মাম্‌মাম্

মাম্মাম্

পুষ্পার্ঘ্য দাস

 

বিশাখ ভূমিষ্ঠ হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই গান্ধর্বী আঁচ করেছিল যে, ওর ছেলে বাকি বাচ্চাদের মত নয় বিশাখের বড় হওয়ার সাথে সাথে গান্ধর্বীর সেই ধারণা ক্রমশ বদ্ধমূল হতে থাকে ছেলের আচার ব্যবহারে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার স্বতন্ত্রতা চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে, শূন্য বেশিরভাগ সময়েই চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না হয় অন্য দিকে অথবা চোখ নামিয়ে সময়ে সময়ে

নানারকম মুখভঙ্গী করতে থাকে সবসময় কেমন একটা অস্থির অস্থির ভাব আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, তাকে কোনো কথা বললে হয়ত বদমাশি করে সেটা সে শুনছে না কিন্তু গান্ধর্বী বুঝতে পারে, ছেলে যে ইচ্ছে করে শুনছে না, তা কিন্তু নয় সত্যি সত্যিই বুঝতে পারছে না

বিশাখকে পৃথিবীতে নিয়ে আসার পথটা অত্যন্ত বন্ধুর ছিল গান্ধর্বীর জন্য গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করার পর এসবিআই পিও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল সে দূর শহরের পলাশ নামের একটি ছেলেও ওর সাথে একই সঙ্গে চাকরি পেয়েছিল ব্যাঙ্কে পাশাপাশি কাজ করতে করতে প্রথমে বন্ধুত্ব তারপর সেই বন্ধুত্ব ভালোবাসায় পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগেনি কীরকম দেখতে সেটার থেকেও পলাশের বুদ্ধিমত্তা, আচার ব্যবহার, প্রোগ্রেসিভ চিন্তাভাবনা গান্ধর্বীকে অনেক বেশি আকৃষ্ট করেছিল মেলামেশা বাড়তে লাগল দুজনের নিজের নিজের বাড়ির থেকে বহুদূরে বাধানিষেধ ছাড়া এই শহরে দুটো মন, দুটো শরীর বিপজ্জনকভাবে কাছে আসতে লাগল

উত্তেজনার বশে মাঝে মাঝেই তারা ভুলে যেতে থাকল প্রোটেকশনের কথা একদিন সেটাই হল যেটা অবশ্যম্ভাবী ছিল পিরিয়ড মিস হল গান্ধর্বীর হোম প্রেগন্যান্সি কিটে টেস্ট করাতে রেজাল্ট এল পজিটিভ একটা ভয়মিশ্রিত আনন্দ ছেয়ে ফেলল গান্ধর্বীকে যতই হোক, নিজেদের ভালোবাসার প্রথম সন্তান বলে কথা

খবরটা শুনে গুম মেরে গিয়েছিল পলাশ অনেকক্ষণ পর প্রতিক্রিয়া দিয়েছিল, “লেটস গো ফর অ্যান অ্যাবরশানগান্ধর্বী অবাক হয়ে তাকিয়েছিল পলাশের দিকে এতদিন মুখে এত বড় বড় কথা, নিজেকে মহৎ চিন্তাভাবনার অধিকারী প্রমাণ করা, পুরোটাই তাহলে একটা মুখোশ শুধুই লোকদেখানো! গান্ধর্বী কোনো কৈফিয়ত চায়নি চায়নি পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি শুধু দৃপ্ত কণ্ঠে

জানিয়েছিল, “আমার তোমাকে দরকার নেই কিন্তু আমার সন্তান পৃথিবীর আলো দেখবেই

গান্ধর্বী যখন বেরিয়ে আসে পলাশের কাছ থেকে, একবারের জন্যও আটকায়নি পলাশ কদিন পরেই ট্রান্সফার নিয়ে অন্য কোথাও চলে যায় একটা অভিনেতার জন্য চোখের জল ফেলতে মন চায়নি গান্ধর্বীর এমনকি প্রথমদিকে বাড়ির লোকজনকেও জানায়নি কারণ সে জানত, কেউ মেনে নেবে না সবাই একই কথা বলবে কিন্তু গান্ধর্বীর সিদ্ধান্ত নড়চড় হওয়ার নয় তাই সে

