ইতিহাসের ইতিহাস হওয়াটা আবশ্যক
দরকার হিস্ট্রির বিকল্প
মূল রচনা: শুভদীপ মুখোপাধ্যায়
অনুবাদকের নিবেদন: বক্তব্য লেখকের নিজস্ব। লেখক ইতিহাস
ও হিস্ট্রি শব্দদুটি সমার্থক মনে করেননি। তবে অনুবাদ করতে গিয়ে হিস্ট্রির বাংলা প্রতিশব্দ হিসাবে অনুবাদককে ‘ইতিহাস’ কথাটাই ব্যবহার করতে হয়েছে।
পাঠ্যসূচিতে ইতিহাস বলতে
কী আছে?
ভারতীয় তথাকথিত
ইতিহাস (History) পাঠ্যসূচিতে বাদশা আকবার ছাড়া একমাত্র সম্রাট অশোকই ‘মহান’ সম্রাটের তকমা পেয়েছেন। NCERT পাঠ্যক্রম
অনুসারী ভারতের স্কুল শিক্ষার জন্য রচিত একটি পাঠ্যপুস্তক থেকে অশোক সম্পর্কে
খানিকটা আলোচনা তুলে ধরছি। বইটির নাম “Our Past – I”, সপ্তম শ্রেণীর
জন্য রচিত।[1]
অশোক ছিলেন
ইতিহাসে জানা (known to history) শ্রেষ্ঠ
সম্রাটদের অন্যতম। তাঁর নির্দেশে বিভিন্ন স্তম্ভে ও পাথরের গায়ে লিপি খোদাই করা
হয়। .... অশোকের ‘ধম্ম’ ঈশ্বর আরাধনা ও
বলিদানের পক্ষপাতী ছিল না। তিনি অনুভব করেছিলেন, একজন পিতা যেমন
নিজের সন্তানদের কাছে পৌঁছতে চায়, ঠিক সেভাবে তাঁরও তাঁর প্রজাদের নির্দেশ দেওয়া কর্তব্য। তিনি বুদ্ধের শিক্ষা/বাণী (teachings) দ্বারাও
অনুপ্রাণীত হয়েছিলেন। অনেক সমস্যাই তাঁকে কষ্ট দিত। তাঁর সাম্রাজ্যে বিভিন্ন
ধর্মের মানুষ বসবাস করত, এবং সেই কারণে মাঝেমধ্যে সংঘাত তৈরি হতো। প্রাণী বলি দেওয়া হত। দাস-দাসীদের সঙ্গে দুর্ব্যহার
করা হত। তাছাড়া পাড়ায় প্রতিবেশী পরিবারগুলির মধ্যেও ঝগড়া হত। অশোক অনুভব করেছিলেন, এইসব সমস্যা
সমাধান করা তাঁর কর্তব্য। তাই তিনি ‘ধম্ম মহামাত্য’ নিয়োগ করেন, যারা ‘ধম্ম’ শিক্ষা দেওয়ার
জন্য বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করতেন। [2]
এবার বোঝার চেষ্টা করি স্কুল পড়ুয়া বাচ্চারা, যারা ভারতের অতীত সম্পর্কে প্রথম জানা শুরু করেছে, তাদের মধ্যে এর প্রভাব কী হতে পারে। তারা এই
সিদ্ধান্তে পৌঁছবে:
অশোক ভারতের
শ্রেষ্ট সম্রাট ছিলেন।
হিন্দুধর্ম ছিল পশ্চাদ্পদ ও
কুসংস্কারযুক্ত।
হিন্দুরা প্রাণী বলি দিত।
হিন্দুরা দাসপ্রথা অনুসরণ করত।
লোকেরা নিজেদের
মধ্যে ঝগড়া করত।
সর্বত্র অসুখ ও শত্রুতা ছিল।
সপ্তম থেকে দশম শ্রেণীর এই
হিস্ট্রি পাঠ্যক্রম মোটের ওপর কী
শেখাচ্ছে? আমরা সেখান থেকে জানছি:
সিন্ধু সভ্যতা
ছিল সাম্যবাদী ও অগ্রসর সমাজ।
তাদের লিপি এখনও অজানা তবে অবশ্যই সংস্কৃত ছিল না।
১৫০০ খ্রীস্ট
পূর্বাব্দে আর্যরা ভারত আক্রমণ দ্বারা অনুপ্রবেশ (invaded) করেছিল এবং স্থানীয়দের পরাস্ত করে অবদমিত রেখেছিল।
আর্যরা সিন্ধু
সভ্যতার মানুষদের চেয়ে আলাদা ছিল।
