

সাধক রামপ্রসাদ যা বুঝেছেন সেই একই সত্য উপলব্ধি করেছেন প্রাচীন ঋষি, যেখানে তিনি মহামায়ার উদ্দেশ্যে বলেন, হে দেবী মহামায়া, হে পরমাপ্রকৃতি, আপনিই পরব্রহ্মরূপে সিদ্ধা 

ত্বমেকা পরব্রহ্মরূপেন সিদ্ধারূদ্রযামল ৪৭ পটল 

ব্রহ্ম শক্তির এই নিত্যত্ব একত্ব স্বয়ংসিদ্ধ এবং পরম সত্য এবং সর্বত্র এই একই সত্যের প্রতিধ্বনি শুনি  

নিত্যৈব সা জগন্মূর্তিস্তয়া সর্বমিদং ততম

তথাপি তৎ সমৎপত্তির্বহুধা শ্রূয়তবং মম।।

দেবানাং কার্যসিদ্ধার্থমাবির্ভবতি সা যদা

উৎপন্নেতি তদা লোকে সা নিত্যাপ্যভিধীয়তে।।শ্রীশ্রীচন্ডী ৬৪-৬৫

- সেই জগন্মূর্তি মহামায়া নিত্যা, জন্মমৃত্যুরহিত এবং এই সমুদয় জগৎ তাঁর সৃষ্ট সর্ব্বব্যাপী নিত্যা হলেও প্রয়োজনে তিনি জগতে আবির্ভূতা হন এবং তিনিপৃথিবীতে উৎপন্নাএইরূপ অভিহিত হন এই ধরণীসম্ভুতা দেবী শক্তিই হৈমবতী উমা যিনি আনন্দময় বিজ্ঞানময় ব্রহ্মস্বরূপিনী শক্তি তিনিই রূপভেদে মাটির আদরিনী মেয়ে উমা নিরাকারা হয়েও তিনি সাকারা শুন্যা হয়েও তিনি নিত্যা তাঁর এই অরূপ রূপপরিবর্তনের সাক্ষ্য পাই সামবেদেও

তস্মিন্নেবাকাশে স্ত্রিয়মাজগাম বহুশোভমানামুমাং হৈমবতীমকেন ১২

- সেই ব্রহ্ম তখন বহুশোভমানা স্ত্রীমূর্তি ধারণ করে হৈমবতী উমারূপে আবির্ভূত হলেন দেবী দূর্গা বা হৈমবতী উমাযাঁর বোধনে শারদোৎসব ধন্যশুধু যে মাটির আদরের মেয়ে তাই নয়, তিনি নিত্যানিত্য ব্রহ্ম, তিনি নির্গুণা অপরা ব্যাপিকা অপরিনামী মঙ্গলস্বরূপিনী তিনি ধ্যানমগ্না বিশ্বাধারা তুরীয়রূপে সংস্থিতা তাঁর সাত্ত্বিকী রাজসী তামসী শক্তিই যথাক্রমে অখিল শাস্ত্রের মর্মগ্রাহিনী মহাসরস্বতী, বিষ্ণুহৃদয়ে অচঞ্চলরূপে স্থিতা মহালক্ষ্মী মহাদেবকে আশ্রয় করে অবস্থিতা মহাগৌরী মহাকালী

নির্গুণা যা সদা নিত্যা ব্যাপিকাহবিকৃতা শিবা

যোগগম্যাহখিলাধারা তুরীয়া যা সংস্থিতা।।

তস্যাস্তু সাত্তিকী শক্তি রাজসী তামসী তথা

মহালক্ষ্মী সরস্বতী মহাকালীতি তাঃ স্ত্রিয়ঃ।।দেবীভাগবত ১৯-২০

দেবীর শক্তিকল্প অনন্ত-সত্য-জ্ঞানরূপ ব্রহ্মে কোনও বিভেদ নেই তিনিই সর্বভুতে বিরাজমানা পরমাত্মা তিনিই আনন্দরূপে অমৃতরূপে নিত্য অনুস্যুত এই আনন্দময় অমৃত রূপটিই তাঁর নিত্যসত্যকল্প এই কল্যাণমূর্তিই চিত্রিত সৃষ্টির বিচিত্রতায় অনির্বচনীয় রূপকল্পে অখিল চরাচর ব্রহ্মান্ড তাঁর এই মধুর রূপ থেকেই সঞ্জাত

আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি 

সর্বভুতের অন্তর্যামী প্রাণদায়িনী শক্তিরূপা জগন্মাতৃকা সকল জীবের পরমা গতি পরমাশ্রয় পরম সম্পদ পরম আনন্দ স্বরূপ

এষাস্য পরমা গতিঃ এষাস্য পরমা সম্পৎ

এষোহস্য পরমো লোকঃ এষোহস্য পরমানন্দ।।বৃহদারণ্যক ৩২

পরমাপ্রকৃতি পরমানন্দ জগন্মাতৃকা এই অখিল ব্রহ্মান্ডের প্রসবিনী জননী, এই নিখিল চরাচর সৃষ্টির আধারস্বরূপা তিনিই আবার এর পরিপালন করেন এবং প্রলয়কালে তিনিই সকল কিছু সংহার করেন তাই তিনিই বিশ্ববিধাতা ব্রহ্মা, তিনিই ত্রিভূবনপতি বিষ্ণু এবং তিনিই রুদ্রমহেশ্বর তিনিই একাধারে ব্রহ্মান্ড নিয়ন্তা এই ত্রিমূর্তিরূপে বিরাজমানা

প্রসূতে সংসারং জননি ভবতী পালয়তি

সমস্তং ক্ষিত্যাদি প্রলয়সময়ে সংহরতি

অতস্তং ধাতাহসি ত্রিভূবনপতিঃ শ্রীপতিরহো 

মহেশোহপি প্রায়ঃ সকলমপি কিং স্তৌমি ভবতীম্।।দক্ষিণাকালিকাস্তোত্রম্ ১২ 

তিনি নিত্য ধ্রুব অনন্তশক্তি পরমাত্মাস্বরূপা আবার তিনিই আপন সৃষ্টিরহস্যের অনুপরমানুতে ওৎপ্রোত জড়িয়ে চরাচরময় যা কিছু পরিদৃশ্যমান যা কিছু অন্তরিন্দ্রিয়ের অনুভবগ্রাহ্য সেসবের মধ্যেই তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি অন্তরে বাহিরে তিনি নিত্য বিরাজমান সচ্চিদাত্মা সত্বরজস্তমো গুণময়ী তিনি স্বয়ং নাম রূপ দ্বারা অনভিব্যক্তা মূলা শাশ্বতীপ্রকৃতি জগদ্ধাত্রী তাঁর স্বপ্রকাশে এই সমুদয় জগৎ সংসার প্রকাশিত বিভাসিত তাঁর আনন্দে এই অপার অনন্ত জগতে রংবদলের মহোৎসব, রূপের পালাবদলের নিত্য নব সমারোহ প্রতিদিনের বিচিত্র বৈচিত্র্যে তাঁর নিত্য বোধন নিত্য বিসর্জন   

তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতিকঠ

- তাঁর (পরমানন্দ পরমাপ্রকৃতি ব্রহ্মস্বরূপ জগজ্জননীর) প্রকাশেই এই সমুদয় জগৎসংসার প্রকাশিত তাঁর আলোতেই সমুদয় চরাচর উদ্ভাসিত 



সেই পরমাপ্রকৃতি এমনই উদার যে বাক্যমনের অতীত হয়েও তিনি নিজেকে লুকিয়ে রাখেন না শরীর ছুঁয়ে মন ছুঁয়ে শিশিরে ফুলে আনন্দে আলোক দিয়ে প্রেম দিয়ে কল্যাণের রূপে প্রতিনিয়ত নিজেকে ধরেছেন তিনি সচ্চিদানন্দ পরমাপ্রকৃতি তিনি কর্ণের কর্ণ চক্ষুর চক্ষু বাক্যের বাক্য প্রাণের প্রাণ মনের মন