তার বাবা-মাকে এমন সময় জানাল, যখন অ্যাবরশানের সময় পেরিয়ে গেছে বাড়িতে তুমুল অশান্তি

গান্ধর্বীর বাবা মেয়ের এই সিদ্ধান্তকে কিছুতেই স্বাগত জানাতে পারলেন না গান্ধর্বীর মা তবুও অনেক চেষ্টা করলেন ওর বাবাকে বোঝানোর কিন্তু গান্ধর্বীর জেদ যে তার বাবার কাছ থেকেই পাওয়া তিনি বললেন, “আজ থেকে তোমার সাথে বাড়ির সব সম্পর্ক শেষ আমি ভাবব যে আমার মেয়ে মারা গেছে

চোখের জলে বাড়ি ছেড়েছিল গান্ধর্বী বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে নিজের ঘরের আসবাবপত্র, বিছানা, বালিশকে জড়িয়ে কেঁদেছিল বেশ করে গান্ধর্বীর মনে হচ্ছিল বিয়ের পর মেয়েরা যেমন বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, সেও যেন তেমনই যাচ্ছে পার্থক্য হল, সে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে না আর বাড়ি ফেরার রাস্তাও তার চিরকালের মত বন্ধ

 

এতকিছুর পরেও গান্ধর্বীর মনে কোথা থেকে যেন দৈত্যাকার এক সাহসের মেঘ এসে বাসা বেঁধেছিল তার কখনো কখনো মনে হত, সাহস তার একার নয় পেটের মধ্যে যে বাড়ছে, সেও এর অংশীদার হিসেবের দাঁড়িপাল্লায় সিঙ্গল মাদার হিসেবে ছেলের জন্ম দেওয়া, তারপর তাকে বড় করা, এই সব জায়গাতেই অসুবিধের পাল্লা প্রায় মাটি ছুঁই ছুঁই কিন্তু গান্ধর্বী যখন ছোট্ট

ভ্রুণটিকে পাল্লার অন্যদিকে বসায়, তখন পুরো হিসেবটাই পালটে যায়প্রেগন্যান্সির সময় কত ধরনের ক্রেভিংস, মুড সুইং ইত্যাদি হয় কিন্তু সেসব আবদার মেটানোর জন্য গান্ধর্বী পাশে একটাও লোককে পায়নি নিজের লড়াই সে দাঁতে দাঁত চেপে একাই লড়ে গেছে দশ মাস দীর্ঘ সময় এই কঠিন সময়ে অবশ্য তার পাশে ছিল ডক্টর মালবিকা পাত্র দিন-রাতের হিসেব নেই, যখন খুশি ফোন করে জ্বালিয়েছে মালবিকাদি হাসিমুখে ওকে সাহায্য করে গেছে হ্যাঁ, ডক্টর মালবিকা একসময় হয়ে যায় মালবিকাদি আপনি থেকে নেমে আসে তুমিতে তারপর যখন বিশাখ গান্ধর্বীর কোল আলো করে এল, তার মনে হল এতদিনের লড়াই সার্থক হল তাহলে

এই নয়নের মণিটিকে পাওয়ার জন্য বাকি সমস্ত দুঃখ-কষ্ট আবার সে সইতে পারে গান্ধর্বী ভেবেছিল, এবার বুঝি তার লড়াই শেষ হল এরপরে কেউ যদি কোনোদিন তাকে ভালোবাসে, তাহলে এই ছোট্ট বাচ্চাটিকেও ভালোবাসতে হবে কারণ সে আর বিশাখ তো আলাদা কেউ নয় দুজনে মিলেই তারা একজন অবশ্য লড়াই শেষ হওয়ার কথা শুনে বিধাতা বোধহয় মনে

মনে হেসেছিলেন গান্ধর্বী ভাবতেও পারেনি, একটা লড়াই শেষ হতে না হতে তার জন্য ওত পেতে রয়েছে আরেকটা লড়াই, যেটা এটার থেকে আরও ভয়ঙ্কর, চলবে আরও অনেক বেশি সময়ব্যাপী