হিন্দু ধর্ম হল জাতিভেদ প্রথা, লিঙ্গবৈষম্যসহ নানা সমস্যার এক জটিল গোলকধাঁধা।
ব্রাহ্মণরা অন্যান্য জাতিকে দমিয়ে রেখেছিল।
রামায়ণ ও মহাভারত হল
মিথ অর্থাৎ ঐতিহাসিক ভিত্তিহীন পৌরাণিক গাথা।
মধ্যযুগের হিন্দু রাজারা সবসময় নিজেদের মধ্যে লড়াই করত।
তুর্কি ও মুঘল বিজেতারা হিন্দু রাজাদের পরাস্ত করেছিল।
ইসলামিক শাসন আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে ‘হিন্দুস্তান’ প্রতিষ্ঠা করে।
মুঘল যুগ ছিল স্বর্ণযুগ।
পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসন পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত রাজ্যগুলোকে সংযুক্ত করে ‘ইন্ডিয়া’ তৈরি করে।
গান্ধী ও নেহেরু অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন।
ভারতের অতীত ও বৈদিক শিকড় সম্পর্কে এই
নেতিবাচক ধারণাটাই ৪-৫ বছর ধরে কচি মনে গেঁথে দেওয়া হয়, যত দিন না তারা দশম শ্রেণী উত্তীর্ণ হচ্ছে। কেউ কেউ হিস্ট্রি নিয়েই স্নাতক স্তরে পড়ছে, কেউ বা
পিএইচডি করছে ভারতীয় তথাকথিত ইতিহাস অর্থাৎ হিস্ট্রির বিভিন্ন শাখা নিয়ে। তাদের মধ্যেই
কেউ কেউ ভারতীয় প্রশাসনিক বিভাগ যেমন Indian Administrative Service (IAS) ও Indian Foreign Service (IFS) এইসবের আধিকারিক
হয়ে বসে দেশে বিদেশে ভারত ও ভারতীয়দের প্রতিনিধিত্ব করছে।
ইতিহাসের
পুনর্লিখন (Re-writing of History):
প্রচলিত পঠনপাঠনে
ভারত সম্পর্কে কোনও ইতিবাচক দিক তুলে ধরা হয় না। বিজ্ঞান, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ব্যাকরণ, তর্কবিদ্যা, মনস্তত্ত্ব, যুদ্ধবিদ্যা এবং
প্রশাসনের ক্ষেত্রে ভারতের চূড়ান্ত উৎকর্ষলাভের কথা নেই এই পাঠ্যক্রমে। পরিবর্তে
ধর্মনিরপেক্ষতার ছদ্মবেশে যা পাওয়া যায় তা হল: প্রবল ‘হিন্দুবিদ্বেষ’ (Hinduphobia)। এই মনোভাব গড়ে
তুলতে কতগুলো বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়, যেমন “বৌদ্ধধর্ম ভালো, হিন্দুধর্ম মন্দ”, “ইসলামিক সাম্যবাদ”, “প্রথা ভাঙা মিশ্র সংস্কৃতি” (syncretic culture), “বিজ্ঞান মনস্কতা” (scientific spirit) ইত্যাদি।
অনেক
মুক্তচিন্তাবিদ ও তৎসহ দক্ষিণপন্থীদের দাবি হল ইতিহাস (History) পুনর্লিখিত হোক।
তাঁদের খুব সঙ্গত দাবি, এই ইতিহাস পাঠ্যসূচি (history curriculum) চরিত্রগতভাবে বৈষম্যপূর্ণ। সেখানে হিন্দুদের
অবদান এড়িয়ে, হিন্দু রাজাদের
ক্ষাত্রবীর্য ছোট করে দেখিয়ে, মুসলিম ও ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচারের ছবি পুরো চুনকাম করে ঢেকে দিয়ে ইসলামিক ও
‘নেহেরুভিয়ান’ সেকুলার আমলকে