শ্রোতস্য শ্রোত্রং মনসো মনো যদবাচো বাচং প্রাণস্য প্রাণঃ

চক্ষুষশ্রচক্ষুরতিমুচ্য ধীরাঃ ... ।।কেন

তিনি যে অন্তরস্থ, পরমাপ্রকৃতির এই সত্যটুকু ফুটিয়ে তুলতেই এত কথা বলা হয়েছে আসলে তিনি ধ্যানের ধন হৃদয়ের দেবী অন্তরের অন্তরসবচেয়ে আপনমাতৃস্বরূপা তাঁর সকল সৃষ্টির মধ্যে তিনি নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন যাতে আমরা অন্তরে বাইরে গভীর করে তাঁকে পেতে পারি তাঁর অমৃতময় রূপটি যথার্থ্য উপলব্ধি করতে পারি যে অমৃতে তিনি অমৃতা সেই অমৃত পেতে পারি যে অনন্ত প্রেমে তিনি বহুর মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন সেই অনির্বচনীয় প্রেমে তাঁকে উপলব্ধ করতে পারি স্রষ্টা যখন সবটুকু উজার করে দেন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে তখন তাঁকে আলাদা করে আর খোঁজার দরকার পড়ে না 

যঃ পৃথিব্যাং তিষ্ঠন্পৃথিব্যা অন্তরো যং পৃথিবী বেদ যস্য পৃথিবী 

শরীরম্যঃ পৃথিবীমন্তরো যময়ত্যেষ তে আত্মাহন্তর্যাম্যমৃতঃবৃহদারণ্যক

- যিনি পৃথিবীর মধ্যে বাস করেন অথচ পৃথিবী যাঁকে জানে না, পৃথিবীই যাঁর শরীর, যিনি পৃথিবীর অন্তরে থেকে পৃথিবীকে পরিচালিত করেন, তিনিই অমৃতস্বরূপা অন্তর্যামী, তিনিই সর্বভুতে আত্মারূপে বিরাজমান সেই জগন্নিবাস অন্তর্যামী পরাপ্রকৃতি সর্বভুতে অধিষ্ঠান করেন, অথচ জগৎ সংসারে কেহ তাঁকে প্রত্যক্ষ জানে না, সর্বভুত যাঁর শরীর, যিনি সর্বভুতের অন্তরে থেকে সর্বভুতকে পরিচালিত করেন, তিনিই অমৃতস্বরূপা অন্তর্যামী, তিনিই সর্বভুতে আত্মারূপে বিরাজমান -

যঃ সর্বেষু ভুতেষু তিষ্ঠন্সর্বেভ্যো ভুতেভ্যোহন্তরো যং সর্বানি ভুতানি বিদুর্যস্য সর্বানি ভুতানি

শরীরং যঃ সর্বানি ভুতান্যন্তরো যময়ত্যেষ তে আত্মাহন্তর্যাম্যমৃতঃবৃহদারণ্যক ১৫

জগজ্জননী মহামায়া যিনি জগৎকারণ ব্রহ্মস্বরূপিনী তিনি জগতের মধ্যেই নানা অছিলায় জড়িয়ে আছেন তাঁকে জগৎ থেকে আলাদা করে ভাবলে ভুল হবে তিনি যে সর্বভুতের অন্তরে স্থিতা অমৃতস্বরূপা অন্তর্যামী আত্মা তিনি অজ অজর অমর অক্ষর অমৃত অভয় ব্রহ্মস্বরূপা -

