বালিশ
সুপর্ণা গঙ্গোপাধ্যায়
তুলো বেরিয়ে
যেতে যেতে
, বালিশটার আর কিছুই নেই। তেলচিটে , শতচ্ছিন্ন
ওয়াড় । তবু মাঝে মাঝে নাক, চোখ, মুখ বন্ধ করেই ওটা রোদে দেয় সুমনা। হাতে গামছা জড়িয়ে ধরে । ভেতরে কাগজের বল , খড়্ বড়্ করে। কষে মুখ বন্ধ সেলাই বলে , কাচাকুচিও করা যায় না ! আর সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করতে হয় সুমনাকে , শুধু অসীমের ঘুমের জন্য। এই
মার্কামারা বালিশটা ছাড়া , অসীমের
ঘুম আসেই না , বিয়ের পর বিগত দশ বছর ধরে দেখছে সুমনা।
এই বালিশ নিয়ে , তাদের দাম্পত্য প্রায় ডিভোর্সের পর্যায়ে এসে পৌঁছে ছিল । চরম সুখের মুহূর্তে
, বালিশের উৎকট গন্ধ, বাকি অনুভূতি গুলোকে অসাড় করে দিত, সুমনার। ঝগড়া ঝাটি অশান্তি। বালিশ বিতাড়িত করতে গিয়ে , দাম্পত্য
সুখই বিদায় নিতে বসেছিল। শেষপর্যন্ত বালিশের মধ্যস্থতায়তার তা ফিরে আসে । অথচ ওটা কি ছেলেবেলার বালিশ ? সদুত্তর পায়নি , সুমনা...
“কি আছে,
ওর মধ্যে? একই দেখতে আর একটা ওয়াড়ের একটা বানিয়ে নিলে, কোন মহাভারত অশুদ্ধ হবে শুনি ? "
"তোমাকে বদলে নতুন কাউকে আনলেই বা কোন অশুদ্ধ সংশোধন হবে শুনি ?"
অসীম মিটি মিটি হাসে ।
"ঢং! বউ আর বালিশ কি এক?"
সুমনা মুখ বাঁকায়।
" দুটোই অভ্যাস । তাছাড়া, নতুন বালিশ নতুনই...তাতে পুরনোর গন্ধ, ছোঁয়া কোথায় ?"
“ছিঃ ! কী নরকের কীট তুমি ?!"
সুমনা ঘেন্নায় মুখ কুঁচকায় অসীমের কথায় ।
■■■■■
দিন কয়েক পর
সুমনা সাটিনের ফুলওয়ালা মখমলের দুটো বালিশ আলমারী থেকে বার করে খাটে রাখে, ইচ্ছে করেই। অসীম শোয়ার সময় কিছুই বলে না।
কিন্তু
মাঝরাতে
হঠাৎই সুমনার ঘুম ভেঙে যায়,
পরিচিত উৎকট গন্ধে । ধড়মড়
করে উঠে বসে, সুমনা দেখে,
তার বিতাড়িত পুরোন বালিশ সগর্বে পুরোন জায়গায় ফিরে এসেছে।আর অসীমের নাসিকাধ্বনি সমস্ত ঘরে গুঞ্জরিত হচ্ছে। পরদিন বাপের বাড়ি চলে গেল,
সুমনা। দিন কয়েকপর ফিরেও এল। অসীমই ফিরিয়ে নিয়ে এল।
তারপর রাতের বেলায় নিজের হাতে, সুমনার
প্রিয় প্রজাপতি আঁকা বেডকভার, সুন্দর
করে বিছিয়ে দিল। ফুলদানীতে রাখলো তাজা লাল গোলাপ । কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে
কালো ক্ষতোর মত বিরাজ করছিল বালিশটা । রাগতে গিয়েও একটু হেসে, একটা বোঝাপড়া করে নিতে বাধ্য হল সুমনা।
তারপর তুলোর মত
ফুরফুরে হয়ে কিছু হালকা দিন ,আবার ভেজা তুলোর মত কিছু ভারি দিন হাতে হাত ধরে কাটছিল । তারপর একদিন-- রোদে দেওয়া বালিশটা , রোদ থেকে তুলে কোনোরকমে খাটের ওপর ছুঁড়ে দিতে গিয়ে,
লক্ষ ফসকে পড়ল মাটিতে, মুখ থেকে একটা বাঁধা প্লাস্টিক বেরিয়ে পড়ে। হয়তো ওয়াড়ের মুখের সেলাই খুলে গিয়েছে, তাই বেরিয়ে
এসেছে। বালিশের
ভেতরের অন্ধকারটা সুমনার চিরকালই অজানা। তুলোর অভাব পূরণ করতে, অসীম ওতে কি
ঢুকিয়ে ছিল, সে সম্পর্কে সুমনার কোন ঔৎসুক্য ছিল না। কিন্তু আজ
মুখটা ছেঁড়া দেখেই কৌতূহল হল
....