অযথা মহিমান্বিত করে দেখানো হয়েছে।
স্কুলের শিশুরা
যাদের মধ্যে এই বিষ ঢেলে দেওয়া হয় তারা হয় নিজেদের বৈদিক ঐতিহ্যকে ঘৃণা করতে শেখে, নতুবা মন্দের
ভালো বলতে অতীত সম্পর্কে উদাসীন হয়ে যায়। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, যারা ইতিহাসের
নামে এই হিস্ট্রি নিয়ে
পড়াশুনো করে, তারা ভারত ও
ভারতীয় সংস্কৃতির সবচেয়ে কঠোর সমালোচক হয়ে যায়। ভারতকে বহির্বিশ্বে ভুল বোঝা ও ভুল
দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখার অন্যতম কারণ হল এই ইংরেজী বলিয়ে কইয়ে শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত
মানুষগুলোই দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে; যাদের মধ্যে ভারত ও তার ঐতিহ্যমণ্ডিত অতীতের প্রতি এতটুকু শ্রদ্ধা বা
সহানুভূতি নেই। আইএএস ও আইএফএস আধিকারিক যাদের কাজ দেশে ও বিদেশে ভারতের হয়ে
প্রতিনিধিত্ব করা, তাদের ভারতের অন্তর্নিহিত ঐক্যের ধারণাটার প্রতিই চূড়ান্ত ঘৃণা ও বিদ্বেষ। বরং
অনেকেই ভারত রাষ্ট্রের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।[3]
তাই অনেক ভারতীয়ই
আমাদের সভ্যতার এই সংকটের সমাধান হিসাবে দেখছেন ইতিহাস পুনর্লিখনকে। তাঁদের বক্তব্য, যদি সঠিক ইতিহাস
পড়ানো হয়, তাহলে আমাদের
ছেলেমেয়েরা নিজেদের ঐতিহ্যকে ঘৃণা করতে শিখে বড় হবে না। তারা শুধু কোন কোন যুদ্ধে
আমরা হেরেছি সেগুলোই নয়, কোনগুলোতে জিতেছি সেই তথ্যও পড়ে – অর্থাৎ উভয় ক্ষেত্রের ইতিবৃত্ত জেনেই ভারতীয় হিসাবে গর্ববোধ করবে। শুধু সতীদাহ
ও বর্ণাশ্রম নয়, ভারতের বিজ্ঞান ও
গণিতচর্চায় সাফল্য সম্পর্কেও জানবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে
‘সঠিক ইতিহাস’ বা Correct History বলতে কী বোঝায়? এর সঠিকত্ব
নির্ণয় করবে কে? বাচ্চাদের কি
সত্যিই সতীপ্রথা, বর্ণাশ্রম বা
নারী নির্যাতন সম্পর্কে জানার প্রয়োজন আছে? যদি থাকে তাহলে
সেসব জানানোর সেরা পদ্ধতি কী হতে পারে? ছোটরা কি মাহমুদ গজ়নির বর্বরতা সম্পর্কে কিছু পড়ে? জানলে কি হিন্দু
মুসলিম বিভাজনের ঘাটাই দগদগে হবে না? এই প্রশ্নগুলোর সবকটা নিয়েই ভাবতে হবে। আমার মতে এ ব্যাপারে মতৈক্যে পৌঁছানো
খুব মুশকিল। উপরন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, জাতিগোষ্ঠী, নারী অধিকারবাদী, প্রসিদ্ধ
ইতিহাসবিদ, সমাজবিদ, বুদ্ধিজীবী এবং
উদারপন্থীদের কাছ থেকে প্রবল বাধা আসবে। কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রশ্ন এই ইতিহাস মানে
হিস্ট্রি কি আদৌ বদলানো সম্ভব?
ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত দর্শন: A Brief
Philosophy of History
এই প্রশ্নগুলোর
উত্তর খুঁজতে প্রথমে জানা দরকার: হিস্ট্রি আসলে কী? এর নেপথ্যে তাত্ত্বিক অনুমানগুলো কী কী? এর অভিপ্রেত
সামাজিক প্রভাবগুলো কী হওয়া উচিত? এই অনুসন্ধানই বলে দেবে তথাকথিত ইতিহাস মানে হিস্ট্রি বদলাতে পারে কিনা, কারণ প্রকৃত
ইতিহাস কিন্তু বদলানো সম্ভব নয়, তার নবমূল্যায়ন করেও লাভ হবে না। তাই ইতিহাস সংশোধনের কথা ভাবার আগে ইতিহাসের
দর্শন বুঝতে হবে। এই পর্যায়ে কতগুলো কেন্দ্রীয় নীতি (tenets) ও তাদের তাৎপর্য (implications) সংক্ষেপে তুলে
ধরছি:[4]
হিস্ট্রির দর্শন
বা Philosophy of
History নামে একটি শাখার আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত করেন হ্যালিকার্নাসাস প্রদেশের গ্রীক দার্শনিক
হেরোডোটাস (খ্রীস্টপূর্ব ৪৮৪-৪২৫)। তিনি চেয়েছিলেন “to preserve the memory of the past by putting
on record the marvelous achievements both of the Greek and non-Greek peoples;
and more particularly, to show how the two races came into conflict.”[5] অর্থাৎ গ্রীক বা
অগ্রীক মানুষদের প্রশংসনীয় কীর্তিগুলো এবং তারা কীভাবে সংঘাতে জড়াল তা নথিবধ্য
করা। সুতরাং বৌদ্ধিক শাখা হিসাবে Histoy অধ্যয়ন শুরুই হয়েছিল একটি সুনির্দিষ্ট সময়ে যার মূলে ছিল সংঘাতের ইতিবৃত্ত।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, পাশ্চাত্তের Philosophy of History শাখাটি ভারতের প্রথাগতভাবে ‘ইতিহাস’ চর্চা শুরুর অনেক
পরবর্তী।
পরবর্তী ধাপে
হিস্ট্রির দর্শন বিকশিত হল ইহুদি-খ্রীস্ট-ইসলামিক জগতের ‘পবিত্র হিস্ট্রির
ধর্মীয় প্রথা’ (religious
practice of sacred-history) হিসাবে, যেখানে অতীত অধ্যয়ন করা হতো উপেক্ষিত বা ভুলে যাওয়া সত্য উদঘাটনের জন্য নয়, বরং স্বর্গীয়
পরিকল্পনার সঙ্গে পার্থিব মানুষের বন্ধন বোঝানোর জন্য। [the past was “not studied for the
sake of disinterested truth, but in the hope of attaining a glimpse of the bond
between the divine plan and a given people’s course in the world”. [ধর্ম ও রিলিজিয়ান
সমার্থক না হলেও অনুবাদের স্বার্থে ও সবার সহজ বোধগম্যতার জন্য রিলিজিয়নের প্রচলিত
ভারতীয় তর্জমাটিই ব্যবহার করা হল – অনুবাদক]। এই ধারার অন্যতম
প্রবক্তা অগস্টিন (৩৫৪-৪৩০ খ্রীস্টাব্দ) হিসট্রিকে সোজাসুজি জন্ম-মৃত্যু-পরলোক (eschatology), ভগবানের চিরন্তন
পরিকল্পনা ইত্যাদি সংক্রান্ত খ্রীস্টান বিশ্বাসের অঙ্গ হিসাবে দেখানো শুরু করলেন।
[Augustine (354-430) who “emphasized the linearity of history as a part
of the Christian eschatology, the necessary unfolding of God’s eternal plan
within a temporally-ordered course of history”][6].