বা এষ মহানজ আত্মাহজরোহমরোহমৃতোহভয়ো ব্রহ্মবৃহদারণ্যক ২৫

সৃষ্টির প্রতিটি কণায় অনুপরমানুতে তাঁর নিত্য উপস্থিতি যিনি উপলব্ধি করতে পারে তিনি এই মরসৃষ্টির মধ্যেই অমৃতরসের সন্ধান পান যিনি এই ব্রহ্মস্বরূপা মহামায়াকে জানতে পারেন তিনি মৃত্যুকে জয় করেন, তিনি সকল পাপপুণ্যের বন্ধন থেকে মুক্ত হন, তিনি অমৃতত্ব লাভ করেন যে অন্তরে তিনি অন্তঃস্থ সেই অন্তর দিয়ে তাঁকে উপলব্ধি করতে হবে যে অপার প্রেমে তিনি বহুত্বে আপাত-বিভাজিত সেই প্রেমে তাঁর একত্বের সত্ত্বাটিকে হৃদয়ে উপলব্ধি করতে হবে যে অমৃতে তিনি মৃত্যুকে রচনা করেন সেই অমৃতে তাঁকে পেতে হবে 

এতাং মায়াশক্তিং বেদ মৃত্যুং জয়তি পাপনং তরতি সোহমৃতত্বং গচ্ছতি



মহামায়া মহাশক্তি দেবীদুর্গা বিশ্বপ্রসবিনী জগন্মাতৃকার রূপটিতেই সমধিক প্রকাশিত চরাচর জগতের তিনি মাতা মা যেন স্বয়ং বিশ্বপ্রকৃতির রূপে ফলেফুলে সেজে সবুজ কোমল দেহলতাখানি নীলবসনে ঘিরে স্বয়ং আবির্ভূতা গ্রহতারকার মণিমালা তাঁর গলায়, আঁধার কালো চুলের বন্যায় ঢাকা পিঠের বসন এমন শুভা সুন্দর পবিত্র স্নেহময়ী রূপের ঐশ্বর্য্য যদি কখনো কারো চর্মচক্ষে ধরা পড়ে সে তবে সন্তানের চোখেই জননী মূর্তির এমন স্নিগ্ধতা মা ছাড়া আর কেই-বা দিতে পারে! মানুষের কোমলতম গুণের শ্রেষ্ঠতম প্রকাশ এই আশ্চর্য্যসুন্দর মাতৃত্বের মধ্যে মধুরের মধ্যে যা মধুরতম, কোমলের মধ্যে যা কোমলতম, প্রেমের মধ্যে যা সর্বাধিক প্রেমময়তারই নির্মল প্রকাশ মাতৃত্বের মধ্যে মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্বন্ধে যে সহজ প্রেমের দীপ্তি নিত্য প্রোজ্জ্বল তা অন্য কোনও সম্বন্ধে দেখি না আত্মা-আত্মজের সম্বন্ধের এই সাবলীলতাই মহাশক্তিকে জননীর আসনে বসিয়েছে

মায়ের কাছে যতটা সহজ করে বলতে পারি, ‘তোমার অমল রূপের জ্যোৎস্নার মত আমার অন্তরও নির্মল করে দাও’, অন্য কারো কাছে সেভাবে চাইতে কোথাও যেন একটু হলেও দ্বিধা লাগে অথচ মায়ের কাছে চাইতে কোনও দ্বিধা নেই, কোনও অভিমানের গর্ব নেই, কোনও জড়তা নেই ; কেবল অনন্ত শুদ্ধতা, অপার স্নেহ আর অপরিমেয় শান্তির প্রসাদ অনুভব করি যখন নিজের পূজাকে নিবিঢ় করে সমর্পন করি, তখন মনে মনে যে মূর্তি সবচেয়ে সহজে ফুটে ওঠে নিঃসন্দেহে তা মায়ের মূর্তি মনুষ্যত্বের জন্ম মূহুর্ত থেকে যার সাথে নাড়ীর সম্পর্কে বাঁধা সে- তো জননী জগদীশ্বরী মহামায়ার পূজাকে যতক্ষণ পূজা বলে মানি ততক্ষণ তার সাথে কেবল তাত্বিকতা মিশে থাকে যখন সে পূজা ভক্তির আকারে শ্রদ্ধার আকারে মায়ের চরণে নিবেদন করি, তখন তা যেন পূর্ণতা পায় 

