ছোটগল্প
ইচ্ছে ডানা
"বিহুর এ লগন....
মধুর....এ.....
আকাশে....বাতাসে....
..... চম্পা ফুটিছে...."
রাত্রির গভীর বৃন্ত চিড়ে ভোরের সোনামুগ রোদ্দুরটা সবে চৌধুরীবাড়ির দিলদরিয়া
উঠোনে হামাগুঁড়ি দিতে শুরু করেছে। বসন্তের সবে শুরু। আকাশে বাতাসে প্রকৃতির আনাচে
কানাচে ঋতুরাজ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। গাছে গাছে ফুল, ফলের আদর...। কোকিলের অর্কেষ্ট্রা
পরিবেশকে করে তুলেছে স্বর্গীয়। পরিযায়ী পাখিদের রোদ্দুরে ভেজা গানের জলসাতে দু
চারটে দেশীয় পাখির সহাবস্থান...। থাম বসানো চওড়া বারান্দার এদিকে ওদিকে সাদা-কালো
পায়রার ডানা ঝাপটানো, কৃষ্ণচূড়া গাছের শাখা প্রশাখায় কাঠবিড়ালির ছটফাটানি আগাম
খুশীর যেন পূর্বাভাস দিচ্ছে। প্রকতি যেন সত্যিই আনন্দে চনমন করে উঠছে।
চৌধুরীগিন্নী বিড়ালের মতন পা ফেলে ফেলে জানালা দিয়ে মেজবৌমার ঘরের ভিতর
উঁকি মারলেন। ঘরের দরজা ভেজানো। ভিতর থেকে গান ভেসে আসছে। উনি দেখেই চমকে উঠলেন।
ঘরে ঢুকে একটু মৃদু হাসির সলতে পাকিয়ে আনন্দ উৎফুল্ল হয়ে...
"মেজ বৌমা, তুমি এত ভাল নাচ কর আগে বলোনি তো ?" শ্বাশুরি গদগদ
হয়ে বললেন।
"মা, একটা সময় অনেক নাচ করেছি। প্রাইজও পেয়েছি। স্কুলে, কলেজে যখন
পড়তাম তখন বহু অনুষ্ঠান করেছি। সে সবের ছবিও আছে। মাঝে মাঝে অন্য বন্ধুদের স্কুলের
অনুষ্ঠানেও পারফর্ম করার জন্য আমার ডাক পড়ত। আর সেই আবদার মেটাতে আমাকে নাচ করতে
হত। এখন সংসারে ঢুকে আর সেইভাবে সব কিছু পেরে ওঠা সম্ভব নয়।" ঝরণার মুখে
বিনম্র হাসি।
"সবই বুঝলাম। আমারও একটা কথা রাখতে হবে। সামনেই রবীন্দ্র জয়ন্তী, বড়
করে পালন করার ইচ্ছে আছে। তোমাকে নাচতেই হবে। চৌধুরীবাড়ির মেজবৌ, তোমাকে পারতেই
হবে। আমি কোন অজুহাত শুনতে চাই না।"
"মা, কি যে বলেন। এখন আমার কি সেই বয়স আছে। লোকে শুনলে বা দেখলে কি বলবে
বলুন তো? ছেলে মেয়েরাও বড় হচ্ছে। তাছাড়া আপনার ছেলে যদি জানতে পারে তাহলে আর
.....", ঝরণা কথা শেষ না করেই ফিক করে হেসে ওঠে।
দুপুরে দুজনে একসাথে খেতে বসে আবারও নিজেদের মধ্যে এই নিয়ে একপ্রস্থ আলোচনা
হয়। সাথে শলা পরামর্শ...। শ্বাশুরীমা ভাল করে আরও একবার বিষয়টা বুঝিয়ে দেন।
"আমি আবারও বলছি কান খাড়া করে শুনে রাখো, ও সব কোন অজুহাত শুনতে রাজী
নয়। নাচতে তোমাকে হবেই। তা না হলে এই বাড়ি থেকে বের করে দেব।" শ্বাশুরি
বাঁহাত দিয়ে ঝরণার অযত্নে লালিত গালটা টিপে দেয়।
"বেশ, আপনি যখন এত করে বলছেন তখন না হয় একবার চেষ্টা করেই দেখি। লোকে
দেখে বড় জোর একটু হাসাহাসি করবে। আপনি উৎসাহ দিলে আর ভয়টা কিসের..."