পরবর্তী
উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব জিয়ামব্যাতিস্তা ভিকো (Giambattista Vico) (১৬৬৮-১৭৪৪) যিনি প্রথম philosopher of history হিসাবে
আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পান। তিনি ধরে নেন (postulated) যে পৃথিবীর সমস্ত
দেশের হিস্ট্রি বিভিন্ন সময়কাল বা যুগে (epochs) মানুষের মানসিক বিকাশ দ্বারা নির্ধারিত।[7] যেমন –
দেবতাদের যুগ (Age of Gods), যখন মানুষ মনে
করত তারা স্বর্গ দ্বারা শাসিত
নায়কদের যুগ (Age of Heroes), যেখানে ধারণা
অসামান্য (larger than life) রাজা ও সেনাপতিরা
জনগণকে শাসন করে
মানবদের যুগ (Age of Men), যেখানে মানুষ সাম্য ও সুবিচার দ্বারা পরিচালিত হয়
এরপর এলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী ফরাসী দার্শনিক
অ্যান্টয়েন-নিকোলাস দি
কন্ডোরসেট (Antoine-Nicolas de
Condorcet) (১৭৪৩-১৭৯৪) যাঁর দ্বারা
সেন্ট সাইমন, হেগেল ও মার্কস্-এর কাজগুলো
প্রভূত প্রভাবিত হয়। তাঁর মতে হিস্ট্রি শুধু মানব সভ্যতার অগ্রগতির বর্ণনা নয়, একে সাম্যবাদ
প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক সংগঠনগুলো ভবিষ্যৎ পূর্বানুমানের আয়ুধ হিসাবেও
ব্যবহার করতে পারে। “The historian is no mere critic
of his time, but also a herald of what is to come.”[8]
এবার আবির্ভূত হলেন বিশ্বের হিস্ট্রি দর্শনের অন্যতম
প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হেগেল (G.W.F. Hegel) (১৭৭০-১৮৩১)। বস্তুত “philosophy of history” বিষয়টাই হেগেলের
গবেষণার সমার্থক মনে করা হয়। হেগেল বললেন হিস্ট্রি হল অধিকতর যুক্তিগ্রাহ্য
স্বাধীনতার দিকে যাত্রা (process of unfoldment or movement towards greater rational freedom). হেগেল মানুষের
ইতিবৃত্তকে তিনটি যুগ বা সময়কালে (epochs) ভাগ করলেন – স্বাধীনতা থেকে
অধিকতর স্বাধীনতার অভিমুখে যাত্রা অনুসারে।[9]:
Public freedom and citizenship of Roman Republic: জনতার স্বাধীনতা
ও রোমান প্রজাতন্ত্রের নাগরিকত্ব
Individual freedom of the Protestant Reformation: প্রোটেস্টান্ট
সংস্কারজাত ব্যক্তি স্বাধীনতা
Civic freedom of modern state: আধুনিক রাষ্ট্রে জনগণের স্বাধীনতা
বা নাগরিক অধিকার
তিনি ধরে নেন (postulated) প্রাচীন প্রাচ্য
সভ্যতায় একমাত্র শাসকই স্বাধীন ছিল। সাধারণ মানুষের কোনও স্বাধীনতা ছিল না। তারা
ছিল রাষ্ট্র ও রিলিজিয়ানের সম্পূর্ণ অধীনস্থ। প্রতীচ্যের বিশেষত খ্রীস্টান মতবাদের
প্রভাবেই সারা বিশ্বে স্বাধীনতার আদর্শ ছড়িয়েছিল। খ্রীস্টীয় মতবাদ দ্বারা স্বীকৃত
জীবনের সততা ও নৈতিকতার ধারণাই ছিল মোটামুটি সর্বসম্মতভাবে যুক্তিগ্রাহ্য যা
স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিতে পারে। “It was first the Germanic Peoples, through Christianity, who came to
the awareness that every human is free by virtue of being human, and that the
freedom of spirit comprises our most human nature”[10]. অর্থাৎ
জার্মানরাই প্রথম খ্রীস্টীয় দর্শনের প্রভাবে অনুভব করে প্রতিটি মানুষ ধর্মত
স্বাধীন এবং মানুষের প্রকৃতিতেই স্বাধীনতার বসবাস।
আমাদের কাছে History বা তথাকথিত
ইতিহাস কী?