পরমাপ্রকৃতিকে যতক্ষণ পরমাপ্রকৃতি বলে জানি সে জানায় কোনও ভুল থাকে না, তবে তা আত্মীকরণে সহজতা অনুভূত হয় না অথচ সেই তাঁকেই যখন মা বলে ডাকি জানি মানি তখন যেন ঘরের চৌকাঠের মধ্যেই বাঁধা পড়েন অনন্তের ঐশ্বর্য্যময়ী পরমাপ্রকৃতি নিজে সত্যের কোনও অসম্মান হয় না তাতে, বরং সত্য যেন আরও নিকট আত্মীয়ের মতো সহজ সম্পর্কে হৃদয়ে নিবিঢ় করে উপলব্ধ হয় মাকে মা বলে ডাকলে সম্বন্ধের দুয়ার দিয়ে ভাবনার আসাযাওয়ার পথটি বড় সহজ সুগম হয় এমনিতে অনন্তের বিশালত্বকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারি না সহজে, মহতের স্থান সংকুলান হয় না আমাদের এতটুকু হৃদয়ে অথচ মায়ের ভাবনার সাথে অন্তহীনের রূপকল্পকে মেশালে হৃদয় উদ্বৃত্ত থেকে যায় এমনইমাকথাটির মহিমা 

যিনি অনন্ত জগৎকারণ ত্রিগুণাত্মিকা অসীম সচ্চিদানন্দময় তাঁকে অমনি ঘরে ডেকে নেবো, এভাবে ভাবতে পারি না তাই তাঁকে অন্তরের ডাকে ডেকে আনি হৃদয়ের ঘরে যে নিত্য অন্তরে সতত বিরাজমান, বাইরে তাঁকে খুঁজলে সাড়া মিলবে কেন? হৃদয়ের ধনকে হৃদয় দিয়েই পেতে হবে প্রেমাস্পদকে প্রেম দিয়েই পেতে হবে ভক্তি সাধনার এই ধারাটিই সব সাধনার মধ্যে সহজ সাধন ঈশ্বরকে পরমাত্মীয় বলে হৃদয়ে গ্রহণ করার সাধনার এই ধারাটি ঈশ্বরের কল্যাণময় রূপের স্বরূপ যেন অনায়াসে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে শিশু যখনমাবলে ডাকতেও পারে না, তখনও কিন্ত্ত অনুভবে মায়ের কল্যাণ পরশটুকু বুঝতে কোনও ভুল করে না মায়ের সাথে আমাদের আত্মীয়তা এমনই আন্তরিক, এতটাই জন্মজন্মান্তরের মায়ের স্নেহসান্নিধ্য অনুভব করার জন্য বাইরের কোন আয়োজনের প্রয়োজন পড়ে না যার সাথে নাড়ীর যোগ তাকে কারও চিনিয়ে দেবার দরকার পড়ে না, হৃদয়ে অমনিই ধরা পড়ে মায়ের ছবি দিনের আলোর মতো সহজ হয়ে অনন্ত আনন্দময় সত্যস্বরূপ জ্ঞানমূর্তি ব্রহ্মকে তাই বসাই মায়ের আসনে আর এক নিমেষে সম্বন্ধের দুয়ার যায় খুলে অনন্ত নিজে এসে ধরা দেন সন্তানের হৃদয়ের ভক্তিমন্দিরে