"হমমম...! এই না হলে চৌধুরীবাড়ির মেজবৌ।"
"তবে আমারও একটা শর্ত আছে।"
"বলো, কি তোমার শর্ত?"
"সব কিছুই হবে গোপনে। মানে নাচের জন্য যা কিছু অনুশীলন, টিপস্ নেওয়া
সবই হবে চার দেওয়ালের মধ্যে। কাকপক্ষীও টের পাবে না।"
"বেশ তাই হবে। তোমার সব শর্ত মেনে নিলাম। তবে নাচটা কিন্তু অসাধারণ
হওয়া চাইই চাই।"
"আপনি ওটা নিয়ে কোন চিন্তা করবেন না। আমি নিজের সেরাটা উজার করে দেব।
একটা কথা মনে রাখবেন, এই বাড়িটা আমার শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুরবাড়ির কোন অবমাননা হোক
সেটা আমি মনে প্রাণে চাই না। চৌধুরীবাড়ির সন্মান ধুলোয় মিশতে দেব না।"
"আমি সেটা তো জানি। তোমার উপর সেই জোরটা আমার আছে। তাই তো এত ভরসা
করতে পারি।"
সব শুনে ঝরণার সারা শরীরে আপাতত একটা শিহরণ খেলে গেল। শ্বাশুরি মায়ের মুখের
দিকে চেয়ে কি যেন ভেবে আবার নিজের কাজে মন দিল। কানের মধ্যে তখন থেকেই নিজের
অজান্তে যেন ঘুঙুরের শব্দ বাজতে শুরু করেছে। শ্বাশুরিমাও একটা সময় ভাল নাচ করতেন।
লক্ষ্য ছিল বড় ডান্সার হবার। তারজন্য চেষ্টাও কম করেন নি। দু একবার স্টেজে
পারফর্মও করেছেন। ইচ্ছে পূরণের "ইচ্ছে ডানা"টা বারবার নাড়া চাড়া দিয়ে
উঠত। নিজের মধ্যে পুষে রাখা খিদেটা ঝরণার মধ্যে আজ আবার নতুন করে দেখতে পেলেন। তাই
শরীরের পেশীগুলো নতুন করে কিছু একটা পাবার আশায় আরবী ঘোড়ার মত যেন ছটফট করছে।
পঞ্চাশ পেরোনো শরীর থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে একস্ট্রা অ্যাড্রিনালিন।
হিমোগ্লোবিনের তেজ অতি প্রবল আর দামাল।
বহু বছর আগে এই চৌধুরীবাড়িতে বৌমা হিসেবে পা রাখার পর পরই মাধবীতলাদেবীকে
সব কিছু ছেড়ে দিতে হয়েছিল। কবিতা লেখা, গান, নাচ সব কিছু। মনের মধ্যে শিকড় বাঁধা
ইচ্ছে ডানাটা সেদিন গুটিয়ে নিতে হয়েছিল। ওটা নীল আকাশে ডানা মেলতে চাইলেও উপায় ছিল
না। কবিতার খাতা, গানের ডায়েরি, নাচের সরঞ্জাম সব কিছু পুরোনো ভারী মরচে পড়া
ট্রাঙ্কে বন্দি করে রাখতে হয়েছিল। সারা জীবনের জন্য। সেই যে তারা ট্রাঙ্কের ভিতর
শয্যা নিল আর বাইরে বেরোনোর সাহস পেল না। চৌধুরীমশাইয়ের রক্তচক্ষূর কাছে সব সেদিন
চাপা পড়ে গিয়েছিল। বহুদিনের বন্দিদশা কাটিয়ে সেইগুলো আবার আজ পৃথিবীর আলো দেখতে
শুরু করেছে। মুক্তিলাভের আশায় যেন ছটফট করছে।
ঝরণা এখন ঘুম থেকে উঠে প্রায় রোজই দেখে শ্বাশুরি মা নাচের অনুশীলন করেন। আর
ওকেও শেখায়। শ্বাশুরি-বৌমার নাচের যুগল বন্দী বেশ চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে পাড়াতে। এই
নিয়ে পাড়া প্রতিবেশীরা টিপ্পনী কাটতেও ছাড়ে না। মাঝে মাঝে লোকচক্ষুর আড়ালে
হাসাহাসি করেন। সময় সুযোগ পেলে দু চার কথা শোনাতেও কৃপণতা করেন না। শ্বাশুরি
মাধবীলতাদেবীও দাঁতে দাঁত চেপে তার আর বৌমার নতুন লড়াইকে স্বাগত জানান।
এই সুযোগে ঝরণাও শ্বাশুরির কাছে অনেক কিছু শিখে নেয়। নাচের প্রতিটা স্টেপ,
ছন্দ ঠিকমত হচ্ছে কি না দেখে নিতে থাকে। শ্বাশুরিমাও নিজেকে উজার করে বৌমাকে
শেখাতে শুরু করেন। কোন রকম ত্রুটি বিচ্যুতি হলে অমনি শুরু হয় শ্বাশুরিমার তথাকথিত
হিটলারী মেজাজে পুষ্ট ঝাঁঝানি।
"আমি এতবার করে বলার পরেও তুমি সেই পুরোনো ভুলটা করলে।"
"মা, আসলে বহুদিন অনভ্যাসের ফলে একটু আধটু ভুলটা থেকে যাচ্ছে।"
"আবার বলে ভুলটা থেকে যাচ্ছে...।মুখে মুখে তর্ক করা তোমার একটা স্বভাব
হয়ে দাঁড়িয়েছে দেখছি। যদি শেখার সত্যি ইচ্ছে থাকে তাহলে শেখো, না হলে এক্ষুণি
বিদায় নাও। আমার সময়ের দাম আছে।"
"মা সত্যিই বলছি...। এই কান ধরলাম...।আর কখনো ভুল হবে না।"
"বেশ তাই যেন সারা জীবন হয়। আর এই ছেলেমানুষী ভাবটাও কমাও। তা না
হলে..."
কথা শেষ না হবার আগেই ঝরণা দেখে শ্বাশুরি মা কটমট করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
ঠিক যেন "লেডি হিটলার"। আর নতুন কোন ইনস্ট্রাকশান দেবার আগেই কি যেন
ভাবছেন। মাঝে মাঝেই ইচ্ছেডানাটা আবার নতুন করে দূর অতীতের আকাশে ঝটপট করছে। আগের মতই।
সময় থেমে থাকে না। হঠাৎই নিন্মচাপের মতনই তার ছন্দপতন। কালের নিয়মে সময়ের
পানসি একটু একটু করে তরতরিয়ে এগিয়ে চলে উজানের দিকে। মাঝে মাঝে সময়কেও হার মানতে
হয়। দিতে হয় চরম পরীক্ষা, নিষ্ঠুরতার পরিচয়। জীবনের চরম বাস্তবতার কাছে। মারণ রোগ
যে এইভাবে সবকিছুকে এক বিরাট প্রশ্নচিহ্নের মধ্যে ফেলে দেবে কে জানত?
ক্যালেণ্ডারের সাদা-নীল-লাল চৌকো চৌকো খোপগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সকলকে চোখের জলে
আষ্টে পিষ্টে বন্দি করে ঝরণা কিছুদিনের মধ্যেই ক্যানসারে বলি হয়ে চলে যায়
ঠিকানাহীন দেশে। ও মারা যাবার পরে বাড়িটা হঠাৎই কেমন থমকে যায়। বদলে যায় চিরাচরিত
সব সমীকরণ।
ঝরণা মারা গেলেও চৌধুরীবাড়িতে নাচ বন্ধ হয়নি। শ্বাশুরিমা মাধবীলতাদেবী
প্রতিদিন নিয়ম করেই নৃত্য অনুশীলন করেন। বুড়ির এই কাণ্ড কারখানা দেখে সকলেই হেসে
ওঠে। কেউ কেউ ভাবেন বুড়ির এটা লোক দেখানো নিছক পাগলামি। বুড়িও মনে মনে এই টিটকিরি
হাসির জবাব দেবার জন্যে তৈরী থাকেন।
তিন তিনটে বছর কোন রকমে কাটল। সময়ের স্রোতের সাথে তাল মিলিয়ে জীবন ভীষণই
গতিশীল ...
ক্যালেণ্ডারের লাল, নীল, সাদা, চৌকো খোপগুলো একে অপরকে ডিঙিয়ে কালের নিয়মে
শরৎকাল এসে পড়েছে। নীল মেঘের খামে বলাকার খোলা চিঠি, ঢাকের মিষ্টি
মল্লারে সোনামুগ রোদ্দুরে শিউলির আল্পনা, সবুজের মখমলে কাশের জলসাতে সাদা বলাকার
নিমন্ত্রণ, পদ্মফোটা দীঘিতে শাপলা শালুকের খুনসুটি, শিশির ভেজা মেঠো পথে ঘাসে
গ্রাম্যবধূর আলতা পায়ের চন্দন, বাউল মাঝির ভাটিয়ালি গান মনে করাচ্ছে চারিদিকে বেশ একটা পুজো পুজো গন্ধ। মা
উমা আসছেন সকলের ঘরে ঘরে। সকলকে উজার করে আশীর্বাদ আর সুখ সম্পদের ডালি সাজিয়ে
ভরিয়ে দিতে।
রাস্তা ঘাটে পথ চলতি মানুষের ভিড়। ছোট বড় দোকান শপিং মলগুলোতে ভিড় উপচে
পড়ছে। শ্বাশুরিমাও এই সময় কম দৌড়ঝাঁপ করেন নি। শিকারী নেকড়ের মতন ওৎ পেতে ছিলেন।
সুযোগটাও সময় মত এসে গেল। আর সুযোগ আসতেই সেটা ঠিকভাবে কাজেও লাগালেন। বহুদিনের
জমানো খিদেটা মিটিয়েই ছাড়লেন। পুজো উপলক্ষ্যে এক রিয়ালিটি শোতে নেচে প্রথম
পুরষ্কার পান। সেই সাথে মেডেল, সার্টিফিকেট আর প্রাইজ মানি।
ভিতরে পুষে রাখা ইচ্ছেটা যে এইভাবে একদিন লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে শ্বাশুরি
স্বপ্নেও ভাবেননি। আর এই সব কিছু সম্ভব হয়েছে তার আদরের মেজবৌমার জন্য। অবশেষে
মাধবীলতাদেবী তপস্যার ফল পেলেন। আর সমস্ত হাসি উপহাসের জবাবও দিলেন। যাঁরা উনাকে
নিয়ে বিদ্রূপ করেছিলেন তাদেরকে নিজের ক্যারিশ্মা দেখিয়ে তাদের গালে সপাটে একটা চড়ও
কষালেন।
নাচের সমস্ত অনুষ্ঠানটা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখিয়েছে। আর দেখান মাত্রই
দাবানলের মত মাধবীলতাদেবীর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। মিডিয়ার একটার পর একটা
ফ্ল্যাশবাল্ব ঝলসে উঠেছে চোখের সামনে। সারাদিনে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে যে কতবার
ছবির জন্য পোজ দিলেন তার হিসেব নেই। তাঁর বন্ধুরা মুখবইতে একটার পর একটা ছবি পোস্ট
করছেন। আর লাইক কমেন্টের বন্যায় ভরিয়ে দিচ্ছেন। মাধবীলতাদেবীর হোয়াটস্ আপ, স্টেটাস
উপচে উঠছে অসংখ্য ম্যাসেজ আর ছবির কৃপায়। উনি নিজেও এমনটা আশা করেন নি। সব দেখে
সাদা-পাকা চুল আর কুঞ্চিত চামড়ার মাধবীলতাদেবী বেশ অবাকই হয়েছেন। আবেগের পানসি তর তর
করে যেন ছুটে চলেছে উজান স্রোতে। আরও বড় কিছু পাবার আশায়। ভিতরের খিদেটা আজকের
ঘটনার পর যেন আরও বেশি করে চাগিয়ে উঠছে।
বিকেলের একটু পরেই মাধবীলতাদেবী লোহার ভারী জং ধরা গেটটা জমিদারি কায়দায়
ঠেলে চৌধুরীবাড়ির নিকোনো উঠোনে পা রাখলেন। চোখের কোণে তখনও পুরু হয়ে সুর্মার মতন
লেপ্টে আছে আশ্বিনের নোনা শিশির। পুরোনো দিনের ঘটনাগুলো মনে পড়ছে। এক জায়গায় স্থির
হয়ে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবতে লাগলেন। এই গেট দিয়েই একদিন এই বাড়িতে বৌমা হয়ে প্রবেশ
করেছিলেন। এই উঠোনেই প্রথম আলতা পায়ের ছাপ...যার স্মৃতি এখনও টাটকা। তখন কতই বা
বয়স...! মনে আছে শ্বশুরমশাইয়ের সেদিনের বলা কথাগুলো...
"এস বৌমা, এস। আজ থেকে এই বাড়ি তোমার। তুমি এই বাড়ির বড় বৌমা। তোমাকে
সব দায়িত্ব মাথা পেতে নিতে হবে।"
শ্বাশুরীমা তুলতুলে নরম গালটা টিপে দিয়ে...
"এই বাড়ির সকলকে নিজের বলে ভাববে। কোন কাজে লজ্জা পাবে না। কোন রকম
অসুবিধা হলে আমাকে বলবে।"
"তুমি চাবির গোছাটা এখনই বৌমার হাতে দাও।"
"ওটা দিতেই তো এসেছি।"
পাড়া প্রতিবেশীদের অনেকেই কেউ ছাদ থেকে, কেউ বা সদর দরজায় দাঁড়িয়ে, কেউ
কেউ জানালা থেকে উনাকে দেখে শ্রদ্ধা ভালবাসা জ্ঞাপন করছেন। তারা সকলে ভাবতেই পারেন
নি উনি এত বড় একটা সাফল্যের বৈতরণী পার করে দেবেন। এবং তা নিজের অসীম জেদ আর
পরিশ্রমের বলে। সবটাই মা দশভূজার আশীর্বাদ। উনি সত্যিই একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করে
গেলেন সকলের মাঝে। সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একটা জোরাল বার্তা দিলেন।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হতে চলল। সারাদিন অনেক ছোটাছুটি করতে হয়েছে। প্রচুর
পরিশ্রমও গেছে। শরীর আর নিতে পারছে না। শ্বাশুরিমা ক্লান্ত শরীরে পুরষ্কারগুলো
নিয়ে ঝরণার ঘরে ঢুকে ওর ফটোর সামনে ভেজা চোখে দাঁড়িয়ে পড়েন। আবেগে গলা বুজে আসছে।
পুরষ্কারের মেডেলটা ছলছল চোখে ঝরণার ফটোতে পরিয়ে দেন। আর প্রদীপ, ধূপকাঠিটাও
জ্বেলে দেন। সাথে সাথেই ফটোর পিছনে থেকে একটা টিকটিকি টক্ টক্ টক্ শব্দে ডেকে ওঠে।
শ্বাশুরিমা দু চোখের নোনা শিশিরে মুচকি হাসি হেসে মনে মনে বললেন, "ঝরণা
এইভাবেই যেন আমাদের পাশে থেকে সাড়া দেয়।"
বাইরে মাইকে বাজছে...
দুর্গে দুর্গে দুর্গতিনাশিনী... মহিষাসুরমর্দিনী জয় মা দুর্গে..."
ফটোফ্রেম থেকে ঝরণা হাসছে। আর ওদিকে মাধবীলতাদেবীর দু চোখের নোনাধারা অঝোর
ধারায় ঝরছে। যেন মনে হচ্ছে ডিভিসির ব্যারেজ থেকে জল ছেড়েছে। উনি শঙ্খটা মুছে তাতে
ফুঁ দিলেন।
ছবির ভিতর থেকে ভেসে আসছে নাচের গান। গান, হাসির টুকরো টুকরো অণু পরমাণু
শঙ্খধ্বনি, ধূপের গন্ধে মাতাল হয়ে নোনা জোয়ারে মিশে ঠিকরে পড়ছে চৌধুরীবাড়ির দরাজ
উঠোনে, দুর্গা দালানে, উচু নীচু থামের গায়ে, শ্বেত পাথরের মেঝেতে, কোটরে লুকিয়ে
থাকা ঝাঁক ঝাঁক নোটন পায়রার মোলায়েম পালকে। কখনো বা তা জমিদাড়ি বাড়ি ছাড়িয়ে
আমবাগান, বাঁশঝাড়, গঙ্গার পাড়ে...সবুজের মখমলে...আঁকা বাঁকা রেললাইনের নিশ্চুপ
জ্যামিতিতে আদর মাখছে।
"....বিহুর...
চম্পা....চামেলি ...."