বিশাখ হওয়ার পর গান্ধর্বী কাজে যোগ দিলে, একজন সারাদিনের ন্যানি রেখে দেয় সে আঙুরদি, বয়স বছর চল্লিশ হবে মালবিকাদিই খোঁজ দেয় মহিলার গ্রাম থেকে শহরে এসেছে পেটের দায়ে আঙুরদির নিজেরও দুটো ছেলেমেয়ে রয়েছে তাই বাচ্চা মানুষ করার ব্যাপারে বেশ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রথম কয়েকদিনের আড়ষ্টতা কাটিয়ে গান্ধর্বী যেমন বিশাখকে আঙুরদির

হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে অফিস চলে যেতে পারল, তেমনই বিশাখও খুব তাড়াতাড়ি ভাব করে ফেলল আঙুরদির সাথে

সবই ঠিক চলছিল বিশাখের অন্যরকম আচরণ দেখে প্রথম প্রথম গান্ধর্বী ভাবত, হয়ত শিশুর খেয়াল বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু ধীরে ধীরে বিশাখ যখন দেড় বছর পার হয়ে গেল, তখন গান্ধর্বীর মনের আকাশে উঁকি দিতে লাগল আশঙ্কার মেঘ ছেলে মুখে শুধু আওয়াজ করে, চিৎকার করে কিন্তু ওর সাথে হাজার কথা বলার চেষ্টা করা হলেও ছেলে কোনো কথা বলে নামাডাক শোনার জন্য ভেতরে ভেতরে তড়পায় গান্ধর্বী আঙুরদিও মাঝে মাঝেই তার কানে তুলত এটা-সেটা

সিঁদুরে মেঘ দেখলেও গান্ধর্বী নিজের মনকে বোঝাত, কিচ্ছু হয়নি, সব ঠিক আছে, বিশাখ একদম স্বাভাবিক আসলে সে নিজেই বোধহয় প্রস্তুত ছিল না বিশাখের কন্ডিশনকে অ্যাকসেপ্ট করার জন্য তাই মনকে নানারকমভাবে প্রবোধ দিত কিন্তু একদিন বিকেলের ঘটনা তার মিথ্যেঅল ইজ ওয়েলএর কাচের দেওয়ালটা ভেঙে চুরমার করে দিল

পুজোর ঠিক আগেটায় দিনটা ছিল মাসের দ্বিতীয় শনিবার ব্যাঙ্ক ছুটি থাকে সেদিন মাসের ওই দুটো দিন গান্ধর্বী নিজে বিশাখকে স্কুলে দিয়ে আসে, নিয়ে আসে স্কুল থেকে ওর ফ্ল্যাট পর্যন্ত একটা বাসেই চলে আসা যায় কোথাও নামতে হয় না ব্যাঙ্কের সবাই মিলে ঠিক করেছিল, সোমবার এথনিক ড্রেস পরে যাবে মাঝরাস্তায় একটা টেলারিং দোকানে গান্ধর্বীর একটা শাড়ি দেওয়া ছিল ফলস্ পাড় লাগানোর জন্য সে ভাবল, এখনই যদি নিয়ে নেওয়া যায় শাড়িটা, তাহলে আর ঝামেলা থাকে না তাই বিশাখকে নিয়ে দোকানের সামনে নেমে গিয়েছিল বাস থেকে আর এটাই ছিল তার সবচেয়ে বড় ভুল

 

বিশাখ বাস থেকে নেমে ওর অ্যাপার্টমেন্ট দেখতে পেল না দেখতে পেল একটা দোকানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ওর মা প্রথমে হাঁচোড়পাঁচোড় করে কোল থেকে নামার চেষ্টা করল যখন দেখল গান্ধর্বী জাপটে ধরে আছে ওকে, তখন শুরু করল চিল-চিৎকার আকস্মিক এই চিৎকারে চমকে উঠল গান্ধর্বী থমকে গেছে আশেপাশের পথচলতি মানুষ সবাই হাঁ করে দেখছে গান্ধর্বীর দিকে গান্ধর্বী থামানোর চেষ্টা করছে বিশাখকে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে, “কী হয়েছে বাবু? চিৎকার করছ কেন?খিদে পেয়েছে?এইতো আমরা বাড়ি চলে যাব এই একটা জিনিস নিয়েই সোজা বাড়ি লক্ষ্মীটি চিৎকার করে না সবাই খারাপ ভাববে তো!”