সংঘর্ষ বা দ্বন্দ্ব (Conflict): এই দ্বন্দ্ব
বিষয়টা ইতিহাসে অপরিহার্য যা আধুনিক কালেও নানা অবতারের মধ্যে বিদ্যমান।
মার্কসবাদীরা মনে করে ইতিহাসের ভিত্তি হল শ্রেণী সংঘর্ষ। সাবঅলটার্ন (Subaltern) দৃষ্টিভঙ্গীতে
ইতিহাসের ভিত্তি হল নিম্নপদস্থ ও বহুমত পাওয়া গোষ্ঠী পরিচালিত রাষ্ট্রের মধ্যে
দ্বন্দ্ব (conflict between
subalterns and a majoritarian hegemonic state). সুতরাং দ্বন্দ্ব
ছাড়া হিস্ট্রির অস্তিত্ব নেই বললে অযৌক্তিক হয় না। তাই সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের
আগে ১৯-২০ শতকে লেখা
ভারতের ইতিহাসে তথাকাথিত আর্য ও ভারতের আদিবাদীদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বকেই ভিত্তি
হিসাবে অনুমান করে নেওয়া হয়েছিল।
রৈখিকতা (Linearity): রৈখিকতার ধারণাটাও
প্রথম থেকেই ইতিহাসের আবশ্যিক অঙ্গ ছিল। ভিকো এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য
ইতিহাসকে পশ্চাদবর্তিতা থেকে যুক্তির দিকে ক্রমবিকাশ বলে ব্যাখ্যা করেন। এই
তত্ত্বের অনুসিদ্ধান্ত হল, যেসব সমাজ বা দেশকে বিভিন্ন যুগ বা সময়কালে ভাগ করা যায় না, তারা তাহলে
ইতিহাসের অঙ্গ নয়। অর্থাৎ ইওরোপীয়রা আমেরিকা পৌঁছোনোর আগে পর্যন্ত
আমরিকার মূল অধিবাসীদের কোনও ইতিহাস ছিল না, যেহেতু তারা
ভিকোর মতে ‘দেবতাদের যুগে’ই ছিল। তাদের
আনুষ্ঠানিক ইতিহাসের সূচনা হচ্ছে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা “আবিষ্কার” এবং তাদের
পশ্চিমী শৈলীর প্রগতি থেকে।[11]. অনুরূপভাবে ভারতের ইতিহাসও আরম্ভ হচ্ছে যখন নর্ডিক/জার্মানিক/মধ্য এশীয় আর্যরা
ভারত আক্রমণ করে অগ্রগতির মালমশলা সরবরাহ করল।
তার আগে দশ হাজার বছর ধরে ভারতীয়রা নিছক স্থবির অ-ঐতিহাসিক (ahistorical) নরকে বসবাস করত।
ভবিষ্যদ্বাণীর সম্ভাব্যতা (Predictability): তথাকথিত ইতিহাস
অধ্যয়নের একটা গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হল সার্বজনীন ভবিষ্যদ্বাণীর সম্ভাব্যতা ও
অবশ্যম্ভাবিতা (universal predictability and inevitability). কোনও এক সময় একটি
দেশ বা সভ্যতায় যা ঘটেছে, অনুরূপ কাণ্ডই নির্ঘাৎ অন্যান্য দেশ বা সভ্যতাতেও ঘটে থাকবে। কারণ তথাকথিত
ইতিহাসের যাত্রা(march of history)-য় যারাই অংশগ্রহণ
করেছে, তাদের অনুরূপ পথই
অনুসরণ করতে হবে। এই ধারণাটি হিন্দুত্বের ‘কর্ম’ বলতে যা বোঝায়, তার সম্পূর্ণ
বিরোধী। আমাদের দর্শনে ভবিষ্যদ্বাণী সম্ভব হবেই এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। ‘ভগ্বদগীতা’য় শ্রীকৃষ্ণ
অর্জুনকে বলেছিলেন, “কর্মেই তোমার অধিকার, ফলাফলের ওপর নয়”।(গীতা ২.৪৭)
জাতিতত্ব (Racism): প্রাচ্য সম্পর্কে
পশ্চিমীদের কিছু বিরূপ কুসংস্কারই বিষয় হিসাবে তথাকথিত ইতিহাস বা হিস্ট্রির বুনন।
হেগেল খোলাখুলি ভারতীয় ও চীনা সভ্যতার প্রতি বিরূপ ছিলেন। তিনি এদের স্থবির ও প্রাগৈতিহাসিক
মনে করতেন।[12]. শুধু তাই নয়, তাঁর ইতিহাস
দর্শনের (philosophy of history) চাষের ভিত্তিই
ছিল জার্মানদের ও খ্রীস্টীয় মতবাদের (Christianity) শ্রেষ্ঠত্ব। ঘটনাচক্রে “Philosophy of History” প্রবন্ধটিতে ভারত