যতবার শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদেরশৃণ্বন্ত্ত বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃবানীটি শুনি, ততবারই নিজের সাথে পরম ব্রহ্মের সম্বন্ধ অনুভব করি অনুভব করি সেই পরমাপ্রকৃতি শক্তিস্বরূপা জননীকে যিনি জন্মসূত্রে আমাদের আধার স্বরূপা অনুভব করি সেই অমৃতময়ী স্নেহময়ী জননীকে যিনি আমাদের মাতার পরিচয়ে গর্বিতা অনুভব করি সেই মমতাময়ী জননীকে যিনি সংসারের নিজে পান করে সন্তানের মুখে বুকের অমৃত ঢেলে দেন অকৃপণ প্রসন্নতায় অনুভব করি সেই চিরপবিত্র চিরস্নিগ্ধা জননীকে আপন গর্ভের সবটুকু নির্মাল্যে অপার প্রেমে আমাদের সৃজন করেছেন অনুভব করি সেই সনাতন শুচিস্মিতা অমিয়া জননীকে যিনি সন্তানের কল্যাণ কামনায় সদা মগ্ন 

এমন যে মা, সে শক্তিময়ী না হয়ে পারে! জগন্মাতৃকা দেবী উমা সেই শক্তিময়ী অমৃতময়ী স্নেহময়ী জননী তাঁর অমৃতধারার প্রসাদে পুষ্ট এই সমুদয় জগৎ চরাচর যখন তাঁকেমাবলে ডাকি সে ডাক সর্বতোভাবে আন্তরিক যখন তাঁকে পূজা করি সে পূজার মধ্যে কোনও অভিমান নেই অহংকার নেইশুধু ভক্তির ফুলে মায়ের পূজা যখন হৃদয়ে তাঁর ধ্যান করি তখনও অমলিন অপার কল্যাণময় মাতৃমূর্তি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে জীবনের সবটুকু আশ্রয় এক মূহুর্তে এনে সঁপে দিই মায়ের পায়ে আত্মসমর্পনের শান্তি আর কে দিতে পারে এমন নিশ্চিন্ততায় সংসারের বাঁধনের দাপট বড় সাংঘাতিক স্বার্থের মতো নিষ্ঠুর আর কেউ বলে মনে হয় না জীবনকে সত্যের বোধে শান্তির বোধে নির্মাল্যের বোধে সৌন্দর্য্যের বোধে আনন্দের বোধে প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে পরমের প্রসাদ পেতে পারবো কি করে! যাঁর কল্যাণে মঙ্গলে দয়ায় হৃদয় ভরেছে তাঁকেমাছাড়া আর কি বলে ভাবতে পারি!

সর্বভুতে যিনি মাতৃরূপে বিরাজিত, সর্বভুতে যিনি শ্রদ্ধারূপে বিরাজিত, সর্বভুতে যিনি প্রজ্ঞারূপে বিরাজিত, সর্বভুতে যিনি শান্তিরূপে বিরাজিত, সেই মাকে নমস্কার করি সর্বভুতে যিনি চৈতন্যরূপে বিরাজিত, সর্বভুতে যিনি শক্তিরূপে বিরাজিত, সর্বভুতে যিনি ক্ষমারূপে বিরাজিত, সর্বভুতে যিনি লজ্জারূপে বিরাজিত, সেই মাকে নমস্কার করি সর্বভুতে যিনি কান্তিরূপে বিরাজিত, সর্বভুতে যিনি লক্ষ্মীরূপে বিরাজিত, সর্বভুতে যিনি দয়ারূপে বিরাজিত, সেই মাকে নমস্কার করি যিনি চিৎশক্তিরূপে এই সমস্ত জগৎ জুড়ে বিরাজিত, সেই সর্বব্যাপিকা ব্রহ্মশক্তিরূপা জননীকে নমস্কার করি -

সর্বস্বরূপে সর্বেশে সর্বশক্তিসমন্বিতে

ভয়েভ্যস্ত্রাহি নো দেবি দুর্গে দেবী নমোহস্তুতে।।শ্রীশ্রীচন্ডী ১১২৪

- ওগো পরমাপ্রকৃতি, তুমিই আমাদের মা তোমাকে মা বলেই যেন জানি, মা বলেই বুঝি তোমাতে আমাদের প্রণাম যেন সত্য হয়।। 

Post a Comment

Previous Post Next Post