এতসব কথার একটাও বিশাখের কানে ঢুকেছে বলে মনে হল না সে চিৎকার করে কাঁদতে থাকল সাথে যোগ হল হাত-পা ছোঁড়া গান্ধর্বী বুঝল, আর থাকা যাবে না এখানে শিগগির বাড়ি ফিরতে হবে এছাড়া বিশাখকে চুপ করানোর আর কোনো উপায় দেখতে পাচ্ছে না সে ভাগ্য ভালো ছিল, তাই সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে গেল আরেকটা বাস বাসে উঠতেই ছেলের কান্না থেমে গেল

বাড়িতে এসে বিশাখকে খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়াল তারপর আঙুরদিকে খুলে বলল রাস্তায় আজ যা যা ঘটেছে বলতে বলতে কান্না চেপে রাখতে পারল না গান্ধর্বী কাঁদতে কাঁদতে ঘুরেফিরে একটাই কথা বলতে লাগল, “শুধু আমার সাথেই কেন বারবার এরকম হবে বলতে পারো দিদি?”

তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে আঙুরদি বলল, “কিচ্ছু চিন্তা কোরো না দিদিমণি ওপরে একজন আছেন সবদিকে তাঁর নজর দেখো, তিনি সব ঠিক করে দেবেন তুমি শুধু ছোটকে ভালো ডাক্তার দেখাও

গান্ধর্বীও বুঝতে পারল, আর পালাবার পথ নেই চোখ বন্ধ করে নিলেই সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যাবেনা মালবিকাদির কাছে খোঁজ নিল কাছাকাছি ভালো চাইল্ড বিহেভিওরাল সাইকোলজিস্ট কে আছেন পরের রবিবারের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে বিশাখকে সঙ্গে করে গান্ধর্বী উপস্থিত হল ডক্টর রিদ্ধিমা চ্যাটার্জীর চেম্বারে প্রায় একঘন্টা নানা ধরনের সাইকোলজিক্যাল টেস্টের পর ডক্টর সেটাই কনফার্ম করলেন যেটা শোনার জন্য গান্ধর্বী মনে মনে মোটামুটি তৈরিই ছিল, “অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার একটা জিনিস খুবই ভালো হয়েছে যে খুব তাড়াতাড়ি আপনি ওকে আমার কাছে নিয়ে এসেছেন বিশাখ এখনও খুবই ছোট তাই ওর পক্ষে শেখাটা একটু সহজ হবে ভাবছি অ্যাপ্লায়েড বিহেভিয়ার অ্যানালাইসিস থেরাপি শুরু করব যেখানে আমরা রিয়েল লাইফ

সিচুয়েশনে চেষ্টা করব হেল্পফুল বিহেভিয়ারগুলো বাড়ানোর এবং হার্মফুল বিহেভিয়ারগুলো কমানোর প্রত্যেকটা মানুষই ইউনিক তাই আমরা আগে বিশাখকে ভালোভাবে বুঝে তারপরেই থেরাপির রুটিন ফাইনালাইজ করব সময়ের সাথে সাথে সেগুলো প্রয়োজনমত চেঞ্জও হতে থাকবে অটিজমের ক্ষেত্রে এবিএ খুব কার্যকরী কিন্তু শুধু আমরা থেরাপি করালেই তো হবে না আপনাকেও বাড়িতে চেষ্টা করতে হবে যেভাবে সহজে বুঝতে পারে, সেভাবে ইন্টার‍্যাক্ট্‌ করতে হবে ওর সাথে আপনাকে দেখতে হবে কোন পরিস্থিতিগুলো ওর মধ্যে ট্রিগার করছে ফ্রাস্ট্রেশন, রেস্টলেসনেস ট্রিগার পয়েন্টগুলো খুঁজে বের করতে পারলে আমাদের চিকিৎসায় বেশ সুবিধেই হবে এখন কিন্তু সামনে ঝড়ঝাপটা মাথায় নিয়ে পাড়ি দিতে হবে অনেক লম্বা পথ তবে চিন্তা করবেন না, আমরা সবাই মিলে হাল ধরলে নৌকো ঠিক একসময় সমুদ্র পেরিয়ে যাবে

গান্ধর্বী যেন প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে নাম্ব্ হয়ে বসে আছে সে চুপ করে তাকিয়ে আছে বিশাখের দিকে কিছুক্ষণ পর একটু ধাতস্থ হয়ে বিশাখের কানে কানে অস্ফুটে বলল, “কীরে? শুনলি তো ডক্টর কী বললেন! আমি তো তোকে সবরকমভাবে সাহায্য করব তুইও আমায় হেল্প করবি তো?”