একটা প্যাকেটে ভর্তি মেয়েদের কাটা চুল...!!
"তোমার বালিশ
... ..."
সুমনা বালিশটা অসীমের দিকে এগিয়ে দেয়।
বালিশটা হাতে নিয়েই চমকে ওঠে অসীম। পাগলের মত হাতড়াতে থাকে ভিতরে ...
সুমনা স্থির দৃষ্টিতে তাকায়। "কি খুঁজছো ?"
"এর মধ্যে একটা দরকারী জিনিস ছিল, কোথায় গেল ?" অসীম কে
মুহূর্তের জন্য অসহায় দেখায় । কিন্তু
তারপরই কী
মনে হতে,
অসীম তীব্র হিংস্র
দৃষ্টিতে সুমনার দিকে তাকায়... "কোথায় রেখেছো ? দাও দাও এক্ষুনি ..."
দাঁত খিঁচিয়ে সুমনার কাঁধটা খিমচে ধরে অসীম ।
হচকিত ভীত সুমনা এগিয়ে দেয় চুলের প্যাকেটটা। অসীম প্রায় প্যাকেটটা কেড়ে নিয়ে বালিশের মধ্যে প্যাকেটটা ঢুকিয়ে ছেঁড়া অংশটায় গার্ডার বাঁধে ।
স্তম্ভিত সুমনা চেয়ে থাকে ... বিয়ের দশ বছর পরও চেনা হোল না লোকটাকে.... !
এবার নিশ্চিন্তে বালিশটা চেপে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে অসীম । ঠিক সেই ছোটবেলার মত। মায়ের
বকুনি সত্ত্বেও যেমন মায়ের বিছানা চুল নাকে দিয়ে তবে ঘুম আসতো । ওঠার সময় টান পড়তো বলে মারও খেয়েছে, তবু ।
তারপর একদিন তার সন্দেহ প্রবণ বাপ,
রাতের বেলায় মাল টেনে এসে হম্বিতম্বি করতে করতে,
মাকে চুলের মুঠি ধরে উঠিয়েছিল। ভয়ের চোটে অসীম খাটের তলায় লুকিয়ে কাঁপছিল। যা
মারের হাত বাপের !
শুরু হয়েছিল হাতাহাতি ,কাঁচি দিয়ে মায়ের চুলের গোছা কেটে দিয়েছিল বাপ তার। চুলগুলো আঁকড়ে মুখ আড়াল করে , কতক্ষণ কান্না চেপে নিঃশব্দে কাঁদছিল, তারপর ঘুমিয়ে পড়েছিল তা অসীমের মনে পড়ে না.....।
তারপর তারা গ্রামের বাড়ি থেকে কলকাতার নতুন বাড়িতে এল, কিছুদিন পর নতুন মা
এল। সব কিছুই হারিয়ে গেল কোথায়..।
নিজের মাকে ধরে রাখার জন্য এই চুলটুকুই সম্বল অসীমের....।