বা ইন্ডিয়া ও হিন্দুত্ব (Hinduism) শব্দগুলোর কোনও উল্লেখই নেই।
সিদ্ধান্ত :
তথাকথিত ইতিহাস
বা হিস্ট্রি বিষয়টাই প্রকৃতিগতভাবে অত্যন্ত অ-নিরপেক্ষ। এটা
একটা জাতিবিদ্বেষী পশ্চিমী উদ্যোগ, যার দার্শনিক চিন্তাভাবনা হিন্দুধর্মের কেন্দ্রীয় নীতির একেবারে বিপ্রতীপে।
সুতরাং এই মনোভাব ও পূর্বকল্পিত ধারণা নিয়ে লেখা এই ইতিহাস ভারতীয় বিশেষত
হিন্দুদের বৈষম্যপূর্ণ ও হিন্দুবিদ্বেষী মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ ঠিক সেইভাবেই
ইতিহাস অধ্যয়ন ও রচনা করারও কথা। তাই ইতিহাসের পুনর্লিখন বা সংশোধন দুটোই আমার মতে
হাস্যকর ও অবান্তর। যেটা আমাদের দরকার তা, বিকল্প হিস্ট্রি (alternate history) নয়, হিস্ট্রির একটা
বিকল্প (an ALTERNATIVE to
history)।
একটা বিকল্প
আমাদের হাতে এখনই আছে, সেটা হল ‘ইতিহাস’। আমার মতে আমাদের
ইতিহাসের বাইরেও তাকাতে হবে। যেখানে ইতিহাস সহস্র সহস্র বছর ধরে হিন্দুদের বেঁধে
রাখার কাজটা করেছে, সেখানে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে বিষয় হিসাবে ‘ইতিহাস’ হিস্ট্রির অনেক
পূর্ববর্তী, এবং খ্রীস্টীয়
মতবাদ তথা পশ্চিমী সভ্যতা ও তার অগুনতি আদর্শ আগমণেরও বহু আগে থাকতে বিদ্যমান।
আমাদের বিশেষজ্ঞদের এখন পর্যায়ক্রমে the philosophy of history-কে প্রশ্ন করে বিকল্প ‘সিদ্ধান্ত’ তৈরি করা উচিত, যা আমাদের অতীতের
তাৎপর্য উপলব্ধি করতে এবং ভবিষ্যতের রূপরেখা তৈরি করতে সাহায্য করবে; আর একই সঙ্গে
হিস্ট্রিকে অপ্রাসঙ্গিক সাব্যস্ত করতে পারবে।
তথ্যসূত্র:
[1] Some part of the first section “History As it is” are from my book
Ashoka the Ungreat
[2] http://www.ncert.nic.in/ncerts/l/fess108.pdf
[3] Do watch this video where Rajiv Malhotra explains the nature of bias
in civil services curriculum https://www.youtube.com/watch?v=0RYS6V76lRQ
[4] It is based on the article called “Philosophy of History” in the
Internet Encyclopedia of Philosophy, which is a peer-reviewed academic resource
https://www.iep.utm.edu/history/
[5] Ibid
[6] Ibid
[7] Ibid
[8] Ibid
[9] Hegel’s philosophy of history in https://plato.stanford.edu/entries/history/
[10] https://www.iep.utm.edu/history/
[11] Watch this video to understand the idea of Doctrine of Christian
Discovery https://www.youtube.com/watch?v=MqvZxu1TaSQ
[12] Ibid
লেখক শুভদীপ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে: একজন IK, ডেটা সায়েন্স
নিয়ে পড়েছেন। গবেষণার বিষয় হল বাণিজ্য অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও
দর্শন। তাঁর প্রকাশিত বই “The Complete Hindu’s Guide to Islam” ও “Ashoka the Ungreat”।
https://intellectualkshatriya.com/history-needs-to-be-history-we-need-an-alternative-to-history/
রচিত : ১৭.০৫.২০
বিধিবদ্ধ ঘোষণা: প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব; এর জন্য 'স্বয়ংসিদ্ধা'-র পরিচালনমণ্ডলীর দায় নেই।