ওইটুকু বিশাখ কী বুঝল কে জানে! মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ করল - ‘হুম

সজল নয়নে জড়িয়ে ধরল গান্ধর্বী তার একমাত্র অবলম্বনকে

 

এরপরেই শুরু হল কঠিন লড়াই দিনে চার ঘন্টা করে সপ্তাহে সাতদিনই থেরাপি সাথে সাথে রিদ্ধিমা গান্ধর্বী এবং আঙুরদিকে শিখিয়ে দিয়েছেন বিশাখের সাথে কীভাবে বাড়িতে ইন্টার‍্যাকশন করতে হবে কোন কোন দিকে খেয়াল রাখতে হবে ডক্টরের কথামত গান্ধর্বী ডায়েরিতে লিখে রাখতে শুরু করল কোন অস্বাভাবিক আচরণটা দিনের ঠিক কোন সময়ে দেখা দিচ্ছে কোথায় দেখা দিচ্ছে এবং তার ঠিক আগে কী ঘটেছিল সেগুলো ডক্টরের কাছে জমা দিলে ডক্টরও সেগুলোকে অ্যানালাইজ করে নতুন নতুন পন্থা বাতলে দিচ্ছেন

অনেক রাতে বিশাখ যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায় গান্ধর্বীর ছেলেকে কোলের কাছে টেনে এনে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে কিচ্ছু তো চায়নি সে যা অবিচার হয়েছে সব মুখ বুজে মেনে নিয়েছে শুধু একটা সাধারণ জীবন চেয়েছিল সেটাও তাকে দিল না ঈশ্বর তবু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে, কিছুতেই হাল ছাড়বে না বিশাখকে যতভাবে পারা যায়, যতটা পারা যায়, সুস্থ করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে কখনো শীতকালে ঠান্ডা হাওয়াকে ভয় পেল বিশাখ, বাড়ি থেকে বেরোতেই চাইল না কখনো বা কুকুরদের রাস্তায় দেখলেই উল্টোপথে যেতে বাধ্য করল তবুও এইভাবে ডক্টরের কাছে এবং বাড়িতে বছর দুয়েক থেরাপির পর বিশাখের চোখের কিছুটা ঘোলাটে মেঘ যেন আস্তে আস্তে সরে সেখান দিয়ে এক-আধটা রোদের কিরণ উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল

গান্ধর্বী বিশাখের জন্য গল্পের বই, আঁকার খাতা, নানারকম ইনডোর গেমস, কিছুরই অভাব রাখেনি একদিন সকালে গান্ধর্বী ঘুম থেকে উঠে তার পাশে বিশাখকে দেখতে পেল না বিছানা থেকে ছিটকে উঠে পড়েবিশাখ’, ‘বিশাখবলে চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে এল ড্রয়িংরুমে দেখল, যে বিশাখ আজ পর্যন্ত আঁকার খাতা কোনোদিন ছুঁয়েও দেখেনি, সে আজ সকাল সকাল উঠে মেঝেতে বসে মগ্ন হয়ে খাতায় তার জীবনের প্রথম ছবিটা আঁকছে গান্ধর্বী চুপিসাড়ে ছেলের পেছনে এসে দাঁড়াল

অপটু হাতে বিশাখ এঁকেছে মা আর ছেলের ছবি ছেলের হাতটা মায়ের মুঠোয় ধরা দুজনে চলেছে কোনো এক অজানার উদ্দেশে গান্ধর্বী হাঁটু গেড়ে ছেলের পেছনে বসে কানের কাছে আলতো করে ডাক দিল, “বিশাখ

যে ছেলে একটু আগেই তার নাম ধরে মায়ের চিৎকারটা শুনতে পায়নি, সে এই আস্তে ডাকটা ঠিক শুনে নিল মাথা ঘুরিয়ে গান্ধর্বীর দিকে তাকিয়ে হাসল একগাল আর তারপরেই হাসিমুখে খাতায় আঁকা মায়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “মাম্মাম…” 

Post a Comment

Previous Post Next Post