গ্রন্থ সমালোচনা

 

গ্রন্থ সমালোচনা

 বালুকাবেলায় ।। বিদ্যাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশক: পত্রাবলী, মূল্য: ১২০.০০ টাকা, পেপারব্যাক

বিদ্যাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় লেখা শুরু করেছেন বছর আড়াই, করোনা লকডাউনের পর থেকে। তবে অবসরপ্রাপ্ত মানুষটি চাকরিসূত্রে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে কাটানোর সুবাদে একাধিক ভাষা রপ্ত করেছেন। সেটা তাঁর লেখাতে প্রতিফলিত। এ যাবৎ তাঁর দুটি বই গ্রন্থিত হয়েছে – ‘মেঘপরি’ ও ‘বালুকাবেলায়’। ‘বালুকাবেলায়’ তাঁর দ্বিতীয় সংকলন – একই মলাটে ৭টি গল্প ও ৫০টি পদ্য। এমন মিশ্র শাখার রচনা সম্ভার পত্রিকায় থাকে, অমনিবাস, রচনাবলী, রচনা সমগ্র – এই জাতীয় গ্রন্থেও থাকতে পারে, কিন্তু সচরাচর বইয়ে দেখা যায় না। হয়তো নতুন লিখছেন বলেই এমন অভিনব উপহার।

পদ্য বিভাগে দেখে কবিতা ও ছন্দ নিয়ে পরীক্ষা করতে ভালোবাসেন বোঝা যায়। তার একটি আগ্রহোদ্দীপক উদাহরণ "আন্দামান"। তবে পদ্যের সম্ভার মিশ্র শৈলী ও মিশ্র মানের। কয়েকটা বেশ সুখপাঠ্য, বিষয়েও নতুনত্ব আছে। কোনও কোনওটায় মৃদু সাটায়ার আছে, যেমন "খেলা শেষে", কোথাও আবার নির্মল word pun। সংকলনে কবিতার চেয়ে ছড়াই বেশি। তবে পদ্যগুলির কোনও কোনওটায় অন্তমিল বজায় রাখতে গিয়ে ছন্দ সরে গেছে, বক্তব্যও সেভাবে দানা বাঁধতে পারেনি। তাছাড়া গুরুচণ্ডালী, অনাধুনিক শব্দচয়ন প্রায়ই লক্ষ্য করা গেছে। ‘মোর’, ‘মোরা’, ‘হেন’, ‘হেথা’ ইত্যাদি শব্দগুলো দিয়ে একদা মহান সৃষ্টি হলেও এখন আর চলে না, যদি না ইচ্ছাকৃত পুরাতনী গন্ধ ফোটাতে হয়। বিদ্যাশিসবাবু যথেষ্ট অভিজ্ঞ, সাহিত্যের তন্নিষ্ঠ পাঠক; এইটুকু সাবধানতায় অনেক ভালো লেখা তাঁর কাছে আশা করা যায়। ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে ওনার ছড়া ও কবিতা বেশ জনপ্রিয়। আত্মীয় পরিচিতরা কণ্ঠ দিচ্ছেন, ভিডিও করছেন। তাই পদ্য নিয়ে বিশদে যাচ্ছি না। চলে আসি ছোটগল্প প্রসঙ্গে।

‘বালুকাবেলায়’ সাতটি ছোটগল্প আছে। সাতটি সাতরকম পটভূমিতে লেখা। যেমন :

‘বালুকাবেলায়’ গল্পটিতে সাদামাটার মধ্যে রয়েছে একটু ভৌতিক ছোঁয়া আছে।

‘সেই সব দিনগুলি’ পড়লেই বোঝা যায় গল্পটি তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার ফসল, যেটা পাটনা শহর, চরিত্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক ইত্যাদির অন্তরঙ্গ বর্ণনায় প্রতিফলিত। কেন্দ্রীয় চরিত্রের ভাড়াঘরে প্রথম রুমমেট ও বাড়িওয়ালার চরিত্র গল্পের জন্য যতটা প্রয়োজন, তার চেয়ে একটু বেশি পরিসর পেয়েছে সম্ভবত চরিত্রগুলো সত্য বলেই। ঘটনাবলীর বর্ণনা গল্পের মোড় নেয় তার দ্বিতীয় রুমমেটের আগমনে এবং পরিশেষে একটা নিটোল গল্প পাওয়া যায়।

তৃতীয় গল্প ‘গান গেয়ে যাই’ একটি বার গায়িকার সঙ্গে তার পূর্ব পরিচিতের কথাপকথন। তাদের সম্পর্ক কী সেটা এখানে ভাঙলাম না। খুব ইন্টারেস্টিং দৃশ্য। সংলাপগুলোও গতিশীল যদিও গল্প বলতে সে অর্থে কিছু নেই।

‘উত্তরের অধিকার’ গল্পে দুটো প্লট। একটিতে দেখা যায়, অবস্থার ফেরে এক স্বামী পরিত্যক্তা নারী ও স্ত্রী ত্যাগ করা এক খঞ্জ পুরুষ জুটি বেঁধে স্টেশনে গান গেয়ে ভিক্ষা করে। পুরুষটির মৃত্যুতে তার ঝুলিতে থাকা ব্যাঙের আধুলিসম সম্পত্তির উত্তরাধিকার কার-- সম্পর্কচ্যুত স্ত্রী না সর্বক্ষণের সঙ্গিনীর, বা কার কতটুকু – এই উত্তর খুঁজতে গিয়ে নানা টানাপোড়েনে এগিয়েছে গল্পটি। অন্যটি দাঁত উঁচু এক গরীব শ্যামলা মেয়ের বড় বাড়ির ছেলের সঙ্গে প্রেম ও পরিণয়ের একেবারে সাদামাটা কাহিনী। চরিত্র চিত্রায়ন মনোগ্রাহী, বাস্তবোচিত। উত্তর ও ‘উত্তরের অধিকার’ ব্যাপারটা একাধিক পরিপ্রেক্ষিতে সার্থকভাবে ব্যবহৃত। তবে প্রথম স্টোরিলাইনটাই যথেষ্ট ছিল, দ্বিতীয়টির দরকার ছিল না, কারণ একাধিক স্টোরিলাইন থাকলে তাদের মধ্যে কোথাও কোনো যে যোগসূত্র থাকে, তা এখানে সেভাবে নেই। শুধু দ্বিতীয় স্টোরিলাইনে উল্লিখিত Right To Information বা 'তথ্যের অধিকার' যাকে লেখক "উত্তরের অধিকার" বলেছেন, সেটা ঘিরেই গল্পের বিস্তার। সেটা সংক্ষেপেও বলা যেত। কিন্তু লেখক বিস্তার ঘটিয়েছেন এবং সেখানেও 'উত্তর' ব্যাপারটা এসেছে 'অধিকার' না থাকলেও। কিন্তু এই বিস্তারের শেষটা আরেকটু কৌশল দাবি রাখে। তাছাড়া প্রশ্ন: প্রাইভেট কোম্পানির ক্ষেত্রে কি RTI প্রয়োগ করা যায়? পরিবর্তে ভিখারীর সম্পত্তি ভাগ নিয়ে টানাপোড়েনযুক্ত প্রথম অংশটি সার্থক ছোটগল্পের শর্ত অনেকটাই পূরণ করেছে।

'দূরভাষ' গল্পটি টেলিফোনিক কথপোকথন পড়তে মন্দ না লাগলেও শেষটা আশানুরূপ নয়।

পঞ্চম গল্পটি সম্পত্তি লাভের জন্য স্বপ্নাদেশ পেয়ে বুদ্ধি প্রয়োগে একটি ধাঁধা ভাঙার গল্প। বিষয়টা আগ্রহ জাগালেও রচনাটি আরেকটু পরিণত হতে পারত।

‘রূপকথা’ গল্পে লেখক পাত্রদের স্বয়ম্বরসভায় ইন্টারভিউ নিয়ে বাছাই করার আইডিয়া নিয়ে এসেছেন। সেটা বাস্তবসম্মত না হলেও আইডিয়া হিসাবে ভালোই। কিন্তু শেষটা কী হতে পারে, তা একটু পড়েই বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু কীভাবে জানার জন্য কৌতুহল হতে পারে। সেই কৌতুহল নিরসনের পক্ষে কিন্তু বিস্তার পর্বটি অতিসরীকৃত। পাত্রদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় প্রশ্নোত্তর পর্ব একটু প্রাসঙ্গিক হতে পারত।

তবে লেখক বিদ্যাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে গল্প আছে, প্যারা স্পেসিং একটু গুছিয়ে নিলে এবং গল্পটা লেখার পর কাউকে পড়িয়ে নিলে অনেক ভালো গল্প ওনার কাছে আশা করা যায়। কারণ তাঁর ভাষাটা ঝরঝরে। তার ওপর বহুমুখী অভিজ্ঞতা এবং একাধিক প্রদেশের সংস্কৃতি ও ভাষার জ্ঞান ওনার লেখার অন্যতম সম্পদ হতে পারে। 

 

Post a Comment

Previous Post